আপনি এক্ষুণি বাড়ি যেতে চাইছেন, মি লর্ড? পোয়ারো এক মুহূর্ত কি ভেবে বলল, কিন্তু আমার সঙ্গে আপনার যেসব কথাবার্তা হল তা ভুলেও যেন কাউকে বলবেন না। মনে রাখবেন আমরা আজই বিকেল পাঁচটার কিছু পরে ওখানে যাচ্ছি।
বেশ, কিন্তু অবস্থাটা শেষ পর্যন্ত কি দাঁড়াবে তা এখনও বুঝে উঠতে পারছি না, লর্ড ইয়ার্ডলির গলায় নিশ্চিত্ততার কোনও ভাব সত্যিই পেলাম না।
আপনার হীরেটা যাতে খায়ো না যায় তা আমি দেখব, এটাই আপনি চান, তাই? পোয়ারো বলল।
হ্যাঁ, কিন্তু!
হলে যা বলছি তাই করুন!
বিভ্রান্ত মুখে ইয়ার্ডলি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
বিকেল সাড়ে পাঁচটার পরে আমরা পোঁছোলাম ইয়ার্ডলি চেজে লর্ড ইয়ার্ডলির খাস জমিদারীতে। দুধে সোনালী জরির বিল্লা আঁটা ফুলহাতা সাদা জ্যাকেট আর লাল ফিতে লাগানো ট্রাউজার্স পরা এক পেটমোটা বাটলারের পেছন পেছন পোয়ারো আর আমি এসে হাজির হলাম ইয়ার্ডলি ভবনের ড্রইংরুমে। ঘরের ভেতরে পুরোনো মানার অভিজাত্যের ছাপ এখনও টিকে রয়েছে, ফায়ার প্লেসের কাঠ ভূছে গমগম করে। ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছেন সুন্দরী লেডী ইয়ার্ডলি তার দুই মেয়েকে নিয়ে, মেয়ে দুটিও তাদের মায়ের মতন সুন্দর দেখতে। ঘন কালো চুলে ভরা মাথাটা গর্বিত ভঙ্গীতে মেয়েদের মাথার ওপর নুইয়ে দাঁড়িয়ে আছেন লেডী ইয়ার্ডলি। অপূর্ব দেখাচ্ছে তাকে এভাবে। লর্ড ইয়ার্ডলি হাসিমুখে মেয়েদের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন।
বাটলার দুপা এগিয়ে আমাদের আগমনবার্তা জানাতেই ইয়ার্ডলি নিমেষে চমকে উঠে তাকালেন, তার স্বামীর পোয়ারোর মুখের দিকে তাকানোর ভঙ্গী দেখে বুঝতে বাকি রইল না যে অতঃপর কি করবেন তা ইঙ্গিতে জানতে চাইছেন তার কাছে।
মাফ করবেন, পোয়ারো পরিস্থিতি সামাল দিতে সঙ্গে সঙ্গে বলল, মিস মার্ভেলের কেসের তদন্তু এখনও আমি চালিয়ে যাচ্ছি। আচ্ছা, আগামী শুক্রবার দিন ত ওর এখানে আসার কথা, তাই না? তার আগে সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা তা নিজের চোখে একবার দেখতেই আমি চলে এলাম। আর হ্যাঁ, তাছাড়া আমার এখানে আসার পেছনে আরো একটা কারণ আছে—আমি লেডি ইয়ার্ডলির কাছে জানতে এসেছি যেসব উড়ো চিঠি উনি পেয়েছিলেন তাদের সাথে কোন পোেষ্ট অফিসের ছাপ মারা ছিল তা ওর মনে আছে কি?
