সাক্ষী হপকিন্স বলেছে যে আউট হাউসের গোলাপ গাছের কাঁটা ফুটেছিল তার কব্জিতে। সাক্ষী ওয়াদ্রেভ গাছটাকে পরীক্ষা করে অভিমত দিয়েছেন ঐ ধরনের গাছে কাটা হয় না। আপনারাই সিদ্ধান্ত নেবেন নার্স হপকিন্সের কব্জিতে দাগ কেন হয়েছিল এবং কেনই বা সে মিথ্যা করা বলবে…
যদি সরকারী পক্ষ আপনাদের মনে বিশ্বাস জন্মাতে সক্ষম হয়ে থাকেন যে আসামী ছাড়া কারুর পক্ষে এই অপরাধ করা সম্ভব নয়, তবে আপনারা আসামীকে দোষী সাব্যস্ত করবেন।
যদি আসামীপক্ষের উপস্থাপিত বিকল্প তত্ত্বটিকে আপনারা যুক্তিযুক্ত মনে করেন এবং সাক্ষ্যপ্রমাণের সঙ্গে তার সঙ্গতি খুঁজে পান, তবে আসামীকে রেহাই দিতে হবে।
আপনাদের যেসব প্রমাণ পেশ করা হয়েছে শুধু তারই ভিত্তিতে সাহস, ধৈর্য্যের এবং সুচিতার সাহায্যে আপনারা আপনাদের অভিমত দেবেন এটাই আমার অনুরোধ।
.
৩.৪.৩
এলিনরকে আবার আদালতে আনা হলো। জুরীরা যথাস্থানে সার বেঁধে বসলেন।
জুরী মহোদয়গণ, আপনারা আপনাদের সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে ঐক্যমত হয়েছেন কি?
হ্যাঁ।
কাঠগড়ার মধ্যে বসে থাকা আসামীকে দেখুন এবং বলুন যে সে অপরাধী না। নিরপরাধ।
নিরপরাধ।
.
৩.৫.১
পাশের দরজা দিয়ে এলিনরকে ওরা বারের করে আনল। যারা এগিয়ে এসে ওকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছিল তাদের মুখগুলো এলিনরের চেনা..রডি…বড় গোঁফওয়ালা ডিটেকটিভ পোয়ারো..
ও কিন্তু এগিয়ে গেল লর্ডের দিকে।
আমি এখান থেকে বেরোতে চাই…
মসৃণ গতিতে ডেমলার ছুটে চলেছে লণ্ডনকে পিছনে ফেলে, গাড়িতে ড. লর্ড আর এলিনর। ডাক্তার একটা কথাও তাকে বলেননি, আশীর্বাদের ধারার মতো এই নিঃশব্দের মধ্যে নিশ্চল হয়ে বসেছিল এলিনর। প্রতিমুহূর্তে এগিয়ে চলেছে…এক নতুন জীবনের দিকে, এটাই ও চাইছিল…এত নতুন জগৎ.হঠাৎ এলিনর বললো, আমি…আমি এমন একটা শান্ত জায়গায় যেতে চাই…যেখানে কোনো চেনামুখ থাকবে না… ।
ধীর গলায় ড. লর্ড বললেন, সব ঠিক করা আছে, আপনাকে একটা স্যাটেরিয়ামে নিয়ে যাচ্ছি। শান্ত জায়গা। সুন্দর বাগান। কেউ আপনাকে বিরক্ত করবে না…। দীর্ঘশ্বাস ফেলে এলিনর বললো, আমি ঠিক ওটাই চাইছি। ডাক্তার বলেই হয়তো ওর মনের ও শরীরের অবস্থা বুঝে এই বন্দোবস্ত করেছেন, মনে মনে খুশি হলো এলিনর। ক্রমশ এক নিরাপদ দূরত্বে চলে যাচ্ছে সে..ড. লর্ডের থাকায় অনেকটা স্বস্তি আছে যেন। লণ্ডনের শহরতলী পার হয়ে যাচ্ছে তারা। শেষপর্যন্ত কথা বললো এলিনর, সবটাই আপনার জন্যে..আপনার জন্যে। ড. লর্ড বললেন, পোয়ারোর জন্য। লোকটা যেন জাদু জানে। অবাধ্য মেয়ের মতো এলিনর মাথা নাড়ল, আপনার জন্য। ওঁকে আপনিই জোগাড় করে কাজ করিয়ে নিয়েছেন। পিটার লর্ড একটু হাসলেন, সেটা ঠিক যে ওঁকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে হয়েছে।
আপনি কি বিশ্বাস করতেন আমি করিনি, নাকি আপনার দ্বিধা ছিল?
