–যেখানেই থাকুন তিনি নিরাপদে আছেন। এখনও তার কোনো বিপদ ঘটেনি। তবে যেকোনো মুহূর্তে তাকে আমরা হত্যা করতে পারি।
-কেন তাকে আটকে রেখেছেন? টাকার জন্যে? কত টাকা চান আপনারা?
–আমাদের প্রয়োজনীয় টাকা মেটানো আপনার পক্ষে সম্ভব হবে না।
তবে কেন তাকে আটকে রেখেছেন?
-তাঁকে না আটকালে কি আপনাকে আমরা হাতের মুঠোয় পেতাম। আর আপনাকে না পেলে সেই বেলজিয়াম গোয়েন্দাটাকে আমার পাবো কিভাবে?
-মানে?
-মানে সোজাই। আপনাকে মঁসিয়ে পোয়ারোকে একটা চিঠি লিখতে হবে। তাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে এখানে আনতে হবে।
অসম্ভব। অমন চিঠি আমি মেরে ফেললেও লিখতে পারবো না।
দরজার দিকে তাকিয়ে একটা হাততালি দিল লোকটা। দুজন চীনেম্যান এলো। লোকটা তাদের উদ্দেশ্যে দুর্বোধ্য ভাষায় কীসব বলতেই তারা আমার হাত-পা বেঁধে ঠেলতে ঠেলতে ঘরের এককোণে নিয়ে গেল। হঠাৎ দেখলাম, আমার সামনের মেঝের উপরে খানিকটা জায়গা ফাঁকা হয়ে গিয়েছে।
দীর্ঘদেহী মানুষটি আমাকে বলল, ক্যাপ্টেন, ঐ ফাঁকের নিচ দিয়ে নদী বয়ে যাচ্ছে। এখনও বলুন চিঠি লিখতে রাজী আছেন কিনা?
–যদি না লিখি?
–হাত পা বাঁধা অবস্থায়ঐ নদীর মধ্যে আপনাকে ফেলে দেওয়া হবে।
–তাহলে তাই করুন। আমি বরং ডুবে মরি, কিন্তু তাই বলে আমার বন্ধুকে আমি ডোবাতে পারবো না।
.
১৩.
মৃত্যুকে এত কাছ থেকে আমি কখনও দেখিনি। এখুনি আমাকে ফেলে দেওয়া হবে।
আশ্চর্য, নদীগর্ভে আমাকে ফেলে দেওয়া হল না। কিন্তু আমাকে না মেরে আমার স্ত্রীকে তিলে তিলে মারবার ভয় দেখানো হল আমাকে। ভয়াবহ উপায়ে অমানুষিক শাস্তি দেওয়া হবে তাকে।
আমি আঁতকে চেঁচিয়ে উঠলাম, না, না, তার কোনো দোষ নেই। তাকে আপনারা নির্যাতন করবেন না।
–তাহলে ঐ কলমটা তুলে নিয়ে আপনার বন্ধু মঁসিয়ে পোয়ারোর কাছে একটা চিঠি লিখুন। তাহলে আপনার স্ত্রীকে আমরা মুক্তি দেব।
আমি যা বলছি, শুধু তাই লিখুন।
আমি কাগজে কলম ছোঁয়ালাম। লিখলাম ঃ
প্রিয় পোয়ারো,
চতুরঙ্গের গুপ্তঘাঁটির সন্ধান আমি পেয়েছি। আজ বিকেলে চতুরঙ্গের চর একজন চীনেম্যান আমাদের ফ্ল্যাটে গিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করেছিল। একটা ভুয়ো-খবর দিয়ে সে আমাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে এখানে নিয়ে আসে। তখন তার চোখে ধুলো দিয়ে সরে পড়ি, এবং খানিক বাদে আমিই তার অলক্ষ্যে তাকে অনুসরণ করতে থাকি। এখানে তাদের গুপ্তঘাঁটি একটা পোড়ো বাড়িতে সে ঢুকেছে। আমি দূর থেকে বাড়ীটায় নজর রাখছি। বাড়ীটার মধ্যে ঢোকা আমার একার কাজ নয়। তাই একটা ছেলেকে নিয়ে তোমার কাছে চিঠি পাঠালাম। পত্রপাঠ তুমি চলে এসো। একটা কথা, তোমার গোঁফ দেখলে লোকে চিনে ফেলবে, তাই মাফলারে মুখটাকে ভালোভাবে ঢেকে আসবে। আমি তোমার প্রতীক্ষায় অপেক্ষা করে রইলাম। তুমি এলে আমরা দুজনে মিলে চতুরঙ্গের ঘাঁটিতে হানা দেব। ভালোবাসা সহ,
ইতি–
হেস্টিংস
ডিক্টেশন অনুযায়ী চিঠিখানা লিখতে লিখতে লজ্জায়,অপমানে আমার বুক ফেটে যাচ্ছিল। আমি নিজের হাতে বন্ধুকে শত্রুর হাতে তুলে দিচ্ছি; যে বন্ধু এ চিঠি পেয়েই ছুটে আসবে। অথচ এছাড়া আমি আর কী-ই বা করতে পারি? পোয়ারোর চাইতে আমার স্ত্রীর নিরাপত্তার প্রশ্নই এখন আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
আমি ঢ্যাঙা লোকটাকে বললাম, এবার আমার স্ত্রীকে ছেড়ে দেবেন তো?
