নার্স হপকিন্স বললেন, দেখছি আপনি সবই জানেন। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পর নার্স হপকিন্স ঘরের অন্যদিকে একটা আলমারী খুলে একটা খাম নিয়ে পোয়ারোর হাতে দিয়ে বলেলেন, কি করে এটা আমার হাতে এল তা বলছি। মনে রাখবেন আমার একটু সন্দেহ ছিল। প্রথমতঃ মিসেস ওয়েলম্যান যে চোখে মেয়েটিকে দেখতেন এবং দ্বিতীয়তঃ, যে গুজব চালু হয়েছিল, অসুস্থ অবস্থায় বুড়ো জেরার্ড আমাকে বলেছিলেন, মেরী তার মেয়ে নয়। মেরী মারা যাবার পর আমি আউটহাউসের ঘর পরিষ্কার করছিলাম, একটা ড্রয়ারে বুড়োর অন্যান্য কাগজপত্রের সঙ্গে এই চিঠিটা পাই।
খামটার ওপর বিবর্ণ হয়ে আসা কালিতে লেখা, মেরীর জন্য, আমার মৃত্যুর পর পাঠাতে হবে। নার্স হপকিন্স জানালেন, চিঠিটা মেরীর মায়ের লেখা, যিনি প্রায় ১৪ বছর আগে মারা গেছেন।
পোয়ারো চিঠিটা বের করলেন–চিঠিতে লেখা–যদি কখনও প্রয়োজন পড়ে সেইজন্য এই চিঠিতে সত্য কথাটি লিপিবদ্ধ করে যাচ্ছি। হান্টারবেরীর মিসেস ওয়েলম্যানের পরিচারিকা ছিলাম আমি। উনি আমাকে খুব স্নেহের চোখে দেখতেন, একবার আমি বিপদে পড়ি, উনি আমাকে সাহায্য করেন এবং সব শেষ হবার পর আবার কাজে বহাল করেন, বাচ্চাটা কিন্তু মারা যায়। আমার মনিবগিন্নী এবং স্যার লিউইল রাইক্রফট পরস্পর পরস্পরকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন কিন্তু তারা বিয়ে করতে পারেননি, কারণ ভদ্রলোকের স্ত্রী পাগলা-গারদে ছিলেন। স্যার রাইক্রফট অত্যন্ত অমায়িক মানুষ ছিলেন। যুদ্ধে তিনি মারা যান। অল্পকাল পরেই মনিবগিন্নী আমাকে জানান তার বাচ্চা হবে। তারপর তিনি আমাকে সঙ্গে নিয়ে স্কটল্যাণ্ডে যান। ওখানে আরডলোক্রিতে শিশুটি জন্ম নেয়। জেরার্ড, যে আমাকে বিপদে ফেলে পালিয়েছিল, আমার বিপদ কেটে গেছে দেখে আবার চিঠি লেখা শুরু করেছিল। বন্দোবস্ত হল যে জেরার্ড আমাকে বিয়ে করবে এবং বাচ্চাটি আমার বাচ্চা বলে মনে করবে, এবং আউটহাউসে থাকবে। উদ্দেশ্য বাচ্চাটিকে চোখের সামনে রাখা। তার লেখাপড়ার বন্দোবস্ত করে সমাজে একটা ভালো জায়গা করে দেওয়া। তিনি চেয়েছিলেন প্রকৃত সত্য যেন কোনদিনও মেরীকে জানানো না হয়। মিসেস ওয়েলম্যান আমাদের দুজনকেই মোটা টাকা দেন। কিন্তু না দিলেও আমি তাকে সাহায্য করতাম। বরকে পেয়ে আমি সুখী হয়েছিলাম, কিন্তু ও মেরীকে সহ্য করতে পারতো না। কিন্তু আমার মনে হয় মারা যাবার আগে একথাটা কাগজে কলমে লিখে রেখে যাওয়া ভাল।–এলিজা জেরার্ড (বিয়ের আগের নাম এলিজা রাইলি)।
জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে চিঠিটা রাখলেন পোয়ারো। নার্স হপকিন্স এসব ব্যাপার আর পাঁচজন না জানলেই ভালো। কারণ ওঁরা সবাই মৃত।
যাঁরা বেঁচে আছেন, তাদের কথাও তো চিন্তা করা উচিত? পোয়ারো বললেন।
কিন্তু এ ঘটনার সঙ্গে খুনের তো কোন সম্পর্ক নেই।
গম্ভীর হয়ে পোয়ারো বললন, কে বলতে পারে, অনেক কিছুই এ থেকে পাওয়া যেতে পারে। বলে পোয়ারো বেরিয়ে গেলেন।
কিছুদুর যাবার পর হরলিকের সঙ্গে দেখা। হরলিক জানাল গাড়িটা ড. লর্ডেরই ছিল। গাড়ির নম্বর এম.এম.এস. ২০২২। হরলিককে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলেন মঁসিয়ে পোয়ারো।
৩. আদালত ঘরে
৩.১.১.
