টেলিফোনটা বেজে উঠল।
-হ্যালো, ক্যাপ্টেন হেস্টিংস বলছি।
অন্যপ্রান্ত থেকে উত্তেজিত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো :
সেন্ট গাইলস হাসপাতাল থেকে বলছি। খানিক আগে এক চীনাকে এখানে ভর্তি করা হয়েছে। তার অবস্থা এখন সঙ্কটজনক। লোকটার পকেট থেকে একটা চিরকুট পাওয়া গেছে, তাতে আপনার নাম, ঠিকানা লেখা ছিল। আপনি এখানে আসবেন?
–যাচ্ছি।
আমি হাসপাতালে গিয়ে দেখলাম অ্যাকসিডেন্ট-ওয়ার্ডে তাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। পাশে ডাক্তার, নার্স।
ডাক্তার বললেন, বাঁচবার কোনো সম্ভাবনা নেই। আপনি একে চেনেন নাকি?
–না। কখনও একে দেখিনি।
-আশ্চর্য। পকেটে আপনার নাম-ঠিকানা কোত্থেকে এলো? ওর পকেটে অন্যান্য কাগজপত্তরও কিছু পাওয়া গেছে, তার থেকে জানা গেছে মিঃ ইনগ্লেস নামে এক ভদ্রলোকের কাছে ও চাকরী করত।
তখন আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, আমি হেস্টিংস…হেস্টিংস…আমাকে কিছু বলবে?
-লাগো…কারোজা…দুটি কথা বলে তার ঠোঁট থেমে গেল। মারা গেল।
লার্গো…কারোজা…এই শব্দ দুটির অর্থ কি হতে পারে?
ফ্ল্যাটে ফিরে এসে সলিসিটরের চিঠি পেলাম।
প্রিয় মহাশয়,
আমাদের পরলোকগত মক্কেল মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো তাহার জীবদ্দশায় আমাদের যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তদানুসারে তাহার একখানি পত্র এইসঙ্গে আপনার কাছে পাঠাইতেছি। মৃত্যুর সপ্তাহকাল পূর্বে এই পত্রখানি আমাদের কাছে জমা দিয়া তিনি এইরূপ নির্দেশ দেন যে, তাহার মৃত্যু ঘটিলে যেন পত্রখানি আপনার কাছে পাঠাইয়া দেওয়া হয়। আপনার বিশ্বস্ত….
এরই সঙ্গে ছিল আমাকে লেখা পোয়ারোর একখানা চিঠিঃ
প্রিয় হেস্টিংস, এই চিঠি যখন তোমার হাতে পৌঁছবে, তখন আমি মৃত। আমার জন্যে দুঃখ না করে যদি আমার নির্দেশ পালন করো, তাহলেই আমার আত্মা শান্তি পাবে। আমার নির্দেশ এই চিঠি পেয়েই তুমি দক্ষিণ আমেরিকায় ফিরে যাবে। আমি জানি তুমি আমার নির্দেশ অমান্য করবে না। আমি আমার জীবদ্দশায় যে প্ল্যান ছকেছি, তুমি ইংল্যান্ডে থাকলে সেই কাজ করা শক্ত হবে। তুমি বুদ্ধিমান। সুতরাং আশা করি এর চেয়ে বেশি কিছু তোমাকে বলার দরকার নেই। পরলোক থেকে আমি শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
ইতি
এরকুল
বারবার পড়লাম চিঠিখানা। পোয়ারোর প্রতি শ্রদ্ধায় আমার মাথা নুয়ে আসছিল। তার কোনো কাজেই খুঁত নেই। মৃত্যুর আগে আমার কথা ভেবে নিজের হাতে সে জানিয়ে গেছে, আমি যেন ফিরে যাই। তার নির্দেশ অমান্য করতে আমি পারব না।
অ্যানিসোনিয়া জাহাজে উঠে আমি দক্ষিণ আমেরিকার দিকে রওনা হলাম। জাহাজ ছাড়ার আগে একজন স্টুয়ার্ড এসে আমার হাতে একটা চিরকূট দিল।
তাতে লেখা : ইংল্যাণ্ড থেকে বিদায় নিয়ে আপনি সুবুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন ৪।
শান্ত সমুদ্র, কেবিনে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ মাঝরাত্রিতে জাহাজেরই এক অফিসারের ধাক্কায় আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। উত্তেজিত গলায় তিনি বলছেন, নৌ-বিভাগ থেকে বিশেষ নির্দেশ পাঠানো হয়েছে আমাদের। জাহাজ থেকে এইখানেই আপনাকে আমরা নামিয়ে দেব।
–এই মাঝসমুদ্রে?
