–ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলছি, আপনার ছেলেকে আমি বাঁচিয়ে তুলব।
কাউন্টেস পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলেন।
আকিল তাঁর ব্যাগ থেকে একটা ফটো বের করে নিয়ে রসাকোফকে বললেন, মাদাম, ফটোটা একবার দেখুন। আমার ব্যাগটা বের করুন।
কাউন্টেস মন্ত্রমুগ্ধের মতো আকিলের কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা ব্যাগ বের করে আনলেন। তার ভেতর থেকে সত্যি সত্যিই একটা ফটো বার করে দেখলেন।
ফটোটা দেখার পর চেঁচিয়ে বলে উঠলেন রসাকোফ, কোথায়…কোথায় পেলেন এই ফটো?
–পরে বলব, আগে বাইরে নিয়ে চলুন।
কাউন্টেস দ্রুত হাতে আমাদের বাঁধন খুলে দিয়ে এগিয়ে নিয়ে চললেন। সুড়ঙ্গপথ এখন পুলিশের ভয়ে অন্ধকার। কতক্ষণ হেঁটেছি তা মনে নেই। ঠিক এমনই সময় আমাদের চোখে পড়ল পুলিশের টর্চের আলো। তারা সুড়ঙ্গের প্রবেশ পথটা খুঁজে পেয়েছে। তারা আমাদের শত্রু ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
— আকিল বললেন, আমরা বন্ধু। বেরিয়ে পড়ুন। এখন ডিনামাইট দিয়ে ওরা ঘাঁটিটাকে উড়িয়ে দেবে! চলুন…শিগগির…।
বলতে না বলতেই প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণে পায়ে নিচের মাটিটা দুলে উঠল। আমি মূৰ্ছিত হয়ে পড়লাম।
জ্ঞান হবার পর দেখি হোটেলের ঘরে শুয়ে আছি। পাশে এরকুল।
এরকুল বলল, এক মিনিটের জন্যে আমরা বেঁচে গেছি।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কিন্তু আকিল পোয়ারো? তিনি কোথায়?
হো-হো করে হেসে উঠল এরকুল। বলল, কল্পনায় তার জন্ম হয়েছিল, কল্পনাতেই আবার মিলিয়ে গেছে।
–তার মানে?
-মানে আর কিছুই নয়। অমন ভাই আমার কখনও ছিল না। আসলে কাল আমি ডাইনিং হল থেকে বেরিয়ে আমার ঘরে গিয়ে গোঁফ কামিয়ে ফেলে একজোড়া নকল গোফ লাগাই। ঔষুধ লাগিয়ে চোখের রঙও পাল্টে ফেলি এবং আর কিছু ছোটখাটো রদবদল ঘটিয়ে মুখের নীচে মাফলার জড়িয়ে আমি লবিতে গিয়ে বসি। কাউন্টেসের চোখে পড়েছিল পরিবর্তনগুলো। তার ওপর ইচ্ছে করে ধরাগলায় কথা বলছিলুম। ঘাঁটিতে রসাকোফ যখন বলেন এ এরকুল নয়, তখন তুমিও বলে উঠলে যে, আমি আকিল পোয়ারো। আসলে তুমিও জানতে না আকিল বলে সত্যিই কেউ নেই। তাতে আমার সুবিধাই হলো। তুমি এমন জোর দিয়ে কথাটা বললে যে তাদের মনে কোনো সন্দেহই জাগল না।
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে আমি বললাম, কিন্তু কাউন্টেস তো তোমাকে বহুদিন ধরে জানেন, তিনিও তো তোমার চালাকিটা ধরতে পারেননি।
মৃদু হেসে পোয়ারো বলল, প্রথমে পারেনি কিন্তু একটু বাদেই পেরেছিল। আবে রাইল্যাণ্ড, মাদাম অলিভিয়ের, চারনম্বর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে সে আমার আপাদ-মস্তক দেখে কী বলেছিলেন তোমার মনে আছে?
