–ছিল আর্থার লেভারশ্যাম নামে এক ভদ্রলোকের। এরপর মিস মার্টিনের সঙ্গে দু-একটা কথা বলে আমি তার কাছে বিদায় নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। ফিরে এসে নোটবুক খুলে চিঠিখানার ভাষাটা টুকলাম। আর বারবার চোখ বুলিয়ে তার রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করতে লাগলাম।
খুব বেশি সময় লাগল-না। চতুরঙ্গের চারটে সংখ্যাটিকে চাবিকাঠি হিসেবে ধরে নিতেই রহস্যটা পরিষ্কার হয়ে গেল। দেখলাম, চিঠির ভাষার মধ্যে তিনটে করে শব্দ বাদ দিয়ে চতুর্থ শব্দটিকে যদি গ্রহণ করি তাহলে চিঠিটা এইরকম দাঁড়ায় :
জরুরী খনি সতেরো চার।
শেষের ঐ চার শব্দটা নিশ্চয়ই চতুরঙ্গের প্রতীক। বাকী থাকছে তাহলে চারটি শব্দ : জরুরী খনি সতেরো এগারো। এর মানেটা কি? আমি জানতাম লোমনশায়ারের আমাদের বাড়িটার কাছে একটা খনি আছে। সতেরো তারিখ এগারোটার সময় সেখানে উপস্থিত থাকার জন্যে কি চতুরঙ্গ কিছু জরুরী নির্দেশ দিচ্ছে? এগারোটা মানে নিশ্চয়ই রাত এগারোটা, দুপুর এগারোটা নয়। আজ ষোলই অক্টোবর। কাল সতেরো। এরকুলকে এক্ষুনি একটা টেলিগ্রাম পাঠিয়ে জানিয়ে দিই, সে যেন নির্দিষ্ট স্থানে, নির্দিষ্ট সময়ে এসে চতুরঙ্গের রাঘব-বোয়ালদের ধরে ফেলে। পাঠিয়েও দিলাম।
পরদিন সতেরোই অক্টোবর সারাদিনটা আমার চাপা উত্তেজনার মধ্যে কাটল। স্টেশনে গিয়ে পোয়ারোর সঙ্গে দেখা করে খনির দিকে নিয়ে যাবো ভাবলাম। কিন্তু রাইল্যান্ড কিছু জরুরী কাজ দিল। সেগুলি সারতে আমার দশটা বেজে গেল। সাড়ে দশটা বাজতেই তিনি আমাকে ছুটি দিলেন।
ঘরে গিয়ে একটা কালো ওভারকোট চাপিয়ে পা চালিয়ে আমি খনির ধারে একটা ঝোঁপের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে বসে রইলুম। তখন দশটা পঞ্চাশ বাজে। মিনিট পাঁচেক বাদেই দেখলাম রাইল্যান্ড চারিদিকে একবার তাকিয়ে খনিতে নেমে গেলেন।
এক-পা এক-পা করে আমিও এগোলাম। নিচের থেকে কিছু কথাবার্তা কানে আসতে বুঝলাম চতুরঙ্গের অন্যান্য সদস্যরা হাজির হয়েছেন। আমি পা টিপে টিপে নিচে নামতে লাগলাম। আমার পকেটে একটা রিভলবার ছিল। চতুরঙ্গের সদস্যদের সামনে ওটা উঁচিয়ে বলব…
-হ্যান্ডস আপ! চমকে উঠে দেখি রাইল্যান্ড। বললেন আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছি। আমরা। রাইল্যান্ডের রিভলবার আমার দিকে তাক করা।
আমাকে বেশ ভালো করে হাত পা বাঁধা হলো। মুখের মধ্যে রুমাল গুঁজে দিয়ে শুইয়ে রাখা হল।
রাইল্যান্ড বললেন, ওহে নেভিল, পোয়ারোর চর, তোমার আসল নাম হেস্টিংস তা আমি জানি। পোয়ারো তোমার কাছ থেকে খবর পেয়ে নিশ্চয়ই এখানে আসবে। চমৎকার। দুজনেই খতম হবে কেমন। খনির মধ্যে ধস নামবার ব্যবস্থা করব আমরা। তারপর জ্যান্ত কবর।
হে ঈশ্বর! পোয়ারো যেন কোনো কারণে এখানে এসে না পৌঁছায়–আমি ভাবতে লাগলাম।
বৃথাই প্রার্থনা। একটু বাদেই পোয়ারোর চেনা পদশব্দ আমার কানে এল।
অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন রাইল্যাণ্ড। পোয়ারো আসতেই রিভলবার উঁচিয়ে বললেন। হ্যাণ্ডস আপ।
পোয়ারো হাত তুলে দাঁড়ালো। বলল, ব্যাপার কী?
