ব্যাপারটা একটু খুলে বল জ্যাপ। পোয়ারো বলল।
-বলছি। রুশ বিপ্লব শুরুর পর ডঃ সাবাহরানকে বলশেভিকদের শত্রু বলে ঘোষণা করা হয়। এমন কি তখন গুজব রটে গিয়েছিল যে, ডঃ সাবারোনফকে তারা হত্যা করেছে। আসলে তিনি মারা যাননি। সাইবেরিয়ায় আত্মগোপন করেছিলেন। সেইসময় রোগে, শোকে তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। নানান দেশ ঘুরতে ঘুরতে শেষে ইংল্যান্ডে এসে আশ্রয় নেন। তার ফ্ল্যাট তার ভাগ্নী সোলিয়া আর ভৃত্য আইভান থেকে। সাবারোনফের ধারণা বলশেভিকরা সুযোগ পেলে এখনও তাকে হত্যা করবে। সেজন্যে তিনি কোথাও বের হন না বা কারো সঙ্গে দেখা করেন না। ম্যাচ খেলার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছিলেন কয়েকবার। কিন্তু উইলসন তার ফলে ঢাক পিটিয়ে রটাতে থাকল যে সুযোগ পেলে সে তাকে গো-হারান হারিয়ে দেবে। অগত্যা তিনি রাজী হলেন সম্মান বাঁচাতে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, সাবারোনফের শত্রুরা সেদিন তার পানীয়ে বিষ মিশিয়েছিল, কিন্তু কোনো বিশেষ ভুলে সেটা খেয়েছিল উইলসন।
–সাবানেফ মারা গেলে কে লাভবান হতো?
–তার ভাগ্নী।
–খেলাটা কোথায় হয়েছিল?
–তার ফ্ল্যাটে। খেলার সময় জনা সাত-আট লোক সেখানে ছিল।
–মৃতদেহ পরীক্ষা হবে কখন?
–আজই রাত্রে। চলুন না মর্গ থেকে একবার ঘুরে আসি।
–চলো।
উইলসনের মৃতদেহকে একটা টেবিলে শুইয়ে রাখা হয়েছিল। তন্ন-তন্ন করে পরীক্ষা করে পোয়ারো মৃতদেহের বাঁ হাতে একটা পোড়ার দাগ দেখতে পেল। একজন কনস্টেবল মৃত উইলসনের পকেট থেকে পাওয়া একটা রুমাল, একতোড়া চাবি, মানিব্যাগ, একতাড়া নোট, কিছু খুচরো পয়সা আর একটা দাবার খুঁটি সেটা হাতির দাঁতে তৈরি–এগুলো নিয়ে এল। জ্যাপ জানালো খুঁটিটা উইলসনের হাতে মুঠোর মধ্যে শক্ত করে আঁকড়ে ধরা ছিল। অনেক কষ্টে সেটা হাত থেকে ছড়ানো হয়েছে।
পোয়ারো জ্যাপের কাছ থেকে খুঁটিটা চেয়ে নিল আর বলল, খুঁটিটা ফের দেবার অছিলায় ডঃ সাবারোনফের সঙ্গে আমি একবার দেখা করতে চাই। আচ্ছা জ্যাপ, উইলসনের সম্পর্কে সবকিছু বললেও তুমি এটা আমাকে জানাওনি যে সে বাঁ হাতে সব কাজ করত অর্থাৎ ন্যাটা ছিল।
–মঁসিয়ে পোয়ারো, হা সে ন্যাটাই ছিল বটে। পোয়ারো হেসে বলল, চলি, কাল সকালে আমি ডঃ সাবাহরানফের সঙ্গে দেখা করতে যাবো।
.
ডঃ সাবারোনফের ওয়েস্টমিনস্টার অঞ্চলের বাড়িতে গিয়ে বেল টিপতে তার রুশ ভৃত্য আমাদের দরজা খুলে দিল। আমাদের পরিচয় জানিয়ে জ্যাপ একখানা চিঠি লিখে দিয়েছিল সেটা দেখাতে আইভান আমাদের ড্রইংরুমে বসালো।
পোয়ারো তৎক্ষণাৎ সামনের টেবিলের পায়ার কাছে মেঝের ওপর উবু হয়ে বসে কার্পেটখানাকে দেখতে লাগল। আমি বললাম, অত মনোযোগ দিয়ে কি দেখছো?
