–একথা মনে হবার কারণ এই যে, ওঁর হাতে ছিল চাবির গোছা। এখন বাড়ির বাসিন্দা যদি বাড়ির মধ্যে ঢুকে গিয়ে দেখে যে, ভিতর থেকে দুজন অপরিচিত মানুষ বেরিয়ে যাচ্ছে, তাহলে তাদের সম্পর্কে কৌতূহল হওয়া স্বাভাবিক, এক্ষেত্রে উনি আমাদের দিকে তাকালেন না পর্যন্ত। আচরণটা একটু অদ্ভুত। কিন্তু এ কি…সরে যাও…সরে যাও।
ধাক্কা দিয়ে আমাকে সরিয়ে দিতেই দেখি একটা মস্ত গাছ ভেঙে পড়ল আমাদের ঠিক পাশেই।
পোয়ারো বলল, একটুর জন্যে বেঁচে গেলাম। চতুরঙ্গ জানে না আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া সোজা নয়। আমি পোয়ারোকে বলি, এখন আমরা কি করব?
–চিন্তা করি। শুক্রবার রাত্রে দারোয়ান তাকে শেষ দেখা দেখেছিল। কিন্তু দারোয়ানতো তাকে আগে কখনও দেখেনি। চতুরঙ্গের চারনম্বর কর্তাটি একটি পাকা অভিনেতা। সে সেদিন রাত্রে হ্যালিডের ঘরে ঢুকে রাত কাটিয়ে পরদিন বেরিয়ে যায়। খুব সম্ভব বিকেলবেলাতেই হ্যালিডে চতুরঙ্গের হাতে বন্দী হয়েছিলেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে হ্যালিডে মাদামের সঙ্গে সাক্ষাতের পরে তার বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন। তারপর?
হঠাৎ পোয়ারো আমার হাত চেপে ধরে বলল, চলো হেস্টিংস এবার নিরুদ্দেশ নাটকের দৃশ্যে অভিনয় করা যাক।
মাদামের বাড়ির প্রবেশপথের ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে পোয়ারো বলল, এবারে আমরা পথে নামব। হ্যালিডে যেমন নেমেছিলেন।
খানিকটা এগিয়ে গিয়ে পোয়ারো বলল, পথ এখানে ডাইনে মোড় নিয়েছে। হয়তো এপথে এগোতেই হ্যালিডেকে খুব সম্ভব কোনো নারী এসে বলেছিল, মঁসিয়ে মাদাম অলিভিয়ের আপনাকে আর একবার ডেকেছেন। শুনে হ্যালিডে যেতে রাজী হলেন। মেয়েটি তখন তাকে এদিকে এই নির্জন পথে নিয়ে গেল। আর হ্যালিডেকে বলেছিল, এইপথে আসুন শর্টকাট হবে, এবার জনাকয় লোক হ্যালিডের ওপর চড়াও হয়। তাকে জোর করে টেনে নিয়ে যায় ওপাশের ঐ বাড়িটার দিকে।
-তাহলে এখন আমাদের কর্তব্য কি?
এখন আমরা ঐ মহিলার সঙ্গে দেখা করব যিনি আমাদের মুখটা পর্যন্ত দেখাতে চাননি। ঐ মহিলাই হয়ত মাদামের সেক্রেটারি।
মাদামের বাড়িতে বেল টিপে আমরা ঐ মহিলার বর্ণনা দিতে দারোয়ান তাকে ডেকে দিল। তিনি নিঃশব্দে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াতে আমরা অবাক হয়ে গেলাম? এ যে আমাদের পুরনো প্রতিদ্বন্দ্বী কাউন্টেস রসাকোফ। পোয়ারো বলল, কাউন্টেস রসাকোফ…
শ শ শ, এখানে আমাকে ও-নামে ডাকবেন না। আমার নাম এখন ইনেজ ভেরোনু। আপনার জ্বালায় লন্ডন থেকে পালিয়ে প্যারিসে এলাম, এখানেও নিস্তার নেই। আমার আসল পরিচয় ফাস করে দিয়ে চাকরীটা খতম করার জন্যে এখানে এসেছেন?
