পোয়ারো, ভ্যালেরি সেন্টক্লেয়ারের পায়ের ছাপ অনুসরণ করে এগিয়ে চলল। তারপর লোহার গেট পেরিয়ে চলে এল। তারপর তারা সেখান থেকে সবুজ ঘাসের ওপর পা রেখে কয়েকগজ পার হয়ে ডেইজিমেডের বাগানের গেটের সামনে দাঁড়াল।
মাদমোয়াজেল সেন্টক্লেয়ার ওই জানলা দিয়েই ডেইজিমেডে প্রবেশ করে থাকবেন। আমাদের খুব একটা তাড়া নেই এখন কি বলো? অতএব সামনের দরজা দিয়েই ঢোকা ভালো।
একজন চাকরাণী আমাদের দরজা খুলে দিল এবং ড্রইংরুমে নিয়ে গিয়ে বসলো। তারপর মিসেস অগল্যাণ্ডের খোঁজে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। গতকাল রাতের পর থেকে ঘরের কোনো কিছুতে যে হাত দেওয়া হয়নি তা বোঝা গেল। ফালতু এবং আজেবাজে জিনিষে ভর্তি ঘরটা। ফায়ার প্লেসে পোড়া ছাই যেমনি পড়েছিল তেমনি রয়েছে। আমি তাসগুলো টেবিলের ওপর পড়ে রয়েছে, অপর তিনজনের হাতের তাসগুলো টেবিলের তিনটে কোণে পড়ে থাকতে দেখা গেল। প্লাস্টার উঠে যাওয়া দেওয়ালের কুৎসিত অংশগুলো ঢাকা পড়ে গেছে অগল্যাণ্ডের পরিবারের অয়েল পেন্টিংয়ের আড়ালে। পোয়ারো আমার চেয়েও তীক্ষ্ণদৃষ্টি নিয়ে সেগুলি মনোযোগ সহকারে দেখছিল। মাঝে মধ্যে দু-একটা ছবির তারিফও করছিল সে।
আমি তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবারের একটি গ্রুপ ফটোর ওপর দৃষ্টিটা আটকালাম নিপুণভাবে দাড়ি গোঁফ ছাঁটা একজন ভদ্রলোক, মিনি-পাহাড় সমান উঁচু করে চুল বাঁধা একজন মহিলা, একটি মোটাসোটা ছেলে এবং মাথায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত রঙীন ফিতে দিয়ে বাঁধা দুটি ছোট ছোট মেয়ে–এই নিয়ে গ্রুপ ফটোটি তোলা। মনে মনে ভেবে নিলাম, এটা বেশ কয়েক বছর আগের তোলা, তাই খুব মনোযোগ সহকারে দেখতে লাগলাম।
ঠিক এইসময় একজন যুবতী মেয়ে এসে ঘরে ঢুকল। পোয়ারো সামনে এগিয়ে গিয়ে বলল, আপনিই তো মিস অগল্যাণ্ড। আপনাদের বিরক্ত করার জন্য আমি খুব দুঃখিত। হাজার হোক গতকাল রাতের ঘটনার পর থেকে আপনারা অল্পবিস্তর এই ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছেন। সব ব্যাপারটাই কেমন যেন অস্বস্তিকর।
এই ঘটনার পর সমস্ত কিছু কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গেছে। মেয়েটি খুব সাবধানে তা স্বীকার করল। মিস অগল্যাণ্ডকে দেখে আমার মনে হল, গতকাল রাতের সব নাটকীয় ঘটনা তার মুখ থেকে মুছে গেছে আজ। তার প্রমাণ আমি তার কথার মধ্যে পেলাম। ঘরের এই খারাপ অবস্থার জন্যে আমি দুঃখিত। চাকর-বাকররা শুধু উত্তেজিত হতে জানে বোকার মতন। বাড়ির যে আরো অন্য কিছু কাজ থাকতে পারে তা হয় তারা ভুলে যায় নয়তো ভুলে যাবার অভিনয় করে।
পোয়ারো প্রশ্ন করল, আপনারা তো গতকাল রাতে এই ঘরে উপস্থিত ছিলেন?
