বলা বাহুল্য, আমরা ওখানে মিস পামারের সঙ্গে গেলাম না। আলাদাভাবে গেলাম। কলিংবেল টিপতে মিসেস টেম্পলটন দরজা খুলে দিলেন।
–আমার নাম এরকুল পোয়ারো, একটা তদন্তের ভার নিয়ে, আমি আর আমার বন্ধু ক্যাপ্টেন হেস্টিংস মিঃ টেম্পলটনের সঙ্গে দেখা করতে চাই।
একটু দাঁড়ান আপনারা, আমি আসছি, বলে ভদ্রমহিলা চলে গেলেন। আর এলেন না। এলেন ডাক্তার ট্রিভস। বললেন, আমি এ বাড়ির ডাক্তার। মিঃ টেম্পলটন ডাইনিং হলে খাচ্ছেন, আপনারা সেখানে গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারেন।
ডাইনিং হলে গিয়ে মিঃ টেম্পলটনের ছেলের সঙ্গেও আলাপ হল। বয়স ৩০/৩২ সে বাপের সঙ্গে খেতে বসেছে।
পোয়ারো মিঃ টেম্পলটনের সঙ্গে কথা বলতে লাগল। আমি শুনতে লাগলুম। ছেলে পাশে। হঠাৎ সে আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল, সবাই আমাকে হাবা মনে করে। আমি সব জানি। বাবা মরে গেলে মা ঐ ডাক্তারকে বিয়ে করবে। তাই ওরা বাবাকে মারতে চায়।
বলেই সে মুখ ফিরিয়ে নিতান্ত নিরীহভাবে রেকাবির ওপরে একটুকরো রুটি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল।
পোয়ারোর দৃষ্টি আমাদের দিকে। হঠাৎ সে পেটে হাত চেপে গোঙাতে লাগল। ডাক্তার এল। পোয়ারো গোঙাতে গোঙাতে বলল, পেটে ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। মাঝে মাঝেই এরকম হয়। একটু বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।
ডাক্তার তখন আমাদের অন্য ঘরে পৌঁছে দিল। সে বেরিয়ে যেতেই পোয়ারো বিদ্যুৎবেগে বিছানা থেকে নেমে পড়ল। বলল, পালাও, হেস্টিংস, পালাও।
তার মানে?
–ডিনার-টেবিলের ঐ ছেলেটাই ক্লড ডরেল। রুটির টুকরো নিয়ে সে রেকাবিতে ঘষছিল, সেটাই তার মুদ্রাদোষ। আমার বিশ্বাস, এ বাড়ির প্রত্যেকেই চতুরঙ্গের চর। এক্ষুনি আমাদের পালাতে হবে। চলো, ঐ জানলা দিয়ে বেরিয়ে, পাঁচিল টপকে পালাই।
তাই করলাম আমরা। দৌড়, দৌড়। স্টেশনে পৌঁছলাম। তারপর বাড়ি পৌঁছে ঘরে ঢুকতে যাবো। পোয়ারো আমাকে বাধা দিল। বলল, দাঁড়াও হেস্টিংস, কে জানে কোনো ফাঁদ পাতা আছে। পা টিপে টিপে আমরা আলো জ্বালালাম। না, কেউ নেই।
অনেকক্ষণ সিগারেট খাওয়ার জন্যে আমার প্রাণ আকুলি-বিকুলি করছিল। প্যাকেট বের করলাম। দেখলাম, বিছানার ওপর একটা দেশলাই পড়ে রয়েছে। দেশলাই তুলে নিয়ে বললাম, দ্যাখো পোয়ারো, তুমি নিজেও কিছু কম অগোছালো নও। দেশলাইটা বিছানায় ফেলে রেখেছ।
-বাজে কথা, পোয়ারো বলল। ততক্ষণে আমি কাঠি বার করেছি। পোয়ারো ঝাঁপিয়ে, দাঁড়াও, দাঁড়াও। আমি তখন কাঠিটাকে বারুদের গায়ে ঘষে দিয়েছি। সঙ্গে সঙ্গে একটা চোখ ধাঁধালো আলোর সঙ্গে বিস্ফোরণ। তারপরে আর কিছু মনে নেই আমার।
.
জ্ঞান হবার পর দেখি ডক্টর রিজওয়ে আমার মুখের কাছে ঝুঁকে আছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, পোয়ারো? পোয়ারো কেমন আছে?
