টেলিফোনটা বেজে উঠল।
পোয়ারো বলল, হ্যালো, আমি পোয়ারো…মিঃ ম্যাকনীল? তাই নাকি? …আচ্ছা ওকে বসিয়ে রাখুন, আমি এখুনি যাচ্ছি।
ফোন নামিয়ে পোয়ারো বলল, ক্লড ডরেলের এক বান্ধবী মিঃ ম্যাকনীলের সঙ্গে দেখা করেছে। চল সেখানে যাই।
ট্যাক্সি ধরে সোজা ম্যাকনীলের অফিসে। একটি রোগা মেয়ে চেয়ারে বসেছিল। পোশাকে বোঝা যাচ্ছে অবস্থা খুব ভালো নয়। বয়স বোঝার উপায় নেই।
–আসুন, মঁসিয়ে পোয়ারো। মিস ফ্লসি মনরোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি মিঃ ক্লড ডরেলের বান্ধবী। মিঃ ম্যাকনীল বললেন।
পোয়ারো হেসে তাকে বলল, তাই নাকি?
–হ্যাঁ, ক্লডি আমার বন্ধু ছিল। আপনাদের বিজ্ঞাপন পড়ে মনে হল, হয়তো ক্লডির কোনোও বড়লোক আত্মীয় মরবার সময় তাকে কিছু সম্পত্তি দিয়ে গেছে, তাই আপনারা ওর খোঁজ করছেন। তাই ওকে খুঁজে বার করার সুবিধার জন্যে আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম।
পোয়ারো বলল, মাদমোয়াজেল, চলুন কোনোও রেস্তোরাঁয় বসি গিয়ে। মিস মনরো আপত্তি করলেন না। আমরা বেরিয়ে একটা শৌখিন রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসলাম।
লাজুক হেসে মনরো বলল, ক্লডি ছিল আমার বন্ধু। আমাকে ভালোবাসত। তারপর বিয়ে করবে বলে আশায় আশায় রেখে একদিন সে নিখোঁজ হল।
–আচ্ছা, তার কোনো মুদ্রাদোষ আছে?
–আছে। এক চুমুক শ্যাম্পেন খেয়ে মনরো বলল, খাবার টেবিলে একটুকরো রুটি হাতে নিয়ে, সে রেকাবির গায়ে সেই টুকরোটাকে ঘষতে থাকে। এটা তার অনেকদিনের মুদ্রাদোষ। এই নিয়ে আমি অনেক ঠাট্টাও করেছি।
পোয়ারোর চোখদুটো চকচক করে উঠলো, আচ্ছা মিস মনরো, তার লেখা কোনো চিঠি আপনার কাছে আছে?
-না, চিঠি নেই, তবে ওর একটা ফটো আমার কাছে আছে।
উত্তেজনায় প্রায় চেঁচিয়ে উঠল পোয়ারো, কোথায় তার ফটো?
–আমার বাসায় আছে। আজ বিকেলে আপনার ফ্ল্যাটে আমি ফটো নিয়ে দেখা করব আপনার সঙ্গে।
নিশ্চয়ই।
–মিস মনরো বিদায় নিলেন।
ফ্ল্যাটে ফিরে এসেই জ্যাপকে ফোন করে পোয়ারো বলল, মিস ফ্লসি মনরো নামে এক মহিলার সঙ্গে আমাদের আলাপ হয়েছে। আজ বিকেলে তিনি আমার কাছে আসবেন। হয়তো তাকে মারবার চেষ্টা হতে পারে। তুমি দুজন গোয়েন্দা পাঠাবার ব্যবস্থা করো। কেউ যেন মনরোর কাছে ঘেঁষতে না পারে।
ফোন নামিয়ে রাখল পোয়ারো। কিন্তু তার মিনিট কয়েক বাদেই আবার ফোন বেজে উঠল। আমি ধরলাম। সেন্ট জেমস হাসপাতাল থেকে বলা হোল, একটু আগে এক ভদ্রমহিলা মোটর চাপা পড়েছেন। নাম মিস মনরো। তার অবস্থা সঙ্কটনজক এবং তিনি বারবার আপনার নাম বলছেন। গাইড থেকে আপনার নম্বর খুঁজে ফোন করছি। এখুনি হাসপাতালে যেন আসেন মঁসিয়ে পোয়ারো।
আমরা এমার্জেন্সি ওয়ার্ডে পৌঁছাতেই একজন নার্সের মুখ থেকে শুনলাম, একটু আগে তিনি মারা গেছেন।
পোয়ারো নার্সের দিকে চেয়ে বলল, ওঁর ব্যাগে আপনারা কি একটা চাবি পেয়েছেন? কারণ তিনি ফ্ল্যাটে একলা থাকতেন। বেরোবার সময় নিশ্চয় চাবি নিয়ে বেরিয়েছেন।
-না, টুকিটাকি জিনিষ ছাড়া কোনো চাবি আমরা পাইনি।
পোয়ারো আমাকে বলল, চলো হেস্টিংস, চারনম্বর মিস মনরোর বাসা থেকে সরে পড়বার আগেই আমার সেখানে পৌঁছোনো দরকার।
আমরা ট্যাক্সি ধরলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি ব্যাপার পোয়ারো?
