জ্যাপ ঠিকানাটা একটা কাগজে লিখে দিয়ে বিদায় নিল।
পরদিনই আমরা মিসেস হ্যালিডের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তার পাশেই দাঁড়িয়ে বছর পাঁচেকের একটি ফুটফুটে মেয়ে। তার একমাত্র সন্তান।
মিসেস হ্যালিডে বললেন, দেখুন মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনার খ্যাতির কথা আমি শুনেছি। ফরাসী পুলিশের ধারণা, প্যারিসে গিয়ে আমার স্বামী কোনো ফরাসী সুন্দরীর প্রেমে পড়েছেন এবং গা ঢাকা দিয়েছেন কিন্তু আমার স্বামী ছিলেন সত্যিকারের বিজ্ঞানসাধক।
পোয়ারো বললেন, মাদাম, আমি আপনার স্বামীকে খুঁজে বার করব, কথা দিচ্ছি। এখন বলুন আপনার স্বামী কবে প্যারিসে গিয়েছিলেন? কি কাজে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে আপনাকে কোনো চিঠি দিয়েছিলেন কিনা, দয়া করে সব খুলে বলুন।
-আমার স্বামী ২০শে জুলাই প্যারিস যান। বৃহস্পতিবার। কথা ছিল, প্যারিসে পৌঁছে তিনি মাদাম অলিভিয়ের এবং আরও কয়েকজন বিজ্ঞানীর সঙ্গে দেখা করবেন।
-তারপর? প্যারিসে গিয়ে আপনার স্বামী কোথায় উঠেছিলেন?
-সন্ধ্যা নাগাদ প্যারিসে পৌঁছে তিনি ক্যাস্তিলিয়ন হোটেলে ওঠেন। পরদিন সকালে তিনি অধ্যাপক বুর্গোনুর সঙ্গে দেখা করতে যান। তাঁর বাড়ি থেকে বেরিয়ে তিনি কাফে রয়্যাল-এ যান এবং সেখানে লাঞ্চ সারেন। টুকিটাকি কাজ সেরে যান প্যাসি অঞ্চলে। সেখানে মাদাম অলিভিয়ের সঙ্গে দেখা করে তিনি বিকেল ছটা নাগাদ আবার পথে বেরিয়ে পড়েন। সন্ধ্যায় তিনি কোথায় গিয়েছিলেন তা কেউ জানে না। রাত এগারোটা নাগাদ তিনি হোটেলে ফিরে জিজ্ঞেস করেন তার নামে কোনো চিঠি এসেছে কিনা। এরপর তিনি নিজের ঘরে চলে যান। পরদিন সকালে তিনি হোটেলে থেকে বেরিয়ে যান। তারপর আর কেউ তাকে দেখেনি।
–সকালে কটার সময়ে তিনি হোটেল থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন?
–খুবই সকালে।
–এমনও তো হতে পারে যে, সকালে নয়, রাত্তিরে হোটেলে ফিরে এসে আবার রাত্তিরেই তিনি বেরিয়ে গিয়েছিলেন?
-না, আমার তা মনে হয় না। হোটেলে সারারাত দারোয়ান থাকে, সে নিশ্চয়ই তাহলে লক্ষ্য করত।
-ঠিক কথা। তার মালপত্র কি হোটেলেই পড়েছিল?
-না, সব মালপত্র নয়। হোটেল থেকে বেরিয়ে যাবার সময় তাঁর সঙ্গে একটা সুটকেশ ছিল। পোয়ারো বলল, মাদাম, আপনার স্বামী নিরদ্দেশের সন্ধ্যাটা কোথায় কাটিয়েছিলেন, সেটা জানলে অনেকখানি জানা যাবে। আচ্ছা সেদিন হোটেলে কি কোনো চিঠি এসেছিল?
-হ্যাঁ, আমার মনে হয় সে চিঠি আমারই লেখা। তার প্যারিস যাত্রার দিনই আমি তাকে একটা চিঠি পাঠাই।
শুনে পোয়ারো কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। বললেন, আমার মনে হয় এখানে বসে থেকে কোনো লাভ নেই। কালই আমি প্যারিসে যাব।
বিদায় নেবার আগে পোয়ারো মিসেস হ্যালিডেকে জিজ্ঞেস করলেন, মাদাম, আপনার স্বামী কখনও আপনার কাছে চতুরঙ্গ নামে কোনো সমিতির কথা বলেছেন?
