কথায় কথায় পোয়ারো একদিন বলল, বুঝলে হেস্টিংস, চারজনে যেই এক জায়গায় এসে যাবে, অমনি আমি তাদের আঘাত হানব। ধৈর্য হারিয়ে বিপদের দিকে ছুটে গেলে লাভ নেই, মিঃ ইনগ্লেসই তার জীবন দিয়ে সে কথা বুঝিয়ে দিয়েছেন।
ইনগ্লেস প্রসঙ্গে ঐ চীনা ভৃত্যের কথা আমার মনে পড়ল। আমি এরকুলকে সমস্ত জানিয়ে বললাম, মরবার আগে দুটো শব্দ সে উচ্চারণ করেছিল, লাগো…কারোজা। পোয়ারো আমার কথাগুলো খুব মন দিয়ে শুনল।
দিন কয়েক পরের কথা। আমাদের বাড়ীতে এলেন ক্যাপ্টেন হার্ভে। পোয়ারো আমার সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিলো।
ক্যাপ্টেন বলল, মঁসিয়ে পোয়ারো, চীনে একটা গুরুতর হাঙ্গামা বাঁধায় চীনের সঙ্গে বাইরের পৃথিবীর যোগাযোগ একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সপ্তাহ খানেক আগে আবে রাইল্যাণ্ড ইংল্যাণ্ডে এসেছিলো। গতকাল তিনি ইংল্যাণ্ড ছেড়েছেন।
–ছেড়ে ইতালির দিকে গেছেন, পোয়ারো বলল।
–হ্যাঁ।
–আর মাদাম অলিভিয়ের?
তিনিও ফ্রান্স ছেড়েছেন গতকাল
–তিনিও ইতালীর দিকে গেছেন তাই না?
–হ্যাঁ। ব্যাপারটা আপনি আঁচ করলেন কি করে?
–আঁচ করতে পারতুম না; যদি না আমার বন্ধু হেস্টিংস আমাকে সাহায্য করত। এরকুলের কথা আমি ভাবতে লাগলাম, আমি আবার তাকে কী সাহায্য করলাম।
পোয়ারো বলল, সবাই তাহলে স্বাস্থ্যনিবাসের দিকে যাচ্ছে।
আজ্ঞে হ্যাঁ, সেখানে নজরও রাখা হয়েছে। ইতালি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড সরকার এ ব্যাপারে একযোগে কাজ করছেন। আপনাকে সাহায্য করতে তারা সর্বতোভাবে রাজী।
–ভাবনা তো মঁসিয়ে দেজার্দুকে নিয়ে, তাহলে তিনি আমার কথা বিশ্বাস করেছেন?
–না করে উপায় কী! আপনি যেসব প্রমাণ দিয়েছেন, তা খণ্ডন করা সম্ভব নয়।
-তাহলে সময় নষ্ট না করে আমরা আজই ইতালির পথে রওনা দেব। হেস্টিংস, তুমি বরং বিপদের মধ্যে না গিয়ে এখানেই থাকো।
-অসম্ভব, যত বিপদই আসুক আমি তোমার পাশেই থাকতে চাই, আমি বললাম।
ট্রেন ছাড়ার পর এরকুলকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, এরকুল আমি তোমাকে কিভাবে সাহায্য করলাম ঠিক বুঝলাম নাতো।
-লাগো কারোজা–এই কথাটা তুমি সেদিন জুগিয়ে আমাকে সাহায্য করেছ। ওটা লাগো কারোজা নয়, লাগো-ডি-কারোজা, তুমি শুনতে ভুল করেছিলে। ওটা একটা ইউরোপের সুন্দর স্বাস্থ্যনিবাস। যতদূর মনে হয় ওটাই চতুরঙ্গের সদর দপ্তর। সেখানে পাহাড়ের মধ্যে তাদের গোপন ল্যাবরেটারী, সুড়ঙ্গ, ঘরবাড়ী, অস্ত্রাগার সব আছে। এই গোপন ঘাঁটি থেকে এক-একটা বেতার নির্দেশ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এক-একটা বিপর্যয় ঘটবে। শাসন-ব্যবস্থা, যানবাহন-ব্যবস্থা, যোগাযোগ সব নষ্ট হবে। দুর্ভিক্ষ মহামারী, রক্তস্রোত ঘটবে।
-আর?
–আর চতুরঙ্গের সাঙ্গোপাঙ্গোরা প্রতিষ্ঠা করবে এক ভয়ঙ্কর স্বৈরতন্ত্র।
.
