বেশ, কি জানতে চান বলুন?
গতকাল যা যা ঘটেছিল সবকিছুই জানতে চাই আমি।
তার ঠোঁটে একটা করুণ হাসি ফুটে উঠল–আপনার কি মনে হয় আমি সত্যি কথা বলব… না আর সমস্ত কিছুই গোপন রাখব, আমি ঠিক অতটা বোকা নই। আমি জানি এক্ষেত্রে কোনোকিছুই গোপন করা যায় না। ঐ মরা মানুষটি আমার অনেক গোপন খবর জানতেন। তিনি সেই প্রসঙ্গ ধরেই আমাকে ভয় দেখিয়েছিলেন। পলের স্বার্থে আমি তাঁর শর্ত মেনে নিয়েছিলাম। পলকে হারাবার জন্য আমি কোনোরকম ঝুঁকি নিতে চাইনি। তিনি এখন নেই। আমি এখন সম্পূর্ণ নিরাপদ। কিন্তু তা বলে এটা মনে ভাববেন না যে, আমি তাকে খুন করেছি–না, তাকে আমি খুন করিনি।
পোয়ারো মাথা নাড়িয়ে হাসল, মাদমোয়াজেল আমাকে একথা বলার দরকার ছিল না। বরঞ্চ গতকাল রাতে কি ঘটেছিল সেটা মনে করার চেষ্টা করে আমাকে বলুন।
হ্যাঁ, আমার এবার মনে পড়েছে, কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে নিয়ে ভ্যালেরি বলল–আমি তাকে অনেক টাকা দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তার রকমসকম দেখে আমার মনে হল আমার টাকার প্রতি এতটুকু লোভ নেই, তখন তার মনের মধ্যে শুধু বদ মতলব ঘুরপাক খাচ্ছিল। তিনি তখন আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে চাইছিলেন। তিনি গতকাল রাতে আমাকে নটার সময় যেতে বলেছিলেন। আমার মনডেসারে যাওয়ার কথা। আমি জায়গাটা জানতাম। এর আগে বেশ কয়েকবার সেখানে গিয়েছিলাম। আমার পাশের দরজা দিয়ে লাইব্রেরীর ঘরে ঢোকার কথা। যাতে করে চাকর-বাকররা আমাকে দেখতে না পায়।
ক্ষমা করবেন, সেদিন অত রাতে ওনার মতো লোকের কাছে আপনার যেতে ভয় করেনি মাদমোয়াজেল।
হয়তো ভয় পেয়ে ছিলাম। কিন্তু আমার দিকটাও একবার ভেবে দেখুন, আমি একেবারে একা, নিঃসঙ্গ, সেখানে যাওয়ার মতো আমার সঙ্গে কোনো লোক ছিলো না আর তখন আমি মরীয়া হয়ে উঠেছি তার সঙ্গে বোঝাঁপড়া করার জন্য। তিনি আমাকে লাইব্রেরীর ঘরে আহ্বান জানান। ওঃ! সেই নোকটা কী ভয়ংকর! এখন আমি দারুণ আনন্দিত যে, সে এখন মৃত। আমার সঙ্গে ইঁদুর বেড়ালের খেলা খেলছিলেন। তিনি আমাকে ঠাট্টা করেছিলেন, আমি তার কাছে নতজানু হয়ে দয়া ভিক্ষা করেছিলাম। আমি তাকে আমার সমস্ত অলংকার দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু সমস্তটাই বৃথা।
