বিস্ময়াহত এমা স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে রইল ভদ্রমহিলার দিকে। সে যেন কথাগুলোর অর্থ বুঝতে পারছিল না।
–মার্টিন–আপনিই মার্টিন
-হ্যাঁ, সত্যিই আমি মার্টিন। আপনার পক্ষে অবাক হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু কথাটা সত্যি। যুদ্ধের গোড়ার দিকে আমাদের গ্রামেই এডমান্ডের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। আমাদের মধ্যে বিবাহের কথা পাকা হয়েছিল। সে কথা আপনি জানেন। কিন্তু আমাদের বিয়ের আগেই যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেল।
তারপর খবর পেলাম, সে যুদ্ধে হারিয়েছে। সেদিনের সেই বিভীষিকাপূর্ণ দিনগুলোর কথা এখন অতীতের ইতিহাস। তোমাকে, আজ এতদিন পরে, আমি এটুকু বলতে পারি, তোমার ভাইয়ের সঙ্গে আমার নিবিড় ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল। সেই অকৃত্রিম ভালোবাসা আমাকে যুদ্ধের কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি নিয়ে দাঁড় করিয়েছিল। ফ্রান্স জার্মানির অধীন হল, আমি নাম লেখালাম প্রতিরোধ বাহিনীতে।
ফ্রান্সের ভেতর দিয়ে ইংরাজদের ইংলন্ডে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব যাদের ওপর পড়েছিল, আমি ছিলাম তাদের একজন। সেই সময়ই আমার বর্তমান স্বামীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সেই সময় তিনি ছিলেন বিমান বাহিনীর অফিসার।
যুদ্ধ শেষ হলে বিয়ে করলাম। অনেকবার আমার আপনার কথা মনে পড়েছে। ভেবেছিলাম এসে দেখা করব কিংবা চিঠি লিখব।
কিন্তু পরে চিন্তা করে দেখলাম, নতুন জীবন শুরু করেছি, অতীত স্মৃতিকে জাগিয়ে তুলে আর কি লাভ। তাই কোনোদিনই আর কোনো ভাবে যোগাযোগ করা হয়নি।
কিন্তু অতীতকে ভুলতে চাইলেই কি সবসময় ভোলা যায়। যখন জানলাম, জেমসের স্কুলের প্রিয় বন্ধু এডমান্ডের ভাগনে, তখন অদ্ভুত আনন্দ হল।
আলেকজান্ডার আর জেমসের বন্ধুত্ব অপার এক সুখের বিষয় হয়ে উঠল আমার কাছে, তুমিও হয়তো লক্ষ্য করে থাকবে, আলেকজান্ডার অবিকল এডমান্ডের মত দেখতে হয়েছে।
যাই হোক, তোমাদের বাড়ির হত্যাকাণ্ডের ঘটনার ভাষ্য শুনে আমি জানতে পেলাম, মৃত স্ত্রীলোকটিকে এডমান্ডের পরিচিত বা স্ত্রী বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, তখন তোমার কাছে এসে সত্যি কথাটা জানাবার তাগিদ বোধ না করে পারলাম না। মৃত স্ত্রীলোকটি যে মার্টিন নয়, একথা তোমাকে অথবা পুলিসকে জানানো আমার কর্তব্য বলে মনে হল।
তার সম্মুখে বসা ভদ্রমহিলাকে নিবিড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিল এমা, তার প্রতিটি কথা যেন সে গলাধঃকরণ করছিল। গভীর আবেগে সে যেন কথা হারিয়ে ফেলেছিল।
-আমি ভাবতেই পারছি না, ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্বরে বলল সে, আমার ভাই যার কথা লিখেছিল, আপনিই সেই মার্টিন। কিন্তু, আমি বুঝতে পারছি না, তাহলে এমন একটা চিঠি কি আপনিই আমাকে লিখেছিলেন?