-না, মাদাম। আমি ওদিককার বাড়িটায় একবার ঢুকতে চাই। আমি জানি মঁসিয়ে হ্যালিডেকে ওখানে রাখা হয়েছে। আমি ওঁকে উদ্ধার করে আনতে চাই।
–তিনি ও বাড়িতে নেই।
–কোথায় আছেন?
–যদি না বলি।
-তাহলে হেস্টিংসকে আপনার পাহারায় দেখে পুলিশে জানাব, লন্ডনে আপনার নামে গোটা পাঁচেক মামলা ঝুলছে।
একথার পর কাউন্টেস ফোন তুলে বলল, কে, আঁদ্রে? আমি ইনেজ বলছি। এখানে। বেলজিয়াম গোয়েন্দা এরকুল পোয়ারো ঝামেলা বাঁধিয়েছে। তোমরা যদি হ্যালিডেকে ছেড়ে না দাও তাহলে আমি বিপদে পড়ব। তাকে হোটেলে পৌঁছে দাও। কাউন্টেস বলল, এবারে আপনি খুশী তো।
না। আপনাকে আমাদের সঙ্গে হোটেলে যেতে হবে। ওখানে হ্যালিডেকে দেখলে আপনাকে ছেড়ে দেব।
কাউন্টেসকে নিয়ে হোটেলে গিয়ে হ্যালিডেকে আমাদের ঘরে দেখতে পেলাম। পোয়ারো তার বাঁ হাতের একটা জড়ুল চিহ্ন পরীক্ষা করে নিল।
এবার কাউন্টেসের দিকে ফিরে পোয়ারো বলল, মাদাম, এবার আপনি যেতে পারেন। একটা প্রশ্ন, আপনার সঙ্গে চতুরঙ্গের যোগাযোগ ঘটল কবে থেকে।
মাদাম কোনো উত্তর না দিয়ে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলেন।
আমরা এবার হ্যালিডের কাছে সব জানতে চাইলাম। তিনি বলেন, আমার কিছুই বলার নেই। আমার উপর কী অত্যাচার যে গেছে, তা আপনারা কল্পনাও করতে পারবেন না। মঁসিয়ে পোয়ারো চতুরঙ্গের নাম আপনি শুনেছেন?
–শুনেছি।
–তারা যে কতখানি শক্তিশালী আর নিষ্ঠুর আপনি জানেন না। আমি যদি তাদের সম্বন্ধে একটা কথাও ফাস করি, তাহলে শুধু আমাকে নয়, আমার স্ত্রী কন্যাকেও হত্যা করা হবে। অতএব আমার বলার কিছুই নেই।
চেয়ার থেকে উঠে হ্যালিডে ধীর পদক্ষেপে বেরিয়ে গেলেন।
কাউন্টেস বেরিয়ে যাবার পর আমি একটা চিরকূট পেলাম। পোয়ারো বলল, ইচ্ছে করেই ফেলে যাওয়া হয়েছে, ওটা।
চিরকুটে লেখা, আবার দেখা হবে। I.V.”।
মৃদু হেসে পোয়ারো বলল, I.v. অর্থাৎ ইনেজ ভেরোনু। কিন্তু, রোমান হরফে ওটা চার-ও হতে পারে। চার হচ্ছে চতুরঙ্গের প্রতীক। শুনে শিউরে উঠলাম।
.
০৭.
পরদিনই হ্যালিডে ইংল্যান্ডে ফিরে গেলে। আমি আর পোয়ারো প্যারিসেই রইলাম।
আমি পোয়ারোকে বললাম, দোহাই পোয়ারো, এবারে উঠে পড়ে লাগো।
-কার বিরুদ্ধে আমরা উঠে পড়ে লাগব
–কেন চতুরঙ্গের বিরুদ্ধে।
-ভালো, কিন্তু চতুরঙ্গের ঘাঁটি কোথায়, ওদের বিরুদ্ধে অস্পষ্ট কোনো প্রমাণও আমাদের হাতে নেই। তার চেয়ে চুপচাপ আঘাতের প্রতীক্ষায় বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই। কেননা, তাদের প্রতিটি কাজই আমাদের জন্য হাসিল হচ্ছে না। সুতরাং আমাকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা তারা করবেই।
পোয়ারোর কথার মধ্যেই একটি অপরিচিত লোক আমাদের ঘরে এসে ঢুকল। গায়ে। ওভারকোট, টুপিটা চোখ অবধি নানামো।