আরও আধঘন্টা কাটল, বিশাল ড্রইংরুমে আমরা তিনজন বসে আছি লেডি ইয়ার্ডলির অপেক্ষায় ডিনারের সময় কয়েক মিনিট হল পেরিয়েছে।
হঠাৎ সামান্য খস্ খস্ শব্দ হতে চোখ তুলে দরজার দিকে তাকালাম, দেখলাম পা পর্যন্ত লম্বা দামী সাদা পোষাক পরে সেখানে এসে দাঁড়িয়েছেন লেডি ইয়ার্ডলি। তাঁর গলার দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম, মনে হল সেখানে যেন ধ্বকধ্বক করে জ্বলছে সাদা আগুনের স্রোতরাশি। পরমুহূর্তে বুঝতে পারলাম সাদা আগুন বলে যা মনে হচ্ছে তা আসলে হীরের জ্যোতি— দ্য ষ্টার অফ দ্য ইষ্ট! বাঁ হাত কোমরে রেখে ডান হাতে সেই হীরের নেকলেসটা ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছেন লেডি ইয়ার্ডলী গর্বিত ভঙ্গিতে, এই মুহূর্তে তাকে ঠিক গভীর গহন জঙ্গলের এক হিংস্র চিতাবাঘিনীর মত দেখাচ্ছে।
এটা আপনাদের সামনে বলি দেব, লেডী ইয়ার্ডলি হালকা রসিকতা করতে চাইলেও তার গলায় অদ্ভুত হিংস্র শোনা, একটু অপেক্ষা করুন, আগে বড় বাতিটা জ্বালিয়ে নিই তারপর ইংল্যাণ্ডের সবচাইতে বিশ্রী আর যাচ্ছেতাই দেখতে নেকলেসটা আপনাদের সামনে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করব আমি আজই এখুনি! দামী জিনিস কিভাবে নষ্ট করতে হয় তাই দেখুন আপনারা।
ঘরের বৈদ্যুতিক আলোর সবকটি সুইচ ছিল তিনি যে দরজার ওপর এসে দাঁড়িয়েছেন তার ঠিক পিছনে। লেডি ইয়ার্ডলি সেদিকে হাত বাড়াতেই ঘটে গেল এক অদ্ভুত ঘটনা আগে থাকতে কোন জানান না দিয়ে এঘরের আলেগুলো সব নিভে গেল। দরজার পান্নাতেও কোন কিছু ধাক্কা লেগে প্রচন্ড জোরে আওয়াজ উঠলো। এবং সেই সঙ্গে দরজার ওপার থেকে ভেসে এলো নারী কন্ঠে সুতীব্র আর্তনাদ।
কি ব্যাপার? লর্ড ইয়ার্ডলি উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, এতে মডের গলা! কি হল?
লর্ড ইয়ার্ডলি আগেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন, এবার আমরাও অন্ধকারের ভেতর হাতড়ে হাতড়ে এগোলাম দরজার দিকে। কয়েক পা এগোতে আঁধারে চোখে পড়ল। সামনে কি যেন দলা পাকানো অবস্থায় পড়ে আছে মেঝের উপর। টর্চ বের করে জ্বালাতেই দেখলাম দলাপাকানো অবস্থায় যেটা পড়ে আছে সেটা লেডি ইয়ার্ডলির অচেতন দেহ, এই মুহূর্তে তার গলা খালি, সেখানে দড়ির ফাঁসের মত একটা লাল দাগ ফুটে উঠেছে—নেকলেসটা জোর করে কেউ গলা থেকে ছিনিয়ে নেবার ফলে যে ঐ দাগ ফুটে উঠেছে তার গলায় এবিষয়ে আমাদের কোনও সন্দেহ রইলনা।
ততক্ষণে ঘরের বৈদ্যুতিক আলোগুলো আবার জ্বলে উঠেছে। আমরা তিনজনে উবু হয়ে তার মাথার কাছে বসলাম, হাতের শিরা পরীক্ষা করে দেখলাম লেডি ইয়ার্ডলি এখনও বেঁচে আছেন, হৃৎপিন্ডের গতিও স্বাভাবিক। তাহলে?
