-মাদাম, পোয়ারো বলল, আমার মৃত্যুর আগে যদি অনুমতি করেন তাহলে শেষবারের মতো একটা সিগারেট খাব।
–অর্থাৎ আপনার হাত-দুটোকে খুলে দিতে হবে, না, মঁসিয়ে। অত বোকা আমি নই।
মাদাম পোয়ারোর পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে প্রায় মুখে গুঁজে দিল, জিজ্ঞেস করল, দেশলাই আছে তো?
পোয়ারোর গলায় একটা ঠাট্টার সুর বাজল যেন, নড়বেন না। মাদাম। যদি আর এক পাও যদি নড়েন আমার সিগারেটের ব্লোপাইপ থেকে তক্ষুনি বিষাক্ত উঁচ ছুটে যাবে আপনার শরীরে। তাহলে আপনার মৃত্যু অনিবার্য। কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই মরতে চান না মাদাম। সুতরাং আমি বলি কি, আমার বন্ধু হেস্টিংসের বাঁধনটা আপনি খুলে দিন। রাগে অপমানে কাঁপতে কাঁপতে আমার বাঁধন মাদাম খুলে দিলেন। তক্ষুনি পোয়ারের আদেশে আমি মাদামকে বেশ শক্ত করে বাঁধলাম। তারপর পোয়ারোর বাঁধন খুলে দিলাম।
মাদামকে সেই কুঠুরির মধ্যে ফেলে রেখে আমরা বাইরে বেরিয়ে পা টিপে টিপে বাগানটা পার হয়ে রাস্তায় এলাম। আমি পোয়ারোকে বললাম, এরকুল, এখন কি আমাদের পুলিশে খবর দেওয়া কর্তব্য?
মৃদু হেসে পোয়ারো বলল, পাগল, ভুলে যেও না, মাদাম একজন বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী। আসলে তিনি যে একটা জঘন্য চক্রান্তে লিপ্ত, একথা পুলিশ বিশ্বাস তো করবেই না, উল্টে আমাদের পাগলা-গারদে পাঠিয়ে দিতে পারে।
.
০৮.
প্যারিসে আর সময় নষ্ট না করে আমরা লন্ডনে ফিরলাম। অনেক চিঠির মধ্যে মিঃ রাইল্যান্ডের লেখা একটা চিঠি পড়ে পোয়ারো বলল, জানো হেস্টিংস, রাইল্যান্ড লিখেছেন যে, তার কথামতো আমি আর্জেন্টিনায় না গিয়ে কথার খেলাপ করেছি। তোমার মেয়ারলিংয়ের কথা মনে আছে তো? মরার আগে সে বলেছিল। চতুরঙ্গের দু-নম্বর কর্তার প্রতীক হচ্ছে ডলার। আমার অনুমান এই আবে রাইল্যান্ডই হচ্ছেন সেই কর্তা; তা না হলে আমাকে চতুরঙ্গের রহস্য উদঘাটনের সময়ে আর্জেন্টিনায় সরিয়ে দিতে চাইবেন কেন? এবার আমার সন্দেহটা কতখানি সত্য সেটা জানবার জন্যে তার ওপর নজর রাখতে হবে। ভদ্রলোক এখন ইংল্যান্ডেই আছেন। সুতরাং কাজটা বিশেষ, কঠিন হবে না আশা করি।
দিনকয়েক পরে কাগজে একটা বিজ্ঞাপন বের হলো যে, আবে রাইল্যান্ড একজন সেক্রেটারি চান। পোয়ারো আমাকে হোম সেক্রেটারির সুপারিশ সমেত একটা দরখাস্ত পাঠাতে বলল। করলাম যথাসময়ে উত্তরও এলো, তাতে লেখা ছিল : স্যাভয় হোটেলে মিঃ রাইল্যান্ডের সঙ্গে আমাকে দেখা করতে হবে। চেহারাটা আর্টিস্ট ডাকিয়ে যথাসম্ভব পালটিয়ে আমি স্যাভয় হোটেলে গিয়ে হাজির হলাম।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ডাক পড়ল আমার। একটা মস্ত টেবিলের সামনে তিনি বসে আছেন। রোগা, ঢ্যাঙা, নাকটা বাঁকানো। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ মুখে কালো চুরুট। টেবিলে থেকে মুখ তুলে তিনি বললেন, হোম সেক্রেটারি আপনার চাকরির জন্যে আমাকে অনুরোধ জানিয়েছেন। আপনার কাজটা হল মাঝে মাঝে আমি হয়তো পার্টি দেব।
সে-সব পার্টিতে কাকে; কোথায় বসাতে হবে, তা আপনার জানা চাই। এ ব্যাপারে আপনার অভিজ্ঞতা আছে তো মিঃ নেভিল?
