কিন্তু এর পরের ঘটনা প্রমাণ করল যে আমার আকাঙ্খা ও হুঁশিয়ারী এতটুকু অযৌক্তিক ছিল না—বেলা দুটো নাগাদ টেলিফোন ঝনঝন করে বেজে উঠল। পোয়ারো রিসিভার তুলে কয়েক মুহূর্ত কানে ঠেকিয়ে কি শুনল কে জানে, তারপর আচ্ছা, রাখছি, বলে সেটা আগের জায়গায় রেখে দিল।
কি হয়েছে জানতে চাও? পোয়ারোকে এই প্রথম মুখ কালো করতে দেখলাম। লজ্জার সঙ্গে জানাল, মিস মার্ভেলের হীবেটাও চুরি হয়েছে।
সে কি? পোয়ারোর কথা শুনে আমি লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম, সুযোগ পেয়ে এ রসিয়েই বললাম, কি গো, তোমার পূর্ণিমার রাতের কি হল? এমন ত হবার কথা ছিল না, তাহলে?
পোয়োরা কোনও জবাব দিল না, মুখ নিচু করে বসে রইল সে।
চুরিটা হল কখন?
ওদের কথা শুনে বুঝলাম আজ সকালে, পোয়ারো জানাল।
আমার কথা শুনলে এটা অবশ্যই এড়ানো যেত, আমি জোর গলায় বললাম, আমার ধারণা যে ঠিক তা এখন তুমি নিজেই দেখতে পাচ্ছে।
তাই ত দেখাচ্ছে সোনা, পোয়ারো সতর্কভাবে মন্তব্য করল, অনেকের মতে দেখানোর মধ্যে একটা ঠকানো আর ঠকে যাওয়ার ব্যাপার আছে, তবু ঘটনা যেমন দেখায় সেটা অবশ্যই মেনে নিতে হবে।
এবার আর ঘরের ভেতর শুয়ে বা বসে থাকা চলবে না তাই ট্যাক্সি চেপে আমরা দুজনে রওনা হলাম ম্যাগনিফিসেন্ট হোটেলের দিকে, যাবার পথে বললাম, পূর্ণিমার রাতে হীরে চুরি করার মতলব নিঃসন্দেহে অভিনব। শুক্রবারের আগে পর্যন্ত কিছু হবে না এই বলে আমাদের নজর সেদিকে ব্যস্ত রেখে তস্কর চূড়ামণি তার অনেক আগেই তার কাজ হাসিল করে ফেলল। তার মতলব তুমি আগে থেকে টের পাওনি এটাই যা দুঃখের ব্যাপার।
যা বলেছো! পোয়ারো এতক্ষণ তার স্বভাবিক গলায় বলল, একজনের পক্ষে সব কিছু আগে থাকতে ভেবে রাখা সম্ভব নয়!
পোয়ারো যে জোর করে তার পুরোনো হাসিখুশি মেজাজ বজায় রাখতে চাইছে সে বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ রইল না, অন্যদিকে তার এই ব্যর্থতার কথা ভেবে দুঃখও কম হল না। পোয়ারো নিজে যে কোনরকম ব্যর্থতাকে কিরকম ঘেন্না করে তা আমার অজানা নাই।
জিতে রহো ভাইসাব, পোয়ারোকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, পরের বার তোমাকে ঠেকাবে কার সাধ্য!
