অন্য সাধারণ বয়স্কা কল্পনাপ্রবণ মহিলাদের মতো মিস মারপলকে মনে করে না লুসি। সে জানে তিনি পরিপূর্ণ সুস্থবুদ্ধির মহিলা। একারণে যথেষ্ট সম্মান শ্রদ্ধার মধ্যে তিনি বাস করেন।
লুসি শান্তভাবেই বলল, কোনো ধরনের মৃতদেহের কথা আপনি বলছেন?
–একটি স্ত্রীলোকের মৃতদেহ। একটা ট্রেনের কামরায় তাকে গলাটিপে হত্যা করা হয়েছে। তারপর মিস মারপল ঘটনাটা খুলে বললেন। লুসি আগ্রহ নিয়ে শুনল।
-কাহিনীটাকে সত্য বলে ভাবতে অসুবিধা হয়, বলল লুসি, খুবই অসাধারণ। তবে অসম্ভব মনে করি না। তা এর মধ্যে আমার ভূমিকাটা কি হবে?
–মৃতদেহটা আমি খুঁজে বার করতে চাই। বুঝতেই পারছ, আমার বয়স হয়েছে, দৌড়ঝাঁপ করব, তেমন সামর্থ্য নেই। তোমাকে কাজের মেয়ে বলে মনে করি।
–অর্থাৎ আপনি চাইছেন আমি অনুসন্ধান করি। কিন্তু একাজটা পুলিস করছে না কেন?
–পুলিস যথাসাধ্য করে ব্যর্থ হয়েছে। বুঝতেই পারছ, আমি নিজের মতো করে একটা থিওরি দাঁড় করিয়েছি। মৃতদেহটা ট্রেনের মধ্যে পাওয়া যায়নি। বোঝা যাচ্ছে ওটা ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু রেললাইনের আশপাশে অনুসন্ধান করে কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, লাইনের ধারে মৃতদেহটা ট্রেন থেকে ফেলে দিলে পরে সেটা সরিয়ে ফেলা যায়। ওই পথ ধরে আমি কয়েকবার ট্রেনে যাতায়াত করে এরকম একটা জায়গা খুঁজে পেয়েছি।
ব্র্যাকহ্যাম্পটনে পৌঁছবার আগে একটা বড় বাঁধের কিনার ঘেঁষে ট্রেনটা বাঁক নেয়। সেই সময় একটা জায়গায় ট্রেনটা বেশ ঝাঁকুনি খায়, ঠিক সেই জায়গায় যদি মৃতদেহটা ঠেলে ফলে দেওয়া যায় তাহলে সেটা বাঁধের ঢালে গড়িয়ে নিচে পড়ে যাবে।
দেহটা সেখান থেকেই সরিয়ে ফেলা হয়ে থাকবে। জায়গাটা বোঝাবার জন্য আমি মানচিত্র নিয়ে এসেছি, তুমি সেটা দেখ।
মানচিত্রের যে জায়গাটা মিস মারপল চিহ্নিত করেছিলেন, লুসি আগ্রহ সহকারে সে জায়গাটা দেখল।
জায়গাটা ব্র্যাকহ্যাম্পটনের শহরতলীর অংশ, বললেন মিস মারপল, এখানে আছে একটা পুরনো বাড়ি, সঙ্গে বিস্তৃত মাঠ ও পার্ক। আশপাশে অবশ্য বর্তমানে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট বাড়ি, বড় বড় হাউসিং এস্টেট।
পুরনো যে গাড়িটা রয়েছে, তার নাম রাদারফোর্ড হল। ক্রাকেনথর্প নামে একজন শিল্পপতি বাড়িটা তৈরি করেছিলেন। সেটা ১৮৮২ সালের কথা।
বর্তমানে সেই ক্রাকেনথর্পের এক ছেলে তার এক মেয়েকে নিয়ে এই বাড়িতে বাস করে।
–এখানে দেখছি রেললাইন ওই বাড়ির সংলগ্ন জমির একটা অংশ বেস্টন করে চলে গেছে। এখানে তাহলে আমার কাজটা কি?