দুঃখিত, লেডী ইয়ার্ডলি ঘাড় নেড়ে জানালেন, নামগুলো আমার এই মুহুর্তে আদৌ মনে পড়ছে না। চিঠিগুলো নষ্ট করে আমি খুবই বোকামি করেছি একথা স্বীকার করছি, কিন্তু আমারই বা কি দোষ বলুন, ব্যাপারটা যে শেষকালে এমন গুরুত্ব নেবে তা আমি আগে স্বপ্নেও ভাবিনি।
আপনারা রাতটা এখানেই থাকছেন ত? লর্ড ইয়ার্ডলি জানতে চাইলেন।
না, মি লর্ড, পোয়ারো চটপট জবাব দিল, আমরা এখানে পৌঁছেই একটা সরাইয়ে উঠেছি, মালপত্র সব সেখানেই আছে তাই এখানে থেকে আপনাদের অসুবিধা করতে চাইছি না।
আমাদের অসুবিধার কিছু নেই, লর্ড ইয়ার্ডলি বললেন, আমি এক্ষুনি লোক পাঠিয়ে ওগুলো আনিয়ে নিচ্ছি। না, না, বিশ্বাস করুন আপনারা এখানে থাকলে আমাদের বিন্দুমাত্র অসুবিধা হবে না। লর্ড ইয়ার্ডলি বারবার অনুরোধ করছেন দেখে পোয়ারো আর আপত্তি করল না। লর্ড ইয়ার্ডলির পাশে বসে তার মেয়ে দুটির সঙ্গে গল্পে মেতে উঠল সে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পোয়ারো মেয়েদের সঙ্গে বেশ জমিয়ে নিল, পোয়ারোর ইশারায় আমাকেও হাত ধরে টেনে তাদের পাশে এনে বসিয়ে দিল তারা। কিছুক্ষণ বাদে গালফুলো গম্ভীর দেখতে একজন ধাই মেয়েদের ভেতরে নিয়ে যেতে এল, ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও মায়ের চোখের ইশারায় তারা ধাইয়ের পেছন পেছন ভেতরে চলে গেল।
মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় হল তার ছেলেবেলা, লেডি ইয়ার্ডলির উদ্দেশ্যে মন্তব্য করতে গিয়ে পায়োয়োর গলা থেকে একরাশ শ্রদ্ধা ঝরে পড়ল। আপনার সন্তানদের দেখে আজ সেকথা নতুন করে মনে পড়ল।
ওদের আমি কত স্নেহ করি, ভালবাসি তা বলে বোঝাতে পারব না। কথাটা বলতে গিয়ে লেডি ইয়ার্ডলির গলাটা আবেগে ঝুঁজে এল।
ওরাও আপনাকে শ্রদ্ধা করে, ভালবাসে, কুর্নিস করার ভঙ্গিতে মাথা ঈষৎ ঝুঁকিয়ে পোয়ারো বলল, এবং তার সঙ্গত কারণও আছে।
জমিদার বাড়িতে থাকাই যখন সাব্যস্ত করেছি তখন সেখানকার যাবতীয় রীতি মেনে চলতেই হবে। খানিক বাদে বাড়ির ভেতরে ঘন্টা বাজতেই বাটলার এল আমাদের শোবার ঘরে নিয়ে যাবার জন্য। এমন সময় আরেকজন বাটলার একটা থালায় মুখবন্ধ খাম নিয়ে এসে দাঁড়াল লর্ড ইয়ার্ডলির সামনে।
মাফ করবেন, মঁসিয়ে পোয়ারো। লর্ড ইয়ার্ডলি খামটা তুলে একপলক চোখ বুলিয়ে বললেন, এত দেখছি টেলিগ্রাম। খামের মুখ ছিড়ে ভেতর থেকে তারবার্তা বের করে পড়লেন তিনি, তারপর বললেন, আপনাকে এটা জানিয়ে রাখা আমার কর্তব্য, মঁসিয়ে পোয়ারো। টেলিগ্রাম করেছে হফবার্ণ, ও লিখেছে আমাদের হয়েটা কেনার মত একজন আমেরিকানের সন্ধান ও পেয়েছে, আগামীকাল ওর জাহাজ ছাড়বে। তার আগে আজ রাতে ওরা ওদের লোক পাঠাবে, সে এসে পাথরটা যাচাই করে যাবে। হে ঈশ্বর, সত্যিই যদি ওটা এত সহজে বিক্রী হয় তাহলে, এইটুকু বলেই লর্ড ইয়ার্ডলি কেন জানিনা হঠাৎ মাঝপথে থেমে গেলেন। লেডি ইয়ার্ডলি টেলিগ্রামটা হাতে নিয়ে গলা নামিয়ে বললেন, জর্জ, পাথরটা এত দিন ধরে আমাদের পরিবারে আছে ওটা তুমি বিক্রী করতে চাইছে তা আমার ইচ্ছে নয় বলে তিনিও চুপ মেরে গেলেন। মনে হল স্বামীর কাছ থেকে কোনও উত্তর আশা করছেন, কিন্তু তার স্বামী একটি কথাও উচ্চারণ করলেন না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে লেডি ইয়ার্ডলি আপনমনে বলে উঠলেন, যাই, পোষাকটা পাল্টে ফেলি, মালটা দেখাবার ব্যবস্থাও আমাকেই করতে হবে, বলেই পায়োরের দিকে তাকিয়ে ভুরু সামান্য কুঁচকে গম্ভীর গলায় বললেন, এত বিশ্রী নোংরা আর ভয়ানক নেকলেসের নকশা আগে কোথাও হয়নি। পাথরগুলো নতুন করে সেট করে একটা নেকলেস গড়িয়ে দেবে একথা জর্জের মুখে বহুবার শুনেছি, কিন্তু এ কথা দেয়াই সার হয়েছে, নতুন নেকলেস আজও আমার কপালে জোটেনি! বলেই তিনি ভেতরের দিকে চলে গেলেন।