বললাম, এরকুল, এরা যতখানি ধূর্ত, ঠিক ততখানিই নৃশংস।
.
১২.
শীতের সময় লন্ডন যেমন নোংরা তেমনি স্যাঁতস্যাঁতে।
পোয়ারো বলল, হেস্টিংস, ভাবছি যে, তুমি মাত্র মাস দুয়েকের জন্যে ইংল্যাণ্ডে এসেছিলে কিন্তু মাসের পর মাস কাটছে, তবু তুমি আর্জেন্টিনায় ফেরার নাম করছ না।
-ফিরবো কি করে? সিণ্ডেরেলা মোটেই স্বার্থপর মেয়ে নয়। সে ঠিক বুঝবে, তোমাকে একা ফেলে আমার পক্ষে ফিরে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। যাকগে ও কথা বাদ দাও, এখন বলো চতুরঙ্গকে আমরা ঠিক কবে নাগাদ জালে আটকাতে পারবো?
–অধৈর্য হয়ো না হেস্টিংস, তাদের সম্পর্কে যেটুকু জেনেছি, তার মূল্যও নেহাত কম নয়, আমরা দু নম্বর তিন নম্বর কর্তার খোঁজ পেয়েছি। চার নম্বরের কর্মকৌশলও আন্দাজ করেছি। আমি কি ভাবছি জানেনা, চতুরঙ্গ আমাদের ওপর আঘাত হানছে না কেন? তা যাই করুক, তুমি তাক থেকে আমার পাঁচখানা বই একসঙ্গে নামিয়েছো কেন? সব বইগুলো একসঙ্গে পড়ছো?
একটা কথা বলা দরকার, পোয়ারো ভীষণ ফিটফাট মানুষ। শৃঙ্খলার অভাব সে আদৌ বরদাস্ত করে না। এরপর পোয়ারো বলল, আমি একটু বেরোচ্ছি। ফিরে এসে যেন দেখতে পাই সব জায়গামতো সাজানো আছে। পোয়ারো বেরিয়ে গেল।
এরপর লেডি পিয়ারসন আমাকে একটা টেলিগ্রাম দিয়ে গেল।
টেলিগ্রামটা দক্ষিণ আমেরিকায় আমার কাজকর্ম যে দেখাশোনা করে সেই ব্রনসেন পাঠিয়েছে। সে জানাচ্ছে :
গতকাল থেকে মিসেস হেস্টিংস নিখোঁজ। অপেক্ষা করছি যে, চতুরঙ্গ নামে কোনো গুপ্ত সমিতি তাকে চুরি করেছে। পুলিশে খবর দিয়েছি। কিন্তু এখনও পর্যন্ত মিসেস হেস্টিংসের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। ব্রনসেন।
সিণ্ডেরেলা নিখোঁজ। আমি পাথরের মতো বসে রইলাম। কি করব। পোয়ারোকে এক্ষুনি এ-কথা জানানো দরকার। সে নিশ্চয় কোনোও পথ বার করতে পারবে।
দরজায় আবার টোকা পড়ল। মিসেস পিয়ারসন এবার একটা চিঠি দিয়ে গেলেন। আর তিনি জানালেন, পত্রবাহক একজন চীনেম্যান উত্তরের জন্যে নিচে অপেক্ষা করবে। ছোট্ট চিঠি। তাতে লেখা?
আপনি যদি আপনার স্ত্রীকে আবার জীবিত অবস্থায় দেখাতে চান, তাহলে পত্রবাহকের সঙ্গে চলে আসুন। আপনার বন্ধু পোয়ারোকে এ-কথা জানাবেন না। যদি জানান, তাহলে আপনার স্ত্রীকে তার ফল ভুগতে হবে।
চিঠির নিচে লেখা রয়েছে : ৪।
.
এ চিঠি পাবার পর আমি কী করতে পারতাম? ভাববার মতো মানসিক অবস্থাই আমার নেই।
মুহূর্তে মনস্থির করে নিলাম। পত্রবাহকের সঙ্গে আমি যাব। যা ঘটে ঘটুক।
কিন্তু পোয়ারোকে আমি যদি তা চিঠিতে লিখে দিয়ে যাই, তাহলে চতুরঙ্গের চররা নিশ্চয়ই জানতে পারবে। তার ফল ভুগতে হবে আমার সিণ্ডারেলাকে। আমি বরং এই টেলিগ্রামটাই টেবিলে রেখে দিয়ে যাই। পোয়ারো সমস্ত ব্যাপারটা বুঝতে পারবে।
আমি নিচে নেমে চীনেম্যান পত্রবাহককে দেখতে পেলাম। সে আমার জিজ্ঞেস করল, আপনিই ক্যাপ্টেন হেস্টিংস?
