তবে একটা দিক থেকে লাভবান হবার সুযোগ হয়েছে আলফ্রেডের মৃত্যুতে। সেটাই হারল্ডের আনন্দের বিষয়।
ঠাকুর্দা জোসেফ ক্রাকেনথর্পের অর্থের একজন ভাগিদার কমল। এখন আর টাকাটা পাঁচভাগ হবে না, চার অংশে বাঁটোয়ারা হবে। ফলে এখন হারল্ডের অর্থের পরিমাণ যথেষ্ট বৃদ্ধি পাবে।
শরীরে বেশ অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ ছিল, তবু অফিসে না এসে পারেনি হারল্ড। নিজের খাস কামরায় বসে এসব কথাই ঘুরপাক খেয়েছে মাথায়।
শরীরের অবস্থা বিবেচনা করে আরও একদিন বিশ্রাম নেবে, হারল্ড ভাবল। শরীর এখনো দুর্বল।
কিছুক্ষণ অফিসে থেকে আবার বাড়ি ফিরে এল সে। দরজা খুলে দিয়ে গৃহভৃত্য ডারউইন জানাল, মিসেস হারল্ড ফিরেছেন।
সতর্ক হয়ে গেল হারল্ড। অ্যালিসের যে আজই ফিরে আসার কথা তা সে একেবারেই ভুলে গিয়েছিল। এই ভুলে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, এখন যা সম্পর্ক ওদের দুজনের মধ্যে দাঁড়িয়েছে।
অ্যালিস অতি সাদাসিধে ধরনের স্ত্রীলোক। মোহ তৈরি হবার মতো কিছু নয় সে। তবুও একসময় তার সান্নিধ্য খারাপ লাগত না। তাছাড়া মর্যাদাসম্পন্ন পরিবারের মেয়ে, সমাজের উঁচু মহলে বিস্তর আত্মীয়স্বজন তার।
তাদের সামাজিক মর্যাদা নানাভাবেই হারল্ডের উপকারে এসেছে। এসব কারণে স্ত্রীর প্রতি মনোযোগী থাকার একটা আকর্ষণ ছিল হারল্ডের।
তার আশা ছিল, আত্মীয় স্বজনের সুবাদে ভবিষ্যতে তাদের সন্তানও সামাজিক মর্যাদা ও গৌরবের অধিকারী হবে। কিন্তু হতাশ হয়েছে হারল্ড, তাদের কোনো সন্তান হয়নি। সন্তানহীনতার অনিবার্য ফল হল তাদের পারস্পরিক সাহচর্য কারোর কাছেই তেমন আনন্দদায়ক নয়। থাকতে হয় থাকা, নীরস একটা জীবনের ভারবহন মাত্র।
অ্যালিস তার আত্মীয়স্বজনদের মধ্যেই এখন থাকতে বেশি পছন্দ করে। এখন রিভিয়েরা থেকে ফিরে এসেছে।
হ্যারল্ড দোতলায় ড্রইংরুমে ঢুকে অ্যালিসের সঙ্গে মিলিত হল।
–আমি দুঃখিত অ্যালিস, স্টেশনে তোমার সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। গাড়ির ভিড়ে আটকে পড়েছিলাম। তা সান রাফেল কেমন লাগল?
অ্যালিসের ভাবে ভঙ্গিতে কথায় বার্তায় আভিজাত্যের ছোঁয়া। সে সান রাফেলের বিবরণ দিয়ে স্বামীর স্বাস্থ্যের কথা জানতে চাইল।
–তোমরা সবাই কি করে এমন অসুস্থ হয়ে পড়লে বুঝতে পারলাম না। এমার টেলিগ্রাম পেয়ে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
হারল্ড আর্সেনিকের কথা বলতে গিয়ে বলতে পারল না। একটা পরিবারের শান্তি শৃঙ্খলার পক্ষে ব্যাপারটা অমর্যাদাকর বলে বোধ হল তার।
হ্যারল্ড নিজের ঘরে গিয়ে ঘণ্টা দুয়েক বিশ্রাম করল। তারপর পোশাক পাল্টে ডিনার টেবিলে গিয়ে বসল। দু-চার কথার পর অ্যালিস বলল, তোমার জন্য একটা পার্সেল হলঘরের টেবিলে রাখা আছে।
বিকেলের ডাকে এল বোধহয়, খেয়াল করিনি–
–আচ্ছা শোন, একটা মেয়ে আমাকে বলল, কোনো এক রাদারফোর্ড হলে গুদামঘরে না কোথায় একটা স্ত্রীলোকের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। আমাদের রাদারফোর্ড হলে নিশ্চয় নয়?
