খানিক বাদেই একটা ছেলে আমার কাছে তোমার চিঠিটা নিয়ে এল। আমি তার সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। অলক্ষ্যে অনুসরণ করতে লাগল সেই ছদ্মবেশী গোয়েন্দারা। আমি জানতাম আমার ওপর হামলা হবে। তাই আমি আমার কয়েক বছর আগে যোগাড় করা গ্যাসবোমাটা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। চতুরঙ্গের লোকেরা আমার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়তেই আমি বোমাটা ফাটালাম। আর সকলে অজ্ঞান হয়ে গেল সেই বিষাক্ত ধোঁয়া নাকে যেতে।
–কিন্তু ধোঁয়া তো তোমার নাকেও গিয়েছিল, তুমি কেন অজ্ঞান হওনি?
–ঐ যে চিঠিতে আমার গোঁফ নিয়ে ঠাট্টা করা হয়েছিল, মাফলার দিয়ে আমি যেন মুখটাকে ঢেকে রাখি। তাই মাফলার লাগিয়েছিলাম। আর তার আড়ালে ছিল ধোঁয়া নিরোধক ছোট্ট যন্ত্র রেসপিরেটর। তাই আমি অজ্ঞান হইনি।
একথা শুনে আমি হাসতে গেলাম। কিন্তু তখুনি আমার মনে পড়ল সিণ্ডারেলার কথা। বললাম, এরকুল আমার স্ত্রীর কী হবে?
তার মানে? তোমার স্ত্রীর আবার কি হবে? পোয়ারো হতভম্বের মতো প্রশ্ন করল।
–সেতো এখন চতুরঙ্গের হাতে বন্দিনী। ব্রনসেন আমাকে টেলিগ্রাম করে জানিয়েছে সে চতুরঙ্গের হাতে বন্দিনী। চতুঙ্গের লোকেরাও আমাকে শাসিয়েছিল যে, তোমায় যদি আমি চিঠি না লিখি তাহলে তিলে তিলে ওকে হত্যা করবে।
সব শুনে পোয়ারো বলল, ছি ছি, স্রেফ বাজে কথা। তোমার স্ত্রীকে মোটেই ওরা আটক করতে পারেনি। অনেকদিন আগেই আমার সন্দেহ হয়েছিল যে, চতুরঙ্গের লোকেরা হয়তো তোমার স্ত্রীকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে আমাদের বন্দী করবে। তাই আগে থাকতেই আমি দক্ষিণ আমেরিকায় চিঠি লিখে তাকে এমন জায়গায় সরিয়ে দিয়েছি যাতে ওরা তার নাগাল না পায়। এখন মনে হচ্ছে, তোমাকে আগেই ওসব কথা আমার বলা উচিত ছিল। থাক, এখন নিশ্চিন্ত হলো তো?
–এরকুল, বিশ্বাস করো, আমি যদি জানতাম ওরা আমার স্ত্রীর সম্পর্কে মিথে ভয় দেখাচ্ছে, তাহলে কিছুতেই তোমাকে ঐ চিঠি লিখতে রাজী হতাম না।
-জানি। আমি জানি যে তুমি কাপুরুষ নও।
.
১৪.
গ্যাস বোমা ফাটতেই ঐ ঢ্যাঙা লোকটা সরে পড়েছিল। পুলিশ যাদের গ্রেপ্তার করল তারা নেহাতই চুনোপুঁটি। জ্ঞান ফিরলে তারা জানাল, চতুরঙ্গের কোনোদিন নামই শোনেনি। তারা ঐ বাড়িতে চাকরের কাজ করত মাত্র, মালিকের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে তারা কিছু জানে না। বাড়ীটায় তল্লাসী চালিয়ে জনপ্রাণীর দেখা মেলেনি।
-এরকুল আমরা শুধু হেরেই যাচ্ছি।
দৃঢ় গলায় পোয়ারো বলল, না, তা বলতে পারি না। চতুরঙ্গের চার নম্বর কর্তাকে নিয়েই একটু মুশকিল বেঁধেছে। চার নম্বরকে সনাক্ত করা কঠিন বটে কিন্তু তার সম্পর্কে যে আমরা কিছুই জানিনে, এমন বলাও ঠিক নয়।
-কী জানো তার সম্পর্কে?
