হঠাৎ অন্ধকার চিরে ইলেকট্রিকের আলোয় আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। মনে মনে ভাবতে লাগলাম, এটাই তাহলে চতুরঙ্গের সদর ঘাঁটি।
বাহকরা আমাদের নামাল। চারনম্বর লোকটা আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বিদ্রুপাত্মক কণ্ঠে বলল, আসুন মঁসিয়ে পোয়ারো, আমাদের গুপ্তঘাঁটিতে আপনাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাই।
এবার বাহকরা আমাদের নিয়ে মস্ত একটা ঘরে নিয়ে গেল। পিছনে চারটে চেয়ার। সামনে বড় টেবিল। প্রথম চেয়ারটা শূন্য, দ্বিতীয়, তৃতীয় চেয়ারে বসে আছেন যথাক্রমে রাইল্যাণ্ড, মাদাম অলিভিয়ের আর চতুর্থ চেয়ারে গিয়ে বসল চার-নম্বর।
চতুরঙ্গকে এত কাছ থেকে কখনও দেখিনি। ভয়ে আমার বুক কাঁপছিল।
গম্ভীর গলায় রাইল্যাণ্ড বললেন, মঁসিয়ে পোয়ারো, আজ আপনাকে এখানে দেখতে পাবো বলে সত্যিই আশা করিনি। আপনি যে মারা গেছিলেন, এখন দেখছি তা সত্যি নয়। এবারে আর আপনার রক্ষে নেই।
পোয়ারো বলল, ধন্যবাদ।
বিস্মিত হয়ে পোয়ারোর দিকে তাকালাম। এত গলা ভাঙা আওয়াজ কেন? ঠান্ডা লেগেছে? শুধু কণ্ঠস্বরই নয়, বাচনভঙ্গিও তার পাল্টে গেছে।
আমার ভাবনায় ছেদ টেনে ওদিককার পর্দা সরিয়ে এসে দাঁড়ালেন, কাউন্টেস রসাকোফ। পোয়ারোর দিকে চোখ পড়তেই সে ফোঁস করে উঠল, একী, আমি কি ভূত দেখছি। মঁসিয়ে পোয়ারো আপনি মারা যাননি?
-না, মাদাম, পোয়ারো এত সহজে মরে না।
পোয়ারোর কণ্ঠস্বর কাউন্টেসের সন্দেহকে আরো গাঢ় করল। তার চোখ দুটো জ্বলে উঠল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে আমারও অবচেতন মনে জেগে ওঠা সন্দেহটা হঠাৎ জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল।
আমার মনে হল, এ পোয়ারো হতে পারে না। এরা তাহলে এরকুলের যমজ ভাই আকিলকে ধরে এনেছে। কিন্তু আকিল কিভাবে এল? তাহলে কি ডাইনিং হল থেকে পোয়ারো যখন একবার ঘরে গিয়েছিল, তারপর তার ভাই আকিলকে পাঠিয়ে দিয়েছিলো?
