–উইলসন কি সেদিন খেলা শুরুর আগে এখানে কিছু খেয়েছিলেন?
–এক পাত্র হুইস্কি খেয়েছিলেন। আর কিছু না।
–ধন্যবাদ। পোয়ারো বলল।
আমরা ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এলাম। আইভানকে দেখতে পেয়ে পোয়ারো জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, তোমাদের এই ফ্ল্যাটের ঠিক নিচেরটায় কে থাকেন?
–এই কয়েকদিন আগে নতুন এক ভাড়াটে এসেছেন। তার আগে অনেকদিন ওটা খালি পড়েছিল।
আমরা সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালাম। বাড়িতে পৌঁছে টেবিলে একটা চিঠি পড়ে আছে দেখে পোয়ারো সেটা খুলল। জ্যাপের চিঠি। চিঠিতে লেখা ছিল যে, উইলসনের মৃতদেহ পরীক্ষা করে কোনো বিষের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। চিঠিটা পড়ে পোয়ারো বলল, আমি জানতাম উইলসনকে বিষ খাইয়ে মারা হয়নি। পকেট থেকে একটা দাবার খুঁটি বার করে পোয়ারো বলল, এই খুঁটিটা দেখে জেনেছিলাম। এটা আমি ডঃ সাবারোনফের বাড়ি থেকে হাতিয়ে এনেছি। আর উইলসনের মুঠোর খুঁটিটা আমার বাঁ পকেটে রয়েছে।
-কেন?
–দেখতে চাই এ দুটোর ওজন এক কিনা।
আমি পোয়ারোকে পাশের ঘর থেকে দাঁড়িপাল্লা এনে দিলাম। পোয়ারো দুটো খুঁটি দুটো পাল্লায় বসিয়ে দেখল দুটোর ওজন সমান নয়। উইলসনের মুঠোর হুঁটিটার পাল্লাটা ঝুলে পড়েছে। অর্থাৎ ঐ খুঁটি ভারী। এবং নিশ্চয়ই ওর মধ্যে কিছু কারচুপি করা আছে।
আলোর কাছে খুঁটিটা তুলে নিয়ে দেখল পোয়ারো। তারপর উল্টে ধরে মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করে বলল, দেখো, হেস্টিংস, এই খুঁটির মধ্যে দিয়ে একটা লোহার তার চালিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এরপরই কথার মধ্যে হঠাৎ পোয়ারো ফোন তুলে জ্যাপকে নির্দেশ দিল, ডঃ সাবারোনফের বাড়িতে যারা পাহারা দিচ্ছে, তাদের জানিয়ে দাও, আইভানের ওপর যেন কড়া নজর রাখে, সে যেন পালাতে না পারে। রিসিভার নামিয়ে এবার সে আমাকে বলল, এখনও তুমি কিছু বুঝতে পারনি হেস্টিংস। আরে উইলসন মোটেই বিষ খেয়ে মারা যায়নি, সে মারা গেছে ইলেকট্রিক শক খেয়ে। ডাঃ সাবারোনফের ঘরের মেঝেয় যে কার্পেটটা পাতা আছে, তার একজায়গায় আমি একটু ফুটো লক্ষ্য করেছিলাম। এবং সেই ফুটোটার তলাকার মেঝেটায় ছিল ফুটো।
–মেঝেতে আবার কারা ফুটো করল।
–হত্যাকারীরা। নিচের ফ্ল্যাটটা তারাই ভাড়া নিয়েছিল। তারা সেই ফ্ল্যাটের সিলিং ফুটো করে উপর তলার ঘরের অর্থাৎ ডঃ সাবাহরানফের ঘরের মঝের ওপরে তারা একটা বৈদ্যুতিক তার চালিয়ে দিয়েছিল। ঘরের মেঝে থেকে কার্পেটের ছ্যাদার মধ্যে দিয়ে টেবিলের তলা কুঁড়ে সেই তারের ডগাটা দাবার ছকের একটা নির্দিষ্ট জায়গা এসে পৌঁছে। আর সেটা রাইলোপেজ চাল দিয়ে খেলা শুরু করলে একটা নির্দিষ্ট খুঁটিকে যেখানে পৌঁছতে হয় সেখানে।
আমি সমস্ত ব্যাপারটা এবার বুঝলাম। উইলসন সেই খুঁটিটাকে যখন দাবার ছকের নির্দিষ্ট জায়গায় এগিয়ে দিয়েছে, ঠিক তক্ষুনি সেই ঘুটির মধ্যেকার লোহার তারটা সেখানকার বৈদ্যুতিক তারের সংস্পর্শে এসেছে, আর উইলসনও সেই মুহূর্তে কারেন্ট খেয়ে মারা যায়। বললাম, আমার তো মনে হয় এই চক্রান্তের সঙ্গে সাবারোনফের বাড়ির লোকেদের কিছু। যোগসাজশ আছে।
–তা তো আছেই। আমার মনে হয়, আইভানই চতুরঙ্গের সেই জল্লাদ।
–আর সোনিয়া?
