এইভাবে আশা নিরাশায় দুলতে দুলতে পুলিশ স্টেশনে হাজির হলো। আগেই হাজির ছিলেন গোয়েন্দা পোয়ারো। পুলিশ ইনসপেক্টর রাইসের সঙ্গে গভীর আলোচনায় ব্যস্ত ছিলেন তিনি। তাকে দেখে গম্ভীর স্বরে বললেন, আসুন মঁসিয়ে ফকনার। তিনি না এলে পুলিশ পাঠিয়ে তাকে আনা হত। এবার মিসেস গ্রান্টের ফ্ল্যাটে রওনা হওয়া যাক। ভয়ে বুক কাঁপছিল তার। তারা কি তাকেই মিসেস গ্রান্টের হত্যাকারী হিসাবে চিহ্নিত করেছে?
পুলিশ ইনসপেক্টরের হাতের দিকে ভয়ার্ত চোখে দেখল। মিসেস গ্রান্টের পোস্ট মর্টেম রিপোর্টটা স্থির চোখে দেখছিলেন পোয়ারো। জিমি পোস্ট মর্টেম রিপোর্টটার দিকে তাকিয়ে আছে।
কয়েক মিনিটের জন্য অদ্ভুত নীরবতা। মুখে কোন কথা নেই। পোয়ারো জিমির মনের প্রতিক্রিয়া বুঝবার চেষ্টা করছিল।
নীরবতা ভঙ্গ করে পোয়ারো বললেন, মঁসিয়ে ফকনার। মিসেস গ্রান্টের পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট পাওয়া গেছে। মৃত্যুর কারণ, খুব কাজ থেকে তাকে গুলিবিদ্ধ করা হয়।
তা তো জানতাম।
তীক্ষ্ণ স্বরে পোয়ারো বললেন, জানতেন তিনি?
গতকালই ইনসপেক্টর রাইসের সঙ্গে তার আলোচনার সময় সে শুনেছে। এবং ইনসপেক্টর রাইসকে জিজ্ঞাসা করল, তাই না ইনসপেক্টর রাইস।
হুঁ বলে মাথা নেড়ে উত্তর দিলেন রাইস।
হত্যাকারী কে? জিজ্ঞস করলো জিমি। মঁসিয়ে, এরপর কি হতে পারে?
এরপর আর কিছু নেই। কেস খতম।
কেস খতম? কি বললেন তিনি?
হ্যাঁ, আমি সব জেনে গেছি।
কি জেনেছেন? ছোট্ট বোতলটার মাধ্যমেই তিনি কি সব জেনেছেন?
ঠিক তাই, বলে পোয়ারো বলেন, খবর সংগ্রহ করতে এই বোতলটাই তাকে সাহায্য করেছে।
ঘন ঘন মাথা নেড়ে জিমি বলল, তার কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। ফ্রেজারের বিরুদ্ধে প্রমাণ পাবার পরে তিনি অসন্তষ্ট ছিলেন। তার মনে হয়েছিল, তার অস্তিত্ব পোয়ারো স্বীকার করছেন না।
নরম সুরে পোয়ারো বললেন, যদি যে কেউ হয় তিনি খুব বিস্মিত হবেন।
তার কথা জিমি কিছুতেই বুঝতে পারছে না।
যে একটা নাম। সতর্কতার সঙ্গে রুমালে চিহ্নিত করা একটা নাম। আর চিঠিটা। যদি ফ্রেজার নামে কোন ব্যক্তি চিঠিটা লিখত তবে চিঠিটা বেনামে লেখার কোন প্রয়োজন ছিল না। দ্বিতীয়তঃ এমন ভাবে মৃত মহিলার পকেটে রাখতেন না যাতে পুলিশের নজরে পড়ে যায়। সুতরাং ফ্রেজারের কোন অস্তিত্বই নেই।
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল জিমি। প্রথম যে পয়েন্ট সেটা হলো তিনি একবার বলেছিলেন ফ্ল্যাট বাড়িতে কিছু কিছু জিনিস যা প্রত্যেকেরই ফ্ল্যাটে থাকে। এই ব্যাপারে তিনটি উদাহরণ দিয়েছিলেন। চতুর্থ উদাহরণ হলো, লাইটের সুইচ। তার বন্ধু বলেছিল যে জানালার ধারে যায় নি। টেবিলের ওপর হাত রেখেছিল আর হাত রক্তে ভরে যায়। তখনই তার প্রশ্ন মনে জাগল। কেন টেবিলের ওপর সে হাত রাখতে গেল। আর কি বা খুঁজছিল। দরজার পাশে সুইচ থাকে। তাছাড়া কেন সে আলো জ্বালাবার প্রয়োজন বোধ করেনি। অন্ধকারে কোন অস্বাভাবিক কাজ করা যায় না। আর যারা অন্ধকার জগতের মানুষ তারা আলোয় আসতে ভয় পায়। তার বন্ধুর বক্তব্য অনুযায়ী টেবিলের আলো জ্বালাবার চেষ্টা সে করে কিন্তু ব্যর্থ হয়। কিন্তু সে সুইচ দেওয়া মাত্র আলো জ্বলে ওঠে। তার মানে এই কি, সে আলো জ্বালাতে অনিচ্ছুক ছিল। যদি আলো জ্বালতো তাহলে বুঝত যে তারা ভুল ফ্ল্যাটে এসে পড়েছে। তাহলে এই ফ্ল্যাটে ঢোকার কোন প্রয়োজন থাকতে পারে না।
জিমি বলল, আর একটু খোলসা করে না বললে সে কিছুই বুঝতে পারছে না।
ঠিক আছে বলে মঁসিয়ে পোয়ারো ট্রাউজারের পকেট থেকে একটা চাবি বের করে তার সামনে তুলে ধরলেন। দেখুন তো মঁসিয়ে, এটা কোথাকার চাবি?
