–অনুমতি না নিয়ে ঢোকার জন্যে ক্ষমা করুন। আমি একটা দরকারে আপনার কাছে এসেছি মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি আমার বন্ধুদের কাজে বাধা দিচ্ছেন কেন?
–কে আপনার বন্ধু?
লোকটি টেবিলের ওপর চারটি সিগারেট পাশাপাশি সাজালো। মুখে কিছু বলল না।
পোয়ারো বলল, বুঝেছি। কিন্তু চতুরঙ্গ আমার কাছে কী চায়?
–তারা চায় ছোট খাট চুরি-ডাকাতির কেস নিয়ে সন্তুষ্ট থাকুন। রাঘব-বোয়ালদের ঘাঁটাতে যাবেন না।
–তাদের অনুরোধ যদি না শুনি?
–বড়ই কষ্ট পাবে আমাদের বন্ধুরা। কিন্তু তাতে কি কোনোও মৃত মানুষ জীবিত হয়?
সোজাসুজি বল, তাহলে আমাকে হত্যা করা হবে এই তো? আর যদি অনুরোধ শুনি, তার বিনিময়ে কি পাব?
–বিনিময়ে আপনি দশলক্ষ ফ্রা পাবেন। তার মধ্যে এক লক্ষ ফ্রা আমি এখুনি দিচ্ছি। মানিব্যাগ খুলে লোকটি নোট বার করল। আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না। বললাম, আপনার এতবড় সাহস আপনি পোয়ারোকে ঘুষ দিতে চান?
শান্ত গলায় পোয়ারো বলল, উত্তেজিত হয়োনা হেস্টিংস। তারপর আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে বলল, যদি আপনাকে আটকে রেখে পুলিশে খবর দিই।
–আমাকে এখানে আটকে রাখা আপনাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
–পোয়ারো ফোন তুলতেই আমি আগন্তুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আশ্চর্য, আমাকে একটা প্যাঁচে ধরাশায়ী করে সে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল।
একটা চিরকূট ফেলে গেছে তাতে লেখা আগামী শুক্রবার সকাল এগারোটায়, ৩৪ নং রু দ্য এস্কেল-এ আমাদের পরবর্তী বৈঠক হবে।
পোয়ারো বলল, স্বেচ্ছায় কারো ফাঁদে পা দেবার ইচ্ছে আমার নেই। সবই সাজানো ব্যাপার। ভেবেছে ঐ চিরকূট পড়ে আমি ওদের ফাঁদে পা দেব। না। আমরা এখনেই বসে থাকবো। আসবার হলে চতুরঙ্গের লোকেরাই এখানে আসবে।
ঠিক সাড়ে এগারোটার সময় একজন লোক এল। সে এসেছে মাদাম অলিভিয়ের কাছ থেকে। মাদাম একটি চিঠি পাঠিয়েছে। পত্রপাঠ আমরা যেন তার সঙ্গে দেখা করি।
আমরা মাদামের বাড়িতে গেলাম।
পোয়ারো মাদামকে বলল, কী ব্যাপার?
মাদাম বললেন, ব্যাপার গুরুতর। শুনলাম, কাল আমার সঙ্গে দেখা করবার পর আবার আপনারা আমার সেক্রেটারি ভেরোনুর সঙ্গে দেখা করেন। তারপর ইনেজ আপনাদের সঙ্গে বেরিয়ে যায়। আর সে ফিরে আসেনি।
–আর কিছু বলার আছে? পোয়ারো বলল।
–আমার ল্যাবরেটরিতে ঢুকে জরুরী কিছু কাগজপত্র চুরি করেছে। আমার বড় সিন্দুকটা তারা ভাঙতে পারেনি। নইলে আরো মূল্যবান জিনিষ চুরি করতে পারত।
পোয়ারো বলল, মাদাম, আপনার সেক্রেটারি ইনেজ একটি পাকা চোর। তার আসল নাম কাউন্টেস রসাকোফ। বিজ্ঞানী হ্যালিডে যে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন, তার জন্যে কাউন্টেসই দায়ী। সে কতদিন এখানে চাকরি করছে?
–মাস পাঁচেক।
–আমার মনে হয়, ইনেজ খুব সম্ভব চোরেদের গোপনে জানিয়ে দিয়েছিল। আপনার ল্যাবে কাগজপত্রগুলোর ব্যাপারে। কিন্তু, মাদাম আরো কী দামী জিনিষ তারা চুরি করতে পারেনি! গহনা?
