এক অজানা চাপা উচ্ছ্বাসে এলিনর হাত রাখলেন ড. লর্ডের হাতের ওপর, বললো, আপনি..আপনি আসবেন তত আমার সঙ্গে দেখা করতে?
নিশ্চয়ই।
প্রায়ই আসবেন তো?
আপনি যেমনটি চাইবেন, ড. লর্ড বললেন।
আসবেন নিশ্চয়ই…প্রায়ই আসবেন।
.
৩.৬.১
এরকুল পোয়ারো বললেন, তাহলে দেখছেন তো বন্ধু, মানুষ যে-সব মিথ্যে কথা বলে সেগুলো সত্যি কথার মতোই প্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে পারে?
ড. লর্ড বললেন, সকলেই কি আপনার কাছে মিথ্যে কথা বলছে?
হ্যাঁ। কেননা কোন কারণে, বুঝতে পারছেন তো, যে মানুষটির কাছে সত্যি কথাটা বলা ছিল একটা গুরুদায়িত্ব এবং এ ব্যাপার যে ছিল স্পর্শকাতর আর খুঁতখুঁতে–সেই মানুষটি আমাকে খাইয়ে ছিল সবচেয়ে বেশি।
ড. লর্ড অস্ফুট স্বরে বললেন, এলিনর নিজে, তাই না?
ঠিক তাই। প্রমাণগুলো বলে দিচ্ছিল ওই দোষী। আর সে নিজেও তার স্পর্শকাতর মন আর অত্যন্ত খুঁতখুঁতে বিবেক নিয়ে ঐ অনুমানকে নস্যাৎ করার কোন চেষ্টাই করেনি। প্রকৃত কাজটা না করলেও, খুনের চিন্তা করেছিল এই অপরাধবোধেই সে তাই নিজেকে দোষী বলে স্বীকার করে নিতে চলেছিল, যে অপরাধ সে আদৌ করেনি। দীর্ঘশ্বাস চেপে ড. লর্ড বললেন, অবিশ্বাস্য।
পোয়ারো মাথা নাড়লেন, আদৌ নয়। সে নিজেকেই দোষী বলে মনে করেছিল, সাধারণ মানুষের চিন্তাশক্তির মাপকাঠি দিয়ে নয়, আরও উচ্চস্তরের মানবিকতার মাপকাঠি দিয়ে।
ড. লর্ড বললেন, হ্যাঁ, উনি ঐ ধরনেরই মহিলা।
এরকুল পোয়ারো বললেন, তদন্ত শুরু করার প্রথম থেকেই এলিনর কার্লিসলই যে অপরাধী তার নানা জোরালো প্রমাণ পাচ্ছিলাম। কিন্তু আপনার প্রতি আমার দায়িত্ব আমি পালন করেছি, আমি দেখলাম অন্য আরেক জনের বিরুদ্ধেও জোরালো কেস পাওয়া যাচ্ছে।
নার্স হপকিন্স?
না, প্রথমে তা ছিল না। আমার নজর প্রথমে পড়েছিল রডারিকওয়েলম্যানের ওপর। তার ব্যাপারেও অবশ্য আমাকে প্রথমে একটা মিথ্যে দিয়ে শুরু করতে হয়েছিল। ও আমাকে বলেছিল ৯ই জুলাই ইংল্যাণ্ড ছেড়ে যায়। ফেরে ১লা আগস্ট। কিন্তু কথায় কথায় নার্স হপকিন্স আমাকে বলেছিল যে মেরী জেরার্ড রডারিককে একবার মেডেনসফোর্ডে এবং আর একবার যখন ও মেরীর সঙ্গে লণ্ডনে দেখা করেছিল তখন রডারিককে বেশি ঘনিষ্ঠতা দেখানোর জন্য কড়া কথা শুনিয়েছিল। আপনি আমায় বলেছিলেন যে মেরী লণ্ডনে যায় ১০ জুলাই। অর্থাৎ রডারিক ইংল্যাণ্ড ছাড়ার একদিন পরে। তাহলে কবে লণ্ডনে মেরীর সঙ্গে রডারিকের দেখা হল? আমার যে সিঁধিলে চোর বন্ধু আছে,তার শরণাপন্ন হলাম, রডারিকের পাশপোর্ট দেখতে হবে। দেখা গেল যে, সে ইংল্যাণ্ডে ফিরে এসেছিল, ২৫ থেকে ২৭ শে জুলাই পর্যন্ত ছিল। এবং ইচ্ছাকৃতভাবেই মিথ্যে কথা বলেছে ও।
ভাঁড়ার ঘরে প্লেটে স্যাণ্ডউইচ রেখে এলিনর মেরীদের ডাকতে গেল আউট হাউসে–ঐ সময়টুকুর কথা আমার মনে ভীষণভাবে দাগ কেটেছিল। কিন্তু তাতে এই ধারণাও মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, যদি ঐ সময়ের মধ্যে বিষ মেশানো হয়ে থাকে তবে হত্যাকরীর লক্ষ্য ছিল এলিনর, মেরী জেরার্ড নয়। এলিনর কার্লিসলকে হত্যা করার কোন উদ্দেশ্য ছিল কি রডারিকের? হ্যাঁ, খুব সঙ্গত কারণ ছিল। এলিনর তার উইলে সব সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করেছিল রডারিক ওয়েলম্যানকে। এবং খুঁটিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম ঐ ব্যাপারটা জেনে ফেলার পুরো সুযোগ রডারিকের ছিল।
ড. লর্ড বললেন, তবে কেন আপনি ধরে নিলেন যে ও নিরপরাধ?