বলতে ভুলে গেছি চেহারার সঙ্গে আমি নামটাও পালটে নিয়েছি। আমার নাম এখন আর্থার নেভিল। হোম-সেক্রেটারীর সুপারিশেও ঐ ছদ্মনামটা উল্লেখ ছিল।
আমি উত্তর দিলাম, এ কাজ আমি আগেও করেছি। অসুবিধা হবে না। আমাকে কি লন্ডনে থাকতে হবে?
-না। বেশির ভাগ সময় আমি লোমশায়ারে থাকি। সেখানকার ডিউকের বাড়িটা আমি ভাড়া নিয়েছি। প্রচুর জায়গা, সুতরাং পার্টির আয়োজন করতে আপনার কোনো অসুবিধা হবার কথা নয়। চাকুরীটা সুখের চাকরী।
বাড়িটার নাম হ্যাটন চেস। সেখানে গিয়ে জানলাম রাইল্যান্ডের একজন মার্কিনী সেক্রেটারী এবং একটি মেয়ে স্টেনো আছে। মার্কিনী সেক্রেটারীর নাম মিঃ অ্যাপলবি। আমার সঙ্গে মেয়ে স্টেনো মিস্ মার্টিনের বেশ ভাব জমে গেল। বয়স তেইশ হবে। স্পষ্ট করে কোনো কথা না বললেও ওর কথায় আমি বুঝেছিলাম মিঃ রাইল্যান্ডকে ও বিশেষ পছন্দ করে না। হপ্তা তিনেক হ্যাটন চেস্ এ থাকার পর আমার মনে হল, এই রাইল্যান্ডের সঙ্গে চতুরঙ্গের কোনো সম্পর্ক নেই। এরমধ্যে রাইল্যান্ডকে আমি জানাইনি যে, পোয়ারোকে আমি চিনি।
একদিন আমি আর মিস মার্টিন ঘুরে বেড়াচ্ছি। মিস মার্টিন কথায় কথায় বলল, একটা কথা বলবো?
আমি বললাম, বলুন,
ভাবছি এ চাকরিটা আমি ছেড়ে দেব।
–সেকি! কেন?
–মিঃ রাইল্যান্ড আমাকে অতি ইতর ভাষায় গালমন্দ করেছে, তার নীলকাগজে লেখা একটা চিঠি আমি ভুলবশতঃ পড়ে ফেলেছিলাম বলে। নীল কাগজে লেখা এমন কিছু চিঠি তার কাছে আসে, যেগুলি আমার পড়বার হুকুম নেই।
–চিঠিগুলোর কোনো বিশেষতঃ আছে?
–আছে। নীলকাগজে লেখা চিঠিগুলোর এককোণে লেখা থাকে : ৪।
চিঠিতে কি লেখা ছিল আপনার খেয়াল আছে?
–ছোট্ট চিঠি। তার প্রতিটি কথাই আমার মনে আছে।
–কী লেখা ছিল তাতে?
-লেখা ছিল, সম্পত্তিটা দেখাই এখন জরুরী কাজ। সম্পত্তির সঙ্গে খনি চান তো সেই সতেরো হাজার পাউন্ড পড়বে। এগারো পার্সেন্ট কমিশন কেন? চার পার্সেন্টই যথেষ্ট। ব্যাস, এটুকুই লেখা ছিল। দেখুন তো, নিতান্ত ব্যবসায়িক একটা চিঠি পড়ে ফেলেছি বলে মিঃ রাইল্যান্ড যাচ্ছেতাই গালিগালাজ করলেন।
–আচ্ছা, মিস মার্টিন চিঠির তলায় কারও স্বাক্ষর ছিল?