পোয়ারো কিন্তু চোর ধরতে আমার সঙ্গে যায়নি, সে লেডি ইয়ার্ডলিকে নানাভাবে প্রশ্ন করে বাস্তবে কি ঘটেছে তাই জানতে চাইছিল।
বড় বাতির সুইচটা জ্বালাতে যাব এমন সময় পেছন থেকে লোকটা ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর, লেডি ইয়ার্ডলি বললেন, ও এত জোরে নেকলেসটা আমার গলা থেকে ছিড়ে নিল যে আমার মাথা গেল ঘুরে। টাল সামলাতে না পেরে আমি মেঝের ওপর পড়ে গেলাম। পড়ে যাবার সময় এক পলকের জন্য দেখলাম লোকটা দেওয়ালের লাগায়ো দরজা দিয়ে পালাচ্ছে, আর তখনই চোখে পড়ল ওর মাথায় পেছনে হোট বাঁধা চুলের হোট বিনুনি আর পরণে হলদে রেশমী আলখাল্লা, তাই দেখেই বুঝলাম লোকটা জাতে চীনে। এইটুকু বলে সম্ভবত ঘটনার আকস্মিকতায় শিউড়ে উঠে থেমে গেলেন লেডি ইয়ার্ডলি। পোয়ারো মন দিয়ে তার বক্তব্য শুনল, একটি প্রশ্ন বা মন্তব্যও করলনা সে।
মিঃ হফবার্নের কাছ থেকে এক ভদ্রলোক দেখা করতে এসেছেন, মি লর্ড, বাটলার ভেতরে ঢুকে চাপা গলায় বলল, আপনারা ওঁর জন্য অপেক্ষা করছেন।
হায় ঈশ্বর! লর্ড ইয়ার্ডলি নিজেই আক্ষেপের সুরে বলে উঠলেন, পরমুহূর্তে স্বাভাবিক গলায় বললেন, তবু ওঁর সঙ্গে আমায় অবশ্যই দেখা করতে হবে। শোন, মুলিংস, এখানে নয়, ভদ্রলোককে লাইব্রেরীতে নিয়ে গিয়ে বসাও, আমি যাচ্ছি।
আর কি আমাদের এখানে থাকা ভাল দেখাবে? পোয়ারোকে একপাশে ডেকে বললাম, এই রাতেই লণ্ডনে ফিরে গেলে হয় না?
লণ্ডনে ফিরে যাব? পোয়ারো আমার কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়ল কিন্তু কেন যাব, ক্যাপ্টেন হেস্টিংস?
এটাও আমায় ব্যাখ্যা করতে হবে? গলা ঝেড়ে নিয়ে চাপা গলায় বললাম ব্যাপারটা যে এখন আমাদের হাতের বাইরে চলে গেছে তাও কি তুমি বুঝতে পারছে না? তুমিই লর্ড ইয়ার্ডলিকে বলেছিলে তোমার কথামত যেন উনি চলেন–তারপরে তোমারই চোখের সামনে হীৱেটা চুরি হয়ে গেল, এর পরে কোন লজ্জায় আমরা আর এখানে থাকব বলতে পারো?
সে ত বটেই, পোয়ারো এমনভাবে কথাটা বলল যেন আসলে তেমন কিছুটা ঘটেনি, আমি যেসব কেসে বিরাট ভেলকি দেখিয়ে জিতেছি এটা তাদের মধ্যে পড়েনা ঠিকই। তাহলে ত বুঝতেই পারছে, কিছু মনে কোনো যেন তোমার মকেল ল্যাজেগোবরে হবার পরে এখানে দাঁড়িয়ে থাকার চাইতে বাড়ি ফিরে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না কি?
আর জমিদার বাড়ির ডিনার, তার কি হবে? পোয়ারো এতক্ষণে গলা চড়ালো, লর্ড ইয়ার্ডলির খাস রাঁধুনি আমাদের জন্য যে কি ডিনার বানিয়েছে তা না খেয়েই চলে যাব? না বাবু ফিরে যেতে চাও তুমি যাও, আমি আগে ডিনার খাব, তারপর জমিদার বাড়ির বিছানায় নরম গদীতে গা ঢেলে আরমে ঘুমোব।
বয়স বাড়লে মানুষের বুদ্ধি কমে আর সেই তুলনায় তার নোনা আর বেহায়াপনা যায় খুব বেড়ে, পোয়ারো যে সেই পর্যায়ে পৌঁছে গেছে এই মুহুর্তে সে বিষয়ে আমার মনে এতটুকু সন্দেহ নেই।
হুঁ, কি এমন আহামরি ডিনার! আমার মন্তব্যে ভেতরের অধৈর্য ভাব কিছুটা বেরিয়ে পড়ল।
তোমার কি হল, হেস্টিংস?
