Site icon BnBoi.Com

এলিফ্যান্টস ক্যান রিমেমবার – আগাথা ক্রিস্টি

এলিফ্যান্টস ক্যান রিমেমবার - আগাথা ক্রিস্টি

এলিফ্যান্টস ক্যান রিমেমবার

১.১ সাহিত্যের ভোজসভা

এলিফ্যান্টস ক্যান রিমেমবার (১৯৭২) – আগাথা ক্রিস্টি
অনুবাদ : পৃথ্বীরাজ সেন

সাহিত্যের ভোজসভা

মিসেস অলিভার কেশবিন্যাস নিরীক্ষণ করতে আয়নায় নিজের দিকে তাকাতেই হঠাৎ ম্যান্টলপিসের ওপর রাখা ঘড়িটার দিকে তাকালেন কারণ তার ধারণা সেটা কুড়ি মিনিট স্লো যাচ্ছে। তিনি খোলাখুলিভাবেই স্বীকার করেন যে, তার কেশবিন্যাসের স্টাইল সবসময়েই কেমন যেন বদলে যায়। তিনি প্রায় সর্বতোভাবে চেষ্টা করেন কেশবিন্যাসের স্টাইল একইরকম রাখতে এবং ভ্রূ-লেখা বুদ্ধিদীপ্ত করে তুলতে। আঁটো করে চুলগুলো থোকায় থোকায় কুঞ্চিত করতে চেষ্টা করেছিলেন আবার কখনও বা চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে একধরনের চুলের আর্ট সৃষ্টি করার চেষ্টাও করেছিলেন। তার কেশবিন্যাস কী ধরনের হবে সেটা কোনো ব্যাপারই। নয় আজ কারণ আজ তিনি যা করতে যাচ্ছেন তা তিনি কদাচিত করে থাকেন।

তার ওয়ারড্রবের একেবারে ওপরের তাকে চারটি টুপি শোভা পাচ্ছিল। আপনি যখন বিয়েবাড়িতে যাবেন অবশ্যই টুপি ব্যবহার করতে হবে। তাই মিসেস অলিভার দুটি টুপি রেখেছেন বিবাহবাসরের জন্য চিহ্নিত। একটা হল পাখির পালকের তৈরি গোলাকৃতি ব্যান্ডবক্সের মতো, সেটা মাথার ওপর বেশ আঁটো করে বসানো যায় ফলে এর সুবিধা হল যে, হঠাৎ বৃষ্টি হলে বিবাহবাসরে যেতে গিয়ে চুল ভিজে যাওয়ার ভয় থাকে না।

অপরটি আরো বেশি সম্প্রসারিত, এ ধরনের টুপি গ্রীষ্মের কোনো এক শনিবারের অপরাহ্নে বিয়েবাড়িতে যোগ দিতে যাওয়ার পক্ষে উপযুক্ত। তাতে ফুল সিফনে লাগানো থাকে লজ্জাবতী লতা জড়ানো একটা হলুদ জালের আবরণে ঢাকা থাকে।

অপর দুটি টুপি সর্বপ্রয়োজনের উপযোগী। একটা টুপির তো তিনি নাম দিয়েছেন–কান্ট্রি হাউস হ্যাট।

মিসেস অলিভার শীতের দিনে কাশ্মীরী পুলওভার এবং গরমের দিনে পাতলা পুলওভার ব্যবহার করেন। কিন্তু তিনি পুলওভার গায়ে চাপালেও টুপি বড়ো একটা ব্যবহার করেন না। সত্যি কথা বলতে কি মফসসলে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ভোজ সারতে টুপি পড়ার দরকার হয় না।

চতুর্থ টুপিটা অত্যন্ত দামি এবং অস্বাভাবিক টেকসইও বটে। সম্ভবত তিনি কিছু সময়ের জন্য ভাবলেন কারণ সেটা অত্যন্ত দামি।

একটু দোটানায় পড়ে তাকে সহযোগিতার জন্য হাঁক দিলেন। মরিয়া ছুটে এলো, পরামর্শ দেবার জন্য তাকে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

মরিয়া জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনার সুন্দর স্মার্ট টুপিটা কি আপনি পড়তে যাচ্ছেন?

এই কথার উত্তরে হ্যাঁ বলেছিলেন মিসেস অলিভার এবং জানতে চেয়েছিলেন এইভাবে কিংবা অন্য কীভাবে পড়লে ভালো দেখাবে তাকে।

মরিয়ার দিক থেকে সাহায্যের আশায় বেশ কয়েকবার ট্রায়াল দেবার পর টুপিটা মাথার থেকে সরিয়েছিলেন। উলের পোশাক পরিহিতা মিসেস অলিভারের মাথায় টুপিটা চাপিয়ে সামান্য একটু আধটু এদিক ওদিক ঘুরিয়ে মরিয়া বলেছিল, আপনাকে এরকম স্মার্ট আগে কখনও দেখা যায়নি।

তাকে কিছু বলার সুযোগ দিলেই সব সময়েই তার পছন্দে সায় দেয়, তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে, এই জন্যই মরিয়াকে খুব পছন্দ করেন।

মধ্যাহ্নভোজে বক্তৃতা দিতে যাচ্ছেন, মরিয়া জিজ্ঞাসা করায় মিসেস অলিভার যেন দারুণ ভয় পাওয়ার মতন চমকে উঠলেন এবং বললেন, না, অবশ্যই নয়। এবং বললেন, তুমি ত জানো আমি কখনও বক্তৃতা দিই না।

মরিয়া ভেবেছিল, সাহিত্যিকদের মধ্যাহ্নভোজে সবাই যা করে থাকেন আপনিও তাই করতে যাচ্ছেন। ১৯৭৩ সালের সব বিখ্যাত লেখকরা কিংবা যে বছরেই হোক না কেন আমরা এখন তাদের কাছে পেয়েছি।

মিসেস অলিভার বললেন, আমি কোনো বক্তৃতা দিতে চাই না, যাঁরা বক্তৃতা দিতে পছন্দ করে থাকেন তারাই দেবেন, আর তারা আমার থেকে ভালোই বক্তা।

মরিয়া বলল–আমি নিশ্চিত, আপনি এতে ঠিক মতো মন দিলে ভালো বক্তৃতা দিতে পারবেন।

মিসেস অলিভার বললেন, না, আমার বলা উচিত নয়, আমি জানি কী করতে পারি, এবং এও জানি আমি কী করতে পারি না। আমি বক্তৃতা দিতে পারি না কারণ স্নায়ু দুর্বল হয়ে ওঠে আমার, সম্ভবত তখন আমি তোতলাতে থাকি কিংবা একই কথা দুবার বলে ফেলি, আমি চিন্তায় পড়ে যাই তখন আমি কেবল অপমান বোধ করি না, সম্ভবত তখন আমাকে ভীষণ অপমানিত দেখায়। বক্তৃতা লিখে নিয়ে গিয়ে পড়া যায় আমি সেটাও পারি, কিন্তু আমি সেটাকে বক্তৃতা বলে মনে করি না।

মরিয়া বললেন, বেশ, আশাকরি সব কিছুই ভালোভাবে সম্পন্ন হবে। তবে আমি এও নিশ্চিত যে, মধ্যাহ্নভোজ দারুণ সুন্দর হয়ে উঠবে।

বিমর্ষ গলায় মিসেস অলিভার বললেন, অনেক অনেক ভালো মধ্যাহ্নভোজ।

মুখে প্রকাশ না করে তিনি ভাবলেন যে, আমি নরকে যাচ্ছি? একটু সময়ের জন্য নিজের মনে চিন্তা করলেন কারণ কোনো কিছু করার পর ভাবার থেকে কিছু করার আগে ভেবে দেখাটাই বেশি পছন্দ করেন তিনি।

তিনি নিজের মনে বললেন, স্টোভের ওপর জ্যাম উতলে পড়ার গন্ধ পেয়ে সে তখন ছুটে গিয়েছিল রান্নাঘরে। আমি দেখতে চাই সেটা কী রকম অনুভূত হয়, সব সময়েই সাহিত্যবাসরের মধ্যাহ্নভোজে আমি আমন্ত্রিত হয়ে থাকি, বা সে রকম ধরনের কিছুতে আর আমি কখনও যাই না।

সুন্দর মধ্যাহ্নভোজের শেষ পদে এসে মনে মনে সন্তোষ প্রকাশ করলেন মিসেস অলিভার যে, তাঁর প্লেটে তখনও ডিমের শ্বেতাংশের সঙ্গে চিনি মিশিয়ে মিষ্টি খাবারের কিছু অবশিষ্ট পড়েছিল। মিষ্টি খাবার তার খুব পছন্দ, মধ্যাহ্নভোজের শেষ পাতে এটা খুবই সুস্বাদু। সেটা বেশ তৃপ্তি সহকারে খেতে গিয়ে ভাবছিলেন কেউ যখন মাঝ বয়সে যায় এই মিষ্টি খাবারের ব্যাপারে তাকে খুব সতর্ক থাকতে হবে, বিশেষ করে দাঁতের ব্যাপারে। তার দাঁতগুলো দেখতে সুন্দর সাদা ঝকঝকে কিন্তু এটা সত্যি আসল জিনিসের মতন হলেও ওগুলো আসল দাঁত নয়। বরং কুকুরের দাঁতগুলো সব সময়ে তার মনে হয় সত্যিকারের হাতির দাঁতের মতন, কিন্তু তার ধারণা মানুষের দাঁতগুলো নকল প্লাস্টিকের নেহাতই হাড় বৈ কিছু নয়। যাইহোক লজ্জাজনক কোনো ব্যাপারে জড়িয়ে না পড়াই ভালো যেমন লবণাক্ত কাজুবাদাম কিংবা চকোলেটে লোভ না করাই ভালো, একটা পরিপূর্ণ তৃপ্তিতে শেষ গ্রাসটা মুখভর্তি করে খেলেন। বেশ ভালো মধ্যাহ্নভোজ বলতে হয়।

মধ্যাহ্নভোজ যেমন উপভোগ করলেন সেই সঙ্গে উপস্থিত অতিথিদের সঙ্গও তেমন ভাবে উপভোগ করলেন। শুধুমাত্র মহিলা লেখিকাদের সংবর্ধনা জানানোর জন্যই এই মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন–কিন্তু সৌভাগ্যবশত সেটা আর কেবল মহিলা লেখিকাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল না। সেখানে অন্য লেখক সমালোচক এবং পড়ুয়ারাও উপস্থিত ছিল, দু-জন আকর্ষণীয় পুরুষের মাঝে বসেছিলেন মিসেস অলিভার। একজন হল এডউইন অ্যাবাইন যাঁর কবিতা তিনি সবসময়ে উপভোগ করে থাকেন, সাহিত্যে তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারও বিরাট। এবং তিনি দারুণ আতিথ্যপরায়ণ ব্যক্তি। বিদেশ ভ্রমণে তার অনেক আতিথেয়তার অভিজ্ঞতা আছে। শুধু তাই নয় রেস্তোরাঁ এবং ভালো ভালো খাবারেও যথেষ্ট আগ্রহী তিনি। তারা দু-জনে অত্যন্ত খুশি মনে খাবারের প্রসঙ্গে আলোচনা করলেন সাহিত্যের আলোচনা দূরে সরিয়ে রেখে।

অপরজন হলেন স্যার ওয়েসলি কেল্ট, মধ্যাহ্নভোজের একজন ভালো সঙ্গী। তিনি তার বই-এর প্রসঙ্গে অনেক সুন্দর সুন্দর কথা বললেন। কিন্তু এমন কোনো মন্তব্য করলেন না যাতে মিসেস অলিভার অসন্তুষ্টি বোধ করেন, এই কারণেই মিসেস অলিভার তাকে তার পক্ষের একজন বলে মনে করলেন। মিসেস অলিভার মনে করেন, পুরুষদের প্রশংসা সবসময়ই গ্রহণযোগ্য। এ ব্যাপারে মহিলারাই সাধারণত উৎসাহিত হয়ে থাকে। এমন কিছু কিছু কথা মহিলারা লিখে থাকে তাকে। এক এক সময়ে দেশের অনেক দূর থেকে কিছু ভাবপ্রবণ যুবকও চিঠি লেখে তাকে। গত সপ্তাহে তিনি তার এক ভক্ত যুবকের কাছ থেকে একটা চিঠি পান যার শুরুটা ছিল : আপনার বই পড়ে আমার মনে হয়েছে, আপনি নিশ্চয়ই মহৎ মহিলা। দ্য সেকেন্ড গোল্ডফিশ, বইটা পড়ার পর ছেলেটি তার সাহিত্য সম্পর্কে প্রচণ্ড উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। যা তিনি মনে করেন সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত। বিনয়ীর সম্মান পাওয়ার যোগ্য তিনি কিনা জানেন না কারণ তার ধারণা, যে সব গোয়েন্দা কাহিনি তিনি লেখেন সেই নিরিখে খুব ভালো কিছু কাহিনি আছে অন্য সব কাহিনির থেকে অনেক অনেক বেশি ভালো হয়তো বরং তাতে কেউ যদি তাকে একজন মহৎ মহিলা বলে আখ্যা দেয় তাতে তিনি কোনো যুক্তি খুঁজে পান না। এবং তিনি একজন ভাগ্যবতী মহিলা যিনি কিছু কাহিনি লিখে তার পাঠকদের কাছে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছেন ভালোভাবে, এবং তিনি মনে মনে ভাবলেন একেই বলে হয়তো চমৎকার সৌভাগ্য।

অবশেষে সব কিছু বিবেচনা করে মনে হয় তিনি তার ভাগ্য পরীক্ষায় বেশ ভালোভাবেই উত্তীর্ণ হতে পেরেছেন। এখন তারা কফির উদ্দেশ্যে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে যেখানে আপনি আপনার সঙ্গী বদল করতে পারেন। এবং নতুন সঙ্গীর সঙ্গে খোসগল্প করতে পারেন। মিসেস অলিভার ভালোভাবেই জানেন এখন মহিলারা যেখানে জমায়েত হবে সেখানে তাকে আক্রমণ করবে এবং এধরনের আক্রমণ মানে নক্কারজনক প্রশংসা, এ-সব ক্ষেত্রে তিনি সব সময় সঠিক উত্তর দেবার পরে নিজেকে ভীষণ অনভিজ্ঞ বলে মনে করেন কারণ তিনি জানেন আপনার দেবার মতন সত্যিকারের সঠিক উত্তর সেই। সেই আলোচনা এমনভাবে চলে যেন মনে হয় বিদেশ ভ্রমণে ভাষার প্রকাশভঙ্গি সহ একটা ভ্রমণসঙ্গী জাতীয় বই সঙ্গে নিয়ে যাওয়া।

একজন প্রশ্ন করলেন, আপনার বই পড়তে কি দারুণ ভালো লাগে আমার, এবং আরও মনে হয় কী রকম বিস্ময়করই না সেগুলো।

লেখিকা উত্তরে বললেন, এটা আপনার অত্যন্ত দয়া আমি যে কী খুশি

পরবর্তী প্রশ্ন করলেন, আপনার বোঝা উচিত আপনার সঙ্গে মিলিত হবার জন্য মাসের পর মাস ধরে অপেক্ষা করছি এটা তো সত্যিই বিস্ময়কর।

ঠিক, এইভাবেই চলে তাদের আলোচনার গতিপথ। সব কথাই বলতে হবে আপনার বই সম্পর্কে কিংবা অন্য কোনো লেখিকার বই সম্পর্কে। এর বাইরে আপনি একটি কথাও বলতে পারবেন না। কিন্তু মিসেস অলিভার বেশ ভালোভাবেই জানেন তার সঠিক ক্ষমতা। সেই যখন তিনি বিদেশের দূতাবাসে ছিলেন তার বন্ধু তার সামনে কয়েকটি প্রশ্ন রেখেছিলেন।

আলবারটিনা বললেন, আপনার সব কথা আমি শুনেছি, এবং তিনি আরও বলেছিলেন সংবাদপত্রের সেই তরুণ প্রতিনিধিটি আপনার সাক্ষাৎকার নেবার সময় আপনি তাকে কী বলেছিলেন আমি তাও শুনেছি। আপনার ভালো কাজের জন্য যে গর্ব হওয়া উচিত ছিল সেটা আপনি দেখাতে পারেননি তাই না! আপনার তখন বলা উচিত ছিল গোয়েন্দা গল্প আর যাঁরা লেখেন তাদের থেকে অনেক ভালো আমি লিখি, হ্যাঁ আমি ভালো লিখি।

সেই মুহূর্তে মিসেস অলিভার বলেছিলেন, না–কিন্তু আমি সেরকম নই।

না, না বলবেন না, আমি সেরকমই নই। আপনি অবশ্যই বলবেন আপনি খুব ভালো লেখেন। আপনি যদি এই মুহূর্তে মনে করেন যে, আপনি পারেন না তখন আপনাকে বলতেই হবে যে, আপনি পারেন।

মিসেস অলিভার আলবারটিনাকে বললেন, যে সব সাংবাদিকরা আসে তাদের তুমি সাক্ষাৎকার নিতে পারো, কারণ এ কাজটা তুমি বেশ ভালোভাবেই করতে পারো দেখছি। এবং তুমি আমার হয়ে এদের সাথে ভাব করো আর আমি দরজার আড়ালে থেকে শুনব।

আলবারটিনা বললেন, আমি তা করতে পারি এবং সেটা একটা বেশ কৌতুক হবে কিন্তু তারা যে জানবে আমি আপনি নই, আপনার মুখ তারা চেনে, সেই জন্যেই বলছি বরং আপনি নিজেই ওকে থামিয়ে দিয়ে বলবেন হা হা জানি অন্যদের থেকে অনেক ভালো লেখা আমি লিখি। সবাইকে আপনার বলতে হবে এবং সেটা তাদের জানা উচিত। তা না করে সেখানে বসে যদি আপনাকে বলতে শুনি আপনি নিজে ভালো লেখার জন্য গর্ববোধ না করে উলটে বিনয় দেখিয়ে বলছেন, না, না আমি অত ভালো লেখিকা নই, অসম্ভব বেমানান লাগবে সেই কথাগুলো।

মিসেস অলিভার ভাবলেন এ যেন নবাগতা অভিনেত্রীকে কি করে অভিনয় করতে হয় শেখাচ্ছে এবং পরিচালক তাকে তার নির্দেশ দেবার পক্ষে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ বলে ধরে নিলো। যাইহোক এখানে খুব বেশি অসুবিধা হবে না, টেবিলে যে কয়জন মহিলা অপেক্ষা করবে তাদের কাছে হাসি মুখে এগিয়ে যাবেন তিনি এবং খুব সুন্দর করে বলবেন আপনাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। এমনকি কারোর বই-এর মাধ্যমে যে কেউ মানুষকে জেনে আনন্দ পেতে পারে, এ যেন কথামালার বাক্সে হাত ঢুকিয়ে কতকগুলো দরকারি শব্দ তুলে নেওয়া যা আগেই রুদ্রাক্ষের মালার মতন গাঁথা হয়ে গেছে।

তার চোখ টেবিলের চারপাশে ঘোরাফেরা করছিল কারণ তিনি তার কয়েকজন বন্ধু ও ভক্তদের সেখানে দেখেছিলেন। একটু দূরে মায়রিন গ্র্যান্টকে দেখতে পেলেন। দারুণ কৌতুকপ্রিয় তিনি। এবং বিপদের সময় মিসেস অলিভার প্রায়ই নিজের মতন মনে ভেবে থাকেন। ককটেল পার্টিতে এবং সাহিত্যিকদের সভায় কখনও তিনি গিয়ে থাকেন। এখানে যে কোনো মুহূর্তে বিপদ এসে যেতে পারে। যেমন–আপনি যাকে মনে রাখতে পারেননি তিনি ঠিক আপনাকে মনে রেখেছেন, অথবা আপনি হয়তো কারোর সঙ্গে কথা বলতে চান না, কিন্তু তাকে দেখে আপনিও এড়িয়ে যেতে পারবেন না। এক্ষেত্রে তার সামনে উভয় সংকট দেখা দেবে।

একজন ভারিক্কি চেহারার সাদা দাঁতওয়ালা ভদ্রমহিলা মিসেস অলিভারের সাথে পরিচিত হতে চান।

উচ্চৈঃস্বরে তিনি মিসেস অলিভারকে বললেন, আজ আপনার সাথে দেখা হওয়াতে আমার কী আনন্দ। আপনার বই আমার খুব প্রিয়। আবার আমার ছেলেরও। এবং আমার স্বামী ভ্রমণে গেলে আপনার দুটো বই সঙ্গে নেবার জন্য চাপ দেবে।

মিসেস অলিভার ভাবলেন ভদ্রমহিলাটি আমার মনের মতো নয়।

একজন পুলিশ অফিসার ঠিক যেমন করে থাকে সেইভাবে তিনি নিজেকে মহিলার হাতে সঁপে দিলেন। এবং তার নতুন বন্ধু এক কাপ কফি গ্রহণ করে তার সামনে আর এক কাপ কফি রাখলেন।

মিসেস অলিভারকে নতুন বন্ধুটি বললেন, আপনি নিশ্চয়ই আমার নাম জানেন না, আমি মিসেস বার্টন কক্স।

মিসেস অলিভার হ্যাঁ বলে বিহ্বল দৃষ্টিতে ভাবতে লাগলেন যে, উনিই কি গল্প উপন্যাস লেখেন? তাঁর সম্পর্কে সত্যিই তিনি কিছু খেয়াল করতে পারছেন না, তবুও তার মনে হয় তার নাম তিনি শুনেছেন, একটা ক্ষীণ ভাবনা তার মনে এলো। রাজনীতির ওপর কোনো বই না ফিকসন-না কৌতুক? এমনকি অপরাধমূলক লেখাও নয়। কিংবা বুদ্ধিদীপ্তির সঙ্গে রাজনীতির গাঁটছাড়া? এবং সেটা অবশ্যই সহজ হতে পারে এই ভেবে স্বস্তি পেয়ে মিসেস অলিভার নিজের মনেই বললেন ওঁর সঙ্গে কথা বলা যায়। তারপর তিনি বললেন, কেমন মজার বলুন

মিসেস বার্টন কক্স বললেন, শুনে সত্যি খুব আশ্চর্য হবেন আমি যা বলতে যাচ্ছি। আমি আপনার বই পড়ে অনুভব করেছি যে, আপনি কত সহানুভূতিশীল এবং মানুষের স্বভাব কত সহজেই উপলব্ধি করতে পারেন এবং আমার ধারণা আমি এমন একটা প্রশ্ন করতে যাচ্ছি তার উত্তর যদি কেউ না পারেন আপনি ঠিক পারবেন।

মিসেস অলিভার বললেন, আমি তা মনে করি না। সঙ্গে সঙ্গে ভাববার চেষ্টা করলেন তিনি যে অত্যন্ত অনিশ্চিত বোধ করছেন তা একটা ছোট্ট কথায় কীভাবে তাকে বোঝানো যায়।

মিসেস বার্টন কক্স তার কফিতে চিনির একটা ডেলা ফেলে সেটা এমনভাবে চিবুলেন ঠিক যেন মাংসাশী হাড় চিবুচ্ছেন, মিসেস অলিভার আনমনে ভাবলেন তার দাঁতগুলি সম্ভবত হাতির দাঁতের মতন, হাতির দাঁতের কর্মক্ষমতা বিরাট।

মিসেস বার্টন কক্স তখন বলছিলেন–এখন প্রথমেই আমি স্থির নিশ্চিত যে আমার অনুমান ঠিক এবং আমি জিজ্ঞাসা করতে চাই আপনার একটি ধর্মকন্যা আছে কিনা এবং সেই ধর্মকন্যাটির নাম কি সিলিয়া র‍্যাভেন্সক্রফট?

কতকটা আনন্দের আতিশয্যে বিস্মিত হয়ে তিনি বলে উঠলেন, তার অনেক ভালো ভালো ধর্মকন্যা আছে এবং ধর্মপুত্র সেই ব্যাপারে। তাকে এখন স্বীকার করতেই হবে যে বার্ধক্যের ভার পড়ছে তার দেহমনে। ফলে সেই সময়ে তিনি সবাইকে মনে রাখতে পারতেন না। একজনের যা কর্তব্য হয়ে থাক তিনি তাই পালন করে গেছেন, আগের বছরগুলোতে খিস্টমাসের দিনে ধর্ম সন্তানদের জন্য খেলনা পাঠানো, তাদের ও তাদের অভিভাবকদের কাছে যাওয়া, ছেলে ও মেয়েদের স্কুল থেকে নিয়ে আসা এবং জীবনের সেই সেরা দিন একুশতম জন্মদিনে যা ধর্মমা-র অবশ্যই করা উচিত। তিনি বেশ জাঁকজমক সহকারেই পালন করে এসেছেন, তা ছাড়া তাদের বিবাহের সময় অনুরূপ উপহার, আর্থিক সাহায্য এবং আশীর্বাদ জানিয়ে এসেছেন। সেইসব ধর্মর্সন্তানরা যে যার কর্মস্থলে অনেক দূরে চলে গেছে এবং একটু একটু করে তারা তার জীবন থেকে সরে গেছে, যদি তাদের সামনে দেখতে পান আপনি নিশ্চয়ই খুব খুশি হবেন? কিন্তু আপনাকে ভাবতে হবে যে, শেষ কবে আপনি তাদের দেখেছিলেন এবং তারা কাদের কন্যা ছিল এবং আপনি তাদের ধর্মমা হওয়ার সূত্রটাই বা কী ছিল?

সিলিয়া র‍্যাভেন্সক্রফট স্মরণ করার চেষ্টা করলেন এবং বললেন মিসেস অলিভার, হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই।

তার মানে এই নয় যে সিলিয়ার কোনো ছবি তার চোখের সামনে ভেসে উঠল অথবা একেবারে ছোটোবেলার কোনো ঘটনার কথা। কিংবা খ্রিস্টের নামে নামকরণের সময়। ও হ্যাঁ সিলিয়ার খ্রিস্টিয়ান নামকরণের সময় তিনি গিয়েছিলেন। উপহার স্বরূপ একটা সুন্দর কুইন অ্যানি মার্কা রূপার ছাঁকনি দিয়েছিলেন, যাতে ভালোভাবে দুধ ছাঁকা যেতে পারে অথবা কখনও যদি অর্থের প্রয়োজন হয় ধর্মকন্যা সেটা বিক্রিও করতে পারে। কুইন অ্যানির সেই ছাঁকনিটার কথা তিনি মনে করতে পারেন-সতেরোশো এগারো হবে। ব্রিটানিয়ার ছাপ ছিল তাতে। অবাক লাগে কত সহজেই রূপার কফি পেয়ালা বা ছাঁকনির কথা স্মরণ করা যায় কিন্তু যে সন্তানটিকে উপহার দেওয়া হয় তাকে ঠিক মনে রাখা হয় না। তিনি আবারও বললেন, আমার ধারণা বহুদিন সিলিয়াকে আমি দেখিনি।

মিসেস বার্টন কক্স বললেন, ও এখন অবশ্যই আবেগপ্রবণ মেয়ে হয়ে উঠেছে। আমি বলতে চাইছি যে, সম্প্রতি ও ওর ধারণা পালটে ফেলেছে কারণ ও খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব ভালো ফল করেছে কিন্তু আমার মনে হয় ওর রাজনৈতিক ধারণা আজকের দিনের সব তরুণ তরুণীদেরই মতো রাজনৈতিক ধারণা জন্মাচ্ছে।

মিসেস অলিভার বললেন, রাজনীতি নিয়ে আমি খুব বেশি মাথা ঘামাই না কারণ তার কাছে রাজনীতি সবসময়েই অভিশাপ বলে মনে হয়।

দেখুন আমি আপনার ওপর সম্পূর্ণ আস্থা রেখেই এমন একটা কিছু বলতে যাচ্ছি যার সঠিক উত্তর আমি আপনার কাছ থেকে জানতে চাই এবং আমি নিশ্চিত যে, আপনি তাতে কিছু মনে করবেন না। আমি অনেকের কাছ থেকে শুনেছি আপনি কতো দয়ালু এবং কেমন স্বতঃস্ফূর্তভাবে সব কিছু সম্পন্ন করে থাকেন।

মিসেস অলিভারের মনে বিস্ময় জাগছে কারণ যদি উনি টাকা ধার চেয়ে বসেন আমার কাছ থেকে এবং তিনি এও জানেন যে, অনেকে সাক্ষাৎকার শুরু করেন প্রথমে এইরকম মনভেজানো কথাবার্তা বলে।

দেখুন, আমার কাছে এটা একটা বিরাট মুহূর্তের ব্যাপার। কারণ সত্যিই আমি এমন একটা কথা ভাবি যা আমাকে অবশ্যই খুঁজে বার করতে হবে। ভাবুন সিলিয়া বিয়ে করতে যাচ্ছে অথবা সিলিয়া আমার ছেলেকে বিয়ে করতে যাচ্ছে, ডেসমন্ডকে।

মিসেস অলিভার বললেন, তাই বুঝি?

