ডাক্তার চলে যাবার পর স্কটল্যান্ড-ইয়ার্ডে ফোন করে পোয়ারো ইন্সপেক্টর জ্যাপকে ডাকল। সে তার পুরনো বন্ধু।
খানিক বাদেই মিসেস পিয়ারসন এসে খবর দিলেন যে, হ্যাঁনওয়েলের উন্মাদাশ্রম থেকে ইউনিফরম পরা একজন রক্ষী আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।
আমরা তাকে ওপরে পাঠিয়ে দিতে বললাম। সে এলো। জানালো, আমাদের গারদ থেকে একজন পাগল কাল রাতে পালিয়েছে। আপনাদের ফ্ল্যাটে সে ঢোকেনি তো?
ঢুকেছিল। সে মারা গেছে। শুনে যেন লোকটা খুশী হল। বলল, বাঁচা গেছে। এমনিতে লোকটা শান্ত ছিল। আজগুবি সব কথা বলত। বলত কে যেন এক চীনেম্যান ওকে খুন করতে চায়। প্রায় দু-বছর সে গারদে ছিল।
লোকটাকে সনাক্ত করার জন্য পোয়ারো রক্ষীকে ভিতরকার ঘরে নিয়ে গেল। সে দেখে বলল, হ্যাঁ সেই বটে। আচ্ছা এখনি চলি, মরাটাকে সরিয়ে নেবার ব্যবস্থা করি গে। আর তদন্ত যদি হয়, আপনাদের সাক্ষী দিতে হবে।
লোকটা চলে যাবার খানিক বাদে জ্যাপ এসে পৌঁছাল। সব শোনার পর মৃতদেহ দেখে সে চমকে উঠল, আরে এ যে মেয়ার লিং।
কে মেয়ার লিং?
–পুলিশের লোক নয়, সিক্রেট সার্ভিসের লোক। বছর পাঁচেক আগে রাশিয়ায় গিয়েছিল। তারপর আর কেউ ওর খোঁজ পায়নি। সবাই ধরেই নিয়েছিল, বিদেশে ও খুন হয়েছে।
জ্যাপ চলে যাবার পর পোয়ারো বলল, আচ্ছা হেস্টিংস, ওকে রেখে চলে যাবার সময় তুমি কি জানলাগুলো খুলে দিয়েছিলে?
-না তো। জানলা তখন বন্ধই ছিল।
তবে ঘরে ঢোকার জন্যে যদি কেউ জানলা খুলে থাকে, তাহলে মাত্র একটা জানলা খুললেই তো চলতো। তাহলে এ-ঘরের আর বসবার ঘরের সমস্ত জানলাগুলো সে খুলতে গেল কেন? আমার মনে হচ্ছে, আমরা বেরিয়ে যাবার পর কেউ এ ঘরে ঢুকে ওর মুখের ওপর প্রুসিক অ্যাসিড চেপে ধরে ওকে হত্যা করেছে।
বলো কি? পোস্টমর্টেমে এসব নিশ্চয় টের পাওয়া যাবে।
–কিচ্ছু টের পাওয়া যাবে না। নাকের ওপর প্রুসিক অ্যাসিড চেপে ধরলে মৃত্যু অনিবার্য। শুধু ঘরের মধ্যে কিছুক্ষণের জন্যে একটা তীব্র গন্ধ থেকে যায়। হত্যাকারী গন্ধ হাওয়ায় উড়ে যাওয়ার জন্যে জানলাগুলো খুলে দিয়েছে। শরীরে কোনো চিহ্ন না থাকার জন্যে সবাই ভাবছে এ মৃত্যু স্বাভাবিক।
মুখ তুলে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে পোয়ারো উত্তেজনায় চীৎকার করে উঠল, ঘড়ি! দেওয়াল ঘড়িটার দিকে একবার তাকিয়ে দেখো হেস্টিংস। চারটে বাজে, কিছু বুঝছো?
আমি ঘাড় নাড়লাম। পোয়ারো বলল, মেয়ার লিং আততায়ীর পরিচয় জানিয়ে একটা সঙ্কেত রেখে গেছে। কাটা ঘুরিয়ে বাজিয়ে, ঘড়িটাকে সে বন্ধ করে দিয়েছে। কেন? অর্থাৎ হত্যাকারী চতুরঙ্গের চার নম্বর কর্তা সেই জল্লাদ।
পোয়ারো এরপর হালওয়েল উন্মাদাশ্রমে ফোন করে জানালো সেখান থেকে কাল রাত্তিরে কোনো পাগলা পালায়নি।
ফোন রেখে পোয়ারো বলল, হেস্টিংস, আমার ধারণা উন্মাদাশ্রমের ঐ রক্ষীই হচ্ছে চার নম্বর। তুমি ভাবছো অসম্ভব। কিন্তু সবই মেকআপ আর ছদ্মবেশের ব্যাপার। খানিক বাদেই তার সাজ পোষাক, গলার আগের স্বর সবকিছু পাল্টে যাবে। একেবারে অন্য মানুষ ভবিষ্যতে কেউ চিনতে পারবে না।
-তাহলে ভবিষ্যতে দেখা হবে?