-না, না, আমি তোমার কাছে কোনোদিন চিঠি লিখিনি। বললাম যে, তোমাকে চিঠি লেখা উচিত হবে কিনা এই নিয়ে ভেবেছি কিন্তু লেখা হয়নি।
-তবে
এমা গম্ভীর হয়ে গেল। সে যেন অশুভ কিছুর আভাস পেল।
–নিশ্চয় অন্য কেউ তোমার কাছে মার্টিন বলে পরিচয় দিয়েছিল। উদ্দেশ্য বোঝাই যায়। নিশ্চয় কিছু টাকা তোমার কাছে আদায় করা উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু এরকম চিঠি কে লিখতে পারে?
যেই করে থাকুক, এমা বলল, বোঝা যাচ্ছে আপনাদের ব্যাপারটা তার জানা ছিল।
–হ্যাঁ, কোনোভাবে জেনে থাকতে পারে। কিন্তু সেই সময় আমার তেমন অন্তরঙ্গ কেউ তো ছিল না। ইংলণ্ডে আসার পরও কাউকে এবিষয়ে কিছু বলিনি। কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না–এই নকল মার্টিন এতদিনই বা অপেক্ষা করল কেন?
এমা বলল, সবই কেমন গোলমেলে লাগছে। যাইহোক, ইনসপেক্টরকে জানাই, যা করবার তিনিই করবেন। এক অদ্ভুত পরিস্থিতিতে তোমার সঙ্গে পরিচয় হল, তবু আমার খুব ভালো লাগছে।
–এডমান্ড তোমাকে খুব ভালোবাসত। প্রায়ই তোমার কথা বলত।
এমা লেডির হাতের ওপর হাত রেখে বলল, আজ একটা ভারি বোঝা বুক থেকে নেমে গেল। মৃত স্ত্রীলোকটিকে মার্টিন বলে সন্দেহ হওয়ার পর থেকে কেবলই মনে হয়েছে, এই খুনের সঙ্গে আমাদের পরিবার জড়িত। সে যে কী অস্বস্তি তোমাকে বোঝাতে পারব না। হতভাগ্য মেয়েটি যেই হোক, তার সঙ্গে আমাদের পরিবারের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না।
.
আলফ্রেডের মৃতুতে হারল্ড ক্রাকেনথর্পের দুরকম প্রতিক্রিয়া হল।
বর্তমানে তার ব্যবসার খুবই টলমল। ভেতরের অবস্থাটা বাইরের ঠাটবাটের আড়ালে ঢেকে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। দামী আসবাবপত্রে সজ্জিত অফিসে, নিখুঁত আদবকায়দায় সম্পন্ন অবস্থাটাকে ধরে রাখার উপযযাগিতা অস্বীকার করা যায় না।
এই অবস্থা থেকে নিস্তার পাবার একটা পথ হতে গিয়েও হল না। আলফ্রেডের বদলে যদি বৃদ্ধ মানুষটা সংসার থেকে ছুটি নিত,তাহলে ব্যবসার সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে বেশি সময় লাগত না।
এটা খুবই স্বাভাবিক ছিল যে তিয়াত্তর চুয়াত্তর বয়সের একজন মানুষ। বিষপ্রয়োগের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারবেন না। বয়সে জীর্ণ শরীর শক্তি আর কতটুকু আছে। তার ওপরে বছরের পর বছর অথর্ব হয়ে পড়ে আছেন।
অথচ বৃদ্ধ ঠিক সামলে উঠলেন আর যে কিনা সবল সুস্থ এক যুবক, অতি সাবধানী সেই আলফ্রেডই বিষক্রিয়ায় মারা গেল।
অবশ্য আলফ্রেডের মৃত্যু বিরাট একটা ক্ষতি কিছু নয়। অন্ততঃ পরিবারের ক্ষেত্রেও।
জীবনে সে কখনো বড় কিছু করার চেষ্টা করেনি। সব সময়ই দারিদ্র্য আর অপকর্ম তার সঙ্গী হয়েছিল। ফাটকাবাজদের যা হয়, দিন কতকের প্রাচুর্য তারপর আবার দারিদ্র্য আর অপকর্মে লিপ্ত হওয়া। এই ছিল জীবনচক্র। তাছাড়া তার প্রিয়পাত্রও সে ছিল না কোনোদিন।