–হ্যাঁ।
–চিঠিটা আপনি পড়েছেন?
–হ্যাঁ।
চিঠিটা ফেরৎ দিন আমাকে।
আমি জানতাম চিঠিটা ওরা ফেরৎ চাইবে। সঙ্গেই এনেছিলাম। ফেরৎ দিলাম।
দাঁত বের করে লোকটা হেসে বলল, আর্জেন্টিনা থেকে আপনার নামে যে টেলিগ্রামটা এসেছে, সেটাও দিন।
আমি হতবাক। ব্রনসেন টেলিগ্রাম করেছে, তাই কি এদের নজর এড়ায় না।
আমি কিছুই করার নেই ভেবে টেলিগ্রামটা এনে তার হাতে দেব বলে ওপরে গেলাম। কিন্তু এখন পোয়ারোর জন্যে কিছু একটা সঙ্কেত রেখে যেতে হবে। হঠাৎ আমার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। তাক থেকে চারখানা বই নামিয়ে নিয়ে বিছানায় ফেলে রাখি। পোয়ারো সংকেতটা নিশ্চয়ই আঁচ করতে পারবে। তাই করলাম।
টেলিগ্রাম নিয়ে নিচে এসে চীনেম্যানটার হাতে দিলাম। সে বলল, আসুন।
আমি তার সঙ্গে যত পথ ঘুরলাম তার হিসেব নেই। কখনও বাসে, কখনও ট্রেনে, কখনও হেঁটে, ঘিঞ্জি নোংরা সব পাড়া ঘুরে আমি এমন একটা অঞ্চলে পৌঁছালাম যেখানকার অধিকাংশ বাসিন্দা চীনে।
এঁদো একটা গলির মধ্যে জরাজীর্ণ একটা বাড়ির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে কড়া নাড়তে একটা চীনে দরজা খুলে দিল। সেই লোকটার হাতে সে আমাকে সঁপে দিতে দ্বিতীয় চীনাটা আমাকে বাড়ীর মধ্যে নিয়ে গেল। সিঁড়ি, উঠোন পেরিয়ে আমরা একটা হলঘরে গিয়ে হাজির হলাম। ঘরে বিরাট বিরাট বস্তা সাজানো আর তার থেকে কড়া একটা গন্ধ পাচ্ছিলাম।
আমার সঙ্গী দেয়ালের ধার থেকে একটা বস্তাকে ঠেলে সরিয়ে দিল। দেখলাম দেয়ালে একটা ফোকর রয়েছে। সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে আমরা একটা বিরাট ঘরে পৌঁছলাম। আমার সঙ্গী সেই ঘরের দেয়ালে পরপর চারবার টোকা দিতেই যেন একটা ভোজবাজি ঘটে গেল। দরজা খুলে গেল। একটা ঘরে ঢুকলাম। মনে হয় আরব্য রজনীতে বর্ণিত কোনো মায়াকক্ষে আমি হাজির হয়েছি। দরজায় রেশমের পর্দা ঝুলছে।
পর্দার আড়াল থেকে পরিষ্কার ইংরাজীতে কে যেন জিজ্ঞেস করল, ক্যাপ্টেন হেস্টিংসকে নিয়ে এসেছ?
সঙ্গী বলল, হ্যাঁ।
পর্দা সরে গেল। দেখলাম একটা দীর্ঘদেহী মানুষ বসে আছে। সে চীনদেশের মানুষ।
–আসুন ক্যাপ্টেন হেস্টিংস, আমার অনুরোধ রাখার জন্যে ধন্যবাদ।
–কে আপনি? আপনিই কি বিল চ্যাংয় ইয়েন?
-না, আমি তার নগণ্য এক নফর মাত্র। আমার মতো অসংখ্য নফর দেশে দেশে ছড়িয়ে আছে।
বুকের মধ্যে ধক করে উঠল, বললাম, আমার স্ত্রী কোথায়?