লাগো-ডি-কারোজায় পৌঁছালাম আমরা। চারিদিকে পাহাড়, সবুজঘেরা সুন্দর জায়গা।
ক্যাপ্টেন হার্ভে পোয়ারোকে আঙুল নির্দেশ করে দেখাল, বলল, ঐখানে, ঐ যে ঘোরালো পথটা রয়েছে। ভীষণ জটিল পথ, পাহাড়ের গা বেয়ে এঁকেবেঁকে উঠে গেছে।
সেদিন রাত্রে ডাইনিং হলে আমরা খেতে বসেছি। হঠাৎ পোয়ারো বলল, সামনের লোকটাকে একবার দে, দোহারা চেহারা, তলপোয়ারো মুখ নিচু কত
দেখলাম, মাঝবয়সী, দোহারা চেহারা, চোখে চশমা পরা একজন লোক বসে আছে। আমাদের দিকে তার চোখ পড়তেই চমকে উঠল। পোয়ারো মুখ নিচু করে বলল, চার নম্বর। রুটির টুকরো নিয়ে খেলা করার মুদ্রাদোষের কথা মনে আছে তো হেস্টিংস। আমি ভেবেছিলাম, শত্রু যখন আমার সম্পর্কে একেবারে নিশ্চিন্ত হয়ে যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাৎ দেখা দেব। যাতে ওরা আমাকে মারবার জন্যে উঠে পড়ে লাগে। কিন্তু এবার ওদের পাল্টা আঘাতের জন্য তৈরি থাকতে হবে।
–কিন্তু সত্যিই কি ও আঘাত হানবে নাকি?
নিশ্চয়ই। পৃথিবীতে একমাত্র আমাকেই ও ভয় করত। আমার মৃত্যু সংবাদে ওরা বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখছিল। সেই স্বপ্ন পূরণ করতে ওরা সকলে এখানে এসে জমায়েত হয়েছে। ওদের প্ল্যান যাতে ভেস্তে না যায়, তারজন্যে আমার উপর এবার চূড়ান্ত আঘাত হানতে হবে।
লোকটা উঠে দাঁড়াল, বেরিয়ে গেল। পোয়ারো বলল, তাড়াহুড়োর দরকার নেই। কফিটা শেষ কর। আমি একবার ঘর থেকে ঘুরে আসি। এসে লবিতে গিয়ে বসবো।
আমরা লবিতে বসলাম। খানিক বাদে সেই লোকটা আমাদের সামনে এসে বসল আর পোয়ারোর সঙ্গে গল্প জমিয়ে বসল। পোয়ারো পকেট থেকে সিগারেট মুখে ধরতেই লোকটা লাইটার বার করে বলল, আসুন। বলেই সে তার লাইটার জ্বালল। তারপরেই হোটেলের সমস্ত আলো হঠাৎ নিভে গেল। কে যেন আমার মুখে একটা রুমাল চেপে ধরল। তীব্র ঝাঝালো গন্ধে আমি জ্ঞান হারালাম।
.
১৮.
বড়জোর মিনিট খানেক বাদেই জ্ঞান ফিরে আসতে অনুভব করলাম, আমার হাত-পা বাঁধা, মুখে কাপড় ঠাসা। অন্ধকার। অন্ধকারটা চোখে সয়ে আসতে বুঝলাম আমাকে আর আমার সামনে একজনকে চ্যাংদোলা করে বয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পোয়ারোর সিগারেডে বিষাক্ত সূচ ছিল। কিন্তু সেই সূঁচ নিক্ষেপ করার আগেই হোটেলের মেন সুইচের কাছেই কোনো লোক সুইচটা অফ করে দেয়। আমার মনে পড়ল, ডাইনিং হল থেকে চারনম্বর একবার বেরিয়েছিল। তখনই সে এই ব্যবস্থা করে গেছে। ক্ষোভে, অপমানে আমার চোখ ফেটে জল আসছিল।
জঙ্গলে পাহাড়িয়া রাস্তা দিয়ে ধীরে ধীরে আমাদের বয়ে নিয়ে ওপরদিকে উঠছিল তারা। একটার পর একটা বাঁক পার হচ্ছিল তারা। সামনে একটা বড় পাথর। সেই পাথরের কাছে গিয়ে, মনে হল, একজন যেন বোতাম টিপল। পাথরটা তৎক্ষণাৎ সরে গিয়ে একটা সুড়ঙ্গ পথ দেখা গেল। বাহকরা সেই সুড়ঙ্গপথে আমাদের বয়ে নিয়ে নামতে লাগল।