–আছে।
–তিনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন, মঁসিয়ে আকিল পোয়ারো, আপনার বুদ্ধির সত্যিই কোনো তুলনা হয় না।
–তা না হয় হলো, কিন্তু মৃত ছেলেকে বাঁচিয়ে তোলা–এসব উদ্ভট কথার অর্থ কি?
-ঐ তো মজা, পোয়ারো বলল, কাউন্টেসের ছেলে মোটেই মারা যায়নি। ছেলেটা আমার এক বন্ধুর কাছেই থাকে। আর দু-একদিনের মধ্যেই তিনি তাকে ফিরে পাবেন।
–অর্থাৎ?
বছর কয়েক আগে কাউন্টেস রাশিয়ায় ছিলেন, সেইসময় ছেলেটি হারিয়ে যায়। রটে গিয়েছিল যে, কাউন্টেসের শত্রুরা তার ছেলেটিকে হত্যা করেছে। কাউন্টেসও সেটা বিশ্বাস করেছিল।
–এতদিন বাদে তুমি কি করে তার সন্ধান পেলে?
–সহজে পাইনি, পোয়ারো বলল, তার জন্যে অনেক কষ্টে আমার শত্রুদের অতীত ইতিহাস খুঁজে বার করতে হয়েছে। এরজন্যে আমি তোক লাগিয়েছিলুম। কাউন্টেসের ছেলেটিকে আসলে তারই এক শত্রু আঁটকে রেখেছে। প্রচুর টাকা খরচ করে, এক রাশিয়ানকে মোটা অঙ্কের চেক দিয়ে তাকে আমি উদ্ধার করার ব্যবস্থা করেছিলুম। তারপর ছেলেটাকে উদ্ধার করে এনে বেলজিয়ামে আমার এক বন্ধুর বাড়িতে রাখবার ব্যবস্থা করি। তার একটা ফটো আমি তুলে রেখেছিলাম। জানতাম কখনও না কখনও কাউন্টেসের কাছে আমাকে সাহায্য নিতে হবে, তাই ফটোটা সবসময় সঙ্গে রাখতুম।
–তোমার তুলনা হয় না এরকুল, আমি বিভোরের মত বলে উঠলাম। একটু লজ্জিত হলো পোয়ারো।
বলল, না না, আমি কি আর এমন করেছি। এখন আমার কাউন্টেসের ওপর কোনো বিদ্বেষ নেই, আমার যুদ্ধ চতুরঙ্গের সঙ্গে। কাউন্টেস সেদিন ঐ বিস্ফোরণে পড়লে আমি সত্যিই দুঃখ পেতাম।
-কিন্তু পোয়ারো চতুরঙ্গের কি হলো বলো তো?
–বিস্ফোরণে সবাই মারা গেছে।
–আর লি-চ্যাং-ইয়েন? সে তো ঐ গুপ্তঘাঁটির মধ্যে ছিল না। তার কি হলো?
পোয়ারো রহস্যের হাসি হাসল।
সে বলল, রক্ষা সেও পায়নি। সে ছিল চীনদেশে। এই একটু আগে রেডিওতে শুনলাম, সেইখানে সে আত্মহত্যা করেছে। চতুরঙ্গের চক্রান্তের ব্যর্থতার খবরে ভেঙে পড়ে আত্মহত্যা করেছে।
একটুক্ষণ চুপ করে রইল পোয়ারো। বলল, কি যে করবো এখন তাই ভাবছি।
-সেকি? তোমার আবার কাজের অভাব হয় নাকি? –না না, দীর্ঘশ্বাস ফলে পোয়ারো বলল, এরকুল পোয়ারোর কখনও কাজের অভাব হয় না। কিন্তু চতুরঙ্গের কেসটাই ছিল আমার জীবনের সবচাইতে বড় রহস্যভেদ। এর পরে অন্য আর সব রহস্যই বড় ফিকে লাগবে।