তারপর আসা যাক নার্স হপকিন্সের কথায়। ওর মিথ্যে কথার সরল ব্যাখ্যা কি হতে পারে? যতো ভাবতে লাগলাম, ততই জটিল হয়ে উঠল ব্যাপারটা, কব্জিতে ক্ষতচিহ্নের জন্যে অমন একটা বাজে মিথ্যে কথা বলার কি দরকার তার? ঐ দাগটার বিশেষত্ব কি?
আমি নিজেকে প্রশ্ন করতে লাগলাম। চুরি হওয়া মরফিনটা কার ছিল? নার্স হপকিন্সের। মিসেস ওয়েলম্যানকে মরফিন কে দিয়ে থাকতে পারে? নার্স হপকিন্স, বেশ, কিন্তু ওটা পাওয়া যাচ্ছে না এ বিষয়ে সোরগোল তুলল কেন? এর একটাই উত্তর, যদি নার্স হপকিন্স নিজেই অপরাধী হয় তবে, কারণ অপর খুনটা, অর্থাৎ মেরী জেরার্ডের খুনের ব্যাপারটা পরিকল্পনা আগেই হয়ে গেছে, কাকে শিখণ্ডী করা হবে তাও ঠিক হয়ে গেছে। অতএব দেখতে হবে ঐ শিখণ্ডীর পক্ষে মরফিন জোগাড় করা কতটা সম্ভব।
আরও একটা ঘটনা খাপ খেয়ে গেল, এলিনরকে লেখা বেনামী চিঠি। এলিনর ও মেরীর মধ্যে সম্পর্কে চিড় ধরানো। উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার-এলিনর চলে আসবে এবং মিসেস ওয়েলম্যানের ওপর তার প্রভাব কমাবার চেষ্টা করবে। কিন্তু রডারিক ওয়েলম্যান যে পাগলের মত মেরীর প্রেমে পড়ে যাবে, একথা স্বপ্নেও ভাবা যায়নি–কিন্তু ঘটনাটাকে খুব সহজ কাজে লাগিয়ে নিলে নার্স হপকিন্স। এতে অভিসন্ধির ব্যাপারে এলিনরকে শিখণ্ডী করার কাজটা আরও সহজ হয়ে উঠল।
কিন্তু দুটো খুনের কারণ কি? মেরী জেরার্ডকে সরিয়ে ফেলার কথা নার্স হপকিন্স কেন চিন্তা করল? আশার আলো দেখতে পেলাম…তবে তখনও আলোটা খুব ক্ষীণ। মেরীর ওপর নার্স হপকিন্সের প্রচণ্ড প্রভাব ছিল, এবং সেই প্রভাব খাঁটিয়ে মেরীকে দিয়ে ও একটা উইলও করিয়ে নিল। কিন্তু তাতে তো নার্স হপকিন্সের কোন লাভ হচ্ছে না? লাভ হচ্ছিল মেরীর এক মাসির, যে নিউজিল্যাণ্ড থাকে, তখন হঠাৎ মনে পড়ে গেল গ্রামেই কে একজন বলেছিল মেরীর ঐ মাসিও ছিলেন হাসপাতালের নার্স।
তখন আর আলোটা অত ক্ষীণ নয়। অপরাধের পরিকল্পনা…পদ্ধতি ক্রমশঃ সুস্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। পরের ধাপটাও খুব সোজা, নার্স হপকিন্সের সঙ্গে আর একবার দেখা করলাম। নাটকের অভিনয় দুজন ভালোভাবেই করলাম। শেষপর্যন্ত যে কথাটা ও বারবার বলতে চাইছিল সে কথাটাই যেন ওকে দিয়ে জোর করে আমি বলিয়ে নিচ্ছি এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করল। তবে যখন বললে ওর পক্ষে সবচেয়ে ভালো হত, তার চেয়ে একটু আগেই বলে ফেলতে হল কিন্তু এমন সুযোগ সে হাতছাড়া করতে চাইল না। ফলে প্রচণ্ড অনিচ্ছার ভান করে ঐ চিঠিটা বের করে দিল। বুঝলে বন্ধু তখন আমি আর অনুমানের জগতে রইলাম না। আমি জেনে গেলাম সবকিছু। চিঠিটাই ওকে ধরিয়ে দিল।
ড. লর্ড বললেন কিভাবে?
