পোয়ারো যে মেরীকে নিছক ঘাবড়ে দেবার উদ্দেশ্যে এসব বলছে তা বুঝতে আমার বাকি নেই, কিন্তু এও জানি যে পোয়ারোর হাসি ঠাট্টার মধ্যেও কোনও না কোনও কিছু লুকিয়ে থাকে সেটা পরে ধরা পড়ে।
লেভি ইয়ার্ডলির কাছে যে হীরেটা আছে আমি জানি সেটা আমারটার মত এত ভাল নয়, মেরীর গলায় চিরকালের নারীসত্তা ফুটে বেরোল, তবু আমি একবার নিজের চোখে ওটা দেখতে চাই!
পোয়ারো হয়ত কিছু বলত কিন্তু তার আগেই বন্ধ দরজা বাইরে থেকে সজোরে গেল খুলে সেই সঙ্গে সুদর্শন ও স্বাস্থ্যবান একজন পুরুষ মানুষ ঘরের ভেতরে ঢুকলেন। তার চুলের বাহার থেকে শুরু করে পায়ের চামড়ার জুতোজাড়া দেখে যে কেউ রোমান্টিক নায়ক ছাড়া আর কিছু ভাববে না। সঙ্গে সঙ্গে আমি বুঝতে পারলাম ইনি কে।
ডাবলাম এবার তোমায় ডাকব মেরী, গ্রেগরী রলফ ঘরকানো গলায় বলে, উঠলেন, শেষকালে নিজেই চলে এলাম। যাক, মঁসিয়ে পোয়ারো আশাকরি সব শুনেছেন, এই সমস্যা সম্পর্কে আপনার কি অভিমত তাই একবার শুনি। আমার নিজের ধারণা, এ নিছক ভয় দেখিয়ে লোক ঠকানোর কারবার, জানি না আপনি কি বলবেন?
পোয়ারো গ্রেগরীর দিকে তাকিয়ে উদ্দেশ্যপূর্ণ হাসি হেসে বলল, সে যাই হোক না কেন মিঃ রলফ, আমি আপনার স্ত্রীকে বারণ করেছিলাম যাতে উনি অতবড় হীরেটা সঙ্গে নিয়ে আসছে শুক্রবার দিন ইয়ার্ডলি চেজে না যান।
এবিষয়ে আমি আপনার সঙ্গে একমত, রলফ বললেন মেরীকে, আমি আগেই হুঁশিয়ার করেছিলাম, কিন্তু হলে কি হবে, মেরী নিজে যোলআনা মেয়েমানুষ, গয়নাগাটির ব্যাপারে আরেকজন মেয়েমানুষের কাছে সে হার স্বীকার করে কি করে?
কি সব বাজে বক, গ্রেগরী? মেরী রলফকে কড়াগলায় ধমক দিলেন বটে, কিন্তু স্পষ্ট দেখলাম পুলক মেশানো লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছে তার মুখখানা।
মাদাম, পোয়ারো কুষ্ঠিত গলায় বলল, আমি আপনাকে আমার সাধ্যমত সদুপদেশ দিলাম, এর বেশী কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
মেরী আর রলফকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এসে পাটি হয়ে বসল তার চেয়ারে, খুশিখুশি মুখে বলল।
পতিদেবতাটি ভাল সন্দেহ নেই, একদম মোক্ষম জায়গায় ঘা দিয়েছেন।
তবু উনি খেলায়োড় নেহাই কাচা, মেয়েদের খেলানোর কৌশলটা উনি নেন না।
কয়েক বছর আগে ক্যালিফোর্নিয়ায় গ্রেগরীর সঙ্গে লেডি ইয়ার্জলির অসামাজিক প্রেম ভালবাসার সত্যকাহিনী এবার লায়োরোকে যতদূর মনে আছে বললাম, নে সে এমন ভাব দেখালো যা দেখে মনে হল ঘটনাটা তারও মনে আছে।
আমিও ঠিক এমন কিছুই ধরে নিয়েছিলাম, পোয়ারো বলল, যাক, ক্ষন দিয়ে শোন আমি একটু বেরোচ্ছি খানিক পরেইফিরে আসব। আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা রে।