তারপর তিনি তার শর্ত আরোপ করতে আমি তা অস্বীকার করি। তার সম্পর্কে আমার ধারণার কথা আমি তাকে বলি। আমি তখন তাঁর ওপর ভীষণ রেগে যাই। তিনি তখন শান্ত হয়ে হাসতে থাকেন। তার শর্তটা যে কি ছিল আপনি নিশ্চয়ই তা অনুমান করতে পারছেন। আমি তখন একেবারে চুপচাপ হয়ে যাই। আমি তখন বুঝতে পারি পাথরের চোখে জল ফোঁটানো গেলেও, ঐ নিষ্ঠুর মানুষটির হৃদয় কিছুতেই টলানো যাবে না। ঠিক সেই মুহূর্তে জানলার পর্দার ওপার থেকে আচমকা একটা আওয়াজ শোনা যায়। তিনিও উঠে গিয়ে জানলার পর্দাটা তুলে দেন। বোধহয় কোথা থেকে শব্দটা আসছে দেখার জন্য। সেখানে একটা ভয়ংকর বীভৎস আকারের লোককে লুকিয়ে থাকতে দেখা যায়। সে যেন ভবঘুরের মত ঘুরে বেড়াতে বেরিয়েছেন। সে মিঃ রীডবার্নের মাথায় আঘাত করে এবং তক্ষুনি সে পড়ে যায়। ভবঘুরে লোকটি তখন তার রক্তমাখা হাতটা দিয়ে আমার একটা হাত চেপে ধরে। তখন আমি কোনোরকমে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে চলে আসি বাঁচার তাগিদে। তারপর এই বাড়িতে আলো জ্বলতে দেখে ছুটে আসি এখানে। জানলার খড়খড়িগুলো খোলা ছিল। আমি সেখান দিয়ে ভেতরে কয়েকজনকে ব্রীজ খেলতে দেখতে পাই। আমি হুমড়ি খেয়ে পড়ি ঘরের মধ্যে। তখন আমার দম আটকে আসছিল আর চোখের সামনেটা অন্ধকার হয়ে আসছিল, কোনোরকমে খুন শব্দটা উচ্চারণ করি।
মাদমোয়াজেল, আপনাকে ধন্যবাদ, আমি বুঝতে পারছি যে সেই ভয়ঙ্কর ঘটনাটা আপনার স্নায়ুকোষগুলোকে দুর্বল করে দেয়। এখন একটু সেই ভবঘুরে লোকটির কথায় আসা যাক। তার বর্ণনা দিতে পারেন আপনি? সে কি পোশাক পরেছিল, আপনি মনে করতে পারেন?
না–এত তাড়াতাড়ি ঘটনাটা ঘটে যে আমি পোশাকটা দেখার সময় পাইনি। কিন্তু একদিন না একদিন নিশ্চয়ই আমি লোকটাকে দেখতে পাব। তার মুখটা এখনও আমার মস্তিষ্কে জ্বলজ্বল করছে।
মাদমোয়াজেল, আপনাকে আর একটা প্রশ্ন করব? আচ্ছা, অন্যদিকের অর্থাৎ গাড়ি চলার রাস্তার দিকের জানলার পর্দাটাও কি ভোলা ছিলো?
পোয়ারোর এই আকস্মিক প্রশ্নের মধ্যে কি ছিলো জানি না, এই প্রথম তাকে হতভম্ব হতে দেখা গেলো। তার মুখের ওপর একটা কালো ছায়া পড়তে দেখা গেলো। মনে হল সে স্মৃতির পাতা ওল্টাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত যে, জানলার পর্দা ভোলা ছিলো না।
এটা খুবই রহস্যজনক, বিশেষ করে অপর জানলার পর্দা ওঠানো ছিল। তার জন্য অবশ্য কিছু নয়। আমি জোর গলায় বলতে পারি, এটা জানা খুব একটা দরকারী কিছু নয়। তা মাদমোয়াজেল, আপনি কি এখানে বেশ কিছুদিন থাকবেন?
ডাক্তারবাবুর ধারণা, আগামীকাল আমি শহরে ফিরে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠব। তিনি ঘরের চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন। মিস অগল্যাণ্ড চলে গেছে। এ বাড়ির লোকেরা খুব দয়ালু কিন্তু এরা তো পৃথিবীর মানুষ নন। আমি তাদের ভয় দেখিয়েছি। আমার কাছে এঁদের মতোন গৃহস্থ জীবনে আমার আসক্তি নেই। এক জায়গায় বন্ধ হয়ে থাকার মানসিকতা আমার নেই।
তার কথার মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন তিক্ততার ইঙ্গিত পাওয়া গেল।