-ব্যাপার কিছুই নয়। আপনাদের দুজনকে আজ হত্যা করব। আপনারা নিজেরাই আমাদের জালে পা দিয়েছেন।
পোয়ারো হেসে বলল, জাল তো আমি ফেলেছি।
তার মানে?
-মানেটা খুবই সোজা। অন্তত ঘণ্টা খানেক আগে আমরা অর্থাৎ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের জনা দশেক বাছাই করা লোক। জায়গাটাকে ঘিরে রেখেছে তারা। কী, মানেটা বোধগম্য হল?
মিঃ রাইল্যাণ্ডের চোয়াল স্কুলে পড়ল। পোয়ারো শিস্ দিতেই জনা দশেক প্রহরী রাইল্যান্ড আর তার চাকরের রিভলবার কেড়ে নিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করল।
.
খনি থেকে বেরিয়ে পোয়ারো বলল, নাঃ এইভাবে শত্রুর কবলে তোমাকে পাঠিয়ে আমি খুব অন্যায় করেছিলুম। সবটাই আমার জানা ব্যাপার। আমি জানতাম তোমার মারফতেই ওরা আমাকে ধরবার চেষ্টা করবে। ঐ মিস মার্টিন চতুরঙ্গেরই চর। চিঠিটা ভুয়ো। টেলিগ্রাম পেয়েই বুঝেছিলাম এটা একটা ফাঁদ। সঙ্গে সঙ্গে ইন্সপেক্টর জ্যাপকে সব জানিয়ে পাল্টা ফাঁদের ব্যবস্থা করলাম।
খেল কিন্তু খতম হলো না। পরদিন সকালে লন্ডনে ফিরে পোয়ারোর ঘরে বসে আছি। এমন সময় জ্যাপ এসে জানাল, মিঃ রাইল্যাণ্ড যাকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি সে আসলে রাইল্যাণ্ডের বেয়ারা জেমস। রাইল্যাণ্ডের খাস চাকর জর্জের সঙ্গে জেমস নাকি বাজি ধরেছিল যে সে রাইল্যান্ডের ছদ্মবেশ ধারণ করে সবাইকে বোকা বানাবে। নেহাত একটা খেলা ছাড়া কিছু নয়। তাদের গ্রেপ্তার করার পর হ্যাটন চেজ-এ গিয়ে দেখি মিঃ রাইল্যান্ড ঘুমচ্ছেন। তিনি আমাদের যাচ্ছেতাই রকমের গালমন্দ করলেন, জানি না তিনি আবার পুলিশের নামে মানহানির মামলা করবেন কিনা।
জ্যাপ ঝড়ের বেগে চলে গেল।
পোয়ারো মৃদু হেসে বলল, রাইল্যান্ড অতি চালাক লোক। গোটা ব্যাপারটাকে ছেলেমানুষী বলে চালিয়ে দিতে তার অসুবিধা হবে না।
-কিন্তু জেমসের পক্ষে এত নিপুণ ছদ্মবেশ ধরা কি করে সম্ভব হলো?
–সম্ভব হল, তার কারণ, জেমসই হয়তো চতুরঙ্গের চার নম্বর কর্তা অর্থাৎ ছদ্মবেশ ধারণে ওস্তাদ সেই জল্লাদ।
.
০৯.
পোয়ারো বল, মুষড়ে পড়ার কিছু নেই হেস্টিংস। চতুরঙ্গের এখন সুদিন যাচ্ছে, কিন্তু শেষ হাসিটা আমরাই হাসব, মনে রেখো।
সে যাক, ইতিমধ্যে খবরের কাগজে সুঁই-রহস্য” বলে একটা মৃত্যু রহস্য নিয়ে খুব হৈ চৈ পড়ে গেল। এই কেসটার জন্যে জ্যাপ আমাদের সাহায্য চাইছিল। রাইল্যান্ডের চাকরি ছাড়ার প্রায় মাস খানেক বাদে আমরা উস্টারের দিকে রওনা হলাম, এই শহরই হচ্ছে জুই রহস্যের ঘটনাস্থল।