বর্তমানে অন্তত সেটা তাদের ধারণা। মানুষ সম্পর্কে প্রত্যেকেই জানতে চায় এবং সেটা আমি ভীষণভাবে জানতে চাই। এটা এমন একটা অস্বাভাবিক জিনিস যা যে কোনো মানুষকে জিজ্ঞেস করা যায় না। কারণ আমি বলতে চাই যে, একজন আগন্তুকের কাছে জিজ্ঞেস করা, না তা আমি পারব না। বরং আমি মনে করি না, আপনি একজন আগন্তুক প্রিয় মিসেস অলিভার।

মিসেস অলিভার ভাবলেন যে, আমার ইচ্ছা আপনি করুন। কারণ তার স্নায়ু দুর্বল হতে চলেছে। কিন্তু তার উৎকণ্ঠা সিলিয়া অবৈধ সন্তানের জন্ম দেয়নি তো অথবা একটা অবৈধ সন্তানের জন্ম দিতে যাচ্ছে এবং তিনি কি এই ব্যাপারে কিছু জানতে চান বিস্তারিতভাবে? এবং সেটা খুবই বেমানান হবে। অপর পক্ষে মিসেস অলিভার ভাবলেন যে, পাঁচ-ছ বছর হল আমি ওকে দেখিনি এবং ওর বয়স এখন পাঁচশ কিংবা ছাব্বিশ হবে নিশ্চয়ই। সুতরাং খুব বলা সহজ আমি কিছুই জানি না।

সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লেন মিসেস বার্টন কক্স যেন দেখে মনে হল নিঃশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে তার।

আমি চাই আপনি আমাকে বলুন, কারণ আমি নিশ্চিত হই আপনি জানেন নতুবা আপনার বেশ ভালো ধারণা আছে কী করে সেই সব ঘটল। আচ্ছা বলতে পারেন ওর মা কি ওর বাবাকে খুন করেছিল কিংবা ওর বাবা ওর মাকে খুন করে?

মিসেস অলিভার যা কিছুই অনুমান করে থাকুন না কেন মিসেস বার্টন কক্সের দিকে অবিশ্বাস্যভাবে স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন। কিন্তু আমি তা জানি না–একটু থামলেন আমি বুঝতে পারছি না ব্যাপারটা আমি বলতে চাইছি কোনো কারণে

প্রিয় মিসেস অলিভার আপনি নিশ্চয়ই জানেন। মানে আমি বলতে চাই এমন ধরনের একটা বিখ্যাত কেন…এবং অবশ্যই আমি জানি এটা অনেকদিন আগের ঘটনা, মনে হয় অন্তত দশ বারো বছর আগেকার তো হবেই। সেই সময় কিন্তু দারণ আলোড়ন তুলেছিল। আমি নিশ্চিত যে আপনি মনে রেখেছেন এবং আপনার অবশ্যই মনে রাখা উচিত।

মিসেস অলিভারের স্নায়ুকোষগুলো তখন বেপরোয়াভাবে কাজ করতে শুরু করে দিয়েছিল কারণ সিলিয়া ছিল তাঁর ধর্মকন্যা এবং সেটা খুবই সত্য। সিলিয়ার মা ছিল মলি প্রেস্টন গ্রে এবং সে ছিল তার বন্ধু যদিও ঠিক অন্তরঙ্গ নয়। আর হ্যাঁ অবশ্যই একজন সৈনিককে বিয়ে করেছিল। সে কী যেন নাম ছিল তার–হ্যাঁ স্যার অমুক র‍্যাভেন্সক্রফট। নতুবা কোনো এক রাষ্ট্রদূত? না, অস্বাভাবিক এ সব জিনিস কেউ কখনও মনে রাখতে পারে না। শুধু তাই নয় তিনি যে নিজে মলির বিবাহবাসরে তার সহচরীরূপে উপস্থিত ছিলেন সে কথাও মনে করতে পারছেন না। তিনি ভেবেছিলেন, তার মনে আছে, যেমন গাউস চ্যাপেলে স্মার্ট বিবাহ অনুষ্ঠান, অথবা সে ধরনের একটা কিছু। যে কেউ সেটা ভুলে যেতেই পারে, কিন্তু তারপর বেশ কয়েক বছর তাদের সঙ্গে তার আর দেখা হয়নি। হয়তো কোথাও যেন চলে গিয়েছিল তারা মধ্যপ্রাচ্যে? পারসিয়ায়? ইরাকে? একসময়ে ইজিপ্ট? অথবা মালয়ে? যদি কদাচিৎ তারা ইংল্যান্ডে বেড়োতে আসত তিনি আবার দেখা করতেন তাদের সঙ্গে। কিন্তু সে তো ছবি তোলার মতন এবং সেই ভোলা ছবির দিকে তাকিয়ে থাকার মতন। যদি কোনো লোককে অস্পষ্টভাবে মনে রাখলে পরে এবং সেই মনে রাখার ব্যাপারটা ধীরে ধীরে যে ভাবে মন থেকে মুছে যায় এবং সত্যিই পরবর্তীকালে তাদের চেনা বা মনে রাখা যায় না কে ছিল সে। আর আশ্চর্য তিনি এখন মনে করতে পারেন না, স্যার র‍্যাভেন্সক্রফট ও লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট ওরফে মলি প্রেস্টন গ্রে তার জীবনে প্রবেশ করেছিল কিনা। কই সে রকম তার কিছু মনে হয় না। কিন্তু আশ্চর্য তারপর…তখনও তাঁর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকেন মিসেস বার্টন কক্স। তাঁর মনে রাখার অক্ষমতা দেখে মিসেস বার্টন কক্স হতাশ হয়ে উঠেছিলেন। আর সেই ঘটনার কারণই বা কী থাকতে পারে তাও তিনি ভেবে পান না।

খুন? আপনি বলতে চাইছেন মানে–একটা দুর্ঘটনা? ওহো না! দুর্ঘটনা নয়, সমুদ্রের ধারের বাড়িগুলোর মধ্যে একটিতে তারা থাকত। অথবা আমার মনে হয়, কর্নওয়াল যাইহোক সেখানে কাছাকাছি কোথাও পাহাড় ছিল। এবং সেখানেই তাদের একটা বাড়ি ছিল এবং সেই দুর্গম পাহাড়ের এই পাশে একদিন দুজনকে পাওয়া যায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায়। কিন্তু এই থেকে পুলিশ সত্যিই বুঝতে পারে না যে, হয় প্রথমে স্ত্রী তার স্বামীকে গুলি করে এবং তারপর সে নিজেকে গুলিবিদ্ধ করে অথবা স্বামী তার স্ত্রীকে গুলি করে পরে সে নিজেই নিজেকে গুলি করেছিল কিনা। কিন্তু তারা কতকগুলো প্রমাণ ও তথ্য যাচাই করে দেখে বুঝলেন যে, সেগুলোর কয়েকটি হল বুলেট আর অন্য আরও কয়েকটি জিনিস কিন্তু সেই সব জিনিস দিয়ে সেই হত্যার কিনারা করা খুবই দুঃসাধ্য ব্যাপার। তারা এও ভাবল হয়তো দু-জনে যুক্তি করে আত্মহত্যা করে থাকবে–সেই বিচারে কি রায় বেড়িয়েছিল মনে নেই। সেটা একটা ব্যর্থ অভিযান বা ওই ধরনের কিছু একটা হতে পারে। এবং প্রত্যেকেই অবশ্যই জানত যে, এর একটা অর্থ ছিল আর এই জোড়া খুনকে কেন্দ্র করে বহু গল্প লোকের মুখে মুখে আলেচিত হত

মিসেস অলিভার বললেন, সম্ভবত সই মনগড়া এমনকি তিনি একটা গল্পও মনে করার চেষ্টা করলেন, যদি পারেন।

ওহো মনে পড়েছে হয়তো মনে পড়ছে। তবে কিন্তু এটাও ঠিক যে, জোর করে সেটা বলা শক্ত আমি জানি। হয়তো সেদিন অথবা আগের দিন ওদের দুজনের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ হয়–ফলে অন্য আর একজন পুরুষের কথা ওঠে, এবং তারপর অবশ্যই স্বাভাবিক কারণেই অন্য আর এক নারীর প্রসঙ্গ উঠে থাকবে সেই ঝগড়ার মাঝে, এবং কেউ কখনও জানতেও পারবে না যে, ওদের ঝগড়া কী ভাবে শুরু হয়েছিল। আমার ধারণা ব্যাপারটা বেশ ভালোভাবেই গোপন করা হয়, কারণ জেনারেল র‍্যাভেন্সক্রফটের পদমর্যাদা ও সামাজিক মর্যাদা ছিল অনেক উঁচুতে। এবং আরও শোনা যায় যে, সেই যে, সেই বছরেই একটা নার্সিংহোমে সে ভর্তি হয় এবং সেখানেই হয়তো সে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে থাকবে যার পরিণাম সে সত্যিই জানত না, সে কী করতে যাচ্ছে?

দৃঢ়স্বরে মিসেস অলিভার বললেন, সত্যিই আমি বিস্মিত। এবং অবশ্যই আমার বলা উচিত যে, এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না, এবং আপনিই প্রথম উল্লেখ করলেন বলেই এখন আমার একটু মনে পড়ছে যেন এ ধরনের একটা কেস হয়েছিল বটে তবে নামগুলো আমি খেয়াল করতে পারি এবং এই লোকগুলোকেও আমি চিনি। কিন্তু তারপরে ও ব্যাপারে কী ঘটেছিল সে খবর আমার জানা নেই এবং সত্যিই মনে করি না এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ধারণা আমার আছে যে…

মিসেস অলিভার ভাবলেন যে, তিনি সত্যিই যথেষ্ট সাহসের সঙ্গেই কথাগুলো বলতে পেরেছেন। অবার মিসেস বার্টন কক্সের দিকে তাকিয়ে তৎক্ষণাৎ চিন্তা করলেন এ সব প্রশ্ন করার ধৃষ্টতা আপনার কি করে হল কে জানে!

এই ঘটনা অত্যন্ত জরুরি বলেই আমার জানা উচিত, বললেন মিসেস বার্টন কক্স। তখন তার চোখ দুটো মার্বেল পাথরের মতো কঠিন হয়ে উঠতে দেখা গেল এবং বললেন, দেখুন এটা বিশেষ জরুরি কারণ আমার পুত্র সিলিয়াকে বিয়ে করতে চায় বলে।

মিসেস অলিভার আর বললেন, আমি কিছুই শুনিনি কখনও। তাই আমার আশঙ্কা, আমি আপনাকে হয়তো সাহায্যে করতে পারব না।

কিন্তু আপনি অবশ্যই জানেন মানে আমি বলতে চাই যে, যখন আপনি এই রকম চমৎকার গল্প লেখেন তখন অপরাধ সম্পর্কে আপনি সব কিছুই জানেন। এবং আপনি এও জানেন কে অপরাধ করে থাকে আর কেনই বা তারা করে থাকে এবং আমার বিশ্বাস যে, সব ধরনের মানুষই সেই সব কাহিনির আড়ালে থাকে যে সব কাহিনি তারা আপনাকে হয়তো বলে থাকবে। বললেন মিসেস বার্টন কক্স।

আমি কিছুই জানি না এবার বেশ রুক্ষস্বরেই বললেন মিসেস অলিভার।

অথচ দেখুন, সত্যি কথা বলতে কী, এ ব্যাপারে কাকেই বা জিজ্ঞাসা করতে যাব? এবং কেউ জানেও না ব্যাপারটা। আমি বলতে চাইছি মানে আজকের দিনে কেউ পুলিশের কাছে যেতে পারে না। এবং আমার মনে হয় না যে, তারা আপনাকে কিছু বলবে। কারণ হিসাবে বলা যেতে পারে তারা নিশ্চয়ই এটা গোপন করার চেষ্টা করবে। অথচ আমি মনে করি যে, সত্যকে অস্বীকার করা অত্যন্ত জরুরি।

ঠান্ডা গলায় মিসেস অলিভার বললেন, আমি তো কেবল বই লিখে থাকি। সেগুলো সম্পূর্ণ কাল্পনিক। এবং কারোর ব্যক্তিগতভাবে অপরাধ সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না এবং অপরাধতত্ত্বের ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা বা মতামতও জানা নেই, সুতরাং আমার আশঙ্কা আমি কোনোভাবেই আপনাকে সাহায্য করতে পারব না।

কিন্তু আপনি কি আপনার ধর্মর্কন্যাকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন না?

সিলিয়াকে জিজ্ঞেস করব? এবার আবার মিসেস অলিভারের চোখ দুটো স্থির হল। এবং বললেন, জানি না কী ভাবে জিজ্ঞেস করব আমার ধারণা যখন এই বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটেছিল তখন ও খুবই বাচ্চা ছিল।

হ্যাঁ আমার ধারণা, এ ব্যাপারে সব কিছুই জানে ও। মিসেস বার্টন কক্স আরও বললেন, আমার মনে হয় না আপনি জানেন বলে, ডেসমণ্ড এটা পছন্দ করবে এবং এও জানেন যেখানে সিলিয়া জড়িত সেখানে খুবই স্পর্শকাতর সে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী আমার মনে হয় না যে-না–এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ও আপনাকে সব খুলে বলবে।

মিসেস অলিভার বললেন, সত্যিই আমি ওকে জিজ্ঞেস করার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারি।, এবং তিনি তার ঘড়ির দিকে তাকাবার ভান করলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলে উঠলেন, ওহে প্রিয়, আমরা দীর্ঘ সময় ধরে এই সুন্দর মধ্যাহ্নভোজ উপভোগ করলাম, অথচ এখনি আমাকে ছুটতে হবে কারণ আমার একটা জরুরি সাক্ষাৎকার আছে। কিন্তু, আপনাকে সাহায্য করতে না পারার জন্য সত্যিই আমি খুব দুঃখিত, বিদায়, মিসেস বেডলি কক্স, কিন্তু এ সব প্রসঙ্গ অত্যন্ত জটিল এবং সত্যি কথা বলতে কী আপনার ধারণার কি কোনো তফাত হতে পারে তা যে ভাবেই হোক?

ওহো, হ্যাঁ আমি কিন্তু মনে করি অনেক পার্থক্য হতে পারে।

ঠিক সেই সময়ে একজন লেখিকাকে সেদিকে এগিয়ে আসতে দেখলেন মিসেস অলিভার এবং তিনি তাকে বেশ ভালো করেই জানতেন, হঠাৎ লাফিয়ে উঠে তিনি তার একটা হাত ধরে ফেললেন।

সম্বোধন করলেন, লুইস, আমার প্রিয় লুইস, তোমাকে দেখতে পেয়ে কী যে ভালো লাগছে আমার। আচ্ছা, এর আগে তো তোমাকে দেখতে পাইনি।

হাই! এ্যারিয়াডন, বহুদিন হল তোমার সাথে কোনো দেখাসাক্ষাত হয়নি। অথচ তুমি কি খুব রোগা হয়ে গেছ, তাই না?

কী সুন্দর সুন্দর কথা না তুমি আমাকে বলল, বন্ধুকে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললেন মিসেস অলিভার এবং সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালেন তিনি এবং আবার বললেন, একজনের সাথে আমাকে দেখা করতে হবে, আমি যাচ্ছি বন্ধু।

মিসেস অলিভারের বন্ধু তাঁর কাঁধের ওপর দিয়ে আড়চোখে মিসেস বার্টন কক্সকে একবার দেখলেন এবং বললেন, আমার অনুমান ওই ভয়ঙ্কর মহিলার পাল্লায় পড়ে তুমি নিশ্চয়ই আটকে পড়েছিলে, তাই না?

কথার উত্তরে মিসেস অলিভার বললেন, উনি আমাকে যত সব অস্বাভাবিক প্রশ্ন করছিলেন। ওহো, তুমি কি জানতে না যে, কী ভাবে সেগুলোর উত্তর দেওয়া যায়?

না। কিন্তু সেগুলো কোনোভাবেই কাজের এক্তিয়ারে পড়ে না, এবং আমি যেসব প্রশ্নের বিন্দুবিসর্গ পর্যন্ত জানি না। কিন্তু সেগুলোর উত্তর দিতে আমি চাইনি।

কোনো আগ্রহে ব্যাপার আছে?

আমার মনে হয় বললেন মিসেস অলিভার। এবং তখন তার মাথায় একটা নতুন ধারণার আগমন ঘটছিল। যদিও মনে হয়, হয়তো সেটা আগ্রহ জাগাতে পারে কিন্তু কেবল–

বন্ধুটি জিজ্ঞেস করলেন, উইন কি তোমাকে তাগাদা করছিলেন? কিন্তু তোমার যদি গাড়ি না থাকে আমি তোমাকে লিফট দেব, এবং তুমি তোমার খুশিমত জায়গায় নেমে যেও। কিন্তু লন্ডনে আমি কখনও গাড়ি নিয়ে বেরোই না, কারণ পার্ক করা কি যে ভয়ঙ্কর ব্যাপার তা আমি জানি। এক কথায় যাকে বলে অচল অবস্থা।

ধন্যবাদ, পার্টিতে তাঁর সঙ্গ ভালো লাগে। সবাইকে বিদায় জানিয়ে আরও অনেক ভালো ভালো কথা বিনিময়ের পর মিসেস অলিভার তার বন্ধুর গাড়িতে গিয়ে বসলেন এবং গাড়িটা লন্ডন স্কোয়ারের দিকে ছুটে যাচ্ছিল।

ইটন টেরেস তাই না? তার বন্ধুটি জিজ্ঞেস করলেন।

হ্যাঁ, বললেন মিসেস অলিভার, অথচ এখন আমি কোথায় যাব, ও হ্যাঁ আমার মনে হয় হোয়াইটার ফায়ার্স ম্যানসনে। কিন্তু আমি সেটার নামটা কিছুতেই মনে রাখতে পারি না। অথচ আমি জানি, সেটা কোথায়?

ওহো, ফ্ল্যাটগুলো বেশ আধুনিক ধরনের। অত্যন্ত চারচৌকো এবং জ্যামিতিক।

ঠিকই তাই বললেন মিসেস অলিভার।

.

হাতি

মহান আল্ট অ্যালিসের জ্ঞানের পথনির্দেশ, মিস লিভিংস্টোন ঠিকানা লেখা বইটা খুঁজে দিতে পার কি?

তার উত্তরে বললেন, বাঁ হাতের কোণায় আপনার ডেস্কের ওপরই আছে মিসেস অলিভার।

মিসেস অলিভার বললেন, সেটার কথা আমি বলছি না। আমি যেটা বলছি মানে এখন যেটা আমি ব্যবহার করছি। অর্থাৎ আমার শেষেরটা বা আগের বছর কিংবা তার আগের আগেরটা, সন্দেহ প্রকাশ করে মিস লিভিংস্টোন বলল সেটা ফেলে দেওয়া হয়নি তো?

না, ঠিকানার বই আমি ফেলে দিই না কারণ সেটা তোমার প্রায়ই দরকার হয়ে থাকে, অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি কিছু ঠিকানা তুমি নতুন বইতে কপি করোনি? তবে আমার মনে হয় টলবয়েজের ড্রয়ারগুলোর মধ্যে যে কোনো একটায় আছে সেটা।

মিস সেডউইকের স্থলাভিষিক্ত হল মিস লিভিংস্টোন সুতরাং বলতে গেলে একরকম নবাগতা। অ্যারিয়াডন অলিভার মিস সেডউইককে হারিয়েছেন। অনেক কিছু জানত মেয়েটি এবং সে আরও জানত কোন কোন সময়ে মিস অলিভার কোন জিনিস কোথায় রাখতেন। যে সব লোকেদের সুন্দর সুন্দর চিঠি লিখতেন মিসেস অলিভার তাদের নাম কী সুন্দর মনে রাখত। শুধু তাই নয় আবার যে সব লোকেদের রুক্ষ ভাষায় চিঠি লিখতেন তাদের নামও মনে রাখতেন। অত্যন্ত কাজের এই মেয়েটি যে কোনো কারণেই হোক সে অকাজের হয়ে পড়ে থাকবে হয়তো। মিসেস অলিভার বললেন, কী যেন বইটার নাম? সে ছিল সেই বইটার মতন, তার মনটাকে ফেলে আসা দিনগুলোতে পিছিয়ে নিয়ে গিয়ে মনে করার চেষ্টা করলেন এবং বললেন, ও হ্যাঁ আমি জানি। বাদামি রঙের একটা বড়ো বই ভিক্টোরিয় যুগের সব কিছুই তাতে এনকোয়্যার উইদিন আপন এভরিথিং। কী করে নিকেলের ওপর থেকে লোহার নোংরা দাগ তোলা যায়, এবং বিশপের কাছে খোশগল্পের চিঠি লেখা কী করে শুরু করতে হয় সব জানা এই বই থেকে। সব কিছু আছে এনকোয়্যার উইদিন আপন এভরিথিং। বইটি মহান আল্ট অ্যালিসের মহান নির্ভরযোগ্য আশ্রয়।

আনট অ্যালিসের বই-এর যোগ্য ছিল মিস সেডউইক এবং মিস লিভিংস্টোন মোটেও তার মতন নয়। মিস লিভিংস্টোন সব সময় সেখানে দাঁড়িয়ে থাকেন। গায়ের রং পাণ্ডুর বর্ণ, লম্বাটে ধরনের মুখ এবং নিজেকে একজন দক্ষ বলে দেখানোর প্রবণতা আছে কারণ তার মুখের প্রতিটি রেখাই বলে দেয় দেখো আমি অত্যন্ত দক্ষ। কিন্তু মিসেস অলিভার ভাবেন সে কিন্তু সত্যি সেরকম নয়। সে কেবল সব জায়গাগুলো জানে যেখানে প্রাক্তন কর্মীরা বইপত্তর রাখত এবং মিসেস অলিভার যেখানে কোনো জিনিস রাখতে পারেন সেই সব জায়গাগুলিই ছিল তার কাছে পরিষ্কারভাবে বিবেচিত হত।

বকে যাওয়া ছেলের মতন খুব জোরে চিৎকার করে বললেন, আমি কী চাই জানো? আমার চাই ১৯৭০ সালের ঠিকানার বই এবং সেই সঙ্গে ১৯৬৯ সালেরটাও লাগবে। যত শিগগির সম্ভব তুমি কি খোঁজ করবে?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। বলল মিস লিভিংস্টোন। মেয়েটি এমনভাবে শূন্যে তার দিকে তাকাল যেন দেখে মনে হল এমন একটা জিনিস তাকে খোঁজ করতে বলা হয়েছে, যার নাম সে আগে কখনও শুনেছে বলে মনে হয় না, অভাবনীয়ভাবে ভাগ্য তার সহায় না হলে মনগড়া দক্ষতা দিয়ে সে কীভাবে খুঁজে বার করবে।

মিসেস অলিভার নিজের মনে ভাবলেন সেডউইককে না পেলে আমার সব কিছু অচল হয়ে যাবে এবং আমি পাগল হয়ে যাব।

মিস লিভিংস্টোন মিসেস অলিভারের স্টাডি ও লেখার ঘরের ফার্নিচারের সমস্ত ড্রয়ারগুলো খুলতে শুরু করল।

মিস লিভিংস্টোন বেশ খুশি হয়ে আনন্দে বলে উঠল এখানে গত বছরেরটা, অনেক বেশি হাল আমলের লেখা ১৯৭১ চলবে না?মিসেস অলিভার বললেন, ১৯৭১ আমি চাই না। একটা অস্পষ্ট চিন্তা এবং স্মৃতিশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বললেন, চায়ের পেটির টেবিলে দেখো তো? মিস লিভিংস্টোন চারদিকে তাকিয়ে দেখে এবং যতই তাকায় ততোই চিন্তিত দেখায় তাকে, ওই যে ওই-টেবিলটা টেবিলের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন। চায়ের পেটির ওপর একটা ডেস্ক বুক রয়েছে, সেটা কি? মিস লিভিংস্টোন মিসেস অলিভারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।

হ্যাঁ ওটা হতে পারে, আমার মনে পড়ছে মিসেস অলিভার বললেন।

কিন্তু এ তো দেখছি চার বছর আগেকার সেই ১৯৬৮ সালের মিসেস অলিভার।

ওটাই প্রায় ঠিক, মিসেস অলিভার বললেন এবং সেটি হস্তগত করে ডেস্কে ফিরে গেলেন। এর মধ্যে হাল আমলেরও সব কিছু আছে কিন্তু এখন দেখ তো আমার জন্মদিনের বইটা তুমি পাও কিনা মিস লিভিংস্টোন।

আমি তো জানি না।

ওটা এখন আর আমি ব্যবহার করি না তবে এক সময় করতাম। বেশ বড়ো আকারের ছিল, মিসেস অলিভার বললেন এবং আরও বললেন, আমি যখন শিশু ছিলাম তখন থেকেই শুরু করি। আমার ধারণা সেটা ওপরের তলায় আছে, তুমি জানো ছেলেরা ছুটির সময় বাড়িতে এলে আমরা যে ঘরটা ব্যবহার করে থাকি এবং বিছানার পাশে যে আলমারিটা আছে–

ওহো আমি কি সেটার খোঁজ করব? হা, আমি ঠিক তাই চাই, বললেন মিসেস অলিভার। মিস লিভিংস্টোন যেই ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন তিনি একটু উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন এবং দরজাটা বন্ধ করে দিলেন ভেতর থেকে, তিনি ডেস্কের সামনে গিয়ে ঠিকানাগুলোর ওপর চোখ বুলোতে থাকেন। লেখাগুলো অবশ্য ফিকে হয়ে গেছে, তখন চায়ের গন্ধ তার নাকে ভেসে আসছিল। ঠিকানাগুলো দেখতেই চোখে পড়ল র‍্যাভেন্সক্রফট! সিলিয়া র‍্যাভেন্সক্রফট। হ্যাঁ ১৪ ফিশাফ্রে মিউস. এস. ডব্লু ৩। এটাই সিলিয়ার ঠিকানা এবং সেখানেই ও থাকত। কিন্তু আরও একজন ছিল স্ট্যান্ড অন দি গ্রীন, কিউ ব্রিজের কাছে হবে হয়তো। তিনি আবার কয়েকটা পাতা ওল্টালেন, এটা মনে হচ্ছে মারডিক গ্রোভ। সেটা বোধহয় ফুলহাম রোডে বা ওই রকম কোথাও হবে হয়তো, অত্যধিক রবার ঘষা হয়েছে, ওর কি টেলিফোন আছে? মনে হয় ওটাই ছিল ফ্ল্যাক্সম্যান…তবে যাইহোক আমি অন্তত সেটা চেষ্টা করব।

টেলিফোনের দিকে তিনি এগিয়ে গেলেন, সাথে সাথে দরজা খুলে যায় এবং লিভিংস্টোন ভেতরের দিকে তাকায়।

আপনি কি সেটার কথা ভাবছেন?…

আমি যেটা চাইছিলাম ঠিক সেটা আমি পেয়ে গেছি, মিসেস অলিভার বললেন, যাও জন্মদিনের বইটা খুঁজে দেখো কারণ ওটা খুবই জরুরি।

আপনি যখন সিলি হাউসে যান, আপনার কি মনে আছে যে সেটা আপনি দেখে গিয়েছিলেন?

