কিন্তু এসেছিল বলে তুমি যা বলতে চাইছ, নিহত স্ত্রীলোকটি সেই অর্থে রাদারফোর্ড হলে আসেনি। সে এসেছিল মৃত্যুর পরে। চলন্ত রেলগাড়ি থেকে তাকে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল রেলবাঁধের ওপরে।
–হ্যাঁ, তা ঠিক।
তা যদি হয় তাহলে কি প্রমাণ হয়? ওই খামটা প্রমাণ করছে যে খুনী রাদারফোর্ড হলে এসেছিল। অনুমান করা যায় অন্যান্য কাগজপত্রের সঙ্গে খামখানাও মেয়েটির পকেটে ছিল। খুনী যখন পকেট থেকে সবকিছু তুলে নিয়েছিল তখন তার অজ্ঞাতে খামখানা পড়ে গিয়েছিল। অথবা, এমন হওয়াও সম্ভব যে, খুনী সেটা ভুল করে নয়, ইচ্ছাকৃতভাবেই ফেলেছিল। মৃতদেহ আবিষ্কার হবার পর রাদারফোর্ড হলের চত্বর ইনসপেক্টর বেকন এবং তোমার লোকজন আঁতিপাতি করে খুঁজেছে। কিন্তু খামখানা তাদের কারো চোখে পড়েনি। পরে খামখানা উদ্ধার হয় বয়লার হাউস থেকে। তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াচ্ছে?
-সেটা বোঝা যাচ্ছে, ক্রাডক বললেন, বুড়ো মালী বাইরে আজেবাজে যা কিছু দেখতে পায় সবই বয়লার হাউসের মধ্যে নিয়ে জড়ো করে।
ছেলেদের কাছে সেই কারণেই ওই ঘরটা আকর্ষণীয় হয়ে ওঠার কথা। কোনো কিছু তাদের দৃষ্টিতে আনার খুব সহজ জায়গা।
–আপনি কি বলতে চাইছেন, আমাদের হাতে ফেলবার জন্যই পরে খামখানা সেখানে ফেলে রাখা হয়েছিল?
–কৌতূহলী হয়ে ছেলেরা আনাচেকানাচে রহস্যোর সূত্র খুঁজে বেড়াচ্ছিল। তারা শেষ পর্যন্ত কোথায় যাবে তা অনুমান করা কিছু কঠিন ছিল না। তাছাড়া খোঁজার জায়গার একটা ইঙ্গিত তাদের দেওয়াও সম্ভব ছিল। এসব ভাবনা আসছে ওই খামখানা পাওয়ার পর। তোমরা তো আন্না ট্রাভিনস্কির সম্ভাবনার কথা বাদই দিয়েছিলে, তাই না?
তার মানে, আপনি বলতে চাইছেন নিহত মেয়েটি আন্নাই হতে পারে?
তা নয়। আমি ভাবছি আন্নার ব্যাপার নিয়ে তোমরা যখন অনুসন্ধান আরম্ভ কর, তখন কেউ তোমাদের সেই লাইন থেকে সরিয়ে আনার কথা ভেবে থাকবে।
-মূল ঘটনাটা তাহলে কি দাঁড়াচ্ছে, নকল মার্টিন সেজে কেউ অগ্রসর হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো কারণে সে বিরত হয়। কিন্তু সেই কারণটা কি হতে পারে?
বেশ তো বলছ তুমি।
–এমন যদি হয়, কোনো লোক তারবার্তা পাঠিয়ে জানিয়েছিল যে মার্টিন ফ্রান্সে ফিরে যাচ্ছে। তারপর সে মেয়েটিকে নিয়ে ভ্রমণে বেরিয়ে তাকে হত্যা করে, এ পর্যন্ত আপনি নিশ্চয় মেনে নেবেন?
–এরকম হয়েছে বলে আমি মনে করি না, বললেন মিস মারপল, ঘটনাটা বড় বেশি সরল করে ফেলেছ তুমি।
–সরল করে ফেলছি। আপনার কথায় আবার সব গুলিয়ে যাচ্ছে আমার।
–তোমাকে কোনোরকম ধাঁধায় ফেলা আমার ইচ্ছা নয়।
–তা যদি হয়, স্পষ্ট করে বলুন, আপনি কি জানতে পেরেছেন নিহত স্ত্রীলোকটি কে ছিল?