-চতুরঙ্গ? এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে মাদাম বললেন, না, এমন নাম কখনও শুনেছি বলে আমার মনে হয় না।
.
০৬.
প্যারিসে পৌঁছে আমরা অধ্যাপক বুর্গোনুর সঙ্গে দেখা করলাম। তার থেকে নতুন কোনো তথ্য পাওয়া গেল না। পোয়ারোর সন্দেহ যে, হ্যালিডেকে গুম করে দেওয়া হয়েছে, গুম করেছে চতুরঙ্গ।
এরপর আমরা গেলাম মাদাম অলিভিয়ের বাড়িতে, অবশ্যই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে। দীর্ঘাঙ্গী মুখখানি লম্বা শীর্ণ, গালের উপরে একটি পোড়া দাগ। বছর তিনেক আগে তার ল্যাবরেটরিতে একটা মারাত্মক বিস্ফোরণে মাদামের স্বামী মারা যান। গালের ঐ দাগটা বোধহয় তারই স্মৃতিচিহ্ন।
মাদাম জানালেন যে, তিনি দুঃখিত, হ্যালিডের নিখোঁজের ব্যাপারে তিনি আমাদের কোনো সাহায্য করতে পারবেন না।
পোয়ারো জিজ্ঞেস করলো, মঁসিয়ে হ্যালিডে তার বিজ্ঞান সম্মেলনের বক্তৃতায় যে ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্রের কথা বলেছিলেন, আপনি কি মনে করেন যে, তা তৈরি করা সম্ভব?
–অবশ্যই সম্ভব। এ বিষয়ে আমিও কিছু গবেষণা করেছি। রেডিয়াম-সি-নামক পদার্থ থেকে যে রশ্মি বিচ্ছুরিত হয়, তার আকর্ষণ শক্তি সম্পর্কে এমন কিছু রহস্য আমার কাছে ধরা পড়েছে, যার ফলে, মঁসিয়ে হ্যালিডের কথাকে মোটেই আজগুবি বলে উড়িয়ে দেওয়া চলে না। তার গবেষণা সম্পর্কে আমার আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক। সেই বিষয়েই আমাদের আলোচনা হয়েছিল ঐদিন।
-আপনারা ল্যাবরেটরি একবার দেখতে পারি?
–বিলক্ষণ। আমাদের ল্যাবরেটরিতে নিয়ে যাওয়া হলো। যে দরজা দিয়ে আমরা ঢুকেছিলাম সেটা ছাড়া ল্যাবরেটরিতে আরও দুটি দরজা রয়েছে। একটি দিয়ে বাগানে যাওয়া যায়, অন্যটি দিয়ে ছোট্ট চেম্বারে।
মাদাম, পোয়ারো প্রশ্ন করল, মঁসিয়ে হ্যালিডের সঙ্গে যখন আপনার কথা হয় কেউ শুনেছিল।
-না, আমার সহকারী দুজন এঘরে ছিল না। তারা পাশের ঐ ছোট্ট চেম্বারে ছিল। সেখান থেকে কোনো কথা শোনা সম্ভব নয়।
-আচ্ছা মাদাম, মঁসিয়ে হ্যালিডে আপনার এখান থেকে বিদায় নেবার পর কোথায় থাকবেন সে বিষয়ে কিছু বলেছিলেন?
-না।
আমরা বিদায় চাইলাম। ল্যাবরেটরি থেকে আমরা হলঘরে বেরিয়ে দেখি, হলঘরের সদর দরজা দিয়ে একজন মহিলা এসে বাড়ির মধ্যে ঢুকেছেন। মুখটা দেখা গেল না। তাঁর স্বচ্ছন্দ হাঁটাই বলে দিচ্ছে তিনি ঐ বাড়ির বাসিন্দা।
কম্পাউণ্ডে বেরিয়ে পোয়ারো বলল, অদ্ভুত মহিলা।
আমি বললাম, ওঁর মুখটা পর্যন্ত তুমি না দেখে অদ্ভুত মহিলা কিভাবে বলছো?