পোয়ারো বলল, মিস মনরো মোটর চাপা পড়েছেন। সেটা আকস্মিক নয়, চার নম্বর তাকে গাড়ী চাপা দিয়েছে কারণ সে জানতে পেরেছে মনরোর কাছ থেকে আমরা তার সম্বন্ধে খবরাখবর পাচ্ছি। এবং দুর্ঘটনার পর রাস্তার ভিড়ের মধ্যে চারনম্বরের কোনো অনুচর চাবিটা তার ব্যাগ থেকে হাতিয়েছে। চাবি দিয়ে তার মনরোর বাসায় ঢুকে সমস্ত তথ্য সরিয়ে ফেলবে। এই তো আমরা এসে গেছি।
তাড়াতাড়ি মনরোর ফ্ল্যাটে এলাম। দরজা খোলাই ছিল, বুঝলাম কেউ ঢুকেছিল। মেঝের ওপর স্তূপীকৃত কাগজপত্র, আলমারির পাল্লা খোলা, টেবিলের ড্রয়ার হাঁ করা দেখেই বোঝা গেল তল্লাশীর কাজটা ভালোভাবেই সারা হয়েছে। মেঝের ওপর একটা ফটোফ্রেম পড়ে ছিল, ফটো উধাও। এ সবই চতুরঙ্গের চারনম্বরের কাজ বুঝতে একটুও অসুবিধা হলনা।
.
১৫.
মিস মনরোর মৃত্যুর পরে পোয়ারোর চরিত্রে রাতারাতি একটা পরিবর্তন ঘটে গেল। বাড়ি থেকে বেরোয় না, কথা বলে কম। কিন্তু আমার মনে হতো, সে চুপচাপ বসে নেই, তলেতলে সে পাল্টা আঘাতের আয়োজন করছে। অদ্ভুত চেহারার এক একজন মানুষ মাঝে মাঝেই তার কাছে আসে। চাপা গলায় তাদের কথা হয়, তারপর নিঃশব্দে বিদায় নেয়। দিন কয়েক আগে একজন রাশিয়ানকে সে একটা মোটা অঙ্কের চেক দিয়েছে।
একদিন মার্চের শেষের দিকে পোয়ারো আমাকে ডেকে বলল, চল, আমাদের স্বরাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে একবার দেখা করে আসি। ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী মঁসিয়ে দেজার্দু এখন লণ্ডনে। স্বরাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে আলোচনার সময়ে তিনিও উপস্থিত থাকবেন।
মিঃ সিডনি ক্রোথারের বাড়িতে গোপন বৈঠকে মোট পাঁচজন উপস্থিত ছিলেন। আমি এবং পোয়ারো ছাড়া মিঃ ক্রোথার, মঁসিয়ে দেজার্দু, মিঃ ইনগ্লেস।
মাঁসিয়ে দেজাদুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে ক্রোথার বললেন, মঁসিয়ে পোয়ারো চতুরঙ্গের ব্যাপারটা এবার বুঝিয়ে বলুন।
পোয়ারো অল্প কথায় বলল, চতুরঙ্গ একটা গুপ্ত সংগঠন। পৃথিবীর সর্বত্র এরা রাষ্ট্রিয় কাঠামোকে ধ্বংস করতে চায়। মোট চারজন এই সংগঠন চালায়। সেজন্যেই এই সংগঠনের নাম চতুরঙ্গ। প্রথমজন একজন চীনা লি চ্যাং ইয়েন, দ্বিতীয়জন মার্কিন কোটিপতি আবে রাইল্যাণ্ড। তৃতীয়জন এক ফরাসী মহিলা; চতুর্থজন এক ইংরেজ তার নাম ক্লড ডরেল।