নিশ্চয়ই। প্রথম রাউন্ডে ওরা জিতে গেল। কিন্তু রাউন্ড এখনও বাকি আছে। ওরা ভেবেছিল আমাকে লন্ডন থেকে দক্ষিণ আমেরিকায় সরিয়ে দেবে। তাতে ওরা হেরেছে। আর পোয়ারো যে লন্ডনে আছে, এটা ওদের কাছে নিশ্চয়ই সুখবর নয়।
.
০৩.
বলা বাহুল্য আমরা যাকে উন্মাদাশ্রমের রক্ষী ভেবেছিলাম, সে আর ফিরে আসেনি। যাই হোক, ময়না তদন্তের সময় পোয়ারো স্পষ্ট কোনো প্রমাণ নেই বলে জুরিকে বিশ্বাস করানো যাবে না এই ভেবে এবং চতুরঙ্গের কারসাজিটা আমরা টের পেয়েছি, এটা তারা বুঝতে পারলে সতর্ক হয়ে যাবে, এই সমস্ত চিন্তা করে চুপ করে রইল।
জুরি রায় দিলেন, এ মৃত্যু আকস্মিক। কয়েকদিন চুপচাপ কাটানোর পর পোয়ারো প্রস্তাব দিলো, চলো তোমাকে মিঃ জন ইনগ্লেসের কাছে নিয়ে যাই, চীনা গুপ্ত সমিতিগুলো সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট খবরাখবর রাখেন।
মিঃ ইনগ্লেসের বাড়িতে গেলাম। চীনা ভৃত্য দরজা খুলে দিল। মিঃ ইনগ্লেস বললেন, বসুন। আপনাদের চিঠি পেয়েছি। কার সম্বন্ধে খবর চান আপনারা? পোয়ারো বলল, লি চ্যাং ইয়েন সম্পর্কে।
নাম শুনে ইনগ্লেস যেন চমকে উঠলেন, বললেন চিনি, তবে যতটা চেনা দরকার ততটা নয়। পৃথিবীর একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে যাবতীয় সামাজিক এবং রাজনীতিক ব্যবস্থার–সে ওলট-পালট ঘটিয়ে দিতে চায়। তেমন ওলট পালট যে এখানে ওখানে ঘটছে, আমার বিশ্বাস সেটা লি চ্যাং-এর নির্দেশেই। সে চায়, পৃথিবী জুড়ে তার ক্ষমতার জাল বিছাতে। তার টাকার অন্ত নেই। বিশ্ববিখ্যাত কয়েকজন বিজ্ঞানীকেও সে হাত করেছে।
–কোথায় থাকে সে? কেউ তাকে বাধা দেবার চেষ্টা করেনি?
–পিকিংয়ে থাকে। আমি যতদূর জানি চারজন তাকে বাধা দেবার চেষ্টা করেছে এবং তারা এখন কেউ জীবিত নয়। প্রথমজন একটা কাগজে প্রবন্ধ লিখেছিল, তাতে সে পিকিংয়ের দাঙ্গার জন্য চ্যাং দায়ী এরকম আভাস দেওয়ায় ছুরিকাহত হয়। দ্বিতীয়জন এবং তৃতীয়জন বক্তৃতায় লি চ্যাংয়ের নামোল্লেখ করাতে তাদেরও এক সপ্তাহের মধ্যে একজনকে বিষ খাইয়ে মারা হল, অন্যজন কলেরায়; অথচ কলেরায় আক্রান্ত হবার মতো কোনো কারণই ছিল না। চতুর্থজনকেও বিছানায় মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। কোনো আততায়ী ধরা পড়েনি। প্রমাণও কিছু থাকে না বলে মামলাগুলো আদালতে খোপে টেকে না। বছর কয়েক আগে এক অল্পবয়সী চীনা কেমিস্টের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। তাকে দিয়ে জঘন্য সব বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করানো হতো। সে হতাশায় ভেঙে পড়ে আমার কাছে এক রাত্তিরের জন্যে আশ্রয় চায়। আশ্রয় তাকে দিয়েছিলুম। ভেবেছিলাম রাত্তিরটা কাটলে পরেরদিন তাকে সব প্রশ্ন করবো। কিন্তু সেই রাত্তিরেই আমার বাড়িতে আগুন লাগল। সে পুড়ে মরলো। প্রমাণ কিছু নেই।