–এখনো পর্যন্ত জানতে পারিনি, সে ঠিক কে ছিল। তবে সে কিরকম মেয়ে ছিল, তা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। আমি কি বলতে চাইছি নিশ্চয় বুঝতে পেরেছ?
–বুঝতে যা পেরেছি তাতে চোখের সামনে কেবল ধোঁয়া দেখছি।
এইসময় জানালার দিকে চোখ পড়ল ক্রাডকের। সেদিকে তাকিয়ে তিনি বললেন,-লুসি আইলেসব্যারো আসছেন, আপনার সঙ্গে দেখা করতে। আমি বরং এখন উঠি।
.
একটু চঞ্চলতা নিয়েই ঘরে ঢুকল লুসি। প্রাথমিক সম্ভাষণের পর সে বলল, আপনার টনটিন (Tontine) কথাটার অর্থ ডিক্সনারি খুঁজে বার করেছি।
পায়চারি করে ঘরের এটা সেটা নাড়াচাড়া করে দেখে বেড়াতে লাগল সে।
-দেখেছ তাহলে। শান্তকণ্ঠে বললেন মিস মারপল।
–দেখলাম, ইতালির এক ব্যাঙ্কার, লোরেঞ্জে তোতি, ১৬৫৩ খ্রি. একধরনের অ্যানুইটি, প্রবর্তন করেছিলেন, তারই নাম টনটিন। এর দ্বারা লগ্নীকারীদের মধ্যে মৃতদের অংশ যারা বেঁচে থাকে তাদের লাভের অংশের মধ্যে যুক্ত হয়। এই তো অর্থ, তাই নয়? বর্তমানে আমরা যেই সমস্যার মধ্যে রয়েছি টনটিনের অর্থ তার সঙ্গে বেশ মিলে যাচ্ছে। এখানে শেষ দুটি মৃত্যুর আগে আপনি কথাটা বলেছিলেন।
মিস মারপল কোনো জবাব দিলেন না। লুসির চঞ্চলতা নীরবে নিরীক্ষণ করে চললেন।
তাকের ওপরে রাখা একটা চিনামাটির কুকুর লক্ষ্য করতে করতে লুসি আবার বলল, –আমাদের বর্তমান পরিস্থিতি বোঝবার পক্ষে শব্দটা যথোপযুক্ত। বৃদ্ধ জোসিয়া ক্রাকেনথর্প যে উইল করে গেছেন, তার নিষ্পত্তি হতে পারে যখন একজন মাত্র অংশীদার জীবিত থাকে এবং সে সমস্ত সম্পত্তির অধিকারী হয়। তবুও একটা বিরাট পরিমাণ টাকা ভাগাভাগি হলেও প্রতিভাগে টাকার পরিমাণ নেহাৎ কম দাঁড়ায় না।
কিন্তু মানুষ যখন অতিরিক্ত লোভী হয়ে পড়ে, বললেন মিস মারপল, তখনই অপ্রীতিকর ঘটনার সম্ভাবনা দেখা দেয়। প্রথমেই হয়তো লোভের বশবর্তী হয়ে কেউ খুন করে বসে না, কিংবা খুনের কথা চিন্তা করে না–কেবল কি করে নিজের অংশের চাইতে বেশি কি করে পাওয়া যেতে পারে, সেকথা ভাবতে থাকে।
কথা বলতে বলতে কোলের ওপর থেকে কাটা পশমগোলা নামিয়ে রেখে তিনি আবার বললেন, এরকম একটা ঘটনার সূত্রেই ক্রাডকের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হয়। অনেক টাকা পাওয়ার কামনা নিয়ে একটা লোক এমন সহজ একটা কাজ করল, যাকে কোনো ভাবেই অন্যায় বলা চলে না। হত্যার প্রশ্ন তখনো দেখা দেয়নি। কিন্তু শুরুটা হয়েছিল এভাবেই। আর ঘটনার নিস্পত্তি হয়েছিল তিন-তিনটা হত্যাকাণ্ড দিয়ে।
–এখানেও তো আমরা তিনটে হত্যাকাণ্ড দেখতে পাচ্ছি। যাকে মার্টিন বলে সন্দেহ করা হচ্ছিল, সে তার ছেলের জন্য সম্পত্তির একটা অংশ দাবি করতে পারত। সম্পত্তির দাবিদার ছিল আলফ্রেড এবং হারল্ডও। দাবিদারদের মধ্যে আর মাত্র দুজন এখন অবশিষ্ট আছে।