-না মঁসিয়ে। রেডিয়াম। হ্যাঁ, রেডিয়াম। সামান্য কিছু রেডিয়াম আমার নিজেরই আছে। এরপর আরো কিছু রেডিয়াম গবেষণার কাজে দরকার পড়ায় আমি ধার করেছি। পৃথিবীতে আবিষ্কৃত রেডিয়ামের মধ্যে আমার কাছে সংগৃহীত রেডিয়ামের মূল্য হবে কয়েক কোটি ফ্রাঁ। এই মূল্যবান ধাতু আমার সিন্দুকে আছে। বাইরে থেকে সিন্দুক বলে মনে হলেও, ওটার আসলে অনেক মিলিয়ে মিলিয়ে তালা খুলতে হয়। ওটি দারুণ মজবুত।
-এই রেডিয়াম আর কতদিন আপনার কাছে থাকবে?
-আর মাত্র দুদিন। তারপর আমার এক্সপেরিমেন্টের কাজ শেষ হয়ে গেলে ফেরৎ দিয়ে দেব।
-ইনেজ কি এসব কথা জানে?
–জানে।
–উত্তম। সুতরাং আজকালের মধ্যেই আর একবার হামলা হবে। আপনার সঙ্গে আমার রেডিয়ামের ব্যাপারে কথা হয়েছে এটা যেন কেউ জানতে না পারে। আর আমি আপনার রেডিয়াম রক্ষা করব, কথা দিচ্ছি। আপনি শুধু ল্যাবের থেকে যে দরজাটা দিয়ে বাগানে যাওয়া যায় তার চাবিটা আমাকে দিন। আমি রাত্রে আপনার বাড়িতে ফিরে আসব আর পাহারা দেব।
-মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনার অভয়বাণী শুনে স্বস্তি পেলাম।
.
রাত এগারোটায় আবার প্যাসি অঞ্চলে আমরা ফিরে এলাম। কেউ আমাদের অনুসরণ করেনি এটা নিশ্চিন্ত হয়ে দেয়াল টপকে আমরা মাদাম অলিভিয়ের বাগানের মধ্যে গেলাম। সামনেই ল্যাবরেটরি। রাত কাটাতে হবে।
হঠাৎই জনা দশেক লোক হয়তো এরাই চোর এসে আমাদের মুখে কাপড় গুঁজে, হাত পা। বেঁধে ল্যাবরেটরিতে টেনে নিয়ে গেল। চোরেদের মধ্যে একজন গিয়ে বড় সিন্দুক খুলে ফেলল। দেখলাম সিন্দুকের মধ্যে কয়েক ধাপ সিঁড়ি নেমে গেছে। এই সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে দিলো আমাদের। আমরা একটা কুঠুরি ঘরে পৌঁছলাম। দেখলাম, আমাদের সামনে একজন মহিলা এসে দাঁড়ালেন। মুখে মুখোশ আঁটা। চতুরঙ্গের তিননম্বর কর্তা একজন ফরাসী মহিলা–ইনিই কি সেই মহিলা? নাকি ইনি ভেরোনু? কিন্তু ভেরোনু তো এত ঢ্যাঙা নয়।
মহিলা আমাদের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে আমাদের মুখের বাঁধন খুলে দিলেন। হাত পা বাঁধাই রইল।
হঠাৎ একটানে তাঁর মুখোশটা খুলে ফেললেন তিনি। সবিস্ময়ে দেখলাম, তিনি স্বয়ং মাদাম অলিভিয়ার!
চোখের দৃষ্টিতে আগুন জ্বলছে।
তিনি বললেন, মঁসিয়ে পোয়ারো। সবাই বলে যে, আপনি একজন মস্ত গোয়েন্দা। এখন আপনি একজন নারীর কাছে পরাজিত। আপনাকে লোক পাঠিয়ে সতর্ক করলাম, আপনি শুনলেন না। যাই হোক। এবার মৃত্যুর আগে ইষ্টনাম জপুন আর আপনার শেষ ইচ্ছে বলুন, নেহাত অসম্ভব না হলে আপনার মনস্কামনা আমি মিটিয়ে দেব।