এই ফ্ল্যাটের চাবি। উত্তর দেয় জিমি।
না, উপরের ফ্ল্যাটের। মাদমোয়াজেল প্যাট্রিসিয়ার ফ্ল্যাটের চাবি। যেটা ভেনোডেন হাত ব্যাগ থেকে তুলে নেয়।
কেন, প্যাটের ফ্ল্যাটের চাবি সরাতে গেল?
সে জানতো, সেদিন সন্ধ্যায় লিফটের দরজা খোলা ছিল।
কিন্তু হারানো চাবিটা মঁসিয়ে পেলেন কিভাবে?
এক গাল হাসি হেসে পোয়ারো বললেন, এটা তিনি পান গভীর রাত্রে। চাবিটার খোঁজ তিনি পান তার বিশ্বস্ত বন্ধু মঁসিয়ে ভেনোডেনের পকেটে। তার মনে আছে ছোট্ট বোতলটার কথা। এই লাইনে কাজ করতে করতে তার প্রচুর অভিজ্ঞতা হয়েছে। এই জাতীয় বোতল যেখানে, প্রত্যেকে চাইবে ঘ্রাণ নিতে এবং পরে বোতলের বস্তটির দিকে। মঁসিয়ে ভেনোডেনের ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হয়নি। একরকম নোটিশেই সে বোতলটা ছিনিয়ে নেয়। প্রথমে ছিপি সমেত বোতলটার ঘ্রাণ নেয়। তারপর ছিপি খুলে ঘ্রাণ নিতে চেষ্টা করে। এই ভাবে তার পাতা জালে সে ধরা পড়ল। তার সব চালাকির ছন্দপতন ঘটল। তার সাময়িক চেতনাহীন দেহটা পোয়ারো ধরে ফেললেন। বোতলের ভেতরে এথিল ক্লোরইড নামে শক্তিশালী এ্যানসেথটিক ছিল যা শুকলে মানুষ সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারায়। এই সুযোগ নেবার জন্য গভীর রাতে তিনি ওষুধটা কিনে আনলেন। সেই অ্যানাসথেটিকের প্রতিক্রিয়া স্থায়ী হয় এক কি দুই মিনিট। এই মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য তিনি অপেক্ষা করছিলেন। সেই অবসরে তার পকেট থেকে দুটো জিনিস সংগ্রহ করেন। তিনি জানতেন, এই দুটি জিনিস তার পকেটে থাকতে বাধ্য। একটি চাবি আর অপরটি
কিছুক্ষণ থেমে আবার বলেন, তার মনে আছে। ইনসপেক্টর রাইস মৃত দেহ পর্দার আড়ালে লুকোবার কারণ দেখান হাতে সময় পাবার জন্য খুনী এই পন্থা অবলম্বন করেছিলেন। সেই কথা ভেবে একটা কথা তার মনে এসেছে। সেটা হলো সন্ধ্যা ডাকের চিঠিগুলি। সান্ধ্য ডাক আসে সাড়ে নটার কিছু পরে। খুনী যা আশা করেছিল তা হয়নি। তার সেই না পাওয়া জিনিসটা ডাকযোগে পরে আসতে পারে। তাই সে আবার ফিরে আসে। কিন্তু মিসেস গ্রান্টকে খুন করার পর তার মতোকেই যেন পরিচারিকা না দেখতে পায় এবং সন্ধ্যা ডাক না আসা পর্যন্ত পুলিশ যেন ফ্ল্যাটের দখল নিতে না পারে সেইজন্য পর্দার আড়ালে মৃতদেহ লুকিয়ে রেখেছিল। পরিচারিকা বাড়ি ফিরে গৃহকত্রীকে দেখতে না পেয়ে ভাবল তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন এবং রোজকার অভ্যাস মতো চিঠিগুলি টেবিলের ওপর রেখে দেয়।