-দেখছি, এত দামী কার্পেটটাকে এইভাবে ফুটো করল কে?
ইতিমধ্যে সুন্দরী, অল্পবয়সী, নীলচুলের একটা মেয়ে ঘরে ঢুকল এবং নিজের পরিচয় দিল সাবারোনফের ভাইঝি সোনিয়া বলে।
পোয়ারো বলল, আমার নাম এরকুল পোয়ারো। গিলমোর উইলসনের মৃত্যু সম্পর্কে সামান্য কিছু খবর জানতে এসেছি।
–ও, তিনি তো হার্টফেল করে মারা গেছেন।
–পুলিশ সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ নয়।
–সেকি! আইভান তাহলে ঠিক কথাই বলেছে। তার ধারণা আমার মামাকে কেউ বিষ খাইয়ে মারতে চেয়েছিল কিন্তু মামা সেটা খাননি, খেয়েছে মিঃ উইলসন।
-আচ্ছা, আপনার মামার কোনো শত্রু আছে?
–কী জানি! মামা আমাকে বিশ্বাস করে কখনও কিছু বলেন না। অনেক বছর পর আমাদের আবার যোগাযোগ ঘটলো তো। তবে সবসময় তিনি কেমন যেন ভয়ে ভয়ে থাকেন। আড়াল থেকে সেদিন তার মুখে একটা গুপ্ত সমিতির নাম শুনলাম। আচ্ছা মঁসিয়ে, আপনি চতুরঙ্গ বলে কোনোও সমিতির কথা জানেন।
পোয়ারো আর আমি চমকে উঠলাম। পোয়ারো বলল, এ নাম আপনি কোথায় শুনেছেন?
আড়াল থেকে। পরে এ-বিষয়ে মামাকে প্রশ্ন করাতে তিনি কোনো জবাব দেননি। তবে আমার ধারণা ঐ গুপ্তসমিতিই হয়ত বিষ খাইয়ে মামাকে মারতে চেয়েছিল।
–আচ্ছা মাদাম, সেদিন কোনো টেবিলে খেলা হয়েছিল আর কে কোনোদিকে বসেছিলেন আমি জানতে চাই।
ঘরের কোণা থেকে একটা ছোট্ট টেবিল বার করে এনে সনিয়া বলল, এই টেবিলটা মামাকে এক ভদ্রলোক উপহার দিয়েছিলেন। ঘরের মাঝখানে ওটা পাতা হয়েছিল।
দাবার খুঁটিগুলো ভালো করে পরীক্ষা করল পোয়ারো। বলল, চমৎকার সেট।
এবার আমরা গেলাম ডঃ সাবারোনফের সঙ্গে দেখা করতে। দীর্ঘদেহী শীর্ণকান্তি পুরুষ, চোখদুটি উজ্জ্বল, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। সোনিয়া ঘর ছেড়ে চলে গেল। অভিবাদন বিনিময়ের পরে পোয়ারো বলল, ডঃ সাবারোনফ, আপনার এই বিপুল সম্পত্তি আপনি মারা যাবার পর কে পাবে?
-আমার ভাগ্নী সোনিয়া। আমি সম্প্রতি উইল করেছি, তাতে আমি আমার সমস্ত সম্পত্তিই আমার মৃত্যুর পর সোনিয়া পাবে বলে লিখেছি। তা হঠাৎ এ প্রশ্ন?
তার কারণ, দীর্ঘকাল বাদে আপনি আপনার ভাগ্নীকে দেখছেন। কিন্তু যাকে আপনি ভাগ্নী বলে দেখছেন, সে যে আপনার ভাগ্নী তার প্রমাণ কি? যাগে এসব কথা। আপনাকে একটু সতর্ক করে দিলাম আর কি? এবার সেদিনকার খেলার একটু বর্ণনা দিন।
–খেলা তো হয়নি বললেই হয়। প্রথম চাল দিয়েই তিনি মুখ থুবড়ে পড়ে যান।
–কি চাল দিয়েছিলেন তিনি?
রাই লোপেজ–চাল। অনেকেই আজকাল এই চাল দিয়ে খেলা শুরু করেন।