না আমার মনে পড়ছে না, যাও গিয়ে খুঁজে দেখো, বললেন মিসেস অলিভার।

তোমার ইচ্ছা মতন যত পারো দেরি করো, নিজের মনেই বিড়বিড় করে বললেন।

টেলিফোনে ডায়াল করলেন এবং অপেক্ষা করতে থাকলেন। হঠাৎ দরজা খুলে ওপরতলার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলে উঠলেন, স্প্যানিশ আলমারিতে খুঁজে দেখো, সেটা পিতল দিয়ে বাঁধানো বই এবং সেটা যে এখন কোথায়, আমি সম্পূর্ণ ভুলে গেছি। তবে আমার মনে হয় টেবিলের মধ্যেই রয়েছে সেটা।

মিসেস অলিভার প্রথম ডায়ালে সফল না হওয়ায় তিনি যোগাযযাগ করলেন মিসেস স্মিথ পোটারের সঙ্গে। তিনি যে শুধু বিরক্তই হলেন তা নয় কোনো রকম সাহায্যও করলেন না। আগে যারা সেই ফ্ল্যাটে থাকত তাদের কারোরই এখনকার টেলিফোন নম্বর দিতে পারলেন না। সুতরাং আরও একবার ঠিকানার বইটা উলটে-পালটে দেখলেন। আরও দুটো ঠিকানা মিসেস অলিভার আবিষ্কার করলেন। যাইহোক তৃতীয়বারের চেষ্টায় র‍্যাভেন্সক্রফটের একটা অস্পষ্ট ঠিকানা খুঁজে পেলেন। নামের পাশে একটা ক্রস চিহ্ন সই করা। এটা দেখে তিনি মনে করলেন তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবেন। কথাটা যেই মাত্র ভাবলেন তৎক্ষণাৎ তিনি ডায়াল করলেন।

একটা নারীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। তিনি মনে মনে ভাবলেন সিলিয়ার!

ওহে প্রিয়, হা, তা বেশ কয়েকবছর হল এখানে ও থাকছে না এবং আমার মনে হয় এখন ও নিউক্যাসেলে আছে। সম্ভবত শেষবার সেখান থেকেই ওর কণ্ঠস্বর শুনেছিলাম।

মিসেস অলিভার বললে, ওখানকার ঠিকানা আমি পাইনি।

না দুঃখিত আমার কাছেও নেই। তখন মেয়েটি বলল, আমার ধারণা একজন ভেটনারি সার্জেনের সেক্রেটারির কাজ করছে সম্ভবত। সেটা কোনো কাজের কথা নয়। মিসেস অলিভার শেষবারের মতো চেষ্টা করলেন ১৯৬৭ সালের ঠিকানা লেখা বইটার ওপর চোখ বোলাতে। দূরাভাষে প্রশ্ন আসে আপনি কি সিলিয়া র‍্যাভেলক্রফটের কথা বলছেন?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক তাই।

দূরাভাষে লোকটি বলল, আমার কাছে প্রায় দেড় বছর আগে কাজে করে। সে কাজের খুব উপযুক্ত ছিল, এবং সে যদি আরও কিছুদিন থাকত আমি খুব খুশি হতাম। আমার ধারণা এখান থেকে হারলে স্ট্রিটে চলে গেছে। কিন্তু অন্য আর এক জায়গার ঠিকানা আছে আমার কাছে, দাঁড়ান মিঃ এক্স নাম অজানা ঠিকানা। আমি এখানে পেয়েছি ঠিকানা, মনে হচ্ছে ইসলিংটনে কোথাও হবে। আপনার কি ধারণা সেটা সম্ভব?

তার উত্তরে মিসেস অলিভার বললেন, সব কিছুই সম্ভব এবং তিনি মিঃ এক্সকে ধন্যবাদ জানিয়ে ঠিকানাটা লিখে রাখলেন।

লোকের ঠিকানা পাওয়া আজকাল বড়ো কষ্টকর ব্যাপার। যাইহোক তিনি ইসলিংটনের নম্বর চেষ্টা করলেন। ভারিকি গলায় একজন উত্তর দিল, বলুন আপনি কাকে চান? সে কি এখানেই থাকে? নাম বলুন।

মিস সিলিয়া র‍্যাভেন্সক্রফট।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, সে এখানেই থাকে। তবে এখন সে বাইরে। ঘরে ফেরেনি এখনও।

সন্ধ্যায় সে ফিরবে তো?

হ্যাঁ, হ্যাঁ খুব শিগগিরই সে ঘরে আসবে এবং পোশাক বদল করেই আবার সে বেড়িয়ে যাবে কারণ একটা পার্টি আছে তার। খবরটা দেওয়ার জন্য মিসেস অলিভার তাকে ধন্যবাদ জানালেন।

তিনি অনেকক্ষণ ধরে ভাবার চেষ্টা করলেন যে, শেষ কবে তিনি তার ধর্মকন্যা সিলিয়াকে দেখেছিলেন? তিনি কিছুতেই খেয়াল করতে পারলেন না। সমস্ত ব্যাপারটাকে আবার তিনি ভাবলেন, এখন নিশ্চয়ই ও লন্ডনে আছে। ওর বয়ফ্রেন্ডও কি লন্ডনে আছে এবং ওর বয়ফ্রেন্ডের মাও কি লন্ডনে আছে, এই ব্যাপারগুলি খালি মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। তিনি ভাবলেন সত্যিই দেখছি এটা এখন আমার মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াল, এবং মিস লিভিংস্টোনকে দেখে তিনি তার মাথাটা তার দিকে ঘোরলেন।

মিস লিভিংস্টোনের সারা শরীরে ধুলো কালিঝুলি এবং তাকে সেই জন্য খুব বিরক্ত দেখাচ্ছিল এবং সে একগাদা ফাইল নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিল।

জানি না এগুলোর মধ্যে একটাও আপনার কাজে লাগবে কিনা মিসেস অলিভার। ফাইলগুলোর চেহারা দেখে মনে হয় বহুদিন এগুলি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়েছিল। হতেই পারে, বললেন মিসেস অলিভার। আমার মনে হয় না, যাইহোক সোফার এক কোণায় ওগুলো রেখে দাও। সন্ধ্যার সময় আমি দেখব ওগুলো। মিসেস অলিভার বললেন। মিস লিভিংস্টোন তার অসন্তুষ্ট মনোভাব চেপে রেখে বলল, তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমি বরং ততক্ষণে ধুলো পরিষ্কার করে ফেলি। মিসেস অলিভার বললেন, সে তো তোমার অসীম দয়া এবং একটু থেমে মেয়েটির দিকে আপাদমস্তক তাকালেন এবং আবার বললেন, তোমার নিজের চেহারার যা অবস্থা হয়েছে নিজেকেও তার সঙ্গে সাফ করে নিও। আর হ্যাঁ, তোমার বাঁ কানে ছছটা মাকড়সার জাল আটকে গেছে, বিদ্যুতের গতিতে তিনি হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ইসলিংটনের নম্বরটা আবার ডায়াল করলেন। দূরাভাষে উত্তর শোনা গেল খাঁটি এ্যাংলো ফ্যাসনের কিন্তু কথাগুলো বেশ ধারালো, যদিও তাতে সন্তুষ্ট হলেন মিসেস অলিভার। মিস র‍্যাভেন্সক্রফট মানে সিলিয়া র‍্যাভেন্সক্রফট? হ্যাঁ আমিই সিলিয়া র‍্যাভেন্সক্রফট বলছি।

আমার ধারণা আমাকে তোমার ভালো মনে আছে। আমি হচ্ছি অ্যারিয়াডন অলিভার। দীর্ঘ দিন ধরে আমরা পরস্পর পরস্পরকে দেখিনি, আমি হলাম তোমার ধর্ম মা।

হ্যাঁ, অবশ্যই আমি সেটা জানি। আর এও সত্যি আমরা কেউ কাউকে অনেক দিন দেখিনি।

তোমাকে দেখার জন্য মনের অবস্থা বুঝতেই পারছ। ভীষণ ছটফট করছে মন, যদি তুমি আমার বাড়িতে আসো কিংবা তুমি যদি মনে করো এক ভোজসভায় কিংবা…।

ঠিক আছে, আপাতত এক্ষুনি একটু অসুবিধা আছে কারণ যেখানে আমি কাজ করি তাদের তরফ থেকে। আচ্ছা আজ সন্ধ্যায় আসতে পারি অবশ্য যদি আপনি পছন্দ করেন, সময় সাড়ে সাতটা অথবা আটটা। তার পরে কিন্তু অন্য জনকে ডেট দেওয়া আছে…

হ্যাঁ, হ্যাঁ তুমি যদি তাই এসো আমি খুবই খুশি হব।

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আমি আসব।

মিসেস অলিভার তার ঠিকানা দিলেন সিলিয়াকে, টেলিফোন প্যাডের ওপর একটা নোট লিখে রাখলেন। এমন সময় বিরাট একটা অ্যালবাম হাতে নিয়ে লিভিংস্টোন ঘরে ঢুকলেন। তাকে দেখেই তার সারা মুখ বিরক্তিতে ভরে উঠল। সম্ভবত এটা হতে পারে। দেখুন তো মিসেস আলভার?

না এটা নয়, এটা হল রান্নার বই।

মিস লিভিংস্টোনকে একটু আহত হতে দেখে মিসেস অলিভার বললেন, ঠিক আছে ওগুলোর মধ্যে থেকে আমার প্রয়োজনীয় অ্যালবামটা দেখে নেব। তিনি বললেন, আর একবার যাও এবং ভালো করে দেখে এসো। লিলেন কাপবোর্ডের কথা আমি যে ভেবেছিলাম সেটা তুমি জানো, বাথরুমের পরের দরজাটা বাথ টাওয়েলের একেবারে ওপরের তাকে কখন কখন বই বা কাগজপত্র আমি রেখে থাকি। দাঁড়াও, তোমার সাথে আমিও যাব এবং নিজের চোখে দেখব।

মিনিট দশেক পরে ফিকে হয়ে যাওয়া একটা অ্যালবাম দেখছিলেন মিসেস অলিভার। কিন্তু তখন মিস লিভিংস্টোন, মানসিক যন্ত্রণায় তার শহীদ হবার মতো অবস্থা।

ঠিক সেই সময় মিসে অলিভার বললেন, এটা ঠিক আছে, তুমি বরং ডাইনিং রুমে গিয়ে সেই পুরানো ডেস্কের ওপর চোখ বুলিয়ে এসো কারণ কম করে দশ বছরের পুরানো যদি কিছু ঠিকানা লেখা বই দেখতে পাও, আজ আর অন্য কিছুর প্রয়োজন হবে বলে মনে হয় না।

মিস লিভিংস্টোন সেখান থেকে চলে গিয়ে একটা সোফার ওপর হেলান দিয়ে বসলেন এবং নিজের মনে মনে বললেন, আঃ কি বিস্ময়! আবার অ্যালবামের পাতাগুলো ওল্টালেন এবং ভাবলেন তিনি নিজে গেলে না কি ওকে আমার এখানে দেখতে পেলে কে বেশি খুশি হবে? যাইহোক সিলিয়া আসুক বা চলে যাক একটা ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে সন্ধ্যাটা আমাকে কাটাতে হবে।

একটা নতুন খাতা নিয়ে টেবিলের ওপর রাখলেন এবং তাতে একটার পর একটা তারিখ, সম্ভাব্য ঠিকানা এবং নাম লিখে চললেন। টেলিফোন বইতে কি যেন দেখলেন এবং তারপর মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারোকে ফোন করলেন।

হ্যালো মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি কি কথা বলছেন?

হ্যাঁ, ম্যাডাম নিজেই বলছি।

মিসেস অলিভার জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি কিছু করলেন?

কিছু মনে করবেন না, মাপ করবেন। কিন্তু আমি কী করব বলুন তো?

মিসেস অলিভার বললেন, গতকাল আমি কী বলেছিলাম আপনাকে?

ও হ্যাঁ, দ্রুতগতিতেই কাজ এগিয়ে নিয়ে চলেছি। তবে আরও কয়েকটা খোঁজখবর নেবার ব্যবস্থা করেছি।

আবার মিসেস অলিভার জিজ্ঞেস করলেন, ওইগুলো এখনও করে উঠতে পারেননি এই তো? পুরুষদের কাজকর্মের ওপর আমি খুব একটা ভরসা পাই না।

আপনি ম্যাডাম?

আমি এখন খুব ব্যস্ত, তার কথার উত্তরে মিসেস অলিভার বললেন।

পালটা খোঁচা দিয়ে পোয়ারো বললেন, শুনি ম্যাডাম আপনিই বা কতদুর কী করেছেন?

বেশ উত্তেজিত হয়ে মিসেস অলিভার বললেন, হাতিগুলোকে একজায়গায় জড়ো করেছি। এর কোনো অর্থ কি আপনার কাছে আছে?

হ্যাঁ, আপনি কী বলতে চাইছেন মনে হয় তা আমি বুঝেছি।

মিসেস অলিভার মন্তব্য করলেন, অতীত নিয়ে চিন্তা করলে এটা যে খুব সহজ ব্যাপার নয় তখন বোঝা যায়। আরও একটা আশ্চর্যের ব্যাপার নাম মনে করে কজন লোকই বা তাদের চিনতে পারে? আমি এখন মনে করতে পারি না তখন আমার বয়স ষোলো, সতেরো কিংবা তিরিশ হবে। কেন যে আমি আমার জন্মদিনের খাতায় তাদের লিখতে বলেছিলাম! ওই বিশেষ দিনটিতে এক একজন কবির বাণী লিখে দিত এবং তাদের মধ্যে কিছু লেখা অর্থহীন।

আপনি কি আপনার সন্ধানকার্যে উৎসাহিত?

না, ঠিক তা বলব না, তবে আমি মনে করছি যে, আমি ঠিক পথেই চলেছি এবং মিসেস অলিভার আরও বললেন, আমি আমার ধর্মকন্যাকে ফোন করেছিলাম

আর আপনি ওর সাথে দেখা করতে যাচ্ছেন এই তো?

না, ও আসছে আমার সাথে দেখা করতে। আজ রাত সাড়ে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে আসার কথা। কিন্তু যদি সে না আসে, জোর দিয়ে কিন্তু কেউ বলতে পারে না ও আসবে কিনা, কারণ আজকালকার তরুণ তরুণীরা একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।

মিসেস অলিভার বললেন, জানি না, ঠিক খুশি নয় ও, কারণ ওর কণ্ঠস্বরটা যেন কেমন বলে মনে হল। এবার আমার মনে পড়ছে ওকে আমি শেষ দেখেছি বছর ছয়েক আগে, সেই জন্য হয়তো ভাবলাম যে ও হয়তো ভয় পেয়েছে। আমি আপনাকে বোঝাতে চাইছি আমি যত বেশি তর্জন গর্জন করে ওকে বলতাম তার থেকে অনেক বেশি গর্জন করে আমাকে বলত এই আর কী।

সেটা তো ভালোও হতে পারে বরং খারাপ তো নয়ই। আপনি কি তাই মনে করেন?

যদি কোনো লোক মনঃস্থির করে থাকে যে, তারা একদম আপনাকে পছন্দ করে না, সে ক্ষেত্রে কিন্তু তারা তাদের মনোভাব লুকিয়ে রেখে আপনার সাথে বেশ খুশি মনেই কথা বলবে। এবং তারা আপনাকে বেশ ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক খবর দেবে। কিন্তু তারা যদি আপনার সঙ্গে অন্তরঙ্গ হয়ে কথা বলত ঠিক তার ভিন্ন ব্যবহারই তারা করত।

তার মানে আপনি বলতে চাইছেন সেবার ভান করে, তোষামোদ করে আমাকে খুশি করার চেষ্টা করবে, হ্যাঁ কিছু একটা জিনিস আপনি পেয়েছেন, সেই জন্যই তারা ভেবে নিয়েছে আপনি যেভাবে খুশি হন সেই ভাবেই তারা বলবে। আবার অপর দিকে তারা যদি বিরক্ত হয় আপনার ওপর সেক্ষেত্রেও তারা সেইভাবেই কথা বলবে যাতে বিরক্ত হন। সিলিয়ার যখন পাঁচ বছর বয়স তখন ওকে আমি খুব ভালো করে জানতাম, এবং ওর একজন নার্সারি গভরনেস ছিল, তার দিকে ও ওর বই ছুঁড়ে ফেলত। আমার আশঙ্কা যে সিলিয়াও যদি আমার সাথে সেইরকম ব্যবহার করে?

শিশুর প্রতি গভরনেস না গভরনেসের প্রতি শিশু?

মিসেস অলিভার বললেন, অবশ্যই গভরনেসের প্রতি শিশু।

রিসিভার নামিয়ে রেখে সোফায় গিয়ে বসলেন এবং অতীতের স্মৃতি মন্থন করলেন। নিজের মনে নামগুলো বিড়োবিড়ো করে বলছিলেন ঠিক নিঃশ্বাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। মারিয়ানা যোশেফিন পোল্টারলিয়ার–বেশ কয়েক বছর হল তার কথা একদম ভাবিনি। আমার মনে হয়েছিল সে বুঝি মারা গেছে। হা, হ্যাঁ, আন্না ব্রেসবি জগতের সেই প্রান্তে সে বসবাস করত। আমি এখন বিস্মিত এই ভেবে–এই সমস্ত কথা ভাবতে ভাবতে বেল বেজে উঠল এবং তিনি চমকে উঠলেন। এবং তিনি নিজেই উঠে গেলেন দরজা খোলার জন্য।

.

সেই প্রথম হাতির উল্লেখ

মিসেস অলিভার বন্ধু এরকুল পোয়ারোকে তাঁর বাড়িতে পেলেন না ফলে টেলিফোনে যোগাযোগ করলেন।

আজ সন্ধ্যায় আপনি কি বাড়িতে থাকবেন, জিজ্ঞেস করলেন মিসেস অলিভার।

তখন তিনি তার টেলিফোনের সামনে বসেছিলেন এবং একটু স্নায়ু দুর্বলতায় পীড়িত হয়ে টেবিলের ওপর অযথা আঙুলের আঁচড় কাটছিলেন।

তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কে আপনি বলুন তো?

অ্যারিয়াডন, অলিভার বললেন, মিসেস অলিভার তিনি নাম সবসময় উল্লেখ করে থাকেন না। কারণ তিনি আশা করেন যে, তাঁর বন্ধুরা তার কণ্ঠস্বর শুনেই তাকে চিনতে পারে যেন।

হ্যাঁ, আজ সারাটা সন্ধ্যা আমি বাড়িতেই থাকব। তাহলে তার মানে কি ধরে নিতে পারি যে, আমার বাড়িতে আপনার পায়ের ধুলো নিশ্চয়ই পড়বে? যদি পরে আমি খুব খুশি হব।

আমি আপনার কাছে গেলে আপনি যে খুশি হন শুনে খুব ভালো লাগল, বললেন মিসেস অলিভার। কিন্তু আমার কোনো ধারণা নেই সেরকম কোনো খুশির কারণ আমি হব কিনা।

আপনার সঙ্গে দেখা হলেই সব সময়ে আমি খুশি হয়ে থাকি ম্যাডাম।

–জানি না, বললেন মিসেস অলিভার। আপনাকে বিরক্ত করতে হয়তো যেতে পারি, অথবা কিছু জিজ্ঞেস করতে। এবং আমি জানতে চাই কিছু একটা ব্যাপারে আপনি কি কিছু মনে করেন?

যে কোনো লেডিকে যখন তখন সেকথা বলতে আমি সবসময়েই প্রস্তুত, বললেন পোয়ারো।

একটা কিছু উদয় হয়েছে, বললেন মিসেস অলিভার। তবে একটা কিছু ক্লান্তিকর যাকে বলে আর আমি কিছুই জানি না সে ব্যাপারে কি করতে হবে?

তাহলে আপনি আসুন এবং আমার সঙ্গে দেখা করুন। আমি প্রশংসিত এবং অতিরঞ্জিত ভাবে প্রশংসিত।

মিসেস অলিভার জানতে চাইলেন, কোন সময়টা হলে আপনার ভালো হয়?

পোয়ারো বললেন, নটার সময়। আমরা দুজনে এক সঙ্গে কফি খাব কিন্তু তা নাহলে যদি আপনি গ্রেনাডাইন কিংবা সিরাপ পছন্দ করেন। কিন্তু যত দূর মনে পড়ছে আপনি আবার এসব পছন্দ করেন না।

জর্জ, পোয়ারো তার ভৃত্যকে ডাকলেন এবং বললেন, আজ রাতে মিসেস অলিভার আসছেন আমাদের বাড়িতে, তাকে অভ্যর্থনা জানাতে হবে তাঁর কী পছন্দ আমি ঠিক নিশ্চিত নই, তবে আমার ধারণা কফি আর এক ধরনের মদ হলেই চলবে।

আমি ওঁকে ক্যারেশ পান করতে দেখেছি স্যার।

তাহলে তো খুব ভালোই হয় বললেন পোয়ারো। তবে তাই হোক–

একেবারে ঠিক সময়ে এলেন মিসেস অলিভার, পোয়ারো যখন নৈশভোজ সারছিলেন তখন তিনি বিস্মিত হয়ে ভাবছিলেন যে তার কাছে মিসেস অলিভারের আসার উদ্দেশ্য কি হতে পারে এবং তিনি যা করতে যাচ্ছেন সে সম্পর্কে তার সন্দেহই বা কেন? তিনি কি কোনো কঠিন সমস্যা নিয়ে তার কাছে আসছেন অথবা কোনো অপরাধের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চান? পোয়ারো কিন্তু ভালো করেই জানেন মিসেস অলিভারের ক্ষেত্রে অতি সাধারণ কিছু, অথবা অত্যন্ত অস্বাভাবিক জটিল কিছু যে কোনো কিছু হতে পারে। কারণ তার কাছে সবই সমান। ভদ্রমহিলাকে খুবই চিন্তিত দেখে নিজের মনে এরকুল পোয়ারো ভাবলেন, সব সময় সব কাজেই তিনি মানিয়ে নিতে পারেন মিসেস অলিভারের সঙ্গে। হয়তো কোনো কোনো সময়ে তিনি তাকে পাগল করে তোলেন, তা সত্ত্বেও তারা দুজনে একসঙ্গে অনেক অভিজ্ঞতা এবং পরীক্ষা নিরীক্ষার অংশীদার হয়েছেন। সে দিনই সকালে নাকি সান্ধ্য পত্রিকায় তার সম্পর্কে কিছু লেখা তিনি পড়েছেন। তিনি এসে পড়ার আগেই সেটা তাকে মনে করতে হবে। সবে মনে করছেন সেই সময় তাঁর আগমন বার্তা ঘোষিত হল।

ঘরের ভেতর ঢুকলেন তিনি এবং সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলেন পোয়ারো, তার উদ্বেগের বিশ্লেষণ যথেষ্ট সত্য। এবং তার চুলের স্টাইল দেখে মনে হল সময়ের অভাবে হয়তো তাড়াতাড়িতে চুলের মধ্যে হাত চালিয়ে কেশবিন্যাসের কাজটা সেরে নিয়েছেন। তিনি প্রায়ই এরকম করে থাকেন একটু তাড়া থাকলে। যাইহোক তিনি তাকে স্বাগত জানালেন খুশি হয়ে এবং তাকে একটা চেয়ারে বসালেন। তার জন্য নিজের হাতে কাপে কফি ঢেলে দিলেন এবং ক্যারেশ ভর্তি একটা গ্লাস তুলে দিলেন তার হাতে।

আহ। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন এবং বললেন, আমার মনে হয়, আপনি হয়তো ধরে নিয়েছেন, আমি খুব ভয় পেয়ে গেছি, কিন্তু এখনও…

তা তো আমি নিজেই দেখতে পাচ্ছি এবং কাগজে দেখেছি আজ সব বিখ্যাত বিখ্যাত মহিলা লেখিকারা, সেই সাহিত্যিকদের ভোজসভায় যোগ দিচ্ছেন আপনি। আমি ভেবেছিলাম, আপনি তো কখনও পার্টিতে যান না।

সাধারণত আমি যাই না, বললেন মিসেস অলিভার, এবং ফিরে আর কখনও যাবও না।

সহানুভূতির সঙ্গে পোয়ারো বললেন, মনে হচ্ছে আপনি খুব কষ্ট পেয়েছেন?

মিসেস অলিভারের অস্বস্তির মুহূর্তগুলির সঙ্গে তিনি পরিচিত। এবং তাঁর বই সম্পর্কে কারোর অতিরিক্ত প্রশংসা সব সময়ে তাঁকে অতি ভীষণ অস্বস্তিতে ফেলে দেয় এবং একসময় তিনি তাকে বলেছিলেন, সঠিক উত্তর কখনও তার জানা থাকে না।

কেন, আপনি কি সেটা উপভোগ করেননি? উত্তরে মিসেস অলিভার বলেন, একটা সময় পর্যন্ত উপভোগ করেছি, তারপরেই একটা ক্লান্তিকর ঘটনা ঘটে যায়।

ও, সেই জন্যই বুঝি আপনি আমার কাছে ছুটে এসেছেন?

হ্যাঁ, কিন্তু সত্যি আমি জানি না কেন এর সঙ্গে আপনার কোনো সম্পর্ক নেই অথবা বলতে পারি কিছু করার নেই এবং আমার মনে হয় না যে, এ ব্যাপারে আপনি আগ্রহ প্রকাশ করবেন। আর সত্যি কথা বলতে কী আমি নিজেও একেবারেই আগ্রহী নই। এ ছাড়া আমার অন্তত মনে হয়েছে এ ব্যাপারে আপনি কী ভাবেন সেটা জানতে আপনার কাছে ছুটে আসব না। কিন্তু এসেছি কেন, এবং কী জানতে? জানতে এসেছি, আমার মতন অবস্থায় পড়লে আপনি কী করতেন?