হঠাৎ চোখ মেলে চাইলেন লেডি ইয়ার্ডলি, বলে উঠলেন, চীনে, লোকটা জাতে চীনে, পাশের দরজা দিয়েই— বলেই থেমে গেলেন তিনি।
স্ত্রীর কথা কানে যেতেই একটা কঠিন শব্দ বেরিয়ে এল লর্ড ইয়ার্ডলির মুখ থেকে, আমার নিজের বুকের ভিতরে হৃৎপিন্ডটা ধুকপুক করে লাফিয়ে উঠল আবার সেই চীনে! লেডি ইয়ার্ডলি যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন সেখান থেকে আরো বড়জোর চল্লিশ গজ দুরে দেয়ালের গায়ে একটা ছোট দরজা, সেখানে এসে দাঁড়াতে চৌকাঠের দিকে চোখ পড়ল আর সঙ্গে সঙ্গে আমি উত্তেজিত হয়ে আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। উত্তেজনার মানে ঠিক সেখানেই পড়ে আছে লেডী ইয়ার্ডলির সেই নেকলেস, অল্প কিছুক্ষণ আগেও এটা তিনি গলায় পরেছিলেন। বুঝতে পারলুম ঐ দরজা দিয়ে পালিয়ে যাবার মুখে কোন কারণে চোর বাধা পেয়েছিল আর তখনই এক অসতর্ক মুহূর্তে তার হাত থেকে নেকলেসটা চৌকাঠের কাছে মেঝের উপর পরে যায়। হারানো মাল অবশেষে খুঁজে পেয়েছি ভেবে নেকলেসটা মেঝে থেকে তুলে নিলাম, কিন্তু ভাল করে সেটা খুটিয়ে দেখতে গিয়ে আবার চমকে উঠলাম, চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে এল আমার গলার ভেতর থেকে। ততক্ষণে লর্ড ইয়ার্ডলিও এসে দাঁড়িয়েছেন আমার পাশে, নেকলেসের দিকে একপলক তাকিয়ে আমারই মত এক আর্তনাদ বেরিয়ে এল তার নিজের গলা থেকেও। আমাদের দুজনের আর্তনাদের একটাই কারণ লেডি ইয়ার্ডলির নেকলেস থেকে তরল সাদা আগুনের মত দেখতে সেই অমূল্য হীরে দ্য স্টার অফ দ্য ইস্ট উধাও হয়েছে।
তাহলে এই হল ব্যাপার, আমি বললাম, যে এসেছিল সে সাধারণ ছ্যাচরা বা সিঁধেল চোর নয়, শুধু ঐ পাথরটিই ছিল তাদের লক্ষ্য।
কিন্তু লোকটা ভেতরে ঢুকল কোন পথে? লর্ড ইয়ার্ডলি আপন মনে প্রশ্ন করলেন।
এই পথে, আমি দেয়ালে লাগায়ো ছোট দরজাটা ইশারায় দেখিয়ে বললাম।
কিন্তু এটা ত সব সময় তালা বন্ধ থাকে।
অন্য সময় থাকে কিনা জানি না, কিন্তু এখন এই দরজা তালাবন্ধ নেই, বলেই হাতল ধরে টেনে আমি সেই দরজার পাল্লা খুলে ফেললাম। দরজাটা টেনে খোলার সঙ্গে সঙ্গে কি যেন পড়ে গেল মেঝের ওপর। ঝুঁকে তুলে নিতে দেখলাম সেটা একফালি রেশমী কাপড়, তার গায়ে সেলাই করা নকশা দেখে বুঝলাম ওটা কোনও চীনে যুবকের পরনে ছিল, পালিয়ে যাবার সময় দরজার হাতলে লেগে ছিড়ে গিয়ে থাকবে, এই ধাচের নকশা করা রেশমী পোষাক পরার রেওয়াজ এখনও পর্যন্ত শুধু চীনেদের মধ্যেই চালু আছে।
দৌড়ে আসুন সবাই। চেঁচিয়ে বলে উঠলাম, লোকটা এই পথ ধরে নিশ্চয়ই বেশী দূরে যেতে পারেনি।
লর্ড ইয়ার্ডলি, বাটলার, আর রাঁধুনীদের নিয়ে আমি সেই দরজা দিয়ে অনেকদূব পর্যন্ত গেলাম বটে, কিন্তু যাওয়াই সার হল। রাতের আঁধারে চীনে চোর বাবজী তার অনেক আগেই বাড়ির চৌহদ্দি থেকে বেরিয়ে পালিয়ে গেছে। আমরা যে পথ দিয়ে চোর ধরতে গিয়েছিলাম সেই পথ ধরে আবার ফিরে এলাম বাড়িতে। লর্ড ইয়ার্ডলি তার একজন পরিচারককে পুলিশ খবর দিতে তখনই থানায় পাঠালেন।