মঁসিয়ে দেজার্দু হাসছিলেন। পোয়ারোর কথার একবর্ণও তার বিশ্বাস হয়নি। তিনি বললেন, আবে রাইল্যাণ্ড একজন বিখ্যাত মানুষ। তাঁর সম্পর্কে আপনি এসব কি বলছেন? পোয়ারো বলল, ঠিকই বলছি, মঁসিয়ে। আমার প্রত্যেকটি কথার প্রমাণ দিতে পারি।
মিঃ ক্রোথার বললেন, স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডকেও মঁসিয়ে পোয়ারো তথ্যপ্রমাণ দেখিয়েছিলেন।
দেজার্দু বলেছিলেন, মিঃ রাইল্যাণ্ডের কথা না হয় বুঝলাম, কিন্তু ফরাসী মহিলাটি কে?
-মাদাম অলিভিয়ের, পোয়ারো বলল।
–অসম্ভব! মাদাম কুরির পরে তাঁর মত বিজ্ঞানী কোনো দেশে জন্মায়নি। তাঁর নামে এ কি অন্যায় কথা বলছেন? মিঃ ক্রোথার আপনিও কি এইসব আজগুবী কথা বিশ্বাস করেন?
না করে উপায় নেই, মঁসিয়ে। তাঁর সম্পর্কে যে সব প্রমাণ মঁসিয়ে পোয়ারো যোগাড় করেছেন তারপরে বিশ্বাস না করে পারা যায় না।
গুম হয়ে বসে রইলেন দেজার্দু। অনেকক্ষণ বাদে বললেন, মাদাম অলিভিয়েরের বিরুদ্ধে যে প্রমাণই আপনারা দিন না কেন, ব্যাপারটা আমার পক্ষে বিশ্বাস করা শক্ত। কিন্তু এবার বলুন লি চ্যাং ইয়েন আবার কে? এমন নাম তো শুনিনি।
মিঃ ইনগ্লেস এবারে মুখ খুললেন, খুব কম লোকই তার নাম শুনেছে। চীনে দীর্ঘকাল কাটানোর ফলে আমি তাকে চিনি। আড়াল থেকে কাজ হাসিল করে। পৃথিবী জুড়ে আধিপত্য বিস্তারের লালসায় বোধহয় এমন কাজ নেই সে করতে পারে না।
মিঃ ক্রোথার এবার পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি আর কিছু বলবেন মঁসিয়ে?
-হ্যাঁ, আমার আর একটা কথা বলার আছে। চতুরঙ্গের চক্রান্ত ছিঁড়ে ফেলবার জন্যে এতদিন ধরে আমি যে আয়োজন করেছি, তাদের আক্রমণে আমার মৃত্যু হলে তা যাতে ব্যর্থ না হয় তাই চতুরঙ্গ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য আমি একটা খাতায় লিখে রেখেছি, আর সেই খাতাখানাকে আমি একটা ব্যাঙ্কের ভল্টে রেখে দিয়েছি। মিঃ ক্রোথার এই নিন তার চাবি। যদি তারা আমাকে হত্যা করে আপনি খাতাখানাকে বার করে নেবেন, চতুরঙ্গের বিরুদ্ধে কিভাবে এগোতে হবে তার নির্দেশ ওতে পেয়ে যাবেন। আর আমার কিছুই করার নেই।
আমরা সবার কাছে বিদায় নিয়ে নিচে নেমে এলাম। মিঃ ইনগ্লেসও আমাদের সঙ্গে বেরোলেন। তিনি বললেন, খুব শিগগির আবার চীনে যাচ্ছি। লি চ্যাং ইয়েনকে খুঁজে বার কর জোনাথান হোয়েলিকে হত্যা করার অপরাধে শাস্তি দেবার জন্যে। বলে ইনগ্লেস একটা বাসে উঠে পড়ল।
হাঁটতে হাঁটতে পোয়ারো বলল, জানো হেস্টিংস, এক একসময় মনে হয় বেলজিয়াম থেকে আমার যমজ ভাইকে নিয়ে আসি।
পোয়ারোর যে ভাই আছে আমি জানতাম না। বললাম, তার নাম কি?