পোয়ারো বলল, তোমার হাবভাব দেখে আমি সত্যি বলতে কি, কি বলব তাই ভেবে পাচ্ছি না, এখানকার খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারটা যেন এক সাংঘাতিক ব্যাপার, এমন ভাবই বেরোচ্ছে তোমার বুলিতে।
বেশী বাজে বক না, ভেতরের বিরক্তি এবার আমার মুখ দিয়ে ফুটে বেরোল, মিস মার্ভেলের হীরেটার নিরাপত্তার কথা ভেবেও তোমার যত শীগগির সম্ভব লণ্ডনে ফিরে যাওয়া দরকার।
তার সঙ্গে আমার লণ্ডনে এখুনি ফিরে যাবার কি সম্পর্ক?
পোয়ারোর ন্যাকামো দেখে আমার আবার ধৈর্যচ্যুতি হল, গলা কিছুটা চড়িয়ে বললাম, নিজের চোখেই ত দেখলে একটা হীরে কেমন আমাদের চোখের সামনে বেহাত হল, শত্রুপক্ষ যে এবার ওর জোড়াটা হাতাবার তালে থাকবে এই সহজ কথাটা তোমার মাথায় আসছে না কেন?
ওঃ, এই কথা। কয়েক পা এগিয়ে পেছিয়ে পোয়ারো এমন এক চাউনী মেলে আমার দিকে তাকাল যেন অদ্ভুত কিছু দেখছে, তারপর স্বাভাবিক গলায় বলল, কিন্তু তুমি একটা ব্যাপার ভুলে যাচ্ছ বন্ধু, মিস মার্ভেল যেসব চিঠি পেয়েছেন তাতে পূর্ণিমার রাতের উল্লেখ রয়েছে আগামী শুক্রবার পূর্ণিমা, অতএব আমাদের হাতে এখনও প্রচুর সময় আছে।
পূর্ণিমার উল্লেখ সত্যিই আমার মনে ছিল না, পোয়ারো কথাটা মনে পড়িয়ে দিতে আমার শরীর আতঙ্কে হিম হয়ে এল। তবু পোয়ারোকে ধন্যবাদ যে সে সত্যিই ডিনার খাবার জন্য আর বসে রইল না, থাকা সম্ভব হচ্ছে না বলে লর্ড ইয়ার্ডলির কাছে মার্জনা চেয়ে একটি চিঠি লিখে সে আমায় নিয়ে তখনই রওনা হল লণ্ডনের দিকে।
মিস মার্ভেল উঠেছেন ম্যাগনিফিসেন্ট হোটেলে, তা আগেই উল্লেখ করেছি, আমার ইচ্ছে ছিল রাতেই মিস মার্ভেলের সঙ্গে দেখা করে লেভী ইয়ার্ডলির হীরে ছিনতাই হবার খবরটা আগাম দিয়ে তাকে হুঁশিয়ার করে দিই, কিন্তু পোয়ারো তাতে রাজী হল না, বলল যে ঐ খবর আগামীকাল সকালেই দেয়া যাবে সেজন্য তাড়া নেই। পায়োয়োর কথা না মেনে উপায় নেই তাই কোনও প্রতিবাদ না করে নিজের মনে গজগজ করতে লাগলাম।
কিন্তু পরদিন সকালবেলায় পায়োয়োর ভাবগতিক দেখে বুঝতে পারলাম যে বাড়ির বাইরে যাবার ইচ্ছে তার মোটেই নেই। গোড়াতেই আমি ধবে নিলাম একটা বড় ভুল হয়ে গেছে তাই পোয়ারো আর এই কেস নিয়ে এগোতে চাইছে না। কিন্তু আমি জোরাজুরি করতে ও মিস মার্ভেলের কাছে না যাবার যে ব্যাখ্যা কবল তাতে প্রমাণ হল আমার অনুমান ভুল, পায়োরা যুক্তি দিয়ে এটাই বোঝাতে চাইল যেহেতু ইয়ার্ডলি চেজের হীরে ছিনতাইয়ের ঘটনা ইতিমধ্যেই স্থানীয় সব খবরের কাগজে বিবিতভাবে ছেপে বেরিয়েছে তাই মিস মার্ভেল আর তার স্বামী মিঃ রলফকে এই খবটা এখন নতুন করে জানানো নিরর্থক। পায়োরার যুক্তি অকাট্য তা মেনে নিয়ে আপন মনে গজরানো ছাড়া আসার আর কিছুই করার রইল না।