এরপরই কথাত যারা পাহারা দিচ্ছে, তার নামিয়ে এবার সে আমাথায়নি, সে মারা
-সোনিয়া সেই জল্লাদেরই চর। ভাগ্নীর পরিচয়ে সে সাবারোনফের বাড়িতে ঢুকেছিল। আইভান আর সে মিলে ডঃ সাবারোনফকে শক খাইয়ে মারতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের প্ল্যানটা ভেস্তে গেল। কারণ সাধারণত সাবারোনফ সাদা ঘুটি নিয়ে খেলতেন। কিন্তু উইলসনের সঙ্গে খেলার দিন, তিনি উইলসনকে সাদা ঘুটি নিতে দেন। তাছাড়া নিজের আসনটা ছেড়ে প্রথম চালটা উইলসনকে দিতে বলেন। ফলে উল্টো ঘটনা ঘটল।
ফোনের ক্রিং আওয়াজে আমার চমক ভাঙ্গলো।
জ্যাপের গলা, বলল, মঁসিয়ে পোয়ারোকে জানাও আইভান সরে পড়েছে। ট্যাক্সি নিয়ে একটা পোড়ো বাড়িতে ঢুকেছে, পুলিশ এখন বাড়াটাকে ঘিরে রেখেছে।
ফোন নামিয়ে পোয়ারোকে সব জানালাম। বললাম, চার নম্বর তাহলে ধরা পড়ল।
-তাই কি? অর্থাৎ আইভানই যদি চার নম্বর হতো, তাহলে এত সহজে তাকে ঘেরাও করা অন্তত জ্যাপের পক্ষে সম্ভব হতো না। হেস্টিংস আমার একটা ভুল হয়ে গেল। গর্ব করতাম আমার কখনও ভুল হয় না। কিন্তু…
–কিন্তু কি?
দীর্ঘদিন বাদে মামা ভাগ্নীর দেখা হল, আমি ধরেই নিলাম ভাগ্নীটি জাল। এক্ষেত্রে মামাটি জাল। প্রথমে আমি সোনিয়াকে সন্দেহ করেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে, ডঃ সাবারোনফই হয়ত জাল। যাকগে, আর দেরি করা আমাদের ঠিক হবে না। সহজে ধরা দেওয়া আইভান আসলে নিতান্ত গোবেচারা মানুষ। আসল কালপিট ডঃ সাবারোনফই। চলো, তার ফ্ল্যাটে একবার হানা দেওয়া যাক।
বারবার বেল বাজিয়েও কারোর সাড়া না পেয়ে, দারোয়ানের কাছে সব চাবি ছিল; সেই চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে দেখি সোনিয়া হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছে। গোঁ-গোঁ করছে। মুখে কাপড় গোঁজা, নাকের উপর ক্লোরোফর্মের প্যাড। তাড়াতাড়ি বাঁধন খুলে ডাক্তার ডাকলাম। রিপোর্ট শুনলাম, ভয়ের কিছু নেই। খানিক বাদেই সুস্থ হয়ে উঠবে।
–ব্যাপার কি পোয়ারো? ডঃ সাবারোন কোথায়? তিনি যে অসুস্থ।
–মোটেই তিনি অসুস্থ নন। সত্যিকারের সাবারোনফ অনেকদিন আগেই মারা গেছেন। আসল সাবাহরানফের সম্পত্তি হাতাবার জন্যেই এ লোকটা নকল পরিচয়ে লণ্ডনে এসে হাজির হয়েছিল। সম্পত্তিটা হাতিয়ে নিয়েছে। নকল সাবাহরানফকে মারার কোনো চক্রান্ত হয়নি। চক্রান্ত হয়েছিল উইলসনকে মারার। উদ্দেশ্য একটাই, নকল সাবাহরানফের ছদ্মপরিচয়টাকে গোপন রাখা। ভুলে যেও না আসল সাবারোনফ ছিলেন বিশ্বখ্যাত দাবা খেলোয়াড়। এদিকে নকল সাবারোনফ দাবার কিছুই জানেনা। এবং সেটা ফাঁস হবার আগেই সে উইলসনকে খতম করতে চেয়েছে। তাই সে করছেও।