পুরোপুরি বিশ্বাস কখনই করিনি।
এলিনর বললো, ঠিক এই জন্যেই প্রথম দিকে আমি প্রায় বলে ফেলতে যাচ্ছিলাম, আমি দোষী…কারণ জানেন, কথাটা কিন্তু আমি ভেবে ছিলাম…ঐ নার্সের বাড়ির সামনে যখন আমি হেসেছিলাম ঐ চিন্তাটা আমার মাথায় এসেছিল।
ড. লর্ড বললেন, হ্যাঁ আমি জানতাম।
আশ্চর্য হয়ে এলিনর বললো, এখন খুব অদ্ভুত লাগে…গোপন সম্পদের মত। সেদিন আমি মাহের মণ্ড কিনলাম। স্যাণ্ডউইচ তৈরী করছিলাম, তখন নিজের সঙ্গে ছলনা করে চলেছিলাম আমি…আমার মাথায় ঘুরছিলো একটা কথা : এর সঙ্গে আমি বিষ মিশিয়ে দিয়েছি, ও যখন এটা খাবে, মরবে…আর আমার রডিকে আমি ফিরে পাবো।
ড. লর্ড বললনে, এই ধরনের চিন্তা অনেকে করে। সেটা কিন্তু খুব খারাপ নয়। কল্পনার মধ্যে দিয়ে মনের ভার লাঘব করে নেওয়া যায়।
এলিনর বললো, হ্যাঁ, ঠিক তাই। কারণ তারপরই আমার মনের কালিমা মুছে গিয়েছিল। ঐ নার্সটা যখন আউট হাউসের গোলাপ গাছের কথা বললো, তখনই আমি আবার স্বাভাবিক হয়ে গেলাম, মনের নীচতাবোধ মুহূর্তে উবে গেল। তারপর একটু কেঁপে উঠে বলো, পরে যখন আমি সকালের চা খাওয়ার ঘরে গিয়ে দেখলাম ও মারা যাচ্ছে, তখন আমার মনে হয়েছিল খুন করার চিন্তা করা আর সত্যি সত্যিই খুন করার মধ্যে খুব একটা পার্থক্য আছে কি?
প্রচুর পার্থক্য আছে। খুন করার চিন্তা করলে কারুর কোন ক্ষতি হয় না। লোকে অবশ্য উল্টোপাল্টা নানা কথা বলে।…বলে খুনের চিন্তা করা আর খুন করা একই জিনিষ। আসলে তা নয়। অনেকক্ষণ ধরে খুন করার চিন্তা থাকলেও হঠাৎ মনোভাবে দ্রুত পরিবর্তনও আসতে পারে। মনে হয় এতক্ষণ কি যা তা ভাবছিলাম।
এলিনর কান্নার সুরে বললো, আপনি শুধু ভালো ভালো কথা বলে আশ্বাস দিচ্ছেন।
অসংলগ্ন ভাবে ড. লর্ড বললেন, আদৌ নয়…শুধু সাধারণ বুদ্ধি…হঠাৎ এলিনরের চোখ জলে ভরে উঠলো, আদালতে ঘুরে ফিরে বার বার আমি আপনাকে দেখেছি। মনে সাহস পেতাম। আপনাকে দেখতে…খুব সাধারণ লাগতো…।
জোরে হেসে উঠে আবার বললো, কথাটা খুব অভদ্রের মতো বললাম।
ড. লর্ড বললেন, আমি বুঝতে পারছি, মানুষ যখন কোন বিভীষিকার মধ্যে পড়ে তখন সাধারণ মানুষকেই সে চায় আশ্রয় হিসাবে। আরও কিছুক্ষণ চলার পর গাড়ি থামলো পাহাড়ের কোলে একটা সুন্দর ছোটো সাদা রঙের বাড়ির সামনে, ড. লর্ড বললেন, এখানে খুব নিরাপদে থাকবেন আপনি, কেউ আপনাকে বিরক্ত করবে না।