আদালত ঘরে গিয়ে এলিনরের অতীতের কথাই মনে পড়ছিল। সরকারী উকিলের বক্তব্য শেষপর্যন্ত শোনেনি সে। পুরোনো দিনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছিল মনে মনে।…সেই প্রথম..যেদিন ঐ অশুভ চিঠিটা পেল…তারপর পুলিশ অফিসার অনর্গল বলতে লাগলেন, আপনি এলিনর ক্যাথরীন কার্লিসল, গত ২৭শে জুলাই বিষপ্রয়োগে মেরী জেরার্ডকে হত্যা করা অপরাধে আপনাকে গ্রেপ্তার করার পরোয়ানা আমি এনেছি এবং আপনাকে সতর্ক করে দিচ্ছি যে আপনি যা বলবেন তা লিখে রাখা হবে, এবং তা আপনার বিচারের সময় সাক্ষ্য হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
ভয়ংকর গরম সীসার মতো কথাগুলো ওর কানে ঢুকছিল, আর হাজার চোখ অসম্ভব কৌতূহল নিয়ে যেন এলিনরের সমগ্র সত্তাকে গ্রাস করতে চাইছিল। এলিনরের মনে হল জুরীরাই একমাত্র ওর দিকে তাকাচ্ছেন না কারণ…একটু পরেই ওঁরা যা বলবেন সেটা জানেন বলেই ওর দিকে তাকাচ্ছেন না।
.
৩.১.২
সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়ানো ড. লর্ডকে এখন আর সদা হাস্যময়, নম্র, বন্ধুত্বপর্ণ মোটেই মনে হচ্ছে না। পুরোদস্তুর পেশাদার–নিরুত্তাপ, নিস্পৃহ গলায় একসুরে উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন টেলিফোন পেয়ে তিনি হন্টারবেরী পৌঁছানোর কয়েকমিনিট পর মেরী জেরার্ড মারা যায়। কৌড্রোইয়ান্তে শ্রেণির মরফিন বিষক্রিয়ার মৃত্যু হয়েছে বলেই তিনি মনে করেন।
স্যার এডউইন বামার জেরা করতে শুরু করলেন ড. পিটার লর্ডকে।
মেরী জেরার্ডের প্রতি আসামীর ব্যবহার কেমন ছিল বলতে পারনে কি?
অত্যন্ত মধুর এবং স্বাভাবিক।
একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে স্যার এডুইন বামার বললেন, ঈর্ষা মেশানো ঘৃণার কোন চিহ্ন আপনি দেখেননি, যে কথা অনেকক্ষণ ধরে শুনেছি এখানে।
ড. লর্ড বললেন, দেখিনি।
এলিনরের মনে হল ড. লর্ড ওর জন্যই মিথ্যে কথা বলছেন।
ড. লর্ডের পর পুলিশ সার্জেন এলেন কাঠগড়ায়। মরফিনের ক্রিয়া কিভাবে হয় তার খুঁটিনাটি বর্ণনা দিলেন।
.
৩.১.৩
পরদিন কোর্টে বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ ড. অ্যালান গারসিয়া সাক্ষ্য দিতে এসে বোঝালেন মরফিয়ার এক গ্রেনেই মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে।