পোয়ারো বলল, দিন কয়েক আগে আমার ফ্ল্যাটেও একজন অচেনা আগন্তুকের মৃত্যু হয়। সে চারজন মানুষের code নাম দিয়েছিল। প্রথমজন লি চ্যাং; দ্বিতীয়জন এক মার্কিন কোটিপতি, তৃতীয়জন একজন ফরাসী মহিলা। চতুর্থজন–সে বলছিল একজন জল্লাদ। আপনি চতুর্থজনের নাম শুনেছেন?
শুনেছি। আমার এক আলাপী বন্ধু আছে, লোকটি পাঁচ মাতাল, ভবঘুরে গোছের। হাতে কিছু পয়সা জমলেই সে জাহাজে উঠে দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়াত। সম্প্রতি সে আমাকে একটা চিঠি লিখেছে, তাতে সে আমার কাছে অবিলম্বে দুশো পাউন্ড চেয়ে পাঠিয়েছে। টাকাটা না পাঠলে সে নির্ঘাত চতুরঙ্গের হাতে মারা পড়বে। কেননা টাকা তার আছে কিন্তু সে টাকা তুলতে গেলেই সে মারা পড়বে। তার ঠিকানা হল, গ্লানিট বাঙ্গলো, হপাটন, ডার্টমুর। সত্যি বলতে কি আমি টাকা পাঠাইনি, আমি জানি এটা তার কিছু টাকা হাতাবার কারসাজি। কিন্তু এখন ব্যাপারটা আপনাদের কি মনে হচ্ছে?
-খুবই গুরুতর মঁসিয়ে। এক্ষুনি আমরা হপাটনের দিকে রওনা দেব।
–আমি যদি যাই আপত্তি আছে?
–কিছুমাত্র নয়? পোয়ারো বলল।
হপাটন স্টেশন থেকে বাইরে বেরিয়ে প্রথমে একজন বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করলাম, গ্রানিট বাঙ্গলোটা কোনোদিকে?
-কেন? পুলিশ ইন্সপেক্টরের সঙ্গে দেখা করতে চান? এই বাড়িতে একটা খুন হয়ে গেল যে।
–কে খুন হয়েছে?
–কেন, বাড়ির মালিক। বৃদ্ধের জবাব, নাম জোনাথন হোয়েলি।
আমরা কিছুমাত্র সময় নষ্ট না করে তক্ষুনি গ্রানিট বাঙ্গলোয় পৌঁছালাম। আমরা জ্যাপের বন্ধু শুনে তিনি বললেন, আসুন আজ সকালেই খুনটা হয়েছে। ভদ্রলোকের বয়স হয়েছিল প্রায় সত্তর।
আমরা ঘরে পৌঁছে দেখলাম, মেঝের উপর গলা কাটা একটা লাশ পড়ে। চারদিকে রক্ত ভাসছে। ইন্সপেক্টর মেডোজ বলতে লাগলেন, এ বাড়িতে যে মেয়েটা রান্না করে তার নাম বেটসী। সে স্থানীয় বাসিন্দা। বাড়ির অপর মানুষ হল চাকর রবার্ট গ্রান্ট। সে সকালে দুধ আনতে গিয়ে পড়শীর সঙ্গে মিনিট কুড়ির মতো গল্প জুড়েছিল। এই ধরুন দশটা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে মিনিট কুড়ি। খুনটা হয় তারই মধ্যে। গ্রান্ট প্রথমে ফিরে আসে। তারপর আসে বেটসী। গ্র্যান্ট নিজের ঘরে চলে যায়। বেটসীই প্রথম দেখতে পায় কর্তা খুন হয়েছে। সে চীৎকার করে ওঠে। অর্থাৎ খুনের সময় দুজনেই বাইরে ছিল। অন্ততঃ তাদের কথানুযায়ী। আমরা আমাদের কাজ শুরু করলাম। রক্তের ওপর জুতোর ছাপ ধরে আমি গ্রান্টের ঘরে পৌঁছলাম। দেখলাম, তার জুতোর সঙ্গে ছাপ মিলে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়। বৃদ্ধ জোনাথনের কতকগুলো চীনা পুতুল ছিল। যেগুলো সে আগলে রাখতো, সেই পুতুলগুলো গ্রান্টের ঘর থেকে পাওয়া গেল, তার ঘরে পাওয়া কাগজপত্র থেকে জানা গেল তার আসল নাম আব্রাহাম বিগস। চুরির দায়ে ওকে এর আগে একবছর জেল খাটতে হয়েছিল। সুতরাং তাকে আমরা গ্রেফতার করলাম।
হুম, পোয়ারো বলল, এর আগে কোনো খুনীকে এত প্রমাণ রেখে বোকার মতো কাজ করতে দেখিনি। যাই হোক, চলুন, তার ঘরটা একবার দেখে অসি। আমি ঈষৎ চাপা গলায় পোয়ারোকে প্রশ্ন করলাম, ব্যাপার কি এরকুল, এর মধ্যে আবার কোনো রহস্যের গন্ধ পেলে নাকি?
–ব্যাপারটা একবার চিন্তা করে দেখ। হোয়েলি তার চিঠিতে লিখেছিল চতুরঙ্গ তার পিছু নিয়েছে। কিন্তু গ্রান্ট যদি সত্যিই চতুরঙ্গের লোক হতো তবে কি সে পুলিশের হাত ধরা পড়ার জন্যে বসে থাকত। তাও এমনভাবে প্রমাণ সাজিয়ে? না, হেস্টিংস আমি হয়তো জুতোর ছাপ মাপবো না; কিন্তু বুদ্ধি খাটাবো।
.
০৪.
লাশ সরিয়ে নেবার পর ইন্সপেক্টার আমাদের ঐ ঘরে বসতে বললেন। গ্রান্টের জুতোজোড়া এনে বললেন, এই জুতোর সঙ্গে মেঝের ছাপ মিলিয়ে নিতে পারেন। আমি একটা কাজ সেরে আসছি, বলে তিনি বেরিয়ে গেলেন।
ইন্সপেক্টর বেরিয়ে যাবার পর আমরা দেখলাম লাশটার জায়গা থেকে দু-সারি ঢুকবার আর দু-সারি বেরিয়ে যাবার দাগ রয়েছে। ছাপ জুতোজোড়ার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে।
পোয়ারো বলল, হুম, খুনী যদি খুন করে বেরিয়ে যায়, তো দুসারি দাগ থাকবে। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে দু-সারি ঢোকার, দু-সারির বেরিয়ে যাবার দাগ। তবে কি খুনী বেরিয়ে যাবার পর আবার কিছু নিতে দ্বিতীয়বার এঘরে ঢুকেছিল? ঐ পুতুলগুলো? পুতুলগুলো তো গ্রান্টের ঘরে পাওয়া গেছে।
ঘুরতে ঘুরতে আমরা ভাড়ার ঘরে ঢুকলাম। সেখানে পোয়ারো বরফের কুচি মাখানো একখানা খাসীর ঠ্যাং আবিষ্কার করে চীৎকার করে উঠল। খুব সম্ভবত কসাই-এর ডেলিভারি দিয়ে গেছে। সেটা আবার আলমারীতে সে রেখে দিল। আমরা আবার বসবার ঘরে গিয়ে বসলাম। ইতিমধ্যে ইন্সপেক্টর মেজাজে এসে গেলেন।
পোয়ারো আমাকে জিজ্ঞেস করল, হেস্টিংস আজ কি বার?
–সোমবার।
-খুনীরা এটুকু বোঝে না যে, সপ্তাহের প্রথম দিনে, উষ্ণতা সত্তর ডিগ্রী ফারেনহাইট তখন অন্ততঃ কসাইয়ের ছদ্মবেশে খুন করতে নেই।
তার কথার মাথামুণ্ড কিছুই আমাদের মাথায় ঢুকল না। এরপর পোয়ারো ইন্সপেক্টর মেডোজের দিকে তাকিয়ে বললো, একটা অনুরোধ, আমি একবার গ্রান্টের সঙ্গে দেখা করতে চাই। তারজন্যে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের অনুমতি আমি আনিয়ে দেব। সাক্ষাৎটা খুবই জরুরী। আমি জানি গ্রান্ট খুনী নয়। যে খুন করেছে সে অল্পবয়সী। ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে, হাতে ছোরা নিয়ে ঢুকেছিল। তারপর হোয়েলের গলায় ছোরা বসিয়ে, বেরিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে সে চলে যায়।