পোয়ারো বললেন, এটা অত্যন্ত কঠিন প্রশ্ন। আমি জানি যে কোনো ব্যাপারে কাজ করব সম্পূর্ণ আমার মতো করে। কিন্তু আপনার মধ্যে কি রকম প্রতিক্রিয়া হবে, অথবা আপনি কীভাবে সেটা সম্পন্ন করবেন, তা আমার জানা নেই। যদিও আমি আপনাকে বেশ ভালোভাবেই জানি।

মিসেস অলিভার বললেন, যথেষ্ট দীর্ঘ সময় ধরে আপনি আমাকে জানেন, আর আপনার নিশ্চয়ই একটা ধারণা হয়ে গেছে

ঠিক কতদিন বলুন তো–এখন থেকে কুড়ি বছর আগে কি?

–ওহো, ও আমি জানি না। কত বছর থেকে আমি খেয়াল করতে পারি না। কোনো তারিখ সেটা মনে করা তো আরও বেশি মুশকিল। তবে আমি জানি সেটা ১৯৩৯ সাল কারণ সেই সময় যুদ্ধ শুরু হয়েছিল এবং অন্য তারিখও কিছু জানি কারণ সেইসব তারিখগুলোতে এদিক ওদিক অদ্ভুত অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে যেতে দেখেছিলাম।

যাইহোক, সাহিত্যিকদের ভোজসভায় আপনি গিয়েছিলেন এবং সেটা আপনি খুব বেশি উপভোগ করতে পারেননি।

মধ্যাহ্নভোজ উপভোগ করেছি ঠিকই, কিন্তু ঠিক তার পরেই…

যেমন করে চিকিৎসক তার রোগীর কাছ থেকে রোগের লক্ষণ জানতে চায় ঠিক তেমন একজন চিকিৎসকের মতো করুণা দেখিয়ে পোয়ারো বললেন, লোকেরা আপনাকে কিছু বলে। ওহো ভালো কথা ওরা যখন আমাকে কিছু বলার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল, হঠাৎই তাদের মধ্যে কর্তৃত্ব করার মতো একজন বিরাট কাজের মহিলা সব সময় যিনি প্রত্যেকের ওপর কর্তৃত্ব করতে ভালোবাসে, এবং যিনি আপনাকে দারুণ একটা অস্বস্তিতে ফেলে দিতে পারেন। জানেন কেউ যেমন প্রজাপতি ধরার জন্য লাফিয়ে ওঠে সেইরকমভাবে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তার কেবল দরকার ছিল প্রজাপতি ধরে রাখার জন্য একটি জাল। তিনি আমার চারপাশে একবার প্রদক্ষিণ করে একরকম ধাক্কা দিয়ে আমাকে একটা সোফার ওপর বসিয়ে দেন এবং তারপর কথা বলতে শুরু করে দেন, আমার ধর্মকন্যার প্রসঙ্গ নিয়ে।

আহ, হ্যাঁ আপনার তো একটি ধর্মকন্যা এক সময় আপনার খুব প্রিয় ছিল, তাই না?

মিসেস অলিভার বললেন, বেশ কয়েক বছর ওকে আমি দেখিনি এবং সবার সঙ্গে আমার বড়ো একটা যোগাযোগও হয় না। তারপর তিনি আমাকে একটা ভীষণ চিন্তার প্রশ্ন করলেন এবং তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন–ওহে প্রিয়, সেটা বলতে যে কত কষ্ট আমার পক্ষে–না, তা নয়, খুব নম্র গলায় বললেন পোয়ারো, এটা খুবই সহজ, এবং প্রত্যেকেই সবকিছু বলে থাকে আমাকে। দেখুন আমি কেবল একজন বিদেশী, তাই তাতে কিছু এসে যায় না।

বেশ তো, আপনাকে বলা যখন সহজ বলছেন, মিসেস অলিভার তখন বললেন, দেখুন, তাহলে বলি মেয়েটির বাবা ও মার সম্পর্কে খোঁজখবর নেন আমার কাছ থেকে। এবং তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন মেয়েটির মা তার বাবাকে খুন করেছিল, নাকি তার বাবা তার মাকে খুন করেছিল।

আমাকে ক্ষমা করবেন, বলে উঠলেন পোয়ারো। হ্যাঁ, আমি জানি পাগলের প্রলাপের মতো শোনাচ্ছে, ঠিকই আছে আমি ভাবলাম এটা বুঝি পাগলামো।

আপনার ধর্মকন্যার মা তার বাবাকে খুন করেছিল অথবা তার বাবা তার মাকে খুন করেছিল?

তা ঠিক, বললেন মিসেস অলিভার, কিন্তু এটা কি ঘটনা? যে তার বাবা তার মাকে খুন করেছিল নাকি তার মা তার বাবাকে খুন করেছিল?

ভালো কথা ওদের দুজনকেই গুলিবিদ্ধ দেখতে পাওয়া যায়, মিসেস অলিভার আরও বলেন যে, পাহাড়ের একেবারে চূড়ায়, আমি ঠিক মনে করতে পারছি না, হয় সেটা কর্নওয়াল নয় করসিকায়। সেইরকমই একটা জায়গা হবে।

তাহলে সেটা সত্য বটে, পরে তিনি কী বললেন? ওঃ হ্যাঁ, ওই অংশটা সত্য। তা বেশ কয়েক বছর আগে ঘটনাটা ঘটেছিল। হ্যাঁ ভালো কথা, আমি কিন্তু বলতে চাই–আমার কাছে এলেন কেন?

কারণ আপনি একজন অপরাধ কাহিনির লেখিকা কোনো সন্দেহই নেই এবং তিনি নিশ্চয়ই বলে থাকবেন যে সমস্ত অপরাধের ব্যাপারে আপনি জানেন, এটাই কি সত্য, যা ঘটেছিল? বললেন পোয়ারো।

ওঃ হ্যাঁ, এটা সেরকম কিছুই নয় যা এ করতে পারে। অথবা ধরুন আপনার মা আপনার বাবাকে হত্যা করল, কিংবা আপনার বাবা আপনার মাকে হত্যা করল, সে সব ক্ষেত্রে ঠিক মতো কীভাবে অগ্রসর হওয়া যায়। এটা এমনিই একটা কিছু যা সত্যি সত্যি ঘটেছিল, আমার কী মনে হয় জানেন? এ ব্যাপারে আপনাকে সব খুলে বলাই ভালো। কারণ এখন আমি সবকিছু মনে করতে পারি না, সেই সময় সেটা কিন্তু খুবই পরিচিত ছিল। আমার মনে হয় সে প্রায় বছর বারো আগের ঘটনা হবে। ওই যে বললাম লোকগুলোর নাম কিন্তু আমি মনে করতে পারি কারণ আমি তাদের চিনতাম। স্ত্রী আমার সঙ্গে স্কুলে ছিল, আমরা দুজনে বন্ধুর মতন ছিলাম। সেটা ছিল একটা সুপরিচিত মামলা, আর জানেন কেসটা এতোই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, সমস্ত খবরের কাগজে ছাপা হয়েছিল। স্যার অ্যালিস্টার র‍্যাভেন্সক্রন্ট এবং লেডি র‍্যাভেন্সক্রক্ট, তাঁরা অত্যন্ত সুখী দম্পতি। এবং ভদ্রলোক ছিলেন একজন কর্নেল অথবা জেনারেল, তারা সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়িয়েছিল, তারপর তারা কোনো এক জায়গায় আমি ঠিক মনে করতে পারছি না সম্ভবত সেটা বিদেশ হবে এই বাড়িটা কেনে। হঠাৎই একদিন সমস্ত কাগজে এই কেসের খবর বেরুল। অন্য কেউ তাদের খুন করেছে কিনা অথবা তারা পরস্পরকে হত্যা করেছিল কিনা এখন সেটাই একটা প্রশ্ন। এবং আমার যতদূর মনে হয় সেই রিভলবারটা বছরের পর বছর ধরে তাদের বাড়িতে ছিল।

সেই সময় তিনি যা শুনেছিলেন এক এক করে অল্পবিস্তর সব খুলে বললেন পোয়ারোকে, এবং তিনি মাঝে মাঝে বিশেষ বিশেষ জায়গায় এক এক সময় মিলিয়ে নিচ্ছিলেন।

সব শেষে তিনি বলে উঠলেন, কেন সেই ভদ্রমহিলা এ খবর জানতে চাইছেন?

হ্যাঁ, আমিও সেটা জানতে চাই। মিসেস অলিভার বললেন, কারণ আমি সিলিয়ার সাথে যোগাযোগ করতে পারি। অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি ও এখনও লন্ডনেই আছে। এবং আমার ধারণা সে এতদিনে ডিগ্রি পেয়ে গেছে। হয় কেমব্রিজ নয় অক্সফোর্ডে থাকে। সেখানে হয় লেকচারার হিসাবে নয়তো অন্য কোথাও শিক্ষকতার কাজে নিযুক্ত, ও অত্যন্ত আধুনিকা। বড়ো বড়ো চুলওয়ালা পুরুষের সঙ্গে ভয়ঙ্কর পোশাকে মেলামেশা করে। তবে আমার মনে হয় না যে ও ড্রাগে আসক্ত। কখনও কখনও খবর পাই ওর কাছ থেকে। ও আমাকে খ্রিস্টমাসের কার্ড এবং ওই রকম কিছু জিনিস পাঠিয়ে থাকে। ওহো হা, কেউ কি তার ধর্মসন্তানদের কাছ থেকে সব সময় এটা আশা করে না? ওর বয়স তো এখন সবে পঁচিশ কিংবা ছাব্বিশ।

বিবাহিতা নয়?

না। তবে আপাতদৃষ্টিতে বিয়ে করতে যাচ্ছে মিসেস ব্রিটল না বার্টন কক্স-এর ছেলেকে। এবং মিসেস বার্টন কক্স চান না তার ছেলে এই মেয়েটিকে বিয়ে করে কারণ ওর বাবা ওর মাকে হত্যা করেছিল কিংবা ওর মা ওর বাবাকে হত্যা করেছিল।

হ্যাঁ আমিও তাই মনে করি, বললেন মিসেস অলিভার। আমি, একটা জিনিসই খালি চিন্তা করি যেমন ধরুন যদি কারোর অভিভাবকদের মধ্যে কেউ কাউকে হত্যা করে থাকে এবং কোনো ছেলের মায়ের কাছে যাকে মেয়েটি বিয়ে করতে যাচ্ছে, সত্যিই কি সেটা কোনো চিন্তার কারণ হতে পারে?

এই জিনিসটাই সবাইকে চিন্তা করতে হবে, এটা খুবই আগ্রহের ব্যাপার, তবুও আমি মনে করি না যে, স্যার অ্যালিস্টার র‍্যাভেন্সক্রফট কিংবা লেডি র‍্যাভেন্সক্রক্টদের সম্পর্কে কেউ এরকম আগ্রহী হবে। কিন্তু মিসেস বার্টন কক্স-এর ব্যাপারটা অত্যন্ত বিস্ময়কর। ওঁর ছেলে কি ওঁর কাছে খুব প্রিয়? তাই সম্ভবত ওঁর মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।

মিসেস অলিভার আদৌ চান না তার ছেলে এই মেয়েটিকে বিয়ে করুক।

উনি সেইরকমই কোনো আশঙ্কা করছেন যেমন যদি মেয়েটি জন্মসূত্রে ওর মায়ের ভালো-মন্দ গুণগুলো পেয়ে থাকে, যদি ও ওর মায়ের মতো ওঁর ছেলেকেও খুন করে বসে? বা ওই ধরনের অন্য কোনো অপরাধ?

তা আমি কী করে জানব? মিসেস অলিভার বললেন, তিনি হয়তো ভাবছেন, আমি এর বেশি বলতে পারি, কিন্তু সত্যিই তিনি আমাকে এর বেশি কিছু বলেননি। আপনি কি মনে করেন এ সবের আড়ালে কেউ থাকতে পারে? এবং এর কি কোনো অর্থ হতে পারে?

এগুলো খুঁজে বের করা খুব আগ্রহের ব্যাপার, বললেন পোয়ারো।

মিসেস অলিভার বললেন, হ্যাঁ, এই জন্যই তো আপনার কাছে এসেছি। আপনার কি খুব পছন্দ সেগুলোর সন্ধান করার? কিন্তু প্রথমে আপনি সে সব ব্যাপারের কোনো কারণ খুঁজে পাবেন না, কারণ কেউই তা পায় না।

পোয়ারো জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কি মনে হয় মিসেস বার্টন কক্স-এর বিশেষ কোনো পক্ষপাত আছে?

তার মানে আপনি বলতে চাইছেন স্বামী তার স্ত্রীকে খুন করার চেয়ে স্ত্রী তার স্বামীকে খুন করার পক্ষে তিনি তার মতামত জানতে চান? আমার তা মনে হয় না।

পোয়ারো বেশ সহানুভূতি প্রকাশ করে বললেন, আপনার উভয়সঙ্কটের কথা আমি বুঝতে পারছি। এটা খুবই গোপনীয় ব্যাপার যে, পার্টি থেকে আপনি বাড়িতে এলেন এবং আপনাকে এমন একটা কাজ করতে বলা হয় যা আপনার পক্ষে অসম্ভব বলা চলে এবং আপনি অবাক হয়ে ভাবছেন এরকম একটা ঘটনা ঠিকমতো কী করে মোকাবিলা করা যায়।

হ্যাঁ, এবার বলুন এর সঠিক পথ কোনটা? মিসেস অলিভার জিজ্ঞেস করলেন।

আমার পক্ষে বলা অত সহজ নয় কারণ আমি মহিলা নই। বললেন পোয়ারো। তিনি এমন একজন মহিলা, যাকে আপনি চেনেন না এবং আপনি আজই সেই পার্টিতে প্রথম তার সঙ্গে মিলিত হন এবং যিনি আপনার সামনে এই সমস্যাটা রেখেছেন এবং তিনি আপনাকে এই সমসম্যার সমাধান করতে বলেছেন নির্দিষ্ট কোনো কারণ না দেখিয়েই।

হ্যাঁ ঠিক তাই, স্বীকার করলেন মিসেস অলিভার। তিনি জানতে চাইলেন যে, এখন অ্যারিয়াডন কী করবেন আর ওই বা কী করবে? অপরপক্ষে খুব জানতে ইচ্ছা করছে এ-ধরনের সমস্যার খবর আপনি কি খবরের কাগজে পড়েছেন নাকি?

পোয়ারো বললেন, আমার ধারণা তিনটে জিনিস এ করতে পারে। মিসেস বার্টন কক্সকে একটা নোট পাঠাতে পারে, এ বলতে পারে আমি খুবই দুঃখিত। সত্যিই আমি মনে করি এ ব্যাপারে আমি আপনাকে বাধিত করতে পারব না। অথবা আপনি আপনার ধর্মকন্যার সঙ্গে যোগাযোগ করে ওকে বলুন যে, ছেলেটির মা যা যা জানতে চান, অথবা সেই তরুণটি কিংবা যাকে ও বিয়ে করার কথা ভাবছে, আপিন ওর কাছ থেকে জেনে নিতে পারবেন সত্যি সেই যুবকটিকে বিয়ে করার কথা ভাবছে কিনা এবং তাই যদি হয় মেয়েটির কোনো ধারণা আছে, অথবা সেই যুবকটি কী ওকে কিছু বলেছে? তার মার মাথায় কী মতলব এসেছে, যে যুবকটিকে ও বিয়ে করতে যাচ্ছে তার মার সম্পর্কে মেয়েটি কী ভাবে? তৃতীয় জিনিসটা আপনি নিজেও করতে পারেন। আমি আপনাকে দৃঢ়ভাবে পরামর্শ দিতে যাচ্ছিলাম, সেটা…

আমি জানি, বাধা দিয়ে বলেন উঠলেন মিসেস অলিভার। স্রেফ একটা শব্দ।

কিছুই নয়, বললেন পোয়ারো।

মিসেস অলিভার সায় দিয়ে বললেন, আমি জানি সেটা খুব সহজ সরল। একটি মেয়েকে গিয়ে বলা কে আমার ধর্মকন্যা, আর তার ভাবী শাশুড়ি কী বলছেন এবং লোকদের কী জিজ্ঞেস করছেন। কিন্তু

সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন পোয়ারো, আমি জানি এটা মানুষের কৌতূহল।

মিসেস অলিভার বললেন, আমি শুধু জানতে চাই ওই জঘন্য প্রকৃতির মহিলাটি কেন আমার কাছে এসেছিলেন আর কেনই বা অমন সব অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলেছিলেন। কিন্তু যতক্ষণ না জানতে পারছি…

হ্যাঁ, বললেন পোয়ারো। আপনি কিছুতেই ঘুমাতে পারবেন না। আর ঘুমালেও রাতে আপনি জেগে উঠবেন। আর আমি যদি আপনাকে জেনে থাকি তাহলে বলতে পারি আপনার মাথায় অত্যাধিক বিস্ময়কর সব ধারণা গিজগিজ করছে। সেগুলোকে ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারলে একটা আকর্ষণীয় অপরাধমূলক কাহিনি তৈরি করতে পারবেন। রহস্যময় গোয়েন্দা থ্রিলার–এ ধরনের আর কি।

বেশ আমি যদি সেইভাবে ভেবে নিয়ে থাকি তো নিশ্চয়ই পারব। মিসেস অলিভার বললেন। এবং এই সময়ে তার চোখ দুটি একটু উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

ছেড়ে দিন ম্যাডাম, পোয়ারো বললেন, এ-ধরনের প্লট বা উপন্যাসে রূপ দেওয়া অত্যন্ত কঠিন কাজ, আর তাছাড়া মনে হয় না এর জন্য তেমন কোনো ভালো কারণ আছে।

কিন্তু ভালো যে কারণ সেই সেই ব্যাপারে আমি একেবারে নিশ্চিত হতে চাই।

পোয়ারো মন্তব্য করলেন, এটা তো মানুষের স্বাভাবিক কৌতূহল এবং তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন এবং বললেন যে, ইতিহাসের কাছে আমরা কত না ঋণী, জানি না কে প্রথম এই কৌতূহল আবিষ্কার করেছিল। শোনা যায় বিড়ালের সাথে এর সম্পর্ক আছে। আবার এই কৌতূহলই গ্রাস করে বিড়ালকে।

বাধা দিয়ে মিসেস অলিভার বললেন, ঠিক করে আমাকে বলুন তো আমি একজন ভয়ঙ্কর দীর্ঘনাসা পার্কার? আপনি কী মনে করেন?

না, আমি তা মনে করি না। সব কিছু খতিয়ে দেখলে আমার তো মনে হয় না আপনি একজন বিরাট কৌতূহলী মহিলা, বললেন পোয়ারো। কিন্তু আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি সাহিত্যসভায় আপনি বেশ অস্বস্তিবোধ করেছেন, খুব বেশি দয়া ও প্রশংসা আপনার সহ্য হয়নি, বরং একটা বিশ্রী উভয়সঙ্কটে পড়ে গেছেন এবং এক ব্যক্তিকে আপনার ভীষণ অপছন্দ যিনি আগ বাড়িয়ে আপনার কাছে ছুটে এসেছিলেন।

হ্যাঁ, উনি অত্যন্ত ক্লান্তিকর মহিলা যাকে একদম পছন্দ করা যায় না।

অতীতে এই স্বামী-স্ত্রীর খুন হওয়ার ব্যাপারটা কেমন যেন রহস্যজনক। কারণ আপাতদৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে তাদের দুজনের মধ্যে বেশ ভালো সদ্ভাব ছিল। ঝগড়াঝাটির কোনো লক্ষণ ছিল না, অন্তত আপনার মতে কেউ কখনও সেরকম ঘটনা শোনেনি অথবা কাগজে পড়েনি।

তারা গুলিবিদ্ধ হয়, এটা মনে হয় একটা আত্মহত্যার চুক্তি হতে পারে। আমার মনে হয় প্রথমে পুলিশ এই রকমই একটা কিছু ভেবে থাকবে। অবশ্য বহুবছর পরে কেউ কখনও অন্য কোনো ব্যাপার যদি থাকেও সেটা খুঁজে বার করতে পারে না।

হ্যাঁ, ঠিকই। তবে আমার মনে হয় এ ব্যাপারে হয়তো কিছু একটা হদিশ পেলেও পেতে পারি, বললেন পোয়ারো।

তার মানে আপনি কী মনে করেন–উত্তেজিত বন্ধুবান্ধবদের মাধ্যমে আপনি পেয়েছেন?

বেশ তাই হবে। তবে উত্তেজিত বন্ধুবান্ধব আমি বলব না, অবশ্যই কিছু জ্ঞানী বন্ধুবান্ধব, যারা নির্দিষ্ট কয়েকটা রেকর্ড সংগ্রহ করতে পারে এবং অপরাধ অনুষ্ঠানের সেই সময়ে তদন্তের রিপোর্ট দেখতে পারে। আবার সেইসব রেকর্ডের ভেতর থেকে কিছু ফাঁক ফোকর বার করলেও করতে পারি।

মিসেস অলিভার আশান্বিত হয়ে বললেন, সেটা যদি খুঁজে বার করতে পারেন তাহলে আমাকে বলবেন।

হ্যাঁ, পোয়ারো বললেন, আমার ধারণা এই কেসের পুরো ঘটনা যে ভাবেই হোক আপনাকে জানাতে পারব বলে মনে হয়। হয়তো বা একটু সময় লাগতে পারে।

দেখছি, আপনাকে আমি যা করতে বলেছি আপনি যদি সেটা করেন, অবশ্য নিজেকেও মেয়েটির সাথে দেখা করতে হবে এবং জানতে হবে এ ব্যাপারে কোনো কিছু জানে কিনা, ওকে এও জিজ্ঞেস করব ওর শাশুড়িকে জ্ঞান দেব কিনা মানে অন্য কোনো ভাবে আমি ওকে সাহায্য করতে পারি কিনা। আর হ্যাঁ, যে ছেলেটিকে ও বিয়ে করতে যাচ্ছে তাকে দেখার ইচ্ছা আমার আছে।

চমৎকার! তা ঠিক, বললেন পোয়ারো এবং আমার ধারণা মিসেস অলিভার বললেন, যদি কিছু লোক–হঠাৎ মাঝপথে থেমে গেলেন এবং ঐ তুলে তাকালেন তিনি।

এরকুল পোয়ারো তার অভিমত জানালেন যে, এটা একটা অতীতের ঘটনা। সেই সময়ে এর পিছনে একটা কারণ থাকলেও থাকতে পারে, এবং কী সেই কারণ আর কখন থেকে সেটা ভাবতে শুরু করেন? একটা বিস্ময়কর কিছু বলে মনে না হলে এক্ষেত্রে সেটা অনুপস্থিত এবং কেউ সেটা মনেও রাখে না।

না, সে কথা খুবই সত্য, বললেন মিসেস অলিভার। সেই সময়ে খবরের কাগজগুলোতে বেশ কিছুদিন ধরে এই কেসের ব্যাপারে অনেক লেখালেখি হয়। তারপর সব ক্ষেত্রে যা হয় একটু একটু করে ফিকে হয়ে একেবারে চাপা পড়ে যায়। এবার ঘটনাটা একটু ঝালিয়ে নেওয়া যাক। আজ থেকে পাঁচ কিংবা ছয় বছর আগে অন্য আর একটি মেয়ে সেই মেয়েটির মতন তার বাড়ি থেকে একা একা বেরিয়ে পড়ে। হঠাৎ একটি ছেলে বালির স্তূপের ওপর খেলা করার সময় একটা পাথরের স্কুপের খাঁজে মেয়েটির মৃতদেহ আবিষ্কার করে। হয়তো তখন সেখান থেকে বালির স্তূপ সরে গিয়ে থাকবে। পাঁচ কিংবা ছয় বছর পরের ঘটনা।

পোয়ারো বললেন, সে কথা সত্যি, এবং আরও বললেন যে মৃত্যুর দীর্ঘদিন বাদে সেই মৃতদেহ পাবার পর এবং সেই বিশেষ দিনটিতে কী ঘটেছিল এবং লিপিবদ্ধ করে রাখা নানা ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে দেখলে খুনির সন্ধান নিশ্চয়ই পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে কাজটা খুবই কঠিন হবে তার কারণ যে, এর উত্তর হয় একটা নয় দুটোও হতে পারে। হয় স্বামী তার স্ত্রীকে অপছন্দ করতেন তাই তার হাত থেকে রেহাই পেতে চেয়েছিলেন। কিংবা তাঁর স্ত্রী তাকে ঘৃণা করতেন। আবার এমন ঘটনাও হতে পারে যে ভদ্রমহিলার অন্য কোনো প্রেমিক ছিল। সুতরাং এর থেকে মনে করে নেওয়া যেতে পারে যে, এটা একটা আবেগপ্রবণ অপরাধ। কিংবা ভিন্ন ধরনের কিছু। সুতরাং এ কেসের রহস্য খুঁজতে গিয়ে সফল না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এবং হয়তো কিছুই পাওয়া যাবে না সেই সময় পুলিশ যদি কোনো কিছুর হদিশ করতে না পারে। তাহলে খুব সম্ভবত এই কেসের মোটিভ জানা যাবে না। অতএব সেই নদিনের বিস্ময়ের মতোই এটা থেকে যাচ্ছে।

আমার ধারণা আমি ধর্মকন্যার কাছে যেতে পারব, ওই ভয়ঙ্কর মহিলা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে এই কাজটা আমাকে দিয়ে করাতে চেয়েছিল। তিনি ভেবেছেন যে মেয়েটি জানে-ধরে নিলাম মেয়েটি জানে। এবং এও বললেন মিসেস অলিভার, জানেন আজকালকার ছেলেমেয়েরা অস্বাভাবিক অনেক কিছুই জানে।

আচ্ছা বলুন তো সেই সময় আপনার এই ধর্মকন্যার বয়স কত ছিল?

আমি ঠিক মনে করতে পারছি না। তবে আমার মনে হয় মেয়েটি তখন ন-দশ বছরের হবে। তবে বয়সের অনুপাতে তখন বয়স্কাই দেখাচ্ছিল। এটা আমার কল্পনা যে তখন ও স্কুলে ছিল এবং খবরের কাগজে যা পড়েছিলাম যেটুকু মনে আছে বলছি।

কিন্তু আপনি কী মনে করছেন মিসেস কক্স-এর ইচ্ছা আপনাকে দিয়ে মেয়েটির কাছ থেকে খবর সংগ্রহ করা হয় মেয়েটি কিছু জানবে নয়তো ছেলেটিকে ও কিছু বলে থাকবে এবং ছেলেটি তার মাকেও কিছু হয়তো বলে থাকবে। তবে আমার অনুমান মিসেস বার্টন কক্স নিজেই মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করার চেষ্টা করেছিলেন এবং প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। তাই তিনি ভাবলেন মিসেস অলিভার যখন মেয়েটির ধর্ম মা, শুধু তাই নয়, অপরাধতত্ত্ব সম্পর্কে তার প্রভূত জ্ঞান আছে, হয়তো তিনি খবর সংগ্রহ করতে পারেন। তিনি এই ব্যাপারটাকে নিয়ে কেন যে এত মাথা ঘামাচ্ছেন তার কোনো মানে বা কোনো কারণ দেখতে পাচ্ছেন না পোয়ারো। এই একটু আগে আপনি অস্পষ্টভাবে বললেন, লোকেরা সেটাও আমার কাছে ঠিক মতন বোধগম্য হচ্ছে না। কারণ এতদিন বাদে তারা কি আমাদের কোনো সাহায্য করতে পারবে অথবা কেউ কি মনে রাখতে পেরেছে?