-জানি যে, সে মাঝারী দৈর্ঘ্যের মানুষ। এ যাবৎ যে কয়জনের ভূমিকায় তাকে দেখা গেছে, তাদের কারুর দৈর্ঘ্য খুব বেশি নয়। দ্বিতীয়ত, তার নাকটা চ্যাপ্টা। চ্যাপ্টা নাকের লোকেদের পক্ষে নাক খাড়া করা সহজ ব্যাপার কিন্তু খাড়া নাকের লোকের পক্ষে নাকটাকে চ্যাপ্টা করা সহজ নয়। তৃতীয়ত, তার বয়স মোটামুটি ৩০/৩৫ এর মধ্যে। চতুর্থত, তার সমস্ত দাঁত কিংবা অধিকাংশ দাঁতই নকল। কেননা রক্ষীর ভূমিকায় তার দাঁতগুলো ছিল ভাঙাচোরা। ডাঃ কুয়েন্টিনের ভূমিকায় দেখেছি তার সামনের দাঁত ছিল উঁচু। ডঃ সাবারোনফের ভূমিকায় দেখেছি সামনের দাঁত উঁচু ছিল না। দাঁত যদি আসল হতো এভাবে পাল্টানো যেত?
–ছদ্মবেশ ধারণে দেখছি লোকটা ওস্তাদ।
–সেজন্যেই আমার মনে হয় লোকটা এককালে পাকা অভিনেতা ছিল। তা না হলে বিভিন্ন ভূমিকায় তার চালচলন এত সহজ হতো না।
–তাহলে এখন আমাদের করণীয় কি?
করণীয় আর কিছুই নয়। এমন একজনকে খুঁজে বের করতে হবে আমাদের, যে বছর ৩/৪ আগেও স্টেজে অভিনয় করেছে, বয়স মোটামুটি ৩০/৩৫। সত্যি বলতে কি, ইতিমধ্যেই আমি এমন চারজন মানুষের খোঁজ পেয়েছি।
সেই চারজনের বর্ণনা শোন, পোয়ারো বলে যেতে লাগল। প্রথম জন আনোট নাটরেল। তেইশ বছর বয়সে রঙ্গমঞ্চে যোগ দিয়ে বিভিন্ন ভূমিকায় সে অভিনয় করেছে। চার বছর আগে ইংল্যাণ্ড পরিত্যাগ করেছে। উচ্চতা ৫৮”। নাক সোজা, চোখ বাদামী।
দ্বিতীয়জন–জন মরে। গরিব ঘরের ছেলে। বছর তিনেক যাবৎ নিখোঁজ। বাল্যবয়স থেকে অভিনয় করছে। উচ্চতা ৫৮”।
তৃতীয় জন-অস্টেন লী। অক্সফোর্ডের ছাত্র। ছাত্রজীবনেই অভিনয়ে যোগ দেয়। যুদ্ধে যোগ দিয়ে কৃতিত্ব দেখায়। বছর তিনেক আগে মোটর অ্যাক্সিডেন্টে আহত হয়। তারপর আর অভিনয় করেনি। ঠিকানা জানা নেই। বয়স ৩৫। উচ্চতা ৫৭”। চোখ নীল।
চতুর্থ জন-ক্লড ডরেল। বংশপরিচয় কেউ জানে না। ভ্রাম্যমাণ থিয়েটারের সঙ্গে অনেক দেশে গিয়েছে। ১৯১৯ সালে চীনে গিয়েছিল। ফিরতি পথে আমেরিকায় নামে। নিউইয়র্কে কিছুদিন অভিনয় করে। তারপর হঠাৎ একদিন নিখোঁজ হয়ে যায়। বয়স ৩৩। চোখের রং কটা। উচ্চতা ৫৮”।
–এই চারজনের মধ্যে তোমার কাকে সন্দেহ হয়? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
–চারজনকেই, তবে ক্লড ডরেলকেই সন্দেহ হয় সবচেয়ে বেশি।
–তা এই সন্দেহজনক চারজন লোকের খোঁজ পাওয়া যাবে কী করে?
–কাগজে আলাদা আলাদাভাবে এই চারজনের নামে বিজ্ঞাপন দিয়েছি। তাতে এদের আত্মীয়স্বজন কিংবা বন্ধুবান্ধব, অবিলম্বে মিঃ ম্যাকনীলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। ম্যাকনীল আমার অ্যাটর্নী।