হয়তো তাই হবে। হঠাৎই কাউন্টেস রসাকোফ চেঁচিয়ে উঠলেন, এ কাকে ধরে এনেছেন আপনারা? ইনি তো এরকুল পোয়ারো নন। বলেই তিনি পোয়ারোর মুখ থেকে মাফলারটা সরিয়ে গোঁফটায় টান মারলেন। গোঁফটা খসে পড়ল।
–দেখুন, এ লোকটা এরকুল নয়, রসাকোফ বললেন, তখনই আমার মুখ ফস্কে বেরিয়ে এল, আমি জানি ইনি আকিল পোয়ারো। এরকুলের যমজ ভাই।
অসম্ভব, রাইল্যান্ড চেঁচিয়ে উঠলেন।
শান্ত গলায় আকিল পোয়ারো বললেন, না মঁসিয়ে, এরকুল যা চেয়েছিলো ঠিক তাই হয়েছে। তার বুদ্ধির সঙ্গে আপনারা পেরে ওঠেননি। সে আপনাদের প্রতিটা চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিয়েছে। এই স্বাস্থ্যনিবাসে গত একমাসে যত লোক এসেছে তারা সবাই পুলিশ কিংবা গোয়েন্দা। এখানে যে হোটেল আছে, তার প্রতিটি কর্মচারীই ইতালিয়ান, ফরাসী আর নয়তো ব্রিটিশ সরকারের গুপ্তচর বিভাগের লোক। এরকুলের নির্দেশ তারা এই পাহাড়টাকে ঘিরে রেখেছে।
মাদাম এবার মুখ খুললেন, বললেন, আমরা পাহাড়ের কোনো গোলকধাঁধায় লুকিয়ে আছি, তা তারা জানবে কি করে? আমাদের যা বিস্তর রসদ আছে, তাতে আমরা বছরের পর বছর এখানে কাটিয়ে দিতে পারব।
–সেটাও পারবেন না মাদাম। এরকুলের ঘর থেকে বেরোবার সময় আমি জুতোর তলায় বেশ খানিকটা তাৰ্পিন তেল মাখিয়ে এনেছিলাম। হোটেল থেকে শুরু করে এই গুপ্ত ঘাঁটি পর্যন্ত সারা পথে উগ্র তেলের গন্ধে পুলিশ কুকুরের পৌঁছতে দেরি হবে না।
মাদামের চোখ ঝলসে উঠল। চাপা গলায় বললেন, ডিনামাইট দিয়ে এই পাহাড়টাকে উড়িয়ে দেব আমরা। নিজেরা মরব, তার সঙ্গে তোমাদেরও মারব।
এরপর দূর থেকে একটা কোলাহল ভেসে এল। একটা লোক দৌড়ে ঘরে ঢুকে রাইল্যাণ্ডকে কি যেন বলল। রাইল্যাণ্ড, অলিভিয়ের বেরিয়ে গেলেন। চারনম্বর রসাঁকোফের হাতে একটা পিস্তল দিয়ে বলল, পুলিশের লোক জমায়েত হচ্ছে। আমাদের ঘাঁটিটা উড়িয়ে দিতে হবে। আপনি পাহারায় থাকুন। আমি ল্যাবরেটরীতে যাচ্ছি। চারনম্বর চলে গেল।
কী মনে করে কাউন্টেস আকিলের মুখখানাকে বেশ ভালো করে দেখে হেসে উঠে বললেন, মঁসিয়ে আকিল পোয়ারো, আপনার বুদ্ধির সত্যিই তুলনা হয় না।
আকিল বুদ্ধির প্রসঙ্গটাকে এড়িয়ে গিয়ে বললেন, মাদাম সময় বিশেষ নেই। আসল কথাটা সেরে নেওয়া যাক, বলুন আপনার দাম কত?
দাম? আমার আবার দাম কি?
-মাদাম এখন ছলনার সময় নয়। কী দাম পেলে আপনি এই গুপ্তঘাঁটি থেকে আমাদের বাইরে নিয়ে যাবেন?
টাকা দিয়ে আমাকে কিনতে চান? না মঁসিয়ে আমার টাকার দরকার নেই।
আপনার যেকোন ইচ্ছা পূরণ করার জন্যে আমি প্রস্তুত। বলুন মাদাম বলুন, তাড়াতাড়ি।
কী চাই আমি? হাসি থামিয়ে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে কাউন্টেস বললেন, যাই চাই তা কি আপনি দিতে পারবেন?
-পারব মাদাম, বলুন।
-আপনি কি আমার শত্রুদের শাস্তি দিতে পারবেন? আপনি কি আমার বিগত যৌবনকে ফিরিয়ে দিতে পারবেন? আপনি কি আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিতে পারবেন? হো হো করে আবার হেসে উঠলেন রসাকোফ।
আকিল কিছুমাত্র বিচলিত না হয়ে বললেন, আপনার তিনটি ইচ্ছার একটি আমি পূর্ণ করব বলুন কোনো ইচ্ছা আপনি পূর্ণ করতে চান?
–আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিতে পারবেন?
–দেব। আপনি যদি আমাদের এখান থেকে বের করে নিয়ে যান, তাহলে আপনার ছেলেকে আমি ফিরিয়ে এনে দেব।
-মঁসিয়ে আমার ছেলে বেঁচে নেই, সে মৃত, মরা ছেলেকে বাঁচাতে পারবেন?