মিসেস অলিভারের ধারণা, তারা মনে রেখেছে, হতভম্বের মতো তার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললেন, লোকেরা মনে রাখবে?

হ্যাঁ, ভালো কথা, মিসেস অলিভার বললেন, আমি সত্যি সত্যি হাতিদের কথা ভাবছিলাম, হাতিদের?

মিসেস অলিভার যেন সব যুক্তিতর্কের বাইরে। এবারেও ভাবলেন পোয়ারো অকারণে কিছু কিছু এমন কথা বলে ফেলেন যা বোঝা খুব মুশকিল। এখানে হঠাৎ হাতির প্রসঙ্গ এলো কী করে?

গতকাল মধ্যাহ্নভোজের সময় আমি হাতিদের কথা ভাবছিলাম, বললেন মিসেস অলিভার।

পোয়ারো কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হঠাৎ হাতিদের কথা ভাবছিলেন কেন? ওহো, হা, ভালো কথা, সত্যিই আমি দাঁতের কথাই ভাবছিলাম। কারণ এই দাঁত দিয়েই শক্তজাতীয় কোনো খাবার খাওয়া হয়। এবং আপনার যদি নকল দাঁত থাকে কোনো মতেই কিন্তু আপনি ভালোভাবে খেতে পারবেন না। এবং আপনাকে জানতে হবে কী আপনি খেতে পারেন এবং কী খেতে পারেন না।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পোয়ারো বললেন, ওই ডেন্টিস্টরা আপনার জন্য অনেক কিছু করতে পারে কিন্তু সব কিছু নয়।

তা ঠিকই বলেছেন, অথচ জানেন–আমি ভাবলাম আমাদের দাঁতগুলি কেবলই হাড়, ভয়ঙ্কর ভালো কিছু নয়, অথচ দেখুন কুকুরদের দাঁতগুলোকে সত্যিকারের হাতির দাঁত বলা যেতে পারে। হাতির দাঁতের কথা যখন আপনি ভাবেন তখন নিশ্চয়ই হাতির কথাও ভাবেন? বিরাট হাতির দাঁত। সত্যি ভাবেন না?

মিসেস অলিভার ঠিক কী বলতে চাইছেন সেটা পোয়ারোর কাছে বোধগম্য হল না। তাই আমাদের যা করতে হবে সেটা হল হাতির মতো দাঁত যাদের তাদের খুঁজে বের করা। কারণ হাতিরা বলে থাকে ভুলে যায় না কখনও।

এই প্রবাদটা শুনেছি বৈকি! কথার সায় দিয়ে পোয়ারো বললেন।

হাতিরা কখনও ভোলে না। বাচ্চাদের একটা গল্প নিশ্চয়ই জানেন যে একজন ভারতীয় দর্জি একবার একটি হাতির দাঁতে না উদরে সূচ বা ওই জাতীয় কিছু ফুটিয়েছিলেন। অনেকদিন পরে ঘটনাচক্রে সেই দর্জির সামনে দিয়ে হাতিটা যাচ্ছিল এবং হাতিটার মুখে ছিল ভর্তি জল। অথচ হাতিটার সঙ্গে দজিটার বেশ কয়েক বছর কোনো দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। তখন হাতি কী করলো জানেন? তার মুখ ভর্তি জল লোকটার গায়ে ছিটিয়ে দিল। হাতি কিন্তু ভুলে যায়নি যে লোকটা তার পেটে সূচ বিঁধিয়েছিল। এখন আমার কাজ কী জানেন–কয়েকটি হাতির সংস্পর্শে আসতে হবে আমাকে, বললেন মিসেস অলিভার।

এরকুল পোয়ারো বললেন, আপনি যে কী বোঝাতে চাইছেন এবং কাকে হাতি হিসাবে বিশ্লেষণ করতে চাইছেন, আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে। ঠিক আপনি চিড়িয়াখানায় যাচ্ছেন কিছু খবর সংগ্রহের জন্য।

ভালো কথা, এটা ঠিক সেরকম নয়। বললেন মিসেস অলিভার। যে সব লোক হাতির সাদৃশ্য তাদের সন্ধান করাই হল আমার কাজ। সত্যি কথা বলতে কী কিছু লোক আছে যারা সেই ভয়ঙ্কর ঘটনা মনে রাখতে পারে। যেমন অনেক কিছুই আমি মনে রাখতে পারি। কারণ সেই সব ঘটনাগুলোকে আমি চোখের সামনেই ঘটতে দেখেছিলাম। আমার বয়স তখন পাঁচ। একটি জন্মদিনের পার্টির কথা আজও মনে আছে, তার ছিল একটা ফ্যাকাসে লাল রঙের কেক। এবং কেকের উপরে ছিল একটা চিনির পাখি, অথবা যেদিন আমার প্রিয় গায়ক ক্যানারি পাখিটা খাঁচা থেকে উড়ে পালিয়ে গেল, স্পষ্ট মনে আছে তখন আমি খুব কেঁদেছিলাম। কোনদিন সেটাও আমার স্পষ্ট মনে আছে। দিনটা ছিল মঙ্গলবার কিংবা আর একটা দিনের কথা মনে পড়ে, যে দিন আমি মাঠে গিয়েছিলাম। সেই মাঠে ছিল একটা ষাঁড়। কে যেন বলল ষাঁড়টা গুতিয়ে দিতে পারে, তখন আমি ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম এবং মাঠ থেকে ছুটে পালিয়ে আসতে চেয়েছিলাম। আর আমার মনে আছে চমৎকার একটা পিকনিকের কথা। সেই পিকনিকে আমার খুব প্রিয় ফল জাম ছিল যার ডালপাতায় খোঁচা লাগার মতো খুব কাটা ছিল। খোঁচাও লেগেছিল ভয়ঙ্করভাবে, কিন্তু খোঁচা লাগার যন্ত্রণা আমি ভুলে গিয়েছিলাম কারণ অন্যদের থেকে আমি অনেক বেশি জাম পেয়েছিলাম বলে। তখন আমার বয়স ছিল মাত্র নয়। কিন্তু পরিণত বয়সে একশোরও বেশি বিবাহ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গেছি কিন্তু দুটি অনুষ্ঠান ছাড়া আর কোনো অনুষ্ঠানের আনন্দ উপভোগের কথা আজ আর আমার মনে নেই। সেই দুটি বিশেষ বিবাহ অনুষ্ঠানের কথা কেন মনে আছে তার কারণ হল একটি অনুষ্ঠানে আমি কনের সহচরী হিসাবে যাই। অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন হয়েছিল নিউফরেস্টে এবং সেখানে আর কে কে ছিল মনে নেই। তবে মনে হয় এক খুড়তুতো বোনের বিয়ে ছিল। কিন্তু আমি তাকে খুব একটা জানতাম না, সে শুধু চেয়েছিল একজন ভালো সহচরী, আর আমার অন্তত সে রকম ধারণা যে আমিই কেবল তার নাগালের মধ্যে ছিলাম। দ্বিতীয় বিবাহ অনুষ্ঠান ছিল আমার এক বন্ধুর। সে নেভিতে কাজ করত। একবার সাবমেরিন থেকে পড়ে গিয়ে জলের তলায় তলিয়ে যাচ্ছিল। শুধু তাই নয় অনেক কষ্টে সে রক্ষা পায়। সেই সময়ে যে মেয়েটির সঙ্গে তার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল তার বাড়ির লোকেরা প্রথমে চায়নি এই ছেলেটির সঙ্গে তাদের মেয়ের বিয়ে হোক। সেই জলে ডুবে যাওয়া ঘটনার পরই তারা এই বিয়েতে রাজি হয়। এবং সেই বিয়েতেই কনের সহচরী হিসাবে হাজির হই। সুতরাং আমার এতগুলো কথা বলার উদ্দেশ্য একটাই সেটা হল এমন কতগুলো ঘটনা আছে যা আপনার মনে গেঁথে যায় চিরদিনের জন্য। চেষ্টা করলেও ভুলতে পারবেন না।

এখন দেখছি আপনার যুক্তি বেশ আকর্ষণীয়, পোয়ারো তখন বললেন। তাহলে আপনি হাতি নয় হাতি সদৃশ্য মানুষের খোঁজে যাবেন। হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন তবে যাবার আগে সেই ঘটনার সঠিক তারিখ আমাকে জানাতে হবে। পোয়ারো তাকে ভরসা দিয়ে বললেন, আমি নিশ্চয়ই এই ব্যাপারে সাহায্য করতে পারব।

তাহলে আমি সেই সময়কার লোকেদের কথা মানে যে সব লোক জেনারেলের বন্ধুবান্ধবদের চিনত, এবং সেই সব বন্ধুবান্ধবরা জেনারেলের সব খবর রাখত, এবং এও হতে পারে যারা জেনারেলের বন্ধুদের চিনত তারা হয়তো বিদেশে চলে গেছে। তিনি এও বললেন, যাদের আমি দীর্ঘদিন ধরে চিনি তাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই আমার। অথচ আপনি দেখবেন এমন অনেক লোককে আপনি চেনেন কিন্তু দীর্ঘদিন কোনো দেখাসাক্ষাৎ নেই। হঠাৎ যদি একদিন দেখেন তখন দেখবেন খুব খুশি হবে অথবা তারা আপনাকে ভালো করে চিনতে না পারলেও চেনবার চেষ্টা করবে। এবং তখনই আপনি সেই নির্দিষ্ট দিনের ঘটনার প্রসঙ্গ তুলে আলোচনা চালিয়ে যেতে পারবেন।

পোয়ারো বললেন, দারুণ তো, এটা খুবই আকর্ষণীয় ব্যাপার। আপনার কোনো কাজে অসুবিধা হবে না কারণ আপনি খুব ভালোভাবেই প্রস্তুত হয়ে আছেন। যে সব লোক র‍্যাভেন্সক্রফটদের চিনত ভালোভাবে অথবা ভালোভাবে নয়, কিংবা যেসব লোক সেই ঘটনাস্থলের কাছাকাছি বাস করত, তাদের খুঁজে বার করা একটু কঠিন হলেও আমি মনে করি শেষ পর্যন্ত সাফল্য আসবেই। সেই দিন কী ঘটেছিল এবং সেই ঘটনার ব্যাপারে তারা কী চিন্তা করে বা কেউ কী আপনাকে কিছু বলেছে, এইভাবে আলোচনা চালিয়ে যেতে যেতে একটু গভীরে গিয়ে প্রশ্ন রাখবেন তাদের কাছে, স্বামী অথবা স্ত্রীর অন্য কোনো নারী অথবা পুরুষের সঙ্গে প্রেমঘটিত কোনো ব্যাপার ছিল কিনা। কিংবা কোনো অর্থের উত্তরাধিকারী কেউ ছিল কিনা। আমার মনে হয় এই পথ ধরে এগোলে অনেক অজানা তথ্যের সন্ধান আপনি হয়তো পেতে পারেন।

মিসেস অলিভার বললেন, ওহে প্রিয়, আমার মনে হয় সত্যিই আমি দীর্ঘনাসা-পার্কার।

পোয়ারো বললেন, আপনাকে এখন একটা কাজ দেওয়া হয়েছে, আপনার পছন্দমতো কারোর দ্বারা নয় বা আপনি কাউকে বাধিত করতে চান এমন কারোর দ্বারাও নয়। কিন্তু সে এমন একজন যাকে আপনি অপছন্দ করেন, আপনাকে মনে রাখতে হবে জ্ঞান সঞ্চয়ের অভীষ্ট লক্ষে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন, অবশ্য সেটা কোনো ব্যাপার নয়। সুতরাং আপনি আপনার নিজের পথ গ্রহণ করুন। সে পথ হচ্ছে হাতিদের। কারণ হাতিরা মনে রাখতে পারে।

মিসেস অলিভার বললেন, আমি সত্যিই ক্ষমা চাইছি আপনার কাছে।

পোয়ারো বললেন, যে সব হাতিরা মনে রাখে তাদের খোঁজে আপনাকে আবিষ্কারের অভিযানে আমি পাঠাচ্ছি।

মিসেস অলিভার খুব দুঃখের সঙ্গে বললেন যে, এ আমার পাগলামো এবং আমার মনে হয় আমি পাগল। স্ট্রেট ওয়েলপিটারের ছবির মতো নিজেকে ফুটিয়ে তোলার জন্য তিনি তার চুলের ভেতর হাত চালালেন। গোল্ডেন রিট্রিভার-এর বিষয়ে একটি গল্প লিখতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু কিছুতেই শুরু করতে পারিনি এবং ঠিকমতো এগোতে পারছিলাম না কারণ আমি কী বোঝাতে চাইছি আপনি যদি তা জানেন–

ঠিক আছে এখন বরং গোল্ডেন রিট্রিভারের কথা বাদ দিন, এখন শুধু হাতিদের ওপর মনোযোগ দিন।

.

সিলিয়া

বাইরে ম্যাটের ওপর একটি মেয়েকে দাঁড়াতে দেখে মিসেস অলিভার হতভম্বের মতো তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে দেখলেন এবং মনে মনে ভাবলেন এই তাহলে সিলিয়া। মিসেস অলিভারের মতো অনুভূতি অন্য আর কারোর মধ্যে দেখা যায় না। জীবন এবং জীবনশক্তির প্রভাব খুবই শক্তিশালী।

তিনি তাকে দেখে যেন ভাবছিলেন এ যেন অন্য এক মেয়ে যার সম্বন্ধে অন্য কিছু ভাবা যেত। হয়তো আগ্রাসী নয়তো কঠিন বা একেবারেই বিপজ্জনক। যে সব মেয়েদের জীবনে একটা উদ্দেশ্য থাকে সেই সব মেয়ে হয়তো সংঘর্ষের পথে নিজেকে উৎসর্গ করে এবং হয়তো বা তার পিছনে কোনো কারণ থাকতে পারে। অবশ্যই আকর্ষণীয় বটে।

আরে এসো এসো ভেতরে এসো। অনেক দিন বাদে আবার তোমার সাথে আমার দেখা, খুব সম্ভবত কোনো একটা বিবাহ অনুষ্ঠানে দেখেছিলাম কনের সহচরী হয়ে, এবং তোমার পরনে ছিল সিফনের পোশাক, এবং কিসের যেন বড়ো বড়ো গুচ্ছ ঠিক মনে পড়ছে না। কি ছিল সেটা, অনেকটা গোল্ডেন রডের মতন দেখতে?

খুব সম্ভব গোল্ডেন রডই ছিল, বলল সিলিয়া র‍্যাভেন্সক্রফট। আমরা অনেক হাঁচি দিয়েছিলাম–ঠিক তৃণাদি বা বালি নাকে ঢুকে গেলে যে অবস্থা হয় ঠিক আমাদের হাঁচি দেখে–সেরকমই মনে হয়েছিল। মারথা লেবাহন তাই না? সে এক যেন ভয়ঙ্কর বিয়ের আসর। এমন বিশ্রী সহচরীর পোশক আগে কখনও দেখিনি এবং অমন বিশ্রী পোশাক কখনও পড়িনিও।

হ্যাঁ, ঠিক অন্যদের থেকে একেবারে আলাদা এবং আমি বলব, তোমাকেই সবচেয়ে ভালো দেখাচ্ছিল।

সেটা আপনার চোখে ভালো লাগা। মোটেই আমার কাছে ভালো লাগেনি, সিলিয়া বলল। একটা চেয়ারে মিসেস অলিভার তাকে বসতে বললেন এবং বললেন, শেরি না অন্য কিছু, তুমি কী পছন্দ করো?

না, শেরিই আমি পছন্দ করি।

ও আমি ভেবেছিলাম তোমার এটা বিশ্রী লাগবে। মিসেস অলিভার বললেন, হঠাৎ তোমাকে কেন ডেকেছি জানো?

না, আমি জানি না। নিশ্চয়ই কোনো বিশেষ ব্যাপারে।

আমি যে খুব একটা বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন ধর্ম মা নই এই ব্যাপারে আমার মনে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

এই বয়সে আপনি কেন সেরকম হতে যাবেন?

তুমি ঠিকই বলেছ। মিসেস অলিভার বললেন, কারোর কর্তব্য আবার কারোর অনুভব করার স্পৃহা একটা নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হয়ে যায়। আবার নিজেকে পরিপূর্ণভাবে ভরিয়ে তুলতে পেরেছি তাও নয়। কিন্তু তোমার পাকাপাকি স্বীকৃতিতে যাওয়ার কথা আমার মনে পড়ে না।

আমার বিশ্বাস ধর্মমা-র কর্তব্য হল ধর্মসন্তানদের প্রশ্ন উত্তরের মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া এবং যা কিছু খারাপ সব পরিত্যাগ করা, তাই নয় কী? এই কথা বলার সময় সিলিয়ার ঠোঁটে কৌতুকের হাসি ফুটে উঠল।

মিসেস অলিভার ভাবলেন মেয়েটি খুব নম্র বিনয়ী। কিন্তু কতকগুলো ব্যাপারে সাংঘাতিক বিপজ্জনক মেয়ে।

হ্যাঁ, ভালো কথা, মিসেস অলিভার বললেন, কেন আমি তোমাকে ডেকেছি তা বলব এবং সমস্ত ব্যাপারটাই অদ্ভুত। আমি কখনও কোনো সাহিত্য সভায় যাই না কিন্তু তবু গত পরশু একটা সাহিত্যের ভোজসভায় আমাকে যেতে হয়েছিল।

হ্যাঁ, খবরের কাগজে আপনার নাম মিসেস অ্যারিয়াডন অলিভার আমি দেখেছি। বলল সিলিয়া এবং খবরটা পড়ে আমি বিস্মিত হই। কারণ সচরাচর আপনি এরকম পার্টিতে যান না কখনও।

তার উত্তরে মিসেস অলিভার বললেন, না, এ রকম পার্টিতে আমার যেতেও ইচ্ছা করে না।

কেন আপনি আনন্দ উপভোগ করেননি? হ্যাঁ আনন্দ করেছিলাম বৈকি। এই প্রথমই এই ধরনের পার্টিতে আমি যাই। এখানে কিছুটা আমেজ থাকে কিছুটা আনন্দ থাকে কিন্তু এমন কিছুও থাকে যা বিরক্তির কারণ হতে পারে।

এমন কিছু ঘটেছিল কি যাতে আপনি বিরক্তি বোধ করেন?

হ্যাঁ, আর সেই ঘটনা তোমাকে জড়িয়ে এবং আরও ভাবলাম তোমাকে এ-সম্বন্ধে বলতেই হবে কারণ যা ঘটেছিল আমি একদম সেটা পছন্দ করি না।

সিলিয়া বলল, এটা যেন ঠিক ষড়যন্ত্রের মতো শোনাচ্ছে, এই বলে সে শেরিতে চুমুক দিল।

একজন ভদ্রমহিলা উপযাচক হয়ে কথা বলতে এলেন যাঁকে আমি চিনি না এবং তিনিও আমাকে চেনেন না।

আপনার জীবনে এসে রকম ঘটনাও ঘটেছে বলেও আমার মনে হয়।

মিসেস অলিভার বললেন, হ্যাঁ নিশ্চিতভাবেই ঘটেছিল। সাহিত্য জীবনে আকস্মিক ব্যাপারটা, তুমি মনে করো তোমার সামনে দাঁড়িয়ে কোনো লোক বলল, আমি আপনার বই খুব ভালোবাসি এবং আপনার সঙ্গে মিলিত হতে পেরে আমি খুব খুশি। এই রকম ব্যাপারটা আর কি।

ওই রকম কঠিন সব ব্যাপার আমার জানা আছে কারণ একসময় আমি একজন সাহিত্যিকের সেক্রেটারি ছিলাম।

হ্যাঁ, ঠিক এই ধরণের ঘটনা বটে, তবে তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম। এবং সেই মহিলাটি আমার কাছে এসে বললেন, আপনার একজন ধর্মকন্যা আছে এবং তার নাম সিলিয়া র‍্যাভেন্স ক্রট।

আপনার কাছে এসেই আমার কথা বললেন, কী বিশ্রী ব্যাপার, সিলিয়া বলল। কোথায় প্রথমে আপনার বই প্রসঙ্গে আলোচনা করবেন এবং আরও বলবেন আপনার শেষতম বইটি পড়ে খুব আনন্দ পেয়েছি বা সেই রকম কিছু। তারপর নয় আমার প্রসঙ্গে আসতে পারতেন। আমি বুঝতে পারছি না আমার বিপক্ষে তিনি কী এমন খুঁত পেয়েছেন?

তোমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ওঁর নেই বলেই আমার মনে হয়, বললেন মিসেস অলিভার।

তিনি কি আমার বন্ধু?

শুধু জানি না বললেন মিসেস অলিভার। ঠিক এই সময়ে দুজনের মধ্যে একটা নীরবতা নেমে এলো এবং শেরির গ্লাসে চুমুক দিয়ে সিলিয়া মিসেস অলিভারের দিকে তাকালেন সন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে।

সিলিয়া বলল, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না আপনি কোনো পথ ধরে চলছেন? আমার ধারণা আপনি আমাকে ষড়যন্ত্রের মধ্যে ফেলছেন।

ঠিক আছে, আশা করি আমার ওপর রাগ করবে না তুমি, বললেন মিসেস অলিভার।

আমি আপনার ওপর রাগ করতে যাব কেন?

কারণ তোমাকে এমন কিছু কথা বলব এবং এমন কিছু একটার পুনরাবৃত্তি করতে যাব তুমি শুনে হয়তো বলবে এটা আমার কোনো ব্যাপার নয় বা এমনও হতে পারে আমাকে মুখ বুজে চুপ করে থাকতে হবে এবং সেটা আর কখনও উল্লেখ করতে পারব না।

সিলিয়া বলল, আপনি কিন্তু আমার কৌতূহল জাগিয়ে তুলছেন।

তিনি আমাকে তাঁর নাম বলেছিলেন মিসেস বার্টন কক্স।

সিলিয়া বলল, ওঃ যথেষ্ট।

তুমি কি ওঁকে চেনো?

হ্যাঁ, ওঁকে আমি চিনি।

আমিও কিন্তু মনে মনে ভেবেছিলাম তুমি হয়তো চিনতে পারো কারণ—

কারণ কী বলে মনে হয় আপনার?

কারণ এমন কিছু তিনি বলেছিলেন

কী–আমার ব্যাপার? তিনি আমাকে চেনেন বলে?

তিনি বলেছিলেন যে তার ধারণা তার ছেলে হয়তো তোমাকে বিয়ে করতে যাচ্ছে। এই কথা শোনার পর সিলিয়ার মুখের ভাবের পরিবর্তন দেখা গেল। সে কঠিন চোখে মিসেস অলিভারের দিকে তাকালো। আপনি কি সেই ব্যাপারে কিছু জানতে চান?

মিসেস অলিভার বললেন, না, এই ব্যাপারে আমি জানতে চাই না। তোমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে আমি নাক গলাতে চাই না। সেটা তোমাদের দুজনের মন দেওয়া নেওয়া ব্যাপার। আমি শুধু উল্লেখ করলাম, কারণ প্রথমেই তিনি এই প্রসঙ্গটা তুলেছিলেন আমার কাছে। আর যেহেতু তুমি আমার ধর্মকন্যা তাই তোমাকে আমি জিজ্ঞেস করতে পারব কয়েকটা খবর আমাকে দেবার জন্য। তোমার কাছ থেকে সেই খবরটা পেলে আমি অন্তত তাকে সেটা জানতে পারব, তিনি হয়তো সেটা ভেবেছিলেন আমার ধারণা।

কী খবর?

ওঃ ভালো কথা, আমি যে কথাটা তোমাকে এখন বলতে যাব আমার মনে হয় না তোমার সেটা পছন্দ হবে। অবশ্য আমি নিজেও সেটা পছন্দ করি না। আমি মনে করি ভদ্রমহিলার অমন বিশ্রী স্বভাব এবং নোংরা মনোভাব একেবারেই ক্ষমার অযোগ্য। তিনি আমাকে এও বলেছিলেন যে, মেয়েটির বাবা তার মাকে খুন করেছিল অথবা তার মা তার বাবাকে খুন করেছিল, আপনি কি খবরটা খুঁজে বার করতে পারবেন?

একথা তিনি আপনাকে বলেছেন এবং সেটা করতেও আপনাকে বলেছেন?

হ্যাঁ।

আপনাকে একজন লেখিকা জেনেও সেই সাহিত্যের ভোজসভায় এ-ধরনের কথা আপনাকে বলতে পারলেন কী করে?

তিনি আমাকে আদৌ চেনেন না কারণ তিনি কখনও আমার সঙ্গে মিলিত হননি এবং আমিও তাকে দেখিনি কখনও।

সেটা কি আপনার কাছে বিস্ময়কর বলে মনে হয়নি?

না, ওই ভদ্রমহিলার মধ্যে আমি তেমন বিস্ময়কর কিছু দেখতে পাইনি। উপরন্তু তিনি কেবল আমাকে আঘাত করে গেছেন। মিসেস অলিভার বললেন, তিনি একজন জঘন্য প্রকৃতির মহিলা।

হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন।

তুমি তার ছেলেকে বিয়ে করছ নাকি?

এই বিষয়ে আমরা দুজনে আলোচনা করছি। এখনও পর্যন্ত কিছুই ঠিক হয়নি। আপনি কি জানেন তিনি এই বিষয়ে কথা বলেছিলেন?

হ্যাঁ, আমি জানি। কারণ আমার ধারণা যে কেউ সেটা জানতে চাইবে যে, তোমাদের পরিবারের সঙ্গে কে কে পরিচিত?

