কিছু কি ঘটেছে? আমাকে দেখামাত্র সে প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ–আমি এড়িয়ে যাওয়া গলায় উত্তর দিলাম। ফোনটা কোথায়?
খারাপ টারাপ কিছু ঘটেছে কি?
একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। একজন আহত হয়েছে। আমাকে ফোন করতেই হবে।
কে? কে আঘাত পেয়েছেন স্যার?
সেসময় আমি দেখি তার মুখে একটা তীব্র ব্যগ্রতা। সেটা খেয়াল করে আমি জবাব দিই–মিস ম্যাগি বার্কলি।
মিস ম্যাগি? মিস ম্যাগি কি আপনি নিশ্চিত স্যার? মানে, ইয়ে–আপনি কি নিশ্চিত যে মিস ম্যাগিই আহত হয়েছেন?
একশো ভাগ নিশ্চিত–কেন?
ওহ, না–না, সেরকম কিছু না। আমি ভাবলাম অন্য মেয়েদের কেউ……. হয়তো মিসেস রাইস আহত হয়েছেন।
দেখ এলিন যথেষ্ট হয়েছে। আমি এবার কড়া গলায় বলি–এবার টেলিফোনটা কোথায় আছে বলবে?
এবার মেয়েটা কিছুটা থমমত খেয়ে যায়-হা, হা, দুঃখিত স্যার, এই তো এই ঘরে।
সে পাশের ঘরটার দরজাটা খুলে ধরতেই যন্ত্রটার উপর আমার নজর পড়ে। আমি এগিয়ে যাই তার দিকে। এলিন তখনও সেখানে সটান দাঁড়িয়ে।
আপনি যদি ডাঃ গ্রাহামের নম্বর…….
ধন্যবাদ, আমার আপাতত আর কোন সাহায্য চাই না তোমার কাছে।
এবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রায় বাধ্য হয়েই ওকে ওখান থেকে চলে যেতে হয়। ওকে এত ধীরে ধীরে পা ফেলতে দেখে আমার সন্দেহ হয় সে নিশ্চয়ই আমার কথাগুলো আড়ি পেতে শোনার চেষ্টা করবে। কিন্তু আমাকে সেটা হতে দিলে চলবে না, কারণ ও হয়তো এমন কিছু জেনে যাবে যেটা ওর পক্ষে এই মুহূর্তে না জানাই বাঞ্ছনীয়–যদিও একটু পরেই তো সবাই এমন কি এলিনও সব কিছুই জানতে পারবে।
আমি প্রথমে পুলিস থানায় ফোন করে পুরো ঘটনাটা জানাই। তারপর আমি নিজ উদ্যোগে, এলিন যার নাম উল্লেখ করেছিল সেই ডাঃ গ্রাহামের নম্বরটা ফোনের ডাইরি থেকে খুঁজে বের করে তাকেও ফোন করে সব জানাই। উনি কয়েক মিনিটের মধ্যেই এখানে আসছেন বলে আমাকে জানালেন। আমি ফোন রেখে সেই ঘর থেকে বের হয়ে আবার নিকের ঘরে ফিরে এলাম। এলিনকে তখন কোথাও দেখতে পেলাম না। ভাবলাম দরজার পেছনে দাঁড়িয়ে আমার সব কথাগুলো যদি সে শুনেও থাকে, আমার ঘর থেকে ফেরার মুহূর্তে খুব দ্রুততার সঙ্গে সেখান থেকে সরে পড়েছে সে।
ততক্ষণে নিক অনেকটা শক্ কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। সোফায় উঠে বসেছে। আমাকে একটু ব্র্যান্ডি দিতে পারেন?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আমি দ্রুত পায়ে ডাইনিং রুমে হাজির হই। সঙ্গে সঙ্গে ব্রান্ডিও পেয়ে যাই। নিককে এনে দিতে ও দু’ এক চুমুক পান করেই অনেকটা চাঙ্গা হয়ে ওঠে। ওর মুখের রঙ আস্তে আস্তে ফিরে আসে।
ওহ, কি ভয়ঙ্কর।
হ্যাঁ, নিঃসন্দেহে।