পোয়ারো বেরিয়ে যেতে আমি দুচোখ বুজে একটু ঘুমোবার চেষ্টা করছি এমন সময় বাইরে থেকে দরজায় মৃদু টোকা দেবার শব্দ হল! চোখ মেলতেই দেখি ল্যাণ্ডলেডি মিসেস মাচিনসন ঘরের ভেতরে দরজার পাড়া সামান্য ফাক করে মাথাটা ভেতরে ঢুকিয়েছেন। আমি চোখ মেলতেই তিনি বললেন, ক্যাপ্টেন হেস্টিংস, আরেকজন ভদ্রমহিলা মঁসিয়ে পোয়ারোর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন, দেখে মনে হল দূরের গাঁগঞ্জের লোক। উনি কাজে বেরিয়েছেন শুনে মহিলা বললেন তার খুব দরকার মঁসিয়ে পোয়ারো ফিরে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন।
তাহলে ওকে বরং এখানেই নিয়ে আসুন, মিসেস মাচিনসন, আমি বললাম, হয়ত আমি ওঁর জন্য কিছু করতে পারি।
একটু পরে মিসেস মাচিনসন যে ভদ্রমহিলাকে ভেতরে নিয়ে এলেন তাকে দেখেই আমার বুকের ভেতরের কলজেটা ধুকপুক করে উঠল বারেকের জন্য। হ্যাঁ, এ মুখ আমার খুবই পরিচিত। এ দেশের সভ্রান্ত ও রক্ষণশীল সমাজের বিভিন্ন কে কেলেংকারী নিয়ে প্রকাশিত মুখরোচক কাহিনীগুলোতে এই মুখের ফোটো বহুবার ছেপে বেরিয়েছে। আমি উঠে দাঁড়িয়ে একটি চেয়ার তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, বসুন, লেডি ইয়ার্ডলি, আমার বন্ধু মঁসিয়ে পোয়ারো একটু বেরিয়েছেন, অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই তিনি ফিরে আসবেন।
ধন্যবাদ জানিয়ে লেডি ইয়ার্ডলি বসলেন আমার মুখোমুখি। কিছুক্ষণ আগে যিনি এসেছিলেন সেই মেরী মার্ভেলের তুলনায় ইনি অত্যন্ত অন্য রকম। লম্বা, ঘন তামাটে গায়ের রং, মুখখানা ফ্যাকাশে হলেও এক সম্ভ্রান্ত গর্ববোধ সেখানে ফুটে উঠেছে। তার দুচোখ অদ্ভুত দীপ্তিময়, ঠোঁট দুটি কামনামদির।
তার সমস্যা নিয়ে কথা বলার সাধ জাগল আমার মনে। আর জাগবে নাই বা কেন? বন্ধুবর পোয়ারো সামনে থাকলে বেশীর ভাগ সময় আমি কিছু অসুবিধা বোধ। করি নিজের কোণি দেখাতে পারি না বলে। অ হলেও গোয়েন্দাগিরি করার কিছু ক্ষমতা সীমিত পরিমাণে যে আমার মধ্যেও আছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ভেতরের সেই তাগিদেই সামনের দিকে ঘাড় ঝুঁকিয়ে বললাম, লেডি ইয়ার্ডলি, আপনি কেন কি কারণে এখানে এসেছেন তা আমি জানি। হীরে সম্পর্কে আপনি অচেনা কোনও লোকের কাছ থেকে উড়ো চিঠি পেয়েছেন যা ব্ল্যাকমেলিং বলে আপনার সন্দেহ হবে।
প্রশ্ন শোনার সঙ্গে সঙ্গে লেডি ইয়ার্ডলির গাল দুটো গেল চুপসে, আমার মনে হল সেখানকার সব রক্ত কেউ শুষে নিয়েছে। হাঁ করে অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, আপনি কি ভাবে জানলেন?
এত সাধারণ মুক্তির নিয়ম, আমাদের হাসি হেসে বললাম, মিস মেরী মার্ভেল যদি ভয় দেখানো চিঠি পান তাহলে–
মিস মার্ভেল? লেডি ইয়ার্ডলি ব্যাকুলভাবে প্রশ্ন করলেন, উনি এখানে এসেছিলেন?