আমার বাবা আর মার সম্পর্কে বলছি তাহলে শুনুন। সেনাবিভাগ থেকে অবসর নেবার পর কান্ট্রিতে একটা বাড়ি কেনেন আমার বাবা। একদিন ওঁরা দু-জন পাহাড়ের পথে বেড়াতে যান এবং সেখানেই ওঁদের দুজনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। সেখানে যে রিভলবার পাওয়া যায় সেটা ছিল আমার বাবারই। আমার বাবা মাকে প্রথম গুলিবিদ্ধ করে পরে নিজে করেন কিংবা আমার মা বাবাকে প্রথম গুলি করে পরে নিজেকে গুলিবিদ্ধ করেন অথবা সেটা আত্মহত্যার চুক্তি কিনা কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে, আমার মনে হয় আপনি এই খবর আগেই পেয়ে গেছেন।

মিসেস অলিভার বললেন, হ্যাঁ, একরকম ভাবে জেনেছি। তবে আমার মনে হয় প্রায় ছয় বছর আগে এটা ঘটেছিল।

হ্যাঁ, প্রায় সেই রকমই হবে।

এবং সেই সময় তোমার বয়স ছিল বারো অথবা চোদ্দ।

হ্যাঁ।

মিসেস অলিভার বললেন, এ ব্যাপারে আমি বেশি কিছু জানি না কারণ সেই সময় আমি আমেরিকায় যাই লেকচার টুরে। আমি শুধু খবরের কাগজে পড়েছিলাম। খবরটা বেশ বড়ো করে বেড়িয়েছিল। তখন আসল সত্যটা জানা খুব কঠিন ছিল কারণ খুনের মোটিভের কোনো চিহ্ন ছিল না, তোমার বাবা-মার মধ্যে বেশ ভালো সম্ভব ছিল এবং তারা খুব সুখী ছিলেন। সেটাও কিন্তু কাগজে উল্লেখ করা হয়েছিল। আমার আগ্রহ থাকার একটাই কারণ তোমার মা স্কুল থেকেই আমার বন্ধু ছিল এবং পরবর্তীকালে তোমার বাবা-মার সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়। তার কিছুদিন পর আমাদের দুজনের পথ আলাদা হয়ে যায় কারণ আমার বিয়ে হয়ে অন্যত্র চলে যাই এবং তোমার মা বিয়ে করে অন্য জায়গায় চলে যান। তবে আমার যতদূর মনে পড়ে মালায়েতে অথবা সেরকম জায়গায় তার সৈনিক স্বামীকে নিয়ে সে চলে যায়। তোমার মা আমাকে বলেছিলেন তার যে কোনো একটি সন্তানের ধর্ম মা হবার জন্য এবং তোমাকেই আমি ধর্ম কন্যা হিসাবে নিলাম। বছরের পর বছর ধরে তোমার মা বাবা বিদেশে থাকতেন ফলে তাদের সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাৎ হত না এবং তোমার সাথেও আমার দেখা হত একটা বিশেষ উপলক্ষে।

হ্যাঁ, আমার একটু একটু মনে আছে। আপনি আমাকে স্কুল থেকে নিয়ে আসতেন এবং ভালো ভালো খাবার খাওয়াতেন।

কাগজে, এই ব্যাপারের লেখা দেখে আমি খুব মর্মাহত হয়েছিলাম। এই খুনের নির্দিষ্ট কোনো মোটিভ ছিল না, ঝগড়া বিবাদের কোনো চিহ্ন ছিল না এবং বাইরে থেকে তাদের কোনো আক্রমণের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আমি এসব জেনেছি কারণ এই মামলার বিচারের রায় খোলাখুলি ছিল। মিসেস অলিভার বললেন, তারপর ব্যাপারটা আমি একদম ভুলে যাই। আমি শুধু চিন্তা করি এবং অবাক হই কোন পরিস্থিতি তাদের হত্যা বা আত্মহত্যার পথে ঠেলে দিতে পারে এবং এই ঘটনার পিছনে কী ভয়ঙ্কর ঘটনা থাকতে পারে? যেহেতু আমি সেই সময় আমেরিকায় ছিলাম সেইহেতু এই ব্যাপারে বেশি দূর এগোতে পারিনি। তারপর যখন তোমাকে দেখি স্বভাবতই তোমাকে এই ব্যাপারে কোনো কথা বলতে পারিনি।

না, তার জন্য আমি তারিফ করি, বলল সিলিয়া।

মিসে অলিভার বললেন, সারাজীবন ধরে কেউ তার বন্ধু বা পরিচিত কাউকে কেন্দ্র করে দারুণ কৌতূহলের মধ্যে পড়ে থাকুক। তার মনের অবস্থা তখন কেমন হবে বা হতে পারে ভাবতে পারো। যদি বন্ধু হয় তবে তোমার একটা অন্তত ধারণা হতে পারে যে, কোনো ঘটনার থেকে সেই কৌতূহলের সৃষ্টি-কিন্তু সেই ঘটনা যদি দীর্ঘ সময়ের হয় অথবা যদি তুমি দেখো সেটা নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা করতে, তুমি কিন্তু তখন সম্পূর্ণ অন্ধকারে। অথচ তোমার এমন কেউ নেই যার কাছে তুমি কৌতূহল দেখাতে পারো।

সিলিয়া বলে, আমার বেশ মনে আছে যে, যখন আমার বয়স একুশ আপনি খুব সুন্দর সুন্দর উপহার পাঠিয়েছিলেন।

তার কথা শুনে মিসেস অলিভার বললেন, একটা সময় আসে যখন মেয়েদের বাড়তি নগদ টাকার প্রয়োজন হয় কারণ তখন তারা অনেক কিছু করতে চায় আর তাদের হাতে তখন যদি নগদ বাড়তি টাকা না থাকে, তাহলে তাদের ইচ্ছা পূরণ করবে কী করে?

হ্যাঁ, আমি ভাবি আপনি একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি আর আপনি এও জানেন কার কী পছন্দ। আপনি আমাকে বাইরে নিয়ে যেতেন অদেখা জিনিস দেখানোর জন্য বা চমৎকার খাবার খাওয়ানোর জন্য। আমার সঙ্গে মিশে সুখ দুঃখের গল্প করতেন দূর সম্পর্কের কোনো আত্মীয়ার মতন। আমি আমার জীবনে বহু দীর্ঘনাসা পার্কারের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। কিন্তু সব সময়ে নিজেকে প্রশ্ন করে আপনার সম্পর্কে জানতে চাই।

হ্যাঁ, আগে কিংবা পরে প্রত্যেকে সেটার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠবে। মিসেস অলিভার বললেন, এই বিশেষ পার্টিতে আমার সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেছে, আমার মনে হচ্ছে একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত আগন্তুকের নির্দেশে একটা বিস্ময়কর কাজ আমাকে করতে হবে এবং সেই আগন্তুকটি হলেন মিসেস বার্টন কক্স।

আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না কেন তিনি এই বিষয়ে জানতে চাইছেন। আর যখন এটা তার ব্যাপার নয় যদি না…আপনি হয়তো ভেবেছেন ডেসমন্ডকে যদি আমার বিয়ে করার প্রশ্নটা জড়িয়ে না থাকত, হা তা তো বটেই। শত হলেও ডেসমন্ড তাঁর ছেলে।

হ্যাঁ, আমারও ধারণা তাই। তবুও কিছুতেই আমি বুঝতে পারছি না কী করে বা কেমন করে এটা তার ব্যাপার হতে পারে।

সবকিছুই তার কাছে নিজের ব্যাপার বলে মনে হয়। দেখেছেন তো তাঁর নাকটা কতটা উঁচুতে। ওই যে আপনি বলেছিলেন না কী যেন ও হা একজন জঘন্য প্রকৃতির মহিলা।

আমি কিন্তু খবর নিয়েছি যে, ডেসমন্ড জঘন্য চরিত্রের ছেলে নয়।

না, না আমি ডেসমন্ডের খুব প্রিয় এবং ডেসমন্ডও আমার প্রতি অনুরক্ত। কিন্তু তথাপি ওর মাকে আমি মোটেই পছন্দ করি না।

সে কি তার মাকে পছন্দ করে জানো?

খোলাখুলিভাবে সিলিয়া বলল, বিশ্বাস করুন আমি কিছু জানি না। আমার মনে হয় সে তার মাকে পছন্দ করে থাকতে পারে। যাইহোক আমি এখনি বিয়ে করতে চাই না এবং সেরকম কিছু অনুভবও করি না। আর এই বিয়ের পক্ষে ও বিপক্ষে অনেক বাধা বিপত্তি তো থাকবেই, আপনি সেটা জানেন। সিলিয়া আরও বলল যে, এটা আপনাকে কৌতূহলের চেয়ে নিশ্চয়ই অনুভবের খোরাক জোগাবে। কারণ রোজি কক্স কেন আপনাকে বলবেন আমার কাছ থেকে গরম গরম খবর বের করার চেষ্টা করতে। আর সেটা আপনার কাছে ফাস করে দিতে, আমি বলতে চাইছি আপনি কী সেই বিশেষ প্রশ্নটা করবেন।

তুমি কী বলতে চাইছ আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করব তোমার মা কি তোমার বাবাকে খুন করেছিলেন অথবা তোমার বাবা তোমার মাকে খুন করেছিলেন বা এটা জোড়া আত্মহত্যা? তুমিও কি তাই মনে করো?

আমার মনে হয় সেটাই। কিন্তু আমার মনে হয় আপনি আমার কাছ থেকে যে সব খবর পাবেন কিংবা ধরুন যদি-যদি সেই খবরগুলো পান আপনি তাহলে কি মিসেস বার্টন কক্সকে খবরগুলো পাচার করবেন?

না, মিসেস অলিভার বললেন, ওই জঘন্য চরিত্রের মহিলাকে আমি কোনো কিছু বলার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। বরং তাকে বলব এটা তার বা আমার কারোরই কোনো ব্যাপার নয়।

আমিও সেটা ভেবেছি, সিলিয়া বলল। আমার মনে হচ্ছে আপনাকে আমি বিশ্বাস করতে পারি। তাই আমি যতটুকু জানি ঠিক ততটুকুই বলতে আমার কোনো আপত্তি নেই। যেমন ধরুন

আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করছি না আর তোমারও আমাকে বলার প্রয়োজন নেই।

তবে উত্তর আমি আপনাকে দেবই এবং সেই উত্তরটা হল–কিছুই নয়।

কিছুই নয়, চিন্তিত গলায় মিসেস অলিভার জিজ্ঞেস করলেন।

না। সেই সময় আমি সেখানে ছিলাম না। এখন আমি মনে করতে পারছি না ঠিক তখন আমি কোথায় ছিলাম। তবে আমার মনে হয় আমি তখন সুইজারল্যান্ডের একটা স্কুলে ছিলাম অথবা স্কুলের ছুটির দিনগুলিতে আমার স্কুলের এক বন্ধুর কাছে ছিলাম। আমার যেন কেমন সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।

মিসেস অলিভার সন্দেহ প্রকাশ করে বললেন, আমারও ধারণা তোমাকে যে জানতেই হবে তার কোনো মানে নেই, কারণ সেই সময় তোমার বয়সের কথা চিন্তা করলে এরকম একটা ধারণা করে নেওয়া যায়।

সিলিয়া বলল, আমার জানতে খুব আগ্রহ হয় আপনার কি মনে হয় আমি সব কিছু জানি? অথবা জানি না?

কেন, তুমিই তো বলেছ সেই সময় তুমি বাড়িতে ছিলে না। সেই সময় যদি তুমি বাড়িতে থাকতে আমি তখন বলতাম হা, তবুও আমার মনে হয় তুমি কিছু জানেনা, শিশুরা এবং টিনএজাররা জানে। তারা অনেক কিছুই দেখে থাকে। তারা যা জানে তারা সব বলতে চায় না। পুলিশি তদন্তের কথা তুমি শুনবে?

না, আমি জানি আপনার বিবেচনা শক্তি আছে। আমার জানার কোনো দরকার নেই এবং আমি এও ভাবি না যে, আমি কিছু জানি। আমি মনে করি না যে, এ ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা আছে। পুলিশ কী ভাবছে? অবশ্য আমার এই জিজ্ঞেস করার জন্য আপনি যেন কিছু মনে করবেন না। আমি জানতে আগ্রহী কারণ তদন্তের রিপোর্ট বা কোনো কিছু সেরকম আমি কাগজে পড়িনি।

আমার মনে হয় তারা এটাকে জোড়া আত্মহত্যা বলে ভেবে নিয়েছে। কিন্তু আমি মনে করি না। তার কারণ সম্পর্কে তাদের সামান্য ধারণা তাদের আছে।

আপনি জানতে চান আমার ধারণা কী?

তুমি আমাকে বলতে না চাইলে বলো না–বললেন মিসেস অলিভার।

আমার মনে হচ্ছে আপনি জানতে খুবই আগ্রহী। বিশেষ করে অপরাধ কাহিনি যখন লিখে থাকেন। যারা নিজেদের হত্যা করে বা পরপর খুনোখুনি করে মারা পড়ে। অথবা এ-ব্যাপারে যাদের সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে। আমার নিশ্চয়ই ভাবা উচিত যে, আপনি অবশ্যই আগ্রহী হবেন।

হ্যাঁ, আমি অবশ্যই তা স্বীকার করি। মিসেস অলিভার বললেন। কিন্তু একটা খবর জানতে চেয়ে তোমাকে হয়তো আমি অপমান করব যা জানতে চাওয়া আমার এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে না।

বুঝেছি, সিলিয়া বলল। এক সময় আমি নিজেই অবাক হয়ে যাই মানে আমি বলতে চাই, বাড়ির পরিবেশ তখন কী রকম ছিল এবং কী কী ঘটনা ঘটত সেখানে। সেই ছুটির আগে আমি কন্টিনেন্টে চলে যাই। সেই সময়ের হাল আমল বলতে যা বোঝায় আমি কিছুই জানি না। আমার স্কুল জীবনে বাবা মা যতদিন জীবিত ছিলেন মাত্র একবার কী দুবার আমাকে আনার জন্য সুইজারল্যান্ডে গিয়েছিলেন। ওঁদের তখন আমার স্বাভাবিক বলেই মনে হত। মনে হয় বাবা খুব অসুস্থ ছিলেন এবং দিনকে দিন দুর্বল হয়ে পড়ছিলেন। ওঁর হার্টটা হয়তো খারাপ হয়েছিল। আমার মাও যেন স্নায়ুর অসুখে ভুগছিলেন। তবে ওঁরও স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়েছিল। ওঁদের বেশ বন্ধুর মতন সম্পর্কে ছিল আমি অন্তত সেটাই দেখেছিলাম। কোনো কোনো সময়ে কারোর মনে একটা বিরূপ ধারণা হতে পারে। কিন্তু কেউ ভাবতে পারে না সেটা সত্য হোক অথবা প্রয়োজনে সেটা ঠিক হোক। কিন্তু কেউ অবাক হয় যদি

আমি মনে করি না এ-ব্যাপারে আর কোনো কথা বলা ঠিক হবে। আমাদের আর এ-ব্যাপারে কোনো অনুসন্ধান করার অথবা জানার দরকার নেই। এবং বিচারের রায়ও সন্তোষজনক। এর পিছনে কোনো রকম মোটিভও নেই। বললেন মিসেস অলিভার।

সিলিয়া প্রত্যুত্তরে বলল, আমি চিন্তা করি কোনটা সম্ভব হতে পারে। আমার মনে হয় আমার বাবাই মাকে খুন করেছিলেন। কারণ এটাই ভাবা স্বাভাবিক। একজন পুরুষের পক্ষে যে কোনো লোককে গুলি করাটা যতটা সম্ভব একজন নারীর ক্ষেত্রে যে কোনো কারণেই তোক একজন নারী, আরও পরিষ্কার করে বলা উচিত অর্থাৎ আমার মতো নারী আমার বাবাকে গুলি করতে পারেন আমি কল্পনাই করতে পারি না। আবার আমার মনে হয় বাবা যদি সত্যি সত্যিই মৃত্যু চাইতেন তাহলে তোত অন্য উপায়ও ছিল। আবার এও মনে মনে হয় ওঁরা কেউ কারোর মৃত্যু চাইতেন না।

সুতরাং বাইরের কেউ একজন হতে পারে?

হ্যাঁ, কিন্তু বাইরের লোক বলতে আপনি কী বোঝাতে চাইছেন? সিলিয়া জিজ্ঞেস করল।

সেই বাড়িতে আর কে কে থাকত? ওঃ ওই বাড়িতে ছিলেন একজন হাউজকিপার বয়স্ক অথচ বোবা ও কালা, একজন বিদেশিনী মেয়ে সে ছিল আমার গভরনেস। কিছুদিন মা হাসপাতালে ছিলেন, ওখান থেকে ফিরে আসার পর আমার গভরনেস আবার এসেছিলেন মাকে দেখাশুনা করার জন্য। সে খুব ভালো মেয়ে ছিল। এবং আরও একজন ছিলেন মামিমা, তাকে আমি মোটেই পছন্দ করতাম না। তাদের মধ্যে কোনো এক জনের কোনো রাগ বা বিদ্বেষ ছিল, আমার কিন্তু তা মনে হয় না। কারণ ওঁদের মৃত্যুতে তাদের মধ্যে কেউই লাভবান হবে না, আমি আর আমার চার বছরের ছোটো ভাই এডওয়ার্ড ছাড়া। আমার বাবামা-র যা সঞ্চিত অর্থ ছিল অবশ্য খুব বেশি টাকা ছিল না, বাবার পেনসন ছিল আর মার নিজস্ব স্বল্প আয় ছিল। আমরা দুই ভাই বোন তার উত্তরাধিকারী হই।

আমি দুঃখিত, সত্যিই আমার খুব খারাপ লাগছে তোমাকে জিজ্ঞেস করার জন্য এবং আমি হয়তো তোমাকে অসুবিধায় ফেললাম। মিসেস অলিভার বললেন।

না, আমাকে একটুও অসুবিধায় ফেলেননি বরং ব্যাপারটাকে আপনি আমার মনে জাগিয়ে তুললেন এবং সেটার প্রতি আমার আগ্রহ জাগছে জানার জন্য। আমার আগ্রহ হচ্ছে এই কারণে যে আমার এখন বোঝবার জানবার বয়স হয়েছে। তারা ছিলেন অতি প্রিয়জন, অবশ্য প্রত্যেক মানুষের কাছেই তাদের অভিভাবক অতি প্রিয় এবং কাছের মানুষ হয়ে থাকে। আমি ঠিক জানি না কিন্তু উপলব্ধি করতে পারি তারা কী রকম ছিলেন এবং তাদের জীবন কী রকম ছিল। আমার খুব কৌতূহল হয় এবং জানারও প্রচণ্ড ইচ্ছা যে, কী এমন সঙ্কটময় ঘটনা তাদের জীবনে ঘটেছিল? জানেন মিসেস অলিভার এটা ঠিক সাপের উঁচ গেলার মতন। আপনি না পারবেন পুরোপুরি গিলতে আর না পারবেন বার করে দিতে। তবে হ্যাঁ আমি পুরো ব্যাপারটা জানতে চাই এবং আমার জানারও প্রবল ইচ্ছা, কারণ সমস্ত ব্যাপারটা জানা হয়ে গেলে মনের মধ্যে আর কোনো দ্বন্দ্ব থাকবে না আবার নতুন করে কিছু জানার। তাই না?

তাহলে কি তুমি এই ব্যাপারে কিছু চিন্তা করবে?

এক মুহূর্তের জন্য তাঁর দিকে সিলিয়া তাকিয়ে রইল এবং ওর মুখের ভাব দেখে মনে হল, কোনো কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ও চেষ্টা করছে।

মেয়েটি বলল, হ্যাঁ, এ ব্যাপারে আমি সব সময়ই চিন্তা করি। আমি এবং ডেসমন্ডা দুজনেই জানতে চাই, এ ব্যাপারে আপনার যদি কিছু জানা থাকে।

১.২ পুরোনো পাপের লম্বা ছায়া

একটা ছোটো রেস্তোরাঁর ভেতর ঢুকলেন ঘূর্ণায়মান দরজা ঠেলে এরকুল পোয়ারো। দিনের একটা বেখাপ্পা সময় বলে সেখানে খুব বেশি লোক ছিল না। তবে যাঁর সঙ্গে তার দেখা করার কথা তাকে তিনি দেখতে পেলেন টেবিলের এক কোণায়, চারচৌকা ভারিক্কি চেহারায় বসেছিলেন। তিনি হলেন সুপারিনটেন্ডেন্ট স্পেন্স। তিনি বললেন, ‘ভালো’ এটা খুঁজে বার করতে কোনো অসুবিধে হয়নি তো?

না, একেবারেই নয়। আপনার ডিরেকসান যথেষ্ট ছিল।

আসুন এবার আমরা পরিচয় করি। ইনি হলেন চীফ সুপারিনটেন্ডেন্ট গ্যারোওয়ে। আর ইনি হলেন মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো। গ্যারোওয়ের চেহারা ছিল পাতলা রোগাটে, কঠোর তপস্বীর মতো মুখ এবং ধূসর চুল। খুব ভালো বললেন পোয়ারো।

গ্যারোওয়ে বললেন, এখন আমি অবসর প্রাপ্ত, এমন কিছু ঘটনা আছে যে কেউ সেটা মনে রাখতে পারে তা যতই অতীত হোক না কেন। এবং সাধারণ লোক সম্ভবত সব কিছুই মনে রাখতে পারে না কিন্তু, হ্যাঁ।

এরকুল পোয়ারো প্রায় বলেই ফেলছিলেন হাতিরা মনে রাখে, কিন্তু সময় মতো নিজেকে খুব সামলে নিলেন। মিসেস অ্যারিয়াডন অলিভারের সেই প্রবাদ বাক্যটা তার মনের মধ্যে এমন গেঁথে গেছে যে, যে কোনো স্থানে সেটা চেপে যাওয়া খুবই কষ্টকর।

সুপারিনটেন্ডেন্ট বললেন, আমি আশা করতে পারি যে, আপনি খুব একটা অধৈর্য হচ্ছেন না।

একটা চেয়ার টেনে তারা তিনজনে বসলেন। সুপারিনটেন্ডেন্ট স্পেন্স এই রেস্তোরাঁয় আসক্ত সুতরাং মেনু চার্ট দেখে তিনি তার মনের মতো খাবারের অর্ডার দিলেন, গ্যারোওয়ে ও পোয়ারো তারাও তাদের পছন্দমতো খাবারের অর্ডার দিলেন, তারা কিছুক্ষণ চেয়ারে হেলান দিয়ে শেরিতে চুমুক দিলেন। পোয়ারো বললেন, কতকগুলো ঘটনার ব্যাপারে আপনাদের এখানে ডেকে আনার জন্য আমি প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি কারণ সেই ঘটনাগুলো অনেক বছর আগের এবং নিষ্পত্তিও হয়ে গেছে অনেক দিন আগে।

স্পেন্স বললেন, যা আমাকে আগ্রহ জাগায় সেটা যে আপনাকেও আগ্রহী করে তুলেছে, আমি শুনে খুব খুশি হলাম। আমি ভেবেছিলাম অতীত নিয়ে গবেষণা করা নেহাতই একটা মামুলি ব্যাপার কিন্তু এ ব্যাপারে আপনি যে খুবই আন্তরিক এখন বুঝছি সেটা। অতীতের সেই ঘটনার সাথে এখনকার ঘটনার কোনো সম্পর্ক আছে বা হঠাৎ কৌতূহল জাগার মতো কিছু ঘটনা এবং যার কোনো ব্যাখ্যা নেই কারণ নির্ণয় করার উপায়ও নেই। আপনিও কি সেটার সাথে একমত?

টেবিলের চারপাশে তিনি তাকালেন।

ইন্সপেক্টর গ্যারোওয়ে বললেন, র্যভেন্সক্রট শু্যটিং-এর কেসে তদন্তের কাজ পরিচালনা করছিলেন অফিসার-ইন-চার্জ। উনি আমার বিশেষ পুরানো বন্ধু আর সেই কারণেই ওর সঙ্গে যোগাযোগ করার আমার কোনো অসুবিধা হবে না।

যথেষ্ট দায় দেখিয়ে আজ এখানে উনি এসেছেন কারণ খুব সহজ এবং আমাকে স্বীকার করতেই হবে এটা কৌতূহল। তার ফলে আমার আগ্রহ দেখানোর কোনো অধিকার নেই। যেহেতু এটা অতীতের ঘটনা এবং নিষ্পত্তিও হয়ে গেছে অনেক আগে। বললেন পোয়ারো।

গ্যারোওয়ে বললেন, আমি কিন্তু এমন কথা বলব না কারণ অতীতের কয়েকটি মামলার প্রতি আমাদের সকলেরই কিন্তু আগ্রহ আছে। যেমন আজও আমার জানতে ইচ্ছা হয় লিজি বোর্ডব সত্যিই কি তার বাবা মাকে কুঠার দিয়ে হত্যা করেছিল? আজও কিন্তু অনেক লোক আছে যারা এখনও তা বিশ্বাস করে না। আবার চার্লস ব্রেভোকে যে হত্যা করেছিল, আর তার মোটিভ কি ছিল। এ-ব্যাপারে অনেক ভিন্ন ভিন্ন মত আছে। কিন্তু আজও লোকেরা এর বিকল্প ব্যবস্থার ব্যাখ্যা খুঁজে বার করার চেষ্টা করে।

তাঁর আগ্রহী তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টি গিয়ে পড়ল পোয়ারোর ওপর।

আচ্ছা মঁসিয়ে পোয়ারো অতীতের এ-ধরনের খুনের মামলার ব্যাপারে দু-বার কিংবা তিনবার আমরা আগ্রহ প্রকাশ করেছি, তাই না? অবশ্য যদি ভুলচুক না করে থাকি।

সুপারিনটেন্ডেন্ট স্পেন্স বললেন, অবশ্যই তিনবার আমার মনে হয়। একবার বোধহয় একজন কানাডিও মেয়ের অনুরোধে, তাই না?

হ্যাঁ, তা ঠিক। বললেন পোয়ারো। সেই কানাডিও মেয়েটি ছিল খুব উদ্দীপ্ত, আবেগপ্রবণ এবং বেশ শক্তিশালী। সে এখানে একটি খুনের মামলার তদন্তে এসেছিল এবং সে মামলায় তার মাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল। আর যদিও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আগেই তার মা মারা যায় তবুও তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, যে তার মা ছিলেন নির্দোষ।

গ্যারোওয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি মেনে নিয়েছিলেন?

পোয়ারো বললেন, আমি মেনে নিইনি কারণ প্রথম যখন সে আমাকে ঘটনাটি বলেছিল মেয়েটি ছিল খুব উদ্দীপ্ত এবং একেবারে নিশ্চিত।

স্পেন্স বললেন, সেটাই তো স্বাভাবিক। যে কোনো মেয়ে তার মাকে নির্দোষ ভাববেই এবং সে সর্বশক্তি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করবে তার মা নির্দোষ।

পোয়ারো প্রত্যুত্তরে বললেন, এটা তার থেকেও একটু যেন বেশি এবং মেয়েটি আমাকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করে তার মা ঠিক কি ধরনের মহিলা ছিলেন।

তার মা খুন করতে পারে না এই তো?

না, বললেন পোয়ারো। সেটা বলা খুব কঠিন ব্যাপার, এবং আমি নিশ্চিত আপনারা দুজনেই আমার সঙ্গে একতম হবেন এই কথা ভাবতে, কোন পরিস্থিতিতে তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। সেই মামলায় তার মার নির্দোষিতা সম্পর্কে কোনো উল্লেখই করেননি। তিনি যেন দোষী সাব্যস্ত হতেই কাঠগোড়ায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমার কৌতূহলের শুরু এখান থেকেই, আমার মনে হয় না তার মনে পরাজয়ের মনোভাব জেগে উঠেছিল। এবং আমি যখন খোঁজ নিতে শুরু করলাম তখন পরিষ্কার হয়ে গেল মোটেই তিনি সেরকম ছিলেন না। যে কেউ বলবে তিনি ছিলেন ঠিক তার উলটা।

গ্যারোওয়েকে বেশ চিন্তান্বিত দেখাল। তিনি প্লেটের খাবারগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলেন।

তিনি কি সত্যি সত্যিই নির্দোষ ছিলেন?

হ্যাঁ, সত্যিই তিনি নির্দোষ ছিলেন। পোয়ারো বললেন।

সেটা আপনাকে অবাক করে দিয়েছিল?

