কিন্তু পরের দিনেও কোনো খবর পাওয়া গেল না। সন্ধ্যা নাগাদ মিস মারপল সার্জেন্ট কার্নিশের পাঠানো একটা চিরকূট পেলেন। তিনি জানিয়েছেন, আগের দিনে রিপোর্ট করা ঘটনা সম্পর্কে হাসপাতাল ইত্যাদি সহ সকল সম্ভাব্য স্থানেই তদন্ত করা হয়েছে। কিন্তু কোনো মহিলার দেহের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
.
০২.
চিরকুটটা পড়ে চিন্তিত হলেন মিস মারপল। বন্ধুর বিমর্ষ চিন্তাভারাক্রান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার যা করার ছিল সবই করেছ এলসপেথ। রেল কর্মচারীর কাছে, পুলিসের কাছে রিপোর্ট করেছ। আর কিছু করার নেই।
-যথাযথ তদন্ত হয়েছে, এটুকু আমার সান্ত্বনা। কিন্তু মৃতদেহটা এভাবে সকলের চোখে আড়াল হল কি করে সেটাই বুঝতে পারছি না। ক্রিসমাসের পরেই আমি সিংহলে রোডারিকের কাছে গিয়ে কিছুদিন থাকব। এদিকের প্রয়োজন বুঝলে ভ্রমণসূচী না হয় পিছিয়ে দেওয়ার কথা ভাবা যেত। কিন্তু রওনা হয়ে যাবার পর
তুমি আর কি করবে। মৃতদেহটা খুঁজে বার করার দায়িত্ব পুলিসের। তারা যখন ব্যর্থ হয়েছে; বোঝা যাচ্ছে লোকটা চতুরতার সঙ্গেই কাজটা সামাল দিয়েছে। কাজটার পেছনে পূর্ব-পরিকল্পনা ছিল।
হঠাৎ করে উত্তেজনার বশে ঘটনাটা ঘটে যায়নি। ট্রেনের সিটে মৃতদেহটা পড়ে থাকলে সকলেরই নজরে পড়ত। একটা গাড়ি যখন স্টেশনে ঢোকার মুখে সেই সময় ঠান্ডা মাথায় স্ত্রীলোকটিকে খুন করা হয়েছিল এবং ট্রেন থেকে এমন কোনো জায়গায় ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল–যেখানে লোকের চোখে পড়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এছাড়া বিকল্প সম্ভাবনাও ছিল।
–জেন, বললেন মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি, আগামীকাল বিকেলের ট্রেনে আমাকে লন্ডনে ফিরতে হবে।
মিস মারপল বললেন, ঘটনাস্থল ও পারিপার্শ্বিক অবস্থাটা নিজের চোখে একবার দেখব ভাবছি। আমিও তোমার সঙ্গে রওনা হব তাহলে।
–তুমি কি করতে চাইছ বলতো?
-তোমার সঙ্গে আমিও লন্ডন অবধি যাব। তারপর সেদিন তুমি যেই ট্রেনে ব্র্যাকহ্যাম্পটন এসেছিলে আমরাও সেই ট্রেন ধরে ব্র্যাকহ্যাম্পটন ফিরে আসব। সেখান থেকে তুমি ফের লন্ডন ফিরে যাবে, আর আমি এখানে ফিরে আসব।
মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি বললেন, এতে তুমি কতটা কি আর বুঝতে পারবে। বেশ তাই করা যাবে চল।
.