আর একটা মিথ্যা কথার জন্যে। খুব বোকার মতো একটা মিথ্যে কথার জন্যে, নার্স হপকিন্স বলেছিল গোলাপের কাটাতে তার কব্জি ছড়েছে। আমি নিজে গিয়ে গাছটা দেখলাম…ওতে কোন কাটাই ছিল না।…স্পষ্ট বোঝা গেল নার্স হপকিন্স মিথ্যে কথা বলছে। আর মিথ্যেটা এতই বাজে ভাবে ধরা পড়ে গেল যে ওর ওপর আমার সন্দেহ শুরু হয়ে গেল।
নার্স হপকিন্সকে নিয়ে চিন্তা করতে লাগলাম আমি। তার আগে পর্যন্ত ওকে আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য সত্যবাদী সাক্ষী মনে হয়েছিল। মেরীর প্রতি ওর প্রচণ্ড স্নেহ-ভালোবাসার মধ্যেই যে ও এলিনরের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছিল–এটাই আমার ধারণা হয়েছিল। কিন্তু ঐ মিথ্যে কথাটা ধরা পড়ার পর থেকে ওর প্রতিটি কথার বিচার করতে শুরু করলাম। এবং দেখলাম এমন কিছু একটা আছে যা আমার বিদ্যেবুদ্ধি ধরতে পারেনি। নার্স হপকিন্স মেরী জেরার্ড সম্বন্ধে এমন কিছু একটা জানে, এবং সেটা যাতে জানাজানি হয়ে যায় তার জন্যে সে সচেষ্ট।
চমকে গিয়ে ড. লর্ড বললেন, আমি তো উল্টোটাই ভেবেছিলাম।
বাইরে থেকে তাই মনে হবে। এমন অভিনয় করছিল যেন সে জানে কিন্তু কিছুতেই বলতে চাইছে না। কিন্তু ওর কথাগুলো বারবার চিন্তা করে দেখলাম যে কটা কথা ও উচ্চারণ করেছে বা বলেছে ওর উদ্দেশ্য ছিল তার উল্টোটা বলার, প্রকাশ করার। নার্স ও’ব্রায়ানের সঙ্গে কথা বলার পর আমার সন্দেহ পাকা হল, হপকিন্স খুব চালাকি করে ও’ব্রায়ানকে না জানিয়ে কাজটা হাসিল করে নিল।
তখন ব্যাপারটা পরিষ্কার হলো যে নার্স হপকিন্স নিজের চাল চেলে যাচ্ছে। রডারিক আর হপকিন্স, দুজনের মিথ্যে কথাগুলো ওজন করতে শুরু করলাম। এর সরল ব্যাখ্যা দুজনের মধ্যে কে দেবে?
রডারিক-এর ব্যাপারে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর পেয়ে গেলাম : বড্ড অভিমানী ভদ্রলোক, ও যে তার প্ল্যানমাফিক বিদেশে সবটা সময়ে কাটায়নি, চুপিসাড়ে এসে মেরীর সঙ্গে দেখা করেছে। হৃদয়ের টানে, এবং কোনরকম প্রশ্রয় পায়নি, এতে তার ব্যক্তিসত্তা অপমানিত হয়েছে তাই ও প্রকাশ্যে স্বীকার করেনি, বলেছিল একেবারে ১লা আগষ্ট ইংল্যাণ্ডে ফিরেছে। তাছাড়া খুন হবার সময় ঘটনাস্থলের ধারে-কাছে ছিল না রডারিক। খুনের কথা কিছু জানতোও না, তাই নিজের দুর্বলতার দিকটাও ঢাকবার জন্যে বেমালুম মিথ্যে বললে।