হ্যাঁ, রাতের আহারের পর আমরা এখানে বসে ব্রীজ খেলছিলাম, তখন
পোয়ারো বাধা দিয়ে বলল, কিছু মনে করবেন না, তা কতক্ষণ আপনারা ব্রীজ খেলেছিলেন?
মিস অগল্যাণ্ড মনে মনে চিন্তা করতে থাকল। আমি খুবই দুঃখিত যে, আমি ঠিক বলতে পারছি না। আমার অনুমান তখন রাত প্রায় দশটা হবে। ততক্ষণে আমাদের অনেকগুলো রাবারের খেলা হয়ে গিয়েছিল।
আপনি তখন নিজে কোথায় বসেছিলেন?
সে জানলার দিকে মুখ করে বলল, আমি তখন মার সঙ্গে খেলছিলাম, আর একটা নো ট্রাম্পের ডাক দিয়েছিলাম। আচমকা কোনো সতর্কবার্তা না দিয়েই জানলাটা শব্দ করে খুলে যায় আর মিস সেন্টক্লেয়ার ঘরের মধ্যে লাফিয়ে পড়ে।
তাকে আপনি চিনতে পেরেছিলেন?
আমি একটা অনুমান করেছিলাম, তার মুখটা পরিচিত।
তিনি তো এখনও এখানেই আছেন, তাই না?
হ্যাঁ, কিন্তু তিনি এখনো কারুর সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন না। তার সেই অসহায় ভাবটা এখনো কাটেনি।
সে যাহোক, আমার মনে হয় তিনি আমার সঙ্গে দেখা করবেন। তাকে গিয়ে আপনি বলবেন, মাওরানিয়ার যুবরাজ পলের একান্ত অনুরোধে আমি এখানে এসেছি।
আমার অনুমান যুবরাজের নামটা শোনার পরও মেয়েটার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না, সে আগের মতোই শান্ত এবং নিরুত্তাপ রইলেন। তবে সে কোনো মন্তব্য না করেই ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সংবাদটা পৌঁছে দেবার জন্য। এবং প্রায় তক্ষুনি ফিরে এসে জানালেন আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে। মাদমোয়াজেল সেন্টক্লেয়ার তার ঘরে।
আমরা তাকে অনুসরণ করে ওপরতলার শয়নকক্ষে গেলাম, মোটামুটি মাঝারি আকারের হাল্কা শোবার ঘর। জানলার কাছে থাকা একটা কৌচের ওপর অর্ধেক শোয়া অবস্থায় বসে ছিলেন একটি মহিলা। আমরা ঘরে প্রবেশ করামাত্রই তিনি তার ঘাড়টা ফেরালেন। সঙ্গে সঙ্গে আমার নজরে পড়ল দুটি মহিলার মধ্যে একটা অদ্ভুত মিল দেখে। মিস অগল্যাণ্ড ও মিস সেন্টক্লেয়ারের মধ্যে রঙ এবং চেহারার একটা পার্থক্য থাকলেও তাদের দুজনের মুখের মধ্যে একটা মিল দেখা গেলো। সেন্টক্লেয়ার ও মিস অগল্যাণ্ডের চাহনি বা আচরণের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। যাহোক ভ্যালেরির মধ্যে এই মুহূর্তে একটা নাটকীয় ভাব প্রকাশ পেতে দেখলাম। তিনি একটা রোমান্টিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাইছিলেন। তাঁর পা দুটি লাল টকটকে ফ্লানেলের ড্রেসিংগাউনে ঢাকা, এই পোশাকে তার ব্যক্তিত্ব, সৌন্দর্য যেন আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল।
পোয়ারোর ওপর এবার তার বড় বড় দুটি গভীর চোখের দৃষ্টি পড়ল।
আপনি কি পলের কাছ থেকে আসছেন? তার চেহারার সঙ্গে তার গলার স্বর খাপ খেয়ে যাচ্ছে।
হা মাদমোয়াজেল, তার এবং আপনার হয়ে কাজ করতে এসেছি আমি এখানে।