পরদিন লন্ডন থেকে চারটে পঞ্চাশের ট্রেনের একটা প্রথম শ্রেণীর কামরায় চেপে বসলেন মিস মারপল আর মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি।
ক্রিসমাসের আর দুদিন মাত্র বাকি। গাড়িতে ভিড়ের চাপ প্রচণ্ড।
আগের শুক্রবারেই সেই ভয়ঙ্কর অপরাধের দৃশটা দেখেছিলেন মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি। আজ কিন্তু ব্র্যাকহ্যাম্পটন স্টেশন অবধি পৌঁছনো পর্যন্ত কোনো গাড়ি সমদূরত্ব বজায় রেখে পাশাপাশি যেতে দেখা গেল না।
-কোনো লাভ হল না জেন। হতাশ ভাবে বললেন মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি।
অন্যমনস্কভাবে মিস মারপল জবাব দিলেন, তাই তো দেখছি।
কিন্তু তিনি তখন ভাবছিলেন, একটা মৃতদেহ কখনো শূন্যে মিলিয়ে যেতে পারে না। কোথাও না কোথাও অবশ্যই থাকবে।
মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি ট্রেন থেকে নেমে পড়লেন। বারো মিনিট পরেই লন্ডনে যাবার ট্রেন তাকে এখান থেকে ধরতে হবে। জানলা দিয়ে দুই বন্ধু শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন।
বাঁশি বাজিয়ে ট্রেন ছেড়ে দিল। গাড়ির গতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মিস মারপল গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন।
স্বভাবতই অদ্ভুত ঘটনাটা তাকে খুবই আগ্রহান্বিত করে তুলেছিল। তাই অবিলম্বেই তিনি তাঁর সন্ধানকর্ম শুরু করার জন্য মনস্থির করে নিলেন।
প্রস্তুতি হিসেবে আপাততঃ যে কাজগুলো তাকে করতে হবে, তার একটা তালিকাও তিনি মনে মনে ছকে নিলেন।
১. তাঁর বিশেষ বন্ধু স্যার হেনরি ক্লিদারিং ও তার ধর্মপুত্র ডিটেকটিভ ইনসপেক্টর ডারমট ক্রাডকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। তারা দুজনেই স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে রয়েছে।
২. মিস মারপলের ভাগ্নের দ্বিতীয় ছেলে ডেভিড ব্রিটিশ রেলওয়েতে কাজ করে। তারও সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।
৩. তাঁর বান্ধবী গ্রিসলডার ছেলে লেনার্ড মানচিত্রের ব্যাপারে খুবই আগ্রহী। তার কাছ থেকেও প্রয়োজনীয় সাহায্য পাওয়া যেতে পারে।
৪. প্রাক্তন পরিচারিকা ফ্লোরেন্সের সাহায্যও চাওয়া যেতে পার। সে বর্তমানে ব্র্যাকহ্যাম্পটনের বাড়িতেই আছে।
মিস মারপল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলেন, তার বয়স হয়েছে, ছুটোছুটি করা আগের মতো সম্ভব নয় তার পক্ষে। কিন্তু যোগাযযাগগুলো ঠিক ভাবে কার্যকর করা গেলে প্রয়োজনীয় সূত্র আবিষ্কার অসম্ভব হবে না।
ইতিপূর্বে অনেক হত্যাকাণ্ডের তদন্ত তিনি করেছেন। সেগুলো তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান ঘটনাটার অনুসন্ধান কার্য স্বেচ্ছায় হাতে তুলে নিয়েছেন তিনি। অনিশ্চিত জেনেও কেন এমন একটা উদ্যোগ তিনি নিতে চলেছেন, নিজেই জানেন না।
.
পরদিন সকাল থেকেই তাঁর পরিকল্পিত কাজে নেমে পড়লেন মিস মারপল।
প্রথমেই ভাগ্নের ছেলে ডেভিডকে চিঠি লিখলেন। ক্রিসমাসের শুভেচ্ছা জানিয়ে একটা বিশেষ সংবাদ জানবার অনুরোধ জানিয়েছেন সেই চিঠিতে।
প্রতি বছরের মতো তিনি ভিকারের বাড়িতে ডিনারে অংশগ্রহণ করলেন। সেখানে লেনার্ডের সঙ্গে যোগাযোগ হল। তার সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় অঞ্চলের মানচিত্র সম্পর্কে খোঁজখবর নিলেন।
লেনার্ড তার প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো সুন্দরভাবে বলে বুঝিয়ে বেশ আগ্রহ সহকারে লিখেও দিল। পরে তার সংগ্রহ থেকে নির্দিষ্ট অঞ্চলের একটা মানচিত্র মিস মারপলকে ধার দিল।