আমি যে সময় সেটা উপলব্ধি করি সেই সময় নয়, বললেন পোয়ারো। বিশেষ করে একটা ব্যাপার যা দেখিয়ে দেয় এবং তাকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না। এই সেখানে যেমন আছে সেটা দেখে কেউ কী ভাবতে পারে এর বাইরেও অন্য কিছু থাকতে পারে। এবং তার জিজ্ঞাস্য কেন কেউ সেটা ভাবতে পারে না। আমরা কী তাহলে এদিক ওদিক তাকিয়েই বলব মেনু কী?

ঠিক সেই সময় মাছ ভাজার প্লেট রেখে বয় চলে গেল।

স্পেন্স বললেন, আরও একটা মামলায় আপনি অতীতের দিকে ফিরে তাকিয়ে ছিলেন। যেমন একটা পার্টিতে একটি মেয়ে বলেছিল, সে নাকি একবার একটা খুন হতে দেখেছিল। পোয়ারো বললেন, হ্যাঁ, সেটা খুবই সত্য।

মেয়েটি কি কাউকে খুন হতে দেখেছিল?

না, পোয়ারো বললেন, কারণ সেটা ছিল ভুল মেয়ে। তিনি মাছভাজার খুব প্রশংসা করলেন।

সুপারিনটেন্ডন্ট স্পেন্স বললেন, এখানে মাছের সব ডিসই ভালো করে থাকে এরা। পরবর্তী তিন মিনিট ধরে শুধু খাবারের প্রশংসা আলোচনা হল।

সুপারিনটেন্ডন্ট গ্যারোওয়ে বললেন, স্পেন্স যখন আমার কাছে এলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন র‍্যাভেন্সক্রফট মামলার ব্যাপারে আমি কিছু জানি কিনা তখন আমি সঙ্গে সঙ্গে খুব উৎফুল্ল হয়ে উঠি।

এ-ব্যাপারে তো দেখছি আপনি কোনো কিছুই ভোলেননি?

র‍্যাভেন্সক্রফটের এমন মামলা, যা সহজে ভোলো যায় না।

আপনি কি জানেন এই মামলার ব্যাপারে কিছু ভুল-ত্রুটি ছিল? যেমন সাক্ষ্য প্রমাণের অভাব অথবা বিকল্প সমাধান? পোয়ারো বললেন না সেরকম কিছু নয়, গ্যারোওয়ে বললেন, যা প্রত্যক্ষ করা যায় এমন সময় ঘটনার ওপর সাক্ষ্য প্রমাণ রেকর্ড করা হয়েছিল এবং যার মৃত্যুর ধরন ছিল আগের অনেক উদাহরণের মতন খুবই মামুলি আর তবুও

ঠিক? জিজ্ঞেস করলেন পোয়ারো।

তবুও সবই ভুল। বললেন গ্যারোওয়ে।

স্পেন্স বললেন, আজ তাকে যেন বেশ আগ্রহী দেখাচ্ছিল।

তার দিকে তাকিয়ে পোয়ারো বললেন, এক সময় আপনি ঠিক এইরকম ভেবেছিলেন তাই? মিসেস ম্যাকগিল্টির মামলায়? হা আপনি কিছুতেই সন্তুষ্ট হতে পারেননি যখন সেই কঠিন প্রকৃতির যুবকটি গ্রেপ্তার হল। সে যে অপরাধটা করতে পারে ঠিক সেই রকম অপরাধীর মতনই তাকে দেখাচ্ছিল। তার পক্ষে সেটা করার প্রত্যেকটি কারণ ছিল এবং সবাই ভেবেছিল সে সেটা করেছে। কিন্তু আপনি একমাত্র জানতেন সে সেটা করেনি। এবং আপনি এতটাই নিশ্চিত ছিলেন তাই আপনি আমার কাছে ছুটে এসেছিলেন এবং আমাকে বলেন কেসটা হাতে নেওয়ার জন্য যাতে আমি প্রকৃত তথ্য কী সেটা বার করতে পারি।

দেখুন যদি আপনি সাহায্য করতে পারেন আর আপনি আমাকে সাহায্য করেও ছিলেন। কি করেননি আপনি?

লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন পোয়ারো।

হ্যাঁ, আপনাকে সাহায্য করেছিলাম ঠিকই কিন্তু কী অস্বস্তিকর যুবক সে ছিল। ধরুন যদি কখনও কোনো যুবকের ফাঁসি কাঠে ভোলোর মতো শাস্তি তার প্রাপ্য হয় কারণ খুন করার অপরাধে নয় এবং সে যে অপরাধী নয় সেটা প্রমাণ করবার জন্যও নয়। এবং সে যে অপরাধী নয় সেটা প্রমাণ করানোর জন্য কাউকেই সে সাহায্য করবে না। আমাদের সামনেই এখন উপস্থিত র‍্যাভেন্সক্রফট-এর মামলা। এখানে কোথায় যেন একটা ভুল রয়ে গেছে তাই না, সুপারিনটেন্ডন্ট গ্যারোওয়ে?

হ্যাঁ, এ ব্যাপারে আমি অবশ্যই নিশ্চিত যে আমি কি বলতে চাইছি বুঝতে নিশ্চয়ই আপনি পারছেন।

আমি বুঝতে পারি, একসাথে বললেন পোয়ারো আর স্পেন্স। সময়ে সময়ে সবাই এ-ধরনের ঘটনার মুখোমুখি হয়ে থাকে। যেমন প্রমাণ, মোটিভ, সুযোগ, কু। আপনি যাকে বলেন একটা সম্পূর্ণ ব্লু-প্রিন্ট। যাদের এই পেশা তারা সবাই জানে এসবই ভুল। ঠিক যেমন শিল্প জগতের সমালোচক জানে কোন ছবিটা নকল এবং কোনটাই বা আসল।

সুপারিনটেন্ডন্ট গ্যারোওয়ে বললেন, এই কেসের ব্যাপারে আমার করার কিছুই ছিল না, আর আপনি যেমন বলেন এ-কেসের সমস্ত ব্যাপার আমি লক্ষ্য করে দেখেছি। সেখানকার লোকেদের সঙ্গেও কথা বলে দেখেছি কিছুই ছিল না সেখানে। এটা একটা স্রেফ আত্মহত্যার চুক্তি বলেই মনে হয়েছে। কারণ এর মধ্যে আত্মহত্যার চুক্তির সব রকম চিহ্নই দেখতে পাওয়া যায়। অবশ্য এর বিকল্প হতে পারে যেমন স্বামী তার স্ত্রীকে গুলি করে তারপর নিজেকে অথবা স্ত্রী তার স্বামীকে গুলিবিদ্ধ করার পর, নিজেকে গুলিবিদ্ধ করেন। যদি কারোর এই ঘটনা পর্যালোচনা করার ইচ্ছা থাকে তাহলে সে জানতে পারবে সেগুলো ঘটেছিল এবং কেন এমন ঘটল? এ মামলার কি কোনো কেন-র স্থান ছিল? পোয়ারো বললেন।

হ্যাঁ, সেই রকমই। যে মুহূর্তে আপনি একটা কেসে তদন্ত করতে শুরু করলেন মানুষ এবং ঘটনা সম্পর্কে একটা ধাঁধা নিয়মমাফিক ছবি আপনি সংগ্রহ করলেন। অথচ এ-কেসে দেখা যাচ্ছে এঁরা বয়স্ক দম্পতি। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক খুব ভালো এবং সুখী পরিবার যা বোঝায় তাই ছিল। এক সঙ্গে বেড়োতে যেতেন এবং সন্ধ্যায় তাস খেলতেন। তাদের দুটি সন্তান ছিল। ছেলে ইংল্যান্ডে এবং মেয়ে সুইজারল্যান্ডে পড়াশুনা করত। শুধু তাই নয় মেডিক্যাল রিপোর্ট থেকেও দেখা যায় তাদের স্বাস্থ্যের কোনো খারাপ লক্ষণ ছিল না। যদিও স্বামী ব্লাডপ্রেসারে ভুগছিলেন, চিকিৎসার পর আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। স্ত্রী একটু বধির ও অল্প হার্টের ব্যারাম ছিল। এর জন্য অবশ্য চিন্তার কারণ ছিল না কোননা। জানেন এমন অনেক লোক আছে যাদের স্বাস্থ্য খুব ভালো অথচ তাদের বদ্ধমূল ধারণা তাদের ক্যান্সার হয়েছে। এবং শুধু তাই নয় তাদের দৃঢ় বিশ্বাস তারা আর এক বছর বাঁচবে না। এক্ষেত্রে তারা সময় সময় আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়ে থাকে। তাই বলে র‍্যাভেন্সক্র সেই প্রকৃতির লোক ছিলেন না। তিনি ছিলেন ধীর, স্থির, সুস্থ, স্বাভাবিক প্রকৃতির মানুষ।

তাহলে আপনি সত্যিই কী ভাবেন? জিজ্ঞেস করলেন পোয়ারো।

অতীতের দিকে যদি তাকাই তাহলে আমি নিজেকে বলি এটা আত্মহত্যার কেস। একমাত্র আত্মহত্যা ছাড়া কিছুই হতে পারে না। যে কোনো কারণেই হোক, আর্থিক দিক থেকে নয়, স্বাস্থ্য খারাপের দিক থেকেও নয় এবং অসুখী জীবনেরও কোনো কারণ নয় তবু তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, জীবন তাদের কাছে দুর্বিসহ। তারা যখন বেড়োতে বের হন তাদের সাথে রিভলবার ছিল। এবং ওই রিভলবারটা তাদের মৃতদেহের মাঝখানে পড়ে থাকতে দেখা যায় এবং ওই রিভলবারের ওপর দু-জনেরই হাতের ছাপ ছিল। দু-জনেই ওটা ব্যবহার করেছিল কিন্তু কে যে শেষ গুলি চালিয়েছিল তার কোনো চিহ্ন অবশ্য পাওয়া যায়নি। অনেকেই হয়তো ভাবতে পারেন স্বামীই প্রথমে তার স্ত্রীকে গুলিবিদ্ধ করেন এবং এটাই বেশি যুক্তিগ্রাহ্য। এত সব যুক্তি ছিল বলেই এই কেসের আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এটা স্রেফ আত্মহত্যা, যদি কখনও সংবাদপত্রে স্বামী স্ত্রীর মৃত্যুর ঘটনা লেখা থাকে দেখি আমি আমার মনের অজান্তে সেই বারো কী চোদ্দ বছর আগেকার ঘটনার অতীতে ফিরে যাই এবং নিজের মনকেই প্রশ্ন করি কি এমন ঘটনা র‍্যাভেন্সক্রফটের কেসে ঘটেছিল? একটাই কথা তখন আমি চিন্তা করি স্ত্রী কী তাহলে স্বামীকে ঘৃণা করতেন এবং তাঁর হাত থেকে নিস্তার পেতে চেয়েছিলেন? কিংবা তারা কি পরস্পর পরস্পরকে ঘৃণা করতেন? এবং সেই ঘৃণা বোধটাই কি তাদের দুজনের কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছিল?

আরও এক টুকরো রুটি মুখে নিয়ে চিবোতে থাকলেন গ্যারোওয়ে?

আচ্ছা মঁসিয়ে পোয়ারো এ-সম্বন্ধে আপনার কী ধারণা? কেউ এমন কি আপনার কাছে এসেছিল এবং কিছু বলেছে যার ফলে আপনি আপনার মধ্যে এতটা আগ্রহ জাগিয়ে তুলছেন? আপনি কি কিছু জানেন যার ব্যাখ্যা আপনি করতে পারবেন–কেন?

প্রত্যুত্তরে পোয়ারো বললেন, না। সেই একই ব্যাপার। আপনার কাছে নিশ্চয় এর ব্যাখ্যা আছে তাই না?

আপনি ঠিকই বলেছেন কারণ প্রত্যেকেরই কাছে কিছু না কিছু ব্যাখ্যা থাকে যা শোনার জন্য সবাই আশা করে থাকে অথবা সেগুলোর মধ্য থেকে অন্তত একটাও। সেগুলো নিয়ে গবেষণা করা যায় কিন্তু সাধারণ কোনো কাজে লাগে না। আমার অবশ্য মনে হয় আমার ব্যাখ্যা একেবারে শেষ পর্যায়ের যার কোনো কারণ আপনি খুঁজে পাবেন না, কারণ আমার মনে হয় খুব বেশি কিছু কারোর জানা থাকে না। সঠিকভাবে তাদের সম্পর্কে আমি যা জনি তা তাদের জীবিতকালের শেষ পাঁচ কী ছয় বছরের ঘটনার কথা। জেনারেল র‍্যাভেন্সক্রফট-এর বয়স প্রায় ষাট। অবসর নিয়ে পেনসন পাচ্ছিলেন। তাঁর স্ত্রীর বয়স পঁয়তাল্লিশ। বিদেশ থেকে ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন তারা। সাক্ষ্য প্রমাণ আমি যা পেয়েছিলাম তাই থেকে বলা যায় তারা প্রথমে বোর্নমাউথে একটা বাড়ি নেন এবং এর অল্প কয়েকদিন পর আর একটি বাড়িতে উঠে আসেন এবং এখানেই ঘটেছিল সেই বিয়োগান্ত ঘটনা। যাইহোক সেখানে স্কুলের ছুটির সময় তাদের ছেলেমেয়েরা বাড়ি ফিরে আসত। তারা সুখে শান্তিতে বাস করতেন সেই সময়। আমি আরও জানি অবসর নেবার পর ইংলন্ডে তাদের পরিবারের জীবনধারা কেমন ছিল। তাদের মধ্যে আর্থিক অস্বচ্ছলতা ছিল না, ঘৃণার মোটিভ বলতে যা বোঝায় তা নয়, যৌন সংক্রান্ত কোনো ব্যাপারেও জড়িয়ে পড়েছিলেন তাও নয়। এমন কি অবৈধ প্রেমের কোনো ব্যাপার তাদের মধ্যে ছিল না। আপনারা হয়তো প্রশ্ন করবেন সে সম্পর্কে আমি কী জানি? আমি যা জানি তা হল জীবনের বেশির ভাগ সময় তারা বিদেশে কাটিয়েছেন। বিশেষ বিশেষ উপলক্ষে, তাঁরা ঘরে ফিরে আসতেন। ভদ্রলোকের রেকর্ড ভালো ছিল কারণ তার স্ত্রীর বন্ধুরা তাকে সৌজন্য প্রকাশ করত। তাদের জীবনে তেমন দ্বন্দ্ব বিরোধ ছিল না, এর পরও যদি কোনো বিরোধ থেকে থাকে, শুধু আমি কেন সেটা কারোরই জানা নেই। কুড়ি থেকে তিরিশ বছর বিদেশে কাটিয়েছেন মালয় এবং বিভিন্ন কয়েকটি জায়গায়। সম্ভবত সেখানেই ট্রাজেডির মূল শিকড় গেঁথে গিয়েছিল। আমার ঠাকুমা প্রায়ই একটা প্রবাদের কথা বলতেন পাপের লম্বা ছায়া। তাহলে তাদের মৃত্যুর কারণ কি অতীতের কোনো ছায়া? অথবা পাপের দীর্ঘ ছায়াকে অনুসরণ করে? সেটা খুঁজে বার করা খুব সহজ ব্যাপার নয়। আপনি হয়তো একটা লোকের রেকর্ড খুঁজে বার করলেন যা আপনার বন্ধু বা পরিচিতরা বলে থাকে কিন্তু তাই বলে তাদের ভিতরের বিস্তারিত খবর আপনি জানেন না। আমার মনে যে ব্যাখ্যাটা জমে ওঠে তা হল সেই জায়গাটা যদি আমি ভালো করে দেখতাম। আমার মনে হয় কিছু একটা ঘটেছিল অন্য দেশে। একটা ঈর্ষা যার সূত্রপাত বিদেশ বা ইংলন্ডে যার অস্তিত্ব আজও আছে।

যদি কেউ জানে কোথায় তার খোঁজ পাওয়া যাবে, মনে হয় তার কাছে সেটা আর অজানা থাকবে না, আপনি এটাই বোঝাতে চাইছেন।

না, সেরকম কিছু নয়, বললেন পোয়ারো। মানে আমি বলতে চাইছি এমন মনে রাখার কথা যা ইংলন্ডে তাদের কোনো বন্ধু বান্ধবরাও জানে না।

ইংলন্ডে তাদের বন্ধুদের মধ্যে বেশির ভাগ অবসর নিয়েছেন। পুরানো বন্ধুরা বিশেষ বিশেষ উপলক্ষে আসেন শুধু চোখের দেখা দেখবার জন্য। যদিও আমার ধারণা অতীতে কী ঘটেছিল তা অনেকেই শোনেনি আর তাছাড়া মানুষ কিছুতেই মনে রাখতে পারে না তারা ভুলে যায়।

একটু হেসে হঠাৎ সুপারিনটেন্ডন্ট গ্যারোওয়ে কথাটা বললেন যে, তারা হাতি নয়, কারণ হাতিরা সব সময় বলে থাকে তারা সব কিছু মনে রাখতে পারে।

পোয়ারো বললেন, আপনি যা বললেন তা বড়োই অদ্ভুত।

আপনার এই হাতি সম্পর্কের মন্তব্য করার কথাটা আমার মনে খুব আগ্রহ জাগায়।

বেশ আশ্চর্য হয়েই পোয়ারের দিকে তাকালেন সুপারিনটেন্ডন্ট গ্যারোওয়ে। আরও কিছু শোনার জন্যই যেন তিনি উন্মুখ হয়ে আছেন। স্পেন্সও তার পুরানো বন্ধুর দিকে ফিরে একবার তাকালেন।

তিনি পরামর্শ দিলেন যা কিছুই ঘটেছিল সম্ভবত প্রাচ্যে অর্থাৎ হাতিরা যেখান থেকে আসছে, তাই তো? তা যাইহোক, আপনাকে এই হাতিদের প্রসঙ্গ কে উল্লেখ করেছে? পোয়ারো তার এক বন্ধুর নাম বললেন।

সুপারিনটেন্ডেন্ট স্পেন্সকে বললেন, আপনি তাকে চেনেন। তার নাম মিসেস অলিভার।

ওহো মিসেস অ্যারিয়াডন অলিভারের কথা বলছেন–বলে থামলেন একটু এবং আবার বললেন, ভালো কথা।

ভালো কথা মানে কী বলতে চাইছেন? জিজ্ঞেস করলেন পোয়ারো।

ভালো কথা মানে বলতে চাইছি তাহলে কী তিনি কিছু জানেন জিজ্ঞেস করলেন তিনি। অন্তত এখনও পর্যন্ত আমি তা মনে করি না পোয়ারো বললেন। কী যেন চিন্তা করে তিনি বললেন, তবে আমার মনে হয় তিনি হলেন সেই ধরনের মহিলা যিনি কিছু জানেন। আশা করি আমি কী বলতে চাইছি আপনি তা বুঝতে পেরেছেন।

হ্যাঁ, উত্তর দিলেন স্পেন্স এবং জিজ্ঞেস করলেন, তার কোনো ধারণা আছে?

এতক্ষণে গ্যারোওয়ে তার আগ্রহ প্রকাশ করে বললেন, আপনি কি ওই লেখিকা মিসেস অ্যারিয়াডন অলিভারের কথা বলছেন?

হ্যাঁ তিনিই, পোয়ারা বললেন।

আমি জানি তিনি অপরাধ কাহিনি লেখেন।

অপরাধ সম্পর্কে তার কি ভালো বিশেষ জ্ঞান আছে? আমি জানি না তিনি সেইসব কাহিনির ধারণা বা প্লট কোথা থেকে পান?

পোয়ারো বললেন, আমার ধারণা সবই তার মাথা থেকে আসে। এবং ঘটনাগুলো

সে তো আরও কঠিন ব্যাপার, একটু অল্প সময়ের জন্য তিনি চুপ করে থাকলেন।

আপনি কি কিছু বিশেষ চিন্তা করছেন পোয়ারো, একটা বিশেষ কিছু?

হ্যা। একটা ঘটনা সম্পর্কে তার মনে সুন্দর একটার ধারণার জন্ম হয়েছিল। অনেকটা ঠিক উল্যে, লম্বা হাতওয়ালা জামার প্রয়োজন মেটানোর মতন। সেই ধারণাটা তিনি তাঁর মাথা থেক গল্পের আকারে বার করেন। আমি তাকে ফোনে কিছু কথা জিজ্ঞেস করি। এবং তার একটা গল্প নষ্ট করে দিই।

কৌতূহলী হয়ে উঠে বললেন স্পেন্স। বলুন বলুন তারপর! ঠিক যেন গরমের দিনে মাখনের ওপর সুগন্ধি পাতা ভাসার মতন। শার্লক হোমসকে সেই কুকুরটা আর রাত্রে কোনো কিছুই করত না জানেন তাদের?

ওদের কি কুকুর ছিল? জিজ্ঞেস করলেন পোয়ারো, আপনি কি বলতে চাইছেন মাপ করবেন একবার বলুন তো?

আমি বলতে চাইছি ওঁদের কি কুকুর ছিল? র‍্যাভেন্সক্রফটরা যেদিন গুলিবিদ্ধ হন সেইদিন বেড়োনোর সময় তারা কি কুকুর নিয়ে গিয়েছিলেন?

হ্যাঁ, তাদের একটা কুকুর ছিল। গ্যারোওয়ে বললেন, আমার ধারণা যতদিন তারা বেড়োতে যেতেন ততদিনই কুকুর তাদের সঙ্গে থাকত। স্পেন্স বললেন, মিসেস অলিভারের কাহিনি যদি এরকম হয়ে থাকে তাহলে আপনাকে দেখতে হবে মৃতদেহ দুটি ঘিরে তাঁদের সেই কুকুর চিৎকার করেছিল কিনা, কিন্তু মনে হয় এক্ষেত্রে তা হয়নি।

মাথা নেড়ে সায় দিলেন গ্যারোওয়ে।

পোয়ারো বললেন, আমি কিন্তু খুব অবাক হচ্ছি সেই কুকুরটা কোথায় গেল?

এই কথার উত্তরে গ্যারোওয়ে বললেন, চোদ্দ বছর আগের ঘটনা তো আমার মনে হয় কারোর বাগানে তাকে কবর দেওয়া হয়েছে। তাহলে সেখানে গিয়ে কুকুরটাকে আমরা কিছু জিজ্ঞেস করতে পারব না। খুব চিন্তিত হয়ে তিনি আরও বললেন, এটা খুবই বিস্ময়কর ব্যাপার, বাড়িতে সেদিন কি ঘটেছিল মানে সেই অপরাধের ঘটনা জানতে পারে। গ্যারোওয়ে বললেন, একটা তালিকা এনেছি। যদি প্রয়োজন মনে করেন দেখতে পারেন। একজন বয়স্ক রাধুনি মিসেস হুইটেকার সেদিন বাড়িতে ছিলেন না। সুতরাং তার থেকে কিছু আমরা জানতে পারব না। একজন গভরনেস থাকতেন র‍্যাভেন্সক্রফটের ছেলেমেয়েদের দেখাশুনা করার জন্য পরে চলে যান। কিন্তু লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট হাসপাতালে ছিলেন স্নায়ু যন্ত্রের দুর্বলতার জন্য এবং হাসপাতাল থেকে আসার পর গভরনেস ফিরে এসেছিলেন লেডি র‍্যাভেন্সটকে দেখাশুনা করার জন্য। আর একজন মালিও সেখানে ছিল।

কিন্তু একজন আগন্তুক নিশ্চয়ই বাইরের থেকে এসে থাকবেন। হয়তো অতীতের কোনো আগন্তুক। আচ্ছা সুপারিনটেন্ট গ্যারোওয়ে এটাই আপনার ধারণা? ঠিক অতটা ধারণা নয়, তবে একটা স্রেফ একটা ব্যাখ্যা বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। চুপ করে রইলেন পোয়ারো কারণ তাঁকে যখন অতীতে ফিরে যেতে বলা হয়েছিল ঠিক সেই সময়টার কথাই তিনি ভাবছিলেন এখন। সেই অতীতে থেকে পাঁচটা লোককে তিনি পর্যালোচনা করেছিলেন যা এখন তাকে ছেলে ভোলোনো ছড়ার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল ফাইভ লিট পিগ। এবং সেটা খুব উৎসাহব্যঞ্জক ছিল আর একেবারে শেষ পুরস্কার পাওয়ার মতন কারণ সত্যকে তিনি খুঁজে পেয়েছেন।

.

পুরোনো বন্ধু মনে রাখে

পরের দিন সকালে বাড়ি ফিরলেন মিসেস অলিভার এবং দেখলেন তার জন্য অপেক্ষা করে আছে মিস লিভিংস্টোন।

মিসেস অলিভার, আপনার দুটো ফোন এসেছিল।

হ্যাঁ, কোথা থেকে বলো?

প্রথম ফোন এসেছিল ক্রিস্টোন এ্যান্ড স্মিথ থেকে। এবং তারা জানতে চাইছিল লাইম-গ্রীণ ব্রোকেড বা পেল ব্ল কোনটা আপনি পছন্দ করেছিলেন?

এখনও পর্যন্ত আমি কোনো কিছুই মনঃস্থির করতে পারিনি, মিসেস অলিভার বললেন, তুমি বরং কাল-সকালে আমাকে একবার মনে করিয়ে দিও। কারণ রাতের আলোয় আমি সেটা দেখতে চাই।

আর দ্বিতীয় ফোন এসেছিল একজন বিদেশীর কাছ থেকে। আমার অবশ্য বিশ্বাস তিনি মিঃ এরকুল পোয়ারো।

ও! মিসেস অলিভার বললেন, তা তিনি আবার কী চাইছিলেন?

তিনি বললেন, আজ অপরাহ্নে আপনি কি একবার তার সঙ্গে দেখা করতে পারবেন?