মিস মারপল বললেন, ওই বাড়িটাই আমার লক্ষ্য। আমি চাইছি তুমি ওখানে একটা চাকরি নাও। গৃহস্থালীর কাজে তোমার খুবই নাম যশ। চাহিদাও খুব। আমার ধারণা, একটা কাজ তুমি ঠিক জোগাড় করে নিতে পারবে।
আমি কিছুটা খোঁজখবর নিয়েছি। বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্প একটু কৃপণ স্বভাবের লোক। তোমাকে উপযুক্ত মাইনে দিতে না-ও চাইতে পারেন।
তবে আমার কাছ থেকে যে টাকার অঙ্কটা তুমি পাবে সেটা তোমার প্রচলিত মাইনের চেয়ে অনেক বেশিই হবে।
-তাহলে কাজটা কঠিনই বলছেন আপনি।
–কেবল কঠিনই নয়, বিপজ্জনকও। বুঝতেই পারছ, আগে থেকেই ইঙ্গিতটা তোমাকে আমি দিয়ে রাখছি।
–বিপদকে আমি ভয় পাই না–তবে আপনি কি মনে করছেন কাজটায় বিপদের সম্ভাবনা আছে?
–আছে তো বটেই। নিঃশব্দে একটা অপরাধ ঘটে গেছে। কেউ কিছু জানতে পারেনি, কোনো সন্দেহ না। কেবল আমাদের দুই বন্ধুর কাছেই পুলিস অদ্ভুত ঘটনাটার কথা শুনেছে। কর্তব্যের খাতিরে অনুসন্ধান করেছে পুলিস, কিন্তু কোনো সূত্রের হদিশ পায়নি। যে লোকটি অপরাধটি করল, সে যেই হোক, নিশ্চয়ই নিশ্চিন্তে রয়েছে। এই অবস্থায় তোমাকে রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করতে দেখলে সে তা করতে দেবে কেন?
-বুঝতে পারছি, বলল লুসি, তাহলে আমি কী অনুসন্ধান করব?
–আপাততঃ খুনের সূত্র। বাঁধের ধারেকাছে ঝোপঝাড়ে ভাঙাচোরা ডালপালা কিংবা কাটায় আটকে থাকা একটুকরো কাপড় এই ধরনের সন্দেহজনক কিছু তোমার নজরে পড়ে যেতে পারে।
–এরকম কিছু যদি সত্যিই পেয়ে যাই তাহলে আমি কি করব?
-আমাকে জানাবে। আমি তোমার নাগালের মধ্যেই থাকব। ব্র্যাকহ্যাম্পটনে আমার এক পুরনো পরিচারিকা থাকে। তার বাড়িতেই আমি থাকার ব্যবস্থা করেছি।
তুমি তোমার মনিবদের বলবে, এই বুড়ী মাসীমা কাছাকাছি থাকেন। তার দেখাশোনা করতে পারবে সেই কারণেই বলবে তুমি এমন জায়গায় কাজ চাইছ। আর আমার সঙ্গে যাতে দেখাসাক্ষাৎ করতে পার সেই মত একটা অবসর সময় রেখে দেবে।
-কিন্তু আমি তো একাজে তিন সপ্তাহের বেশি সময় দিতে পারব না। তারপর চুক্তিবদ্ধ।
-তিন সপ্তাহ যথেষ্ট সময়। এরমধ্যে যদি কিছু পাওয়া যায় ভালো, না পাওয়া গেলে মিছিমিছি ওর পেছনে আর সময় নষ্ট করব না।
লুসির সঙ্গে কথা পাকা করে মিস মারপল বিদায় নিলেন।
সে কিছুক্ষণ একা বসে সমস্ত ব্যাপারটা ভাবল। তারপর ব্র্যাকহ্যাম্পটনে তার এক পরিচিত রেজেস্ট্রি অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করে মহিলা ম্যানেজারকে জানাল, কাছাকাছি অঞ্চলে তার একটা কাজের দরকার। তার এক বৃদ্ধা মাসীমাকে তাহলে দেখাশোনা করার সুবিধা হয়।
মহিলাটি উৎসাহিত হয়ে অনেকগুলি পরিবারের নাম করল। তার মধ্যে রাদারফোর্ড হলের ক্রাকেনথর্প পরিবারের নামও ছিল।