–আকিল পোয়ারো। তার যেমন বুদ্ধি তেমনি সাহস। তার পরামর্শ নিয়ে আমি বিস্তর রহস্যের সমাধান করেছি। হুবহু আমার মতো দেখতে, তার গোঁফ নেই।
বাড়ী ফিরতে দেখলাম এক নার্স ভদ্রমহিলা পোয়ারোর জন্যে অপেক্ষা করছে। পরিচয় বিনিময়ের পর সে বলল, আমার নাম ম্যাবেল পামার। লার্ক ইনস্টিটিউশন থেকে আমাকে, এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক মিঃ টেম্পলটনের বাড়ী হার্টফোর্ডশায়ারে পাঠানো হয় তাঁকে সেবার। করার জন্যে। এক ছেলে আর স্ত্রী নিয়ে তার সংসার। ছেলেটি হাবা গোছের, প্রথমপক্ষের। সৎ মায়ের সঙ্গে তার বনিবনা নেই। মিঃ টেম্পলটনের প্রথম স্ত্রী মারা যাবার পর তিনি এক অল্পবয়সী মহিলাকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। যাই হোক, মিঃ টেম্পলটন গ্যাসট্রিক আলসারের রুগী। মাঝে মাঝেই পেটে ভীষণ ব্যথা হয় বমি করেন। ডাক্তারের তা নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই। তিনি তাকে একই ওষুধ দিয়ে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে একদিন একটা ব্যাপার ঘটল। আমি দেখলাম সন্ধ্যার অন্ধকারে বাড়ির বাগানের নির্জন জায়গায় মিসেস টেম্পলটন আর ডাক্তার ঘনিষ্ঠভাবে বসে আছেন। এরপর থেকে আমার মনে হয় ডাক্তার হয়ত ইচ্ছে করেই মিঃ টেম্পলটনকে ক্রমশ মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। আমার ধারণা, খাবারের সঙ্গে নিয়মিতভাবে অল্পমাত্রায় সেঁকোবিষ মেশানো হচ্ছে। যাতে একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে তিনি এগিয়ে যান। একদিন শুনলাম মিঃ টেম্পলটন বললেন, এই চারজনেই আমাকে মেরে ফেলবে।
–চারজন বলতে কাদের বুঝিয়েছিলেন?
–ছেলে, স্ত্রী, স্ত্রীর এক বন্ধু, আর ডাক্তার।
–চক্রান্তকে ব্যর্থ করার জন্যে আপনি কিছু চেষ্টা করেছেন?
-হ্যাঁ, গতকাল রাতের স্যুপ খাবার পরেই মিঃ টেম্পলটনের পেটে অসহ্য যন্ত্রণা হয়। আমি সেই স্যুপের কিছু অংশ শিশিতে করে এনেছি। আপনি কি এটা পরীক্ষা করে দেখবেন?
পোয়ারো শিশিটাকে তার কেমিস্ট বন্ধুর কাছে পাঠালো। ঘন্টাখানেক পরে রিপোর্ট এল স্যুপের মধ্যে বিষ আছে। শুনে ভদ্রমহিলা চমকে উঠে বললেন, আমি বাবা পুলিশ-টুলিশের ঝামেলায় যেতে পারব না। তার চেয়ে বরং আপনি একবার ওখানে চলুন। যা ভালো বুঝবেন করবেন।
আমরা মিনিট কয়েকের মধ্যেই হার্টফোর্ডশায়ারে যাবার জন্যে তৈরি হয়ে নিলাম। ইতিমধ্যে আমি লার্ক ইনস্টিটিউশনে ফোন করে জেনে নিলাম মিস পামার সত্যিই নার্স কিনা। তারা জানালো, হ্যাঁ, তিনি নার্স, তাঁকে হার্টফোর্ডশায়ারে পাঠানো হয়েছে।
পোয়ারো বলল, ওখানে গিয়ে আমরা আমাদের উদ্দেশ্য ভাড়ালেও পরিচয় গোপন করবো না। বলব যে, একটা চুরির ব্যাপারে, মিঃ টেম্পলটনের বাড়ির একজন ভৃত্য হয়ত জড়িত আছে, সেই সম্পর্কে খোঁজ নিতেই আমাদের এখানে আসা।