হ্যারল্ড পলকে স্ত্রীর মুখে চোখ বুলিয়ে নিল।
–খুবই অপ্রীতিকর ঘটনা। মেয়েটির মৃতদেহ আমাদের গুদামঘরেই পাওয়া গেছে।
–আমাদের রাদারফোর্ড হলে! কি বলছ হারল্ড। আমাকে বলোনি তো।
–সময় পাইনি। কিন্তু ওই ঘটনার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তবু পুলিস যথেষ্ট জ্বালাতন করেছে সকলকে।
–খুনটা তাহলে কে করেছিল?
–পুলিস এখনো জানতে পারেনি। তদন্ত অব্যাহত আছে।
–স্ত্রীলোকটি কিরকম?
–কেউ তাকে সনাক্ত করতে পারেনি। তবে সন্দেহ করা হচ্ছে ফরাসি বলে।
ডাইনিং রুম ছেড়ে বেরিয়ে হারল্ড হলঘরে এল। পার্সেলটা তুলে নিল। দুজনে চুল্লির পাশে চেয়ারে গিয়ে বসল।
পার্সেলটা ছিঁড়ে একটা ট্যাবলেটের বাক্স বার করল হারল্ড। সঙ্গে একটুকরো কাগজ। তাতে লেখা, ডাঃ কুইম্পারের অনুরোধে পাঠানো হল। প্রতি রাতে দুটো ট্যাবলেট সেবনীয়।
বাক্সটা খুলে ট্যাবলেটগুলো চিনতে পারল হারল্ড। এরকম ট্যাবলেটই সে খাচ্ছিল। কিন্তু কুইম্পার বলেছিল, এখন এগুলোর আর দরকার নেই।
হ্যারল্ডের ভ্রূ কুঞ্চিত হল।
অ্যালিস ট্যাবলেটগুলোর প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হারল্ড চিন্তিতভাবে বলল, কুইম্পারের পরামর্শে কেমিস্ট পাঠিয়েছে। এগুলো রাতে খেতাম। কিন্তু ডাক্তার আপাততঃ বন্ধ রাখতে বলছিল।
অ্যালিস বলল, দু-চারদিন হয়তো বন্ধ দেওয়া নিয়ম।
-তা হতে পারে। শরীরটা দুর্বল লাগছে। অসুখের পর আজই প্রথম বেরিয়েছিলাম। আমি শুতে যাচ্ছি।
-হ্যাঁ, তোমার এখন যথেষ্ট বিশ্রাম দরকার। তারপর ট্যাবলেটের বাক্সটা স্বামীর হাতে তুলে দিয়ে বলল, এটা খেতে যেন ভুলে যেও না।
শোবার ঘরে এসে হারল্ড দুটো ট্যাবলেট জল দিয়ে গিলে ফেলল। তারপর বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল।
.
ডারমট ক্রাডককে খুবই ক্লান্ত হতাশ আর বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল।
ফ্লোরেন্সের বাড়িতে মিস মারপলের মুখোমুখি একটা চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে বসেছিলেন তিনি।
–এখন বুঝতে পারছি, ব্যাপারটা খুবই জট পাকিয়ে ফেলেছি। আমি নিজেই।
বিষণ্ণ ক্রাডককে সান্ত্বনা দিয়ে মিস মারপল বললেন, না, তেমন কিছু করেছ বলে মনে করছি না আমি। তোমার কাজ প্রশংসনীয়ই হয়েছে আমি বলব।
-আপনি বলছেন প্রশংসনীয় কাজ? এসব কি তাই–পাইকারিহারে একটা পরিবারের ওপর বিষপ্রয়োগ করা হয়েছে, আর আমি কিছু করতে পারছি না। পরপর মারা গেল দুই ভাই, আলফ্রেড আর হারল্ড–চিন্তা করা যায় না পরিবারটার ওপরে কী চলেছে। সবই ঘটছে আমার চোখের সামনে।