বন্ধু হে, চিঠির খামের ওপরে লেখা ছিল মেরীকে পাঠাতে হবে আমার মৃত্যুর পর, কিন্তু চিঠির সারমর্ম থেকে জানা যায় মেরী জেরার্ড সত্যি কথাটা জানতো না। তাছাড়া খামের ওপর পাঠাতে হবে (দিতে হবে না) কথাটা অনেক সংকেত বহন করে আনল। চিঠিটা মেরীকে লেখা হয়নি, হয়েছিল অপর একজন মেরীকে। এলিজা রাইলি চিঠি লিখেছিলেন তার বোন মেরী রাইলিকে, যে নিউজিল্যাণ্ডে থাকত।
মেরী জেরার্ডের মৃত্যুর পর নার্স হপকিন্স চিঠিটা আউট হাউস থেকে পায়নি। পেয়েছিল বহু আগে, যখন সে নিউজিল্যাণ্ডে থাকত, ও চিঠিটা ওকে পাঠান হয়েছিল নিউজিল্যাণ্ডে, দিদির মৃত্যুর পর।
মনের চোখ দিয়ে কোন কিছু একবার দেখে নিতে পারলে পরের কাজটা সহজ হয়ে যায়। এরোপ্লেনে সহজে আসা যায় বলে একজন সাক্ষীর পক্ষে সম্ভব হল নিউজিল্যাণ্ড থেকে এসে আদালতে হাজির হওয়া। সে নিউজিল্যাণ্ডে মেরী ড্রেপারকে ভালো ভাবে চিনত।
ড. লর্ড বললেন, ধরুন যদি আপনি ভুল করতেন, নার্স হপকিন্স আর মেরী ড্রেপার যদি সম্পূর্ণ আলাদা দুজন লোক হতো?
পোয়ারো বললেন, আমি কখনও ভুল করি না।
ড. লর্ড হেসে উঠলেন, পোয়ারো বলতে লাগলেন, এখন আমরা এই মহিলা মেরী রাইলি বা ড্রেপার সম্বন্ধে অনেক খবর পেয়েছি। নিউজল্যাণ্ডের পুলিশ ওর বিরুদ্ধে যথেষ্ট সাক্ষীসাবুদ যোগাড় করতে পারেনি, তখন নজর রেখে চলেছিল, তারপর হঠাৎ একদিন মহিলা উধাও হয়ে গেল দেশ ছেড়ে। ওখানে ওর এক বুড়ি রোগী ছিল, যিনি স্নেহের নার্স রাইলিকে মোটামুটি ভালোই সম্পত্তি দিয়ে গিয়েছিলেন। যার মারা যাবার ব্যাপারটা বেশ রহস্যময়। ডাক্তারও খুব আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন। মেরী ড্রেপারের স্বামীও ওর নামে মোটা টাকার বীমা করেছিলেন, স্বামীও হঠাৎ মারা যান এবং তার মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যায়নি। দুর্ভাগ্যবশতঃ, স্বামী প্রথম প্রিমিয়ামের চেকটা লিখে রেখেছিলেন, পোস্ট করতে ভুলে গিয়েছিলেন। অন্য মৃত্যুগুলো তার নিজের এক্তিয়ারের মধ্যেই ঘটেছিল। মহিলার কোন অনুশোচনা বা বিবেক বলে কিছু ছিল না।
একথা সহজেই অনুমান করা যেতে পারে যে চিঠির বিষয়টাকে নিজের কাজে লাগাবার মতো ধূর্ত বুদ্ধির অভাব নার্স হপকিন্সের ছিল না। নিউজিল্যাণ্ডে ওর থাকা ক্রমশঃ অস্বস্তিকর হয়ে ওঠায়, সে এদেশে চলে এল এবং হপকিন্স এই নাম নিয়ে (ঐ নামে বিদেশে তার এক নার্স সহকর্মী ছিল, যে ওখানেই মারা যান) নিজের পেশার কাজ শুরু করে দিল। তার লক্ষ্য ছিল মেডেনসফোর্ডে। বুড়ি মিসেস ওয়েলম্যানের গুপ্তকথা ফাস করে দেবার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করার পরিকল্পনাও তার থেকে থাকতে পারত, তবে মিসেস ওয়েলম্যান ছিলেন কড়া ধাঁচের মহিলা, ওতে খুব সুবিধে হবে না এটা নার্স রাইলি বা হপকিন্স বুঝে ফেলেছিল। ফলে ও পথে পা বাড়াল না। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে মিসেস ওয়েলম্যানের সম্পত্তির পরিমাণ সম্বন্ধেও খোঁজখবর নিয়েছিল আর হয়তো দৈবক্রমে জানতে পেরে গিয়েছিল বুড়ি কোন উইল করেননি।