ম্যাগনিফিসেন্ট হোটেলে গিয়ে পৌঁছোনোর পর ওখানকার কর্মচারীরা আমাদের নিয়ে এল ম্যানেজারের কামরায়। মিস মার্ভেলের স্বামী গ্রেগরী রলফ সেখানে আগেই এসে হাজির হয়েছিলেন। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে আসা দুজন গোয়েন্দা তাকে নানাভাবে জেরা করছে। হোটেলের জনৈক কেরাণীকে দেখলাম ফ্যাকাশে মুখে উল্টোদিকে বসে তাদের কথাবার্তা শুনছেন। আমরা ভেতরে ঢুকতেই রলফ মাথা নেড়ে সংক্ষেপে অভিবাদন জানালেন।
আমরা ব্যাপারটার গোড়ায় যাবার চেষ্টা করছি, রল মন্তব্য করলেন, কিন্তু ঘটনাটা এখনও পর্যন্ত বিশ্বাস করতে পারছি না। জিনিসটা হাতানোর মত সাহস লোকটার হল কি করে তাই আমি বুঝে উঠতে পারছি না।
গ্রেগরী রলফের মুখ থেকে ঘটনার বিবরণ যেটুকু শুনলাম তা রকম। সকাল এগারোটা বেজে পনেরো মিনিট নাগাদ উনি কোনও কাজে হোটেল থেকে বেরিয়েছিলেন, ঠিক পনেরো মিনিট বাদে অর্থাৎ সকাল সাড়ে এগারোটায় হুবহু তারই মত দেখতে একটি লোক হোটেলে ঢুকে ম্যানেজারের কাছে তার গয়নার বাক্সটি চান। ম্যানেজার নিয়ম অনুযায়ী একটি রসিদে তাকে সই করতে বলেন। ভদ্রলোক রসিদে সই করার পরে ম্যানেজার গ্রেগরী রলফের মূল স্বাক্ষরের সঙ্গে সেটা মিলিয়ে দেখেন এবং লক্ষ্য করেন যে পরের স্বাক্ষরটি কিছুটা অন্যরকম। এই বিষয়টি উল্লেখ করলে ভদ্রলোক জানান যে ট্যাক্সি থেকে নেমে দরজা বন্ধ করার সময় তার ডানহাতের দুটি আঙ্গুল জখম হয়েছিল যে কারণে তার পরের স্বাক্ষর হুবহু একরকম ঠেকছে না।
রলফের বক্তব্য শেষ হতেই হোটেলের কেরানী ভদ্রলোক মুখ খুললেন, তিনি যা বললেন তাতে এই বোঝায় যে দ্বিতীয় স্বাক্ষর তিনিও দেখেছেন তবে তাতে উল্লেখ করার মত কোনও তফাৎ ছিল না।
দেখবেন, আপনারা আবার যেন আমাকে চোর চোর বলে ভাববেন না, সেই ভদ্রলোক মন্তব্য করেছিলেন, একজন চীনে বেশ কিছুদিন ধরে আমায় ভয় দেখানো চিঠি লিখছে আর দুঃখের ব্যাপার হল আমি নিজেই অনেকটা চীনেদের মত দেখতে, বিশেষ করে আমার চোখ দুটো ত প্ৰায় ওদের মত।
ভদ্রলোকের মুখের দিকে আমিও তাকিয়েছিলাম, কেরানী ভদ্রলোক বলে উঠলেন, দেখলাম ঠিকই চোখদুটো একটু কুতকুতে যেমন থাকে চীনেদের।
বাজে গালগপ্পো রাখুন, গ্রেগরী রলফ শরীরটা সামনে ঝুকিয়ে দিয়ে বললেন, দেখুন আমার চোখদুটো কি চীনেদের মত কুতকুতে?
কেরানী ভদ্রলোক মুখ তুলে বেশ কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাকে দেখলেন তারপর মন্তব্য করলেন, না মশাই, আমার নিজের চোখে অন্ততঃ ঠেকেছে না। কি ভেবে আমিও ভাল করে তাকালাম রলফের চোখের দিকে। কিন্তু না, এত সেই চেনা কটা দুটি চোখ গভীর আত্মপ্রত্যয় যেখান থেকে ফুটে বেরোচ্ছে। এ চোখের চাউনীকে কোনভাবেই সন্দেহ করা যায় না।
খদ্দেরটির বুকের পাটা আছে বলতে হবে, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে আসা গোয়েন্দা অফিসারটি মন্তব্য করলেন, সন্দেহ এড়ানোর জন্য দুচোখে সামান্য মেকাপ নিয়েছিলেন আগে থেকেই। তবে এটাও ঠিক যে, লোকটা আগে থেকেই আপনার ওপর নজর রেখেছিল, আপনি বেরিয়ে যাবার পবেই ও এসে ঢুকেছিল হোটেলে।
ত মিঃ রলফের সেই গয়নার বাক্সটার কি হল? আমি জানতে চাইলাম।
ওটা পাওয়া গেছে, ম্যানেজার বললেন, হোটলের করিডোরে পড়েছিল, ভেতরে সবকিছু যেমন ছিল তেমনি কি আছে, শুধু একটি জিনিস বাদে তাহল দ্য স্টার অফ দ্য ইষ্ট নামে একটি দামী হীরে।