–দাঁড়ান। আগে পোয়ারোকে আমরা গ্রেপ্তার করি, তারপর তাকে ছাড়া হবে।
–তোমরা শঠ, প্রতারক। কুকুরের চাইতেও ঘৃণ্য জীব।
এতটুকু উত্তেজিত হল না লোকটা। বলল, চটবেন না ক্যাপ্টেন হেস্টিংস। বলে আমাকে ঘরের মধ্যে ফেলে রেখে লোকটা চলে গেল।
ঘণ্টা কয়েক বাদে সেই ঢ্যাঙা লোকটা ঘরে ঢুকে বলল, ক্যাপ্টেন হেস্টিংস, আপনার বন্ধু আমাদের ফাঁদে পা দিয়েছেন। তিনি এই দিকেই এগিয়ে আসছেন। যেহেতু তিনি আপনাকে দেখলে এ বাড়ীতে ঢুকতে রাজী হন, তাই আপনাকে দোরগোড়ায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে। যদি কোনো চালাকি করার চেষ্টা করেন তো তার ফল ভয়াবহ হবে। আমি সদরে গিয়ে দাঁড়ালাম। সেই ঢ্যাঙা লোকটা আর জনাকয় সঙ্গী আমার পিছনে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে রইল। দেখলাম পোয়ারো আসছে একটা অল্পবয়সী ছেলের সঙ্গে। পোয়ারোর মুখটা দেখলাম মাফলার দিয়ে ঢাকা, ভীষণ খারাপ লাগছিল আমার। রাস্তা পার হয়ে সে ব্যাকুল মুখে আমারদিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, যাক, তোমার কোনো বিপদ হয়নি তো? উঃ কি দুশ্চিন্তায় ছিলাম, বলো, এখন কি করতে হবে?
আমি আর পারলাম না। চেঁচিয়ে উঠলাম বিকৃত গলায়, পালাও এরকুল, পালাও। এটা একটা চক্রান্ত। এরা তোমাকে…
দরজার পেছন থেকে ছুটে বেরিয়ে লাফ দিয়ে দাঁড়াল চতুরঙ্গের এক অনুচর।
পোয়ারো এক পা পিছিয়ে গেল। তারপরেই এক প্রচণ্ড শব্দ শুনলাম আর রাশি রাশি ধোঁয়া। আমার দম আটকে এল। দু-চোখে অন্ধকার নেমে এল। আর কিছু মনে নেই আমার।
জ্ঞান হবার পরে প্রথমে যার মুখ দেখলাম, সে পোয়ারো। আমাকে চোখ মেলে তাকাতে সে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল।
তারপর আমাকে সে বলল, বিছানার উপরে এলোমেলোভাবে চারখানা বই তুমি ছড়িয়ে গিয়েছিলে। সেই সংকেতের অর্থ বুঝে আমার এটা বুঝতে অসুবিধা হলো না যে তুমি চতুরঙ্গের পাল্লায় পড়েছ। এটাও বুঝলাম, আমাকে ধরার জন্যে তোমাকে টোপ হিসেবে তারা ব্যবহার করতে চায়। আমি সঙ্কেতটা জ্যাপকে জানিয়ে আমার ফ্ল্যাটের ওপর নজর রাখতে বললাম। তখুনি স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের জনাকয় ছদ্মবেশী লোক নজর রাখতে থাকে।