না, আপনি বুঝতে পারছেন না। এটা আমি হতে পারতাম। আমারই তো হবার কথা ছিল। সব শেষ হয়ে যেত।
আমি ওকে সাহস জোগানোর জন্য বলি–দয়া করে এভাবে বলবেন না। মনে সাহস আনুন।
সে বারবার মাথা বাঁকাতে বাঁকাতে বিড়বিড় করে বলে চলে–আপনি জানেন না–আপনি জানেন না। তারপর আচমকাই সে কাঁদতে শুরু করে। প্রায় নিঃশব্দে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে শিশুর মত।
আমার মনে হল এটাই এখন ওর জন্যে সবচেয়ে ভাল হবে। এতে মনের গ্লানি অনেকটাই হাল্কা হয়ে যাবে, তাই ওকে আর থামানোর কোনও চেষ্টাই করলাম না। কান্নার প্রথম তীব্রতা নিক সামলে ওঠার পর আমি ওর পাশ থেকে সরে গিয়ে জানলার সামনে এসে দাঁড়ালাম, বাইরে নজর দিলাম, অনেকক্ষণ থেকেই সেখানে মানুষের গল্পর স্বর, হৈ-চৈ আওয়াজ, উত্তেজিতভাবে কথাবার্তা, চাপা আতঙ্কের চিৎকার সব শুনতে পাচ্ছিলাম। মৃতদেহটা ঘিরে ঘটনাস্থলে একটা ভিড় জমেছে। প্রায় সকালেই সেখানে জড়ো হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম উর্দি পরা দু’জন অবয়বধারী ঘাস মাড়িয়ে এগিয়ে এল। পুলিস এসে পৌঁছেছে।
আমি আবার পুরানো জায়গায় সোফায় গিয়ে বসলাম। কান্না ক্লিষ্ট মুখ তুলে তাকাল নিক আমার দিকে।
আমার কি এখন কিছু করা উচিত নয়?
না, একদম নয়। পোয়ারোর কড়া নির্দেশ রয়েছে এটা পুরোপুরি ওর ওপর ছেড়ে দিতে হবে। তোমার বাড়ির বাইরে যাওয়া চলবে না।
দু’হাতের তালুতে মুখ ঢেকে কয়েকমুহূর্ত চুপ করে বসে থাকে নিক, তারপর আবার ডুকরে কেঁদে ওঠে–বেচারা ম্যাগি, অভাগা ম্যাগি, এত ভাল মেয়ে ছিল যে জীবনে কারও কোনও ক্ষতি করেনি আর ওর ভাগ্যে কিনা এরকম একটা ঘটনা ঘটল। নিজেকেই আমার খুনী মনে হচ্ছে। ওকে এখানে ডেকে এনে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার জন্য আমিই ওর খুনের জন্য দায়ী।
আমি নীরবে মাথা ঝাঁকালাম। নিয়তির বিধান কেউ খণ্ডাতে পারে? যখন পোয়ারো নিককে বোঝাচ্ছিল, বুঝিয়ে রাজি করাল তার কোনও বন্ধু অথবা আত্মীয়কে এনে ওর সঙ্গে থাকবার জন্যে, তখন কি পোয়ারো জানতে, বুঝতে পেরেছিল, একটি নিষ্পাপ নিরপরাধ মেয়ের মৃত্যু পরোয়ানা সই করেছে সে।
আমরা নিঃশব্দে বসে রইলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম অনুমান করতে পারছিলাম, বাইরে কি ঘটে চলেছে। কিন্তু আমি অনুগতভাবে পোয়ারোর নির্দেশ মান্য করেই নিজের কর্তব্য দায়িত্বে বদ্ধ হয়ে রইলাম। হয়তো আধ ঘন্টা কি মিনিট কুড়ি পর হবে অথচ আমার মনে হল বেশ কয়েকঘণ্টা পর দরজা ঠেলে পোয়ারো ঘরে ঢুকল। সঙ্গে দু’জন পুলিশ কর্মীর একজন এবং আরও একজন। আমার বুঝতে অসুবিধা হল না অপর ব্যক্তি হলেন ডাঃ গ্রাহাম। ঘরে ঢুকে সঙ্গে সঙ্গে নিকের কাছে চলে এলেন ওরা।