–সমুদ্রে নয়, এই ডেস্ট্রয়ারে। নৌবিভাগের আদেশ আমরা অমান্য করতে পারি না।
আমাকে একটা ডেস্ট্রয়ারে নিয়ে যাওয়া হল। খানিকক্ষণের মধ্যেই আমাকে বেলজিয়ামের উপকূলে নামিয়ে দেওয়া হল। সেখানে একজন মোটরগাড়ীর ড্রাইভারকে, ডেস্ট্রয়ার ক্যাপ্টেন বলে দিল, আমাকে যেন এখানকার স্পা-শহরের কাছাকাছি একটা বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়। মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝছিলাম না। গাড়ী ছুটছে। বিদ্যুৎচমকের মতই হঠাৎ আমার মনে পড়ল, এরকুলের ভাই আকিলের কথা। এরা কি আমার আকিল পোয়ারোর কাছে নিয়ে যাচ্ছে? কিন্তু কেন? ছোট্ট একটা বাড়ীর সামনে আমাকে নামিয়ে দেওয়া হল। মাঝবয়সী
একজন ভৃত্য এসে আমাকে জানাল, বাড়ীর মালিক আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন।
আমি সেই ভৃত্যের সঙ্গে গেলাম। একটা ঘরের পর্দা সরিয়ে আমি ভিতরে ঢুকলাম। অসম্ভব…সম্পূর্ণ অসম্ভব। ও, কে! আমার দিকে দুই হাত প্রসারিত করে এগিয়ে আসছে?
-”পোয়ারো!”
-হ্যাঁ, হেস্টিংস, আমি পোয়ারো, ও আমাকে জড়িয়ে ধরল। বলল, আমি মারা যাইনি। এরকুলকে মারা অত সহজ নাকি?
–কিন্তু আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না। এরকুল হাসল, বলল, শত্রুর চোখে ধুলো দিতেই এই মিথ্যে রটনা। ডাঃ রিজওয়ে আমাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করেছেন। সেদিন আমি আহত হয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু আমার পরামর্শানুযায়ী ডাঃ রিজওয়ে রটিয়ে দেন আমি মারা গেছি। ফাঁকা একটা কফিনকে কবর দেওয়া হয়। তোমাকে কিছু না জানানোও আমার প্ল্যানের অঙ্গ। কিছু মনে কোর না ভাই। তোমার শোকার্ত অবস্থা দেখে চতুরঙ্গের লোকেদের আর কোনো সন্দেহই রইল না। নৌ-বিভাগের সঙ্গে ব্যবস্থা করে আমি তোমাকে গোপনে আনিয়েছি। এইবারে শুরু হবে আমাদের আসল আক্রমণাত্মক খেলা। এইবারে আমরা চূড়ান্ত আঘাত হানবো।
.
১৭.
বেলজিয়ামের ঐ নিভৃত অঞ্চল থেকেও পোয়ারো তার সমস্ত যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ রেখেছিল।
বুঝতেই পারছিলাম জালটা এবার বেশ ভালোভাবেই বিস্তৃত করা হচ্ছে। রোজই ফ্রান্স, ইটালি, ইংল্যাণ্ড, চীন দেশ থেকে একটা না একটা প্যাকেট তার কাছে এসে পৌঁছায়। নিচুগলায় কি সব কথাবার্তা হয়। পোয়ারো কাউকে কাউকে টাকা বা অন্যকিছু দেয়। আবার তারা নিঃশব্দে বিদায় নেয়।