ডক্টর রিজওয়ে ভগ্ন, বিকৃত গলায় জানালেন, দৈবক্রমে আপনি বেঁচে গেলেও, মঁসিয়ে পোয়ারো রক্ষা পাননি। তার আত্মা শান্তি লাভ করুক।
.
১৬.
মনে পড়ে বালিশে মুখ গুঁজে আমি সেদিন শিশুর মতো কেঁদেছিলাম। আর রোগশয্যাতে শুয়েই আমি কঠিন প্রতিজ্ঞা নিয়েছিলাম, পোয়ারোর মৃত্যুর প্রতিশোধ আমি নেবই।
ডাক্তার রিজওয়ে আমাকে কোনো উৎসাহ না দিয়েই বললেন, আপনার বরং দক্ষিণ আমেরিকাতে ফিরে যাওয়াই ভালো।
স্বরাষ্ট্রসচিব মিঃ ক্রোথারও ঐ একই উপদেশ দিলেন। আরও বললেন, পোয়ারোর মৃত্যুর পরে ভল্ট থেকে তিনি খাতাখানাকে এনেছিলেন। তাঁর নির্দেশিত পথেই তারা এগোচ্ছেন।
কেউ আমার সাহায্য নিলেন না। আমি একাই আমার কাজে এগিয়ে যাবো।
চতুরঙ্গের বিরুদ্ধে এগোনোর একটা ছক করে ফেললাম। প্রথমে ক্লড ডরেলকে খুঁজে বার করতে হবে। বিভিন্ন কাগজে বিজ্ঞাপন দিলাম। ক্লড ডরেল সম্পর্কে কেউ জানলে আমার সঙ্গে যেন যোগাযোগ করেন।
মার্চ-এপ্রিল-মে গেল। কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ আমার চোখে পড়ল যে, মিঃ ইনগ্লেস মার্সাই থেকে এস. এস. সাংহাই জাহাজে উঠে চীনে যাচ্ছিলেন। মাঝপথে একদিন রাত্রে তিনি হঠাৎ ডেক থেকে সমুদ্রে পড়ে যান। দুর্ঘটনাকালে সমুদ্র ছিল শান্ত। জাহাজ দুলছিল। তবু তিনি রেলিং টপকে কিভাবে পড়লেন তা জানা যায়নি।
এই স্পষ্টই বুঝতে পারছিলাম এটা চতুরঙ্গেরই কাজ।
একদিন রেস্তোরাঁয় খাচ্ছি। আমার সামনের ভদ্রলোক, আমার নুনের দরকার পড়াতে আমার প্লেটে চার জায়গায় নুন ঢেলে বললেন, মরতে আপনি ভয় পান না, ক্যাপ্টেন হেস্টিংস?
আপনার এখন দক্ষিণ আমেরিকাতেই ফিরে যাওয়া উচিত। বলে তিনি দ্রুতবেগে বেরিয়ে গেলেন।
এর দশদিন পর। রাত নটা নাগাদ হাইড পার্কের পাশে হাঁটছি। হঠাৎ একটা গাড়ী আমার গা ঘেঁষে ব্রেক কষল। এক মহিলা মুখ বাড়িয়ে বললেন, ভয় পাবেন না ক্যাপ্টেন হেস্টিংস, এদেশ ছেড়ে চলে যান।
মহিলাকে চিনতে পারলাম। কাউন্টেস রসাকোফ।
আমি বললাম, কেন? আমি থাকলে আপনার প্রভুদের অসুবিধা হচ্ছে?
-পাগল। চতুরঙ্গ ইচ্ছে করলেই আপনাকে পিষে মারতে পারে। কিন্তু তাদের আমিই বাধা দিয়েছি। মঁসিয়ে পোয়ারো আমার প্রতিপক্ষ হলেও, আমি তাকে শ্রদ্ধা করতাম। আপনি তার বন্ধু। তাই বলছি, আপনি ফিরে যান দক্ষিণ আমেরিকায়।
গাড়ীটা ছুটে বেরিয়ে গেল। গাড়ীর নম্বর প্লেটটা ঝুটো বলেই আমি নম্বর টুকলাম না।
ফ্ল্যাটে ফিরে এসে ভাবলাম, তাহলে কি পোয়ারোর মৃত্যুর প্রতিশোধ না নিয়েই আমাকে ফিরে যেতে হবে?