সেটা একেবারেই অসম্ভব। এখুনি আবার আমি বাইরে বেরুব। তিনি কি তার টেলিফোন নম্বর দিয়েছেন? ওকে ফোন করো তো।

হ্যাঁ, তিনি দিয়েছেন।

তাহলে তো খুব ভালো হল। ওঁকে একবার ফোন করো এবং ওঁকে বলো এখন ওঁর সাথে দেখা করতে পারলাম না। আমি খুব দুঃখিত কারণ আমি এখুনি বেরিয়ে যাচ্ছি হাতির খোঁজে।

মিস লিভিংস্টোন বলল আমাকে মাপ করবেন।

ওঁকে বলো এখন আমি হাতির খোঁজ করছি।

আচ্ছা ঠিক আছে, মিস লিভিংস্টোন বলল। কিন্তু তার বাঁকা দৃষ্টি তখন তার নিয়োগকর্তীর ওপর। কারণ সে বোঝবার চেষ্টা করছিল তিনি ঠিক আছেন তো! যদিও তিনি একজন সফল ঔপন্যাসিক তথাপি এক এক সময় তার মাথার ঠিক থাকে না।

মিসেস অলিভার বললেন, আমি এর আগে কখনও হাতির খোঁজ করিনি। তবুও একাজে দারুণ আগ্রহ আছে।

এরপর তিনি বসবার ঘরে গেলেন এবং সোফার ওপর বসে বইয়ের পাতা ওলটাতে লাগলেন। গতকাল সন্ধ্যা থেকে এই বইটা নিয়ে বসে আছেন কিন্তু তিনি কতগুলো ঠিকানা সংগ্রহ ছাড়া আর কিছুই এগোতে পারেননি।

ও ভালো কথা প্রত্যেককেই কোনো না কোনোখান থেকে শুরু করতে হয়। সবদিক থেকে বিবেচনা করে আমার মনে হয় জুলিয়াকে দিয়েই শুরু করব। ও এখনও দৌড়ঝাঁপ ছাড়েনি। সব সময়েতেই ওর একটা না একটা ধারণা মনে আসবেই। আর দেশের সেই অংশটার ব্যাপারে ওর জানা আছে কারণ ওর কাছাকাছি জায়গাতেই ও বাস করে। সুতরাং আমি জুলিয়াকে দিয়েই শুরু করব, মিসেস অলিভার বলল। মিস লিভিংস্টোন চারটে চিঠি তার সামনে দিয়ে বললেন, এই চারটে চিঠিতে আপনাকে সই করতে হবে।

এখন আমি এই বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতে চাই না। সত্যি সত্যিই এক মিনিটও আমি বাজে খরচ করতে পারব না, বললেন মিসেস অলিভার। কারণ তাকে এক্ষুনি হ্যাঁম্পটনগের্টে যেতে হবে আর সেই জায়গাটা এখান থেকে অনেক দূর।

অনারেবল জুলিয়া কারস্টেয়ার্স তার আর্মচেয়ার থেকে উঠতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। ভালো করে নড়তে চড়তে পারেন না। চোখে ভালো দেখতে পান কিন্তু কানে একটু কম শোনেন। বয়স সত্তরেরও বেশি।হোম ফর দি প্রিভিলেজের সদস্য সূত্রে একটা এ্যাপার্টমেন্টে দু-জনে থাকেন। কানে একটু কম শোনেন বলে প্রথমে মিসেস অলিভারের নামটা শুনতে পারেননি। মিসেস অলিভার? কিন্তু ওই নামের কোনো মহিলাকে তো আমি চিনি না। হাঁটুর ব্যথার জন্য খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে এলেন সামনে এবং পিটপিট্‌ করে তাকালেন সামনের দিকে।

আমার ধারণা আপনি আমাকে চিনতে পারবেন না হয়তো কারণ অনেক অনেক বছর আগে আমরা এক সঙ্গে মিলিত হয়েছিলাম।

ঠিক বয়স্ক লোকেরা যেমন গলার স্বর শুনে বুঝতে পারেন, মিসেস কারস্টেয়ার্স সে রকম কণ্ঠস্বর শুনে মিসেস অলিভারকে চিনতে পারলেন। আনন্দে মৃদু চিৎকার করে বলে উঠলেন, কেন চিনতে পারব না। তুমিই তো আমার প্রিয় অ্যারিয়াডন না! উফ তোমাকে দেখে আমার কী আনন্দ লাগছে না!

দু-জনের মধ্যে কুশল বিনিময় হল।

মিসেস অলিভার ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিলেন এবং বললেন, আমি এখানেই আছি। একজনের সাথে এখানে দেখা করতে এসেছিলাম। আর গতকাল রাত্রে খাতার পাতা ওলটাতে গিয়ে আপনার ঠিকানা দেখলাম। যেখানে গিয়েছিলাম তার কাছেই দেখলাম আপনার এ্যাপার্টমেন্ট, তাই চলে এলাম। এই জায়গাটা খুব আনন্দদায়ক তাই না? ঘরের চারিদিক তিনি তাকিয়ে দেখলেন।

খুব একটা খারাপ জায়গা নয় জানো, যে কেউ তার ফার্নিচার, আসবাবপত্র এখানে নিয়ে আসতে পারে। মিসেস কারস্টেয়ার্স বললেন, সব চেয়ে সুবিধা হল কাছেই রেস্তোরাঁ সেখান থেকে তুমি তোমার খাবার সংগ্রহ করতে পারো। তোমাকে দেখার পর বেশ ভালো লাগছে। আরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা হয়, বসো। এই সেইদিন সাহিত্যের ভোজসভায় তোফা দেওয়ার খবর পড়লাম কাগজে, আর আজ সেই কি না সশরীরে হাজির হয়েছে। কি অদ্ভুত ঘটনা বলো তো? দারুণ বিস্ময়কর ঘটনা নয় কি? তুমি কি বলে?

চেয়ারে মিসেস অলিভার বসতে বসতে বললেন, জানি, সব জিনিই এরকম হয়ে থাকে, হয় না?

তুমি কি এখনও লণ্ডনেই আছ?

মিসেস অলিভার বললেন, হ্যাঁ। তিনি আপন মনে ছোটবেলাকার স্মৃতির পাতা ওলটাতে থাকেন। তারপর তিনি মিসেস কারস্টেয়ার্সের মেয়ে এবং দুটি নাতি-নাতনির খবর জিজ্ঞেস করলেন। অপর মেয়েটির খবর নিয়ে তিনি জানতে পারলেন সে এখন নিউজিল্যান্ডে থাকে তবে সেখানে মেয়েটি ঠিক কি করছে তা তিনি জানেন না। বোধহয় সোস্যাল রিসার্চের কাজ হবে। তিনি চেয়ারের হাতলে লাগানো ইলেকট্রিক বেলের সুইচ টিপে এম্মাকে চা আনার জন্য বললেন। মিসেস অলিভার বললেন, ব্যস্ত হবার দরকার নেই। কিন্তু জুলিয়া, কারস্টেয়ার্স জোর দিয়ে বলে উঠলেন, অবশ্যই অ্যারিয়াডনকে চা খাওয়াতেই হবে।

দু-জনে পুরানো বন্ধু। চেয়ারে হেলান দিয়ে ভালো করে বসে গল্প করলেন।

বেশ কয়েক বছর আগে তোমাকে শেষ দেখে ছিলাম, মিসেস কারস্টেয়ার্স বললেন। মিসেস অলিভার বললেন, আমার মনে হয় লেঞ্জয়েলিন্স-এর বিয়ের সময়! হা সেই সময়েতেই হবে। কারণ ময়রাকে সহচরী সাজে কী যে ভয়ঙ্কর লাগছিল দেখতে। আর কী যে ভয়ঙ্কর তাদের পোশাক।

আমি জানি, ওদের ওই পোশাকে মানায় না।

আমাদের সময়কার বিয়ের পোশাকের তুলনায় এখনকার বিয়ের পোশাক মোটেই ভালো নয়। আমার অন্তত তাই মনে হয়, বর এবং কনের কি বিশ্রী সব পোশাক।

অ্যারিয়াডনকে বললেন, তুমি কি চিন্তা করতে পারো চার্চের হালত কেমন? কিন্তু আমি যদি যাজক হতাম দেখতে ঠিক আমি তাদের বিয়ে দিতে অস্বীকার করতাম।

চা খেতে খেতে মিসেস অলিভার বললেন, আগের দিন আমার ধর্মকন্যা সিলিয়া র‍্যাভেন্সক্রক্টকে দেখলাম। আচ্ছা র‍্যাভেন্সক্রফটদের কি মনে আছে আপনার। যদিও অবশ্য অনেক অনেক বছর আগের ঘটনা।

র‍্যাভেন্সক্রফটদের এক মিনিট দাঁড়াও, হা হা, জোড়া আত্মহত্যা, সেই ভয়ঙ্কর ট্র্যাজেডি তাই না? তাদের বাড়ির কাছেই পাহাড়ের ওপর। তারা তাই মনে করেছিল না?

মিসেস অলিভার বললেন, আপনাকে তারিফ করি আপনার অসাধারণ স্মৃতিশক্তির জন্য।

সব সময়েই আমার এইরকম কিন্তু এক এক সময়ে নামগুলো ঠিক খেয়াল করতে পারি না। ঘটনাটা ছিল বড়ই মর্মান্তিক তাই না? অবশ্যই মর্মান্তিক।

আমার এক ভাইপো মালয়েতে তাদের ভালো করে চিনত। রডিফ্রস্টারকে তুমি চেনো তো। র‍্যাভেন্সক্রফট-এর কর্মজীবন ছিল খুব উঁচুমানের, প্রতিভাবান পুরুষ ছিল। তবে অবসর নেওয়ার পর কানে একটু কম শুনতেন। স্বাভাবিক কথাবার্তা খুব একটা ভালো শুনতে পেত না সে।

হ্যাঁ, আপনি তাদের ভালোভাবে চিনতেন?

ও হ্যাঁ, সত্যি মানুষকে কেউ ভুলতে পারে না। আমার ধারণা ওভারক্লিফের কাছে ওরা পাঁচ কী ছয় বছর ছিল।

হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন আমার মনে আছে, বললেন মিসেস অলিভার। তবে মিসেস র‍্যাভেন্সক্রফট-এর খ্রিস্টান যে নামটা ছিল সেটা আমি ভুলে গেছি। কি যেন নাম ছিল?

আমার মনে হয়, মার্গারেট। তবে সবাই কিন্তু তাকে মলি বলেই ডাকত। হ্যাঁ ঠিকই মার্গারেট। তোমার কি মনে আছে সে পরচুলো ব্যবহার করত?

মিসেস অলিভার বললেন, স্পষ্ট হয়তো মনে নেই তবে মনে হয় পরচুলা ব্যবহার করতেন। সে আমাকে বলেছিল আপনি যখন বিদেশ ভ্রমণে যাবেন পরচুলা খুব কাজে লাগে। তার চার রকমের পরচুলা ছিল। একটা সন্ধ্যাবেলা, একটা ভ্রমণের আর একটা খুব অদ্ভুত জানেনা, মাথায় নাকি টুপি পরলেও পরচুলা অবিন্যস্ত হয় না।

মিসেস অলিভার বললেন, ঠিক আপনার মতন আমিও তাদের জানতাম। তারা যখন গুলিবিদ্ধ হন আমি তখন ছিলাম আমেরিকায় লেকচার টুরে। তাই এই ব্যাপারে আমি বিস্তারিত কিছু জানি না।

জুলিয়া কারস্টেয়ার্স বললেন, হ্যাঁ বটে এটা বিরাট একটা রহস্য। তাদের মৃত্যু রহস্য কিন্তু কেউ জানে না। তাদের সেই মৃত্যুকে ঘিরে অনেক মুখরোচক কাহিনি রটেছিল লোকের মুখে মুখে।

আমার ধারণা পুলিশি তদন্ত নিশ্চয়ই হয়েছিল। এবং তখন সেখানকার উপস্থিত লোকেরা কি বলেছিল মনে আছে আপনার?

হ্যাঁ নিশ্চয়ই মনে আছে। এবং সেই অস্বাভাবিক জোড়া আত্মহত্যার ব্যাপারে পুলিশি তদন্ত হয়েছিল বৈকি। আর সেটা ছিল একটা অমীমাংসিত কেস। মৃত্যু হয়েছিল ঠিকই রিভলবারের গুলিতে কিন্তু কী সেই ঘটনা নির্দিষ্ট করে বলতে পারেনি তারা। হতে পারে জেনারেল র‍্যাভেন্সক্রফট প্রথমে তার স্ত্রীকে গুলি করেন তারপর নিজেকে। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে বিচার করলে লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট তার স্বামীকে গুলি করার পর নিজেকে নিজেই গুলিবিদ্ধ করেছিলেন এ সম্ভাবনাটাকেও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আমার মনে হয় যে এটা একটা আত্মহত্যার চুক্তি। আবার জোর দিয়েও কিন্তু বলা যায় না যে কি করেই বা এই রকম একটা সিদ্ধান্ত তারা নিয়েছিল।

তার মানে আপনার কি মনে হয় এর মধ্যে অপরাধের কোনো প্রশ্ন নেই?

না, পুলিসি রিপোর্টে পরিষ্কার বলা হয়েছিল এর মধ্যে কোনো অন্যায় কিছু ছিল না। তার মানে আমি বলতে চাই তাদের কাছে অন্য কোনো তৃতীয় ব্যক্তি এলে তার পায়ের অথবা হাতের ছাপ বা অন্য কোনো চিহ্ন অবশ্যই থাকত। সেখানে সেরকম কিছুই ছিল না। প্রত্যেক দিনের অভ্যাসমতো চা খেয়ে তারা বেড়োতে বেড়িয়েছিলেন, তবে নৈশভোজের পর আর তারা ফিরে আসেনি। তখন পুরুষ পরিচারক এবং বাগানের মালি, তাদের খোঁজের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হল এবং একটু দূরে বাড়ির কাছেই মৃত অবস্থায় তাদের দেখতে পায় এবং রিভলবারটা মৃতদেহের পাশেই পড়েছিল।

রিভলবারটা কার ছিল? জেনারেলের তাই না? হ্যাঁ বাড়িতে তার দুটো রিভলবার ছিল। আজকাল যে রকম দেশের অবস্থা মানে খুন খাবাপি হচ্ছে সেই জন্যই নিরাপত্তার জন্য আগ্নেয়াস্ত্র রেখে দেয় তারা। তারা মারা যাবার সময় দ্বিতীয় রিভলবারটা বাড়ির ড্রয়ারেই ছিল, তাই মনে করে নেওয়া যায় রিভলবার সঙ্গে নিয়েই জেনারেল বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল, অবশ্য আমার মনে হয় না মিসেস র‍্যাভেন্সক্রক্ট রিভলবার সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছিলেন।

না, না, সেটা অত সহজ ব্যাপার নয়।

কিন্তু সাক্ষ্য প্রমাণের মধ্যে কোথাও জানা যায়নি তারা অসুখী ছিল কিনা বা তাদের দু-জনের মধ্যে কোনো ঝগড়া বিবাদ হয়েছিল কিনা এবং কেনই বা তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নিল তারও কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। অবশ্য মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে কত ধরনের দুঃখবোধ থাকতে পারে কেউ তা জানতে পারে না। মিসেস অলিভার বললেন, না, না, কেউ তা জানতে পারে না। কী যে ভীষণ সত্য কথা সেটা জুলিয়া, আপনার কি নিজস্ব কোনো ধারণা আছে?

ভালো কথা, প্রিয়, জানো তো সব সময় সবাই এসব ক্ষেত্রে কম বেশি অবাক হয়ে থাকে?

হ্যাঁ ঠিকই, মিসেস অলিভার বললেন, প্রত্যেকে সব সময় অবাক হয়ে থাকে।

আমার অনুমান নয় শোনা কথা যে–জেনারেলের একটা কঠিন অসুখ ছিল। আমার ধারণা তাকে হয়তো বলা হয়েছিল সে ক্যান্সারে মারা যাবে কিন্তু মেডিকেল রিপোর্টে সেরকম কোনো উল্লেখ নেই। তার স্বাস্থ্য খুব ভালো ছিল। আমি বলতে চাই তার করোনারি ছিল। ওটা রাজমুকুটের মতো শোনায়, রাজকীয় অসুখই বটে। জেনারেলের সেই অসুখটা হয়েছিল তবে ভালো হয়ে যায়। আর মিসেস র‍্যাভেল ট স্নায়ুর রোগে ভুগত। মিসেস অলিভার বললেন, হ্যাঁ, আমার মনে আছে, হঠাৎ তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা মৃত্যুর সময় কি তিনি পরচুলা পড়েছিলেন?

ওহো সত্যি আমি মনে করতে পারছি না, তবে আমি জানি ও সব সময়ে পরচুলা পড়ে থাকত। আমার ধারণা সেগুলোর মধ্যে একটা-মিসেস অলিভার বললেন, শুনে আমি সত্যিই অবাক হচ্ছি। আমার মনে হয় যে ভাবেই হোক আপনি যদি নিজেকে গুলি করতে যান এবং আপনার স্বামীকেও গুলি করতে যান তখন কি আপনি পরচুলা পড়ে যাবেন?

জুলিয়া, আপনি কি ভাবেন?

দেখো তোমাকে তো আগেই বলেছি প্রত্যেকেই অবাক হয়। আর এ-ব্যাপারে একটা গুজব শোনা যায়–জেনারেল না তার স্ত্রীর সম্পর্কে?

হ্যাঁ, তারা বলেছিল একজন যুবতী মহিলা সে জেনারেলের সেক্রেটারির কাজ করত। জেনারেল তাঁর কর্মজীবনের স্মৃতি লিখছিল–আমার বিশ্বাস, একজন প্রকাশকের প্রেরণা সেই মেয়েটিকে দিয়ে সে লেখাতো। কিছু কিছু লোক বলে মেয়েটির সঙ্গে কোনোভাবে ফেঁসে গিয়েছিল জেনারেল। মেয়েটি কিন্তু খুব একটা যুবতী ছিল না। তিরিশের ওপর বয়স, দেখতেও ভালো নয়। সেই মেয়েটি সম্পর্কে কোনো স্ক্যান্ডাল বা অন্য কিছু রটানো করা হয়েছিল যা এখনও কেউ জানে না। লোকেরা ভেবেছিল মেয়েটিকে বিয়ে করার জন্য জেনারেল তার স্ত্রীকে গুলি করে থাকবে। কিন্তু লোকেরা সেরকম রটনা করলেও আমি কিন্তু কখনওই বিশ্বাস করি না।

তা আপনার কী মনে হয়?

মিসেস র‍্যাভেন্সক্রফট-এর সম্পর্কে একটু চিন্তা করি। আপনি কি সেই লোকটার কথা উল্লেখ করতে চাইছেন?

আমার বিশ্বাস মালয়েতে কিছু একটা ঘটে থাকবে এবং সে ধরনের কাহিনী আমি শুনেছিলাম তার সম্পর্কে। এমন একটি যুবকের সঙ্গে সে জড়িয়ে পড়ে বয়সে তার থেকে ছোটো। এবং তার স্বামী সেটা মেনে নেয়নি। এই ব্যাপারে কিছু স্ক্যান্ডাল ছড়িয়ে পড়ে। যাইহোক সে অনেককাল আগের ঘটনা। আমার মনে হয় না পরে কখনও জানাজানি হয়েছে।

বাড়ির কাছে মানে প্রতিবেশীদের মধ্যে কারোর সঙ্গে কোনো বিশেষ সম্পর্ক গড়ে ওঠার খবরে কোনো আলোচনা হয়েছিল বলে আপনার মনে হয় না? বা ওদের দুজনের মধ্যে ঝগড়া আপনার জানা নেই?

না, তা আমার মনে হয় না। কারণ সেই সময় খবরের কাগজের প্রতিটি খবর পড়েছিলাম। তবে যে কোনো লোকই তার মনোভাব ব্যক্ত করতে পারে সে সত্য বা মিথ্যাই হোক। এর সঙ্গে একটা বিয়োগান্ত প্রেমের কাহিনি জড়িয়ে আছে। কিন্তু বাস্তবে তা যে ছিল না আপনি কি সেটা মনে করেন? ওঁদের ছেলেমেয়ে বর্তমান ছিল। তার আমার ধর্মকন্যাও ছিল।

ওহো হ্যাঁ, ওদের একটি ছেলেও ছিল। কোথাও কোনো স্কুলে পড়াশুনা করত। জোয়ান মেয়েটির বয়স তখন বারো কিংবা আর একটু বেশি। সুইজারল্যান্ডে একটি পরিবারের সঙ্গে থাকত।

তোমার কি মনে হয় না পরিবারের মধ্যে কোনো মানসিক যন্ত্রণা ছিল?

তুমি ছেলেটির কথা বলছ। হতেই পারে, তবে তোমাকে একটা আশ্চর্যের কথা শোনাই এ-ঘটনার কয়েক বছর আগে একটি ছেলে তার বাবাকে গুলি করে। এই ঘটনাটা ঘটেছিল নিউ ক্যাসেলের কাছাকাছি কোথাও হবে। খুব বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল সে। আমি শুনেছি তারা বলেছিল ছেলেটি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত তখন সে নাকি গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল। এবং তারপর সে তার বাবার কাছে এসে তাকে গুলি করে। কেউ কিন্তু জানে না কেন তার বাবাকে সে গুলি করতে গেল? অবশ্য র‍্যাভেন্সক্রফটদের সঙ্গে সেই ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই। অন্য কোনোভাবেই এরকমএকটা চিন্তা আমি কিছুতেই করতে পারি না।

হ্যাঁ জুলিয়া!

আমি এও চিন্তা করতে পারি না যে সেই লোকটি আপনি। কি তাহলে বলতে চাইছেন মিসেস র‍্যাভেন্সট-হা জানো কেউ কেউ ভাবে এটা হতেই পারে কারণ সেই পরচুলাগুলো।

আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না এর মধ্যে পরচুলা আসে কী করে?

তার চেহারা এবং সৌন্দর্য দেখবার জন্য।

তিনি তখন বোধহয় পঁয়ত্রিশ বছরের মহিলা, তাই নয় কি?

আমার মনে হয় আরও বেশি, ছত্রিশ হবে হয়তো। আমার পরিষ্কার মনে আছে একদিন সে আমাকে পরচুলাগুলো দেখিয়েছিল। পরচুলা পড়লে সত্যিই তাকে দারুণ আকর্ষণীয় বলে মনে হত। এসব তার শুরু হয় যখন তারা সেখানে বসবাস করতে আসল। এবং বলতেই হবে সে রীতিমতন সুন্দরী মহিলা ছিল।

আপনি বলতে চাইছেন অন্য কোনো পুরুষের সাথে তিনি মিলিত হয়েছিলেন?

হ্যাঁ, আমি সেটা সব সময়ই ভেবেছিলাম। বললেন মিসেস কারস্টেয়ার্স। যদি কোনো পুরুষ কোনো মেয়ের সঙ্গে প্রেমের ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ে, সাধারণ লোকেরা কিন্তু সেটা লক্ষ্য করে থাকে। কারণ পুরুষরা এ-ব্যাপারে একদম গোপনীয়তা রক্ষা করতে পারে না। কিন্তু একজন মহিলা কোনো পুরুষের সঙ্গে মিলিত হলে সে খুব বেশি কিছু জানতে পারে না। আপনি কি সত্যি তাই মনে করেন জুলিয়া?

জুলিয়া বললেন, সত্যি আমি তা মনে করি না। কারণ আমি মনে করি লোকেরা সব সময়েই জানতে পারে। তার মানে আমি বলতে চাইছি তুমি জানো, চাকরবাকররা জানে, মালিরা জানে, বাস চালকরা জানে কিংবা পাড়ার কেউ জানে। এখানেই সেরকম কিছু হতে পারে আর সেটা দেখে ফেলে থাকবে…

আপনি বলতে চাইছেন যে, এটা একটা ঈর্ষাজনিত অপরাধ?

হ্যাঁ, আমার মনে হয় তাই।

তাহলে আপনি এও মনে করেন জেনারেল তার স্ত্রীকে প্রথম গুলি করেছিল। তারপর নিজেকে। নিশ্চয়ই আপনি মনে করেন না মিসেস র‍্যাভেন্সক্রফট তার স্বামীকে গুলি করার পর নিজেকে গুলি করেছেন? হা সেই রকমই ভাবা উচিত। কারণ আমি মনে করি তিনি যদি তার স্বামীর হাত থেকে রেহাই পেতে চাইতেন তাহলে ওরা দুজনে একসাথে বেড়াতে বেরত না। এবং সে ক্ষেত্রে মিসেস র‍্যাভেন্সক্রফট রিভলবারটা হ্যান্ডব্যাগে নিত কারণ সেই হ্যান্ডব্যাগটা বেশ আকারে বড়ো হতে হত। আর তখনই অনেকে তার হাতে একটা বেমানান হ্যান্ডব্যাগ দেখে বাস্তব দিকের ব্যাপার চিন্তা করত।

মিসেস অলিভার বললেন, আমি জানি। এটা খুবই আগ্রহব্যঞ্জক।

প্রিয়, তুমি অপরাধ কাহিনি লিখে থাকো। এটা তোমার মনেও খুব আগ্রহ জাগাবে। তাই আমি আশা করছি এ বিষয়ে তোমার ভালো ধারণা থাকতে পারে এবং কি ঘটতে পারে তা তুমি বেশ ভালোই জানো।

মিসেস অলিভার বললেন, কী ঘটতে পারে আমি তা জানি না। কারণ সমস্ত অপরাধ কাহিনিগুলোতে যা লিখি তা সবই আমার আবিষ্কার, তার মানে আমার কাহিনিতে আমি যা ঘটাতে চেয়েছি ঠিক সেটাই ঘটেছে। আর এসব ঘটনাগুলো ঠিক সে ধরনের নয় যা আসলে ঘটেছিল বা ঘটতে পারে। আপনি কি এই ব্যাপার চিন্তা করেন সেটা জানতে খুব আগ্রহ হচ্ছে। কারণ লোকগুলোকে আপনি ভালো চেনেন জুলিয়া। এবং আমি আরও মনে করি যে, মিসেস র‍্যাভেন্সক্রফট কিংবা জেনারেল আপনাকে একদিন নিশ্চয়ই কিছু বলে থাকবে।

তুমি যখন বললেই একটু অপেক্ষা করো। আমার মনে হচ্ছে অতীতের কিছু কিছু মনে আসছে।

মিসেস কারস্টেয়ার্স চেয়ারে হেলান দিয়ে দ্বিধাগ্রস্তভাবে মাথা নাড়লেন। চোখ দুটি তার অর্ধনিমীলিত যেন তার মনে এখনও সন্দেহ আছে। উলটোদিকে মিসেস অলিভার নীরবে গভীর আগ্রহ নিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ঠিক যেমন করে চায়ের কেটলিতে জল দিয়ে প্রত্যেক নারী তাকিয়ে থাকে কখন জল ফুটবে এবং কেটলির ঢাকা খুলে যাবে।

হ্যাঁ, আমার মনে হচ্ছে একবার মিসেস র‍্যাভেন্সক্র কিছু যেন একটা বলেছিল এবং তখন আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। সেটা দিয়ে কী সে বোঝাতে চেয়েছিল নতুন করে জীবন শুরু করার ব্যাপারে বোধহয়। আমার ধারণা সেন্ট টেরেসার সম্পর্কে এ্যাভিলার সেন্ট টেরেসা…

মিসেস অলিভারকে একটু হতভম্বের মতো দেখাল কিন্তু এখানে এ্যাভিলার সেন্ট টেরেসার কথা আসে কী করে।

আমার মনে হয় সে নিশ্চয়ই তার জীবনী পড়ছিল তখন। সে বলেছিল চমৎকারভাবে মহিলারা তাদের নতুন জীবন পেয়ে যায়। ঠিক এই রকম ভাষা সে ব্যবহার করেনি। তুমি কি জানো মেয়েদের বয়স যখন চল্লিশ পঞ্চাশ হয় হঠাৎ তারা নতুন জীবন শুরু করতে চায়। এ্যাভিলার টেরেসা তাই করেছিলেন। তারপর তিনি বেরিয়ে পড়েছিলেন সমস্ত কনভেন্ট গুলোর সংস্কার করতে। এবং তারপর তিনি একজন মহান সেন্ট হয়ে যান।

কিন্তু সেটা একই ধরনের ব্যাপার বলে তো মনে হচ্ছে না।

সেটা নয়, বললেন কারস্টেয়ার্স। কিন্তু জানো মেয়েরা ভীষণ বোকার মতো কথা বলে যখন তারা জীবনের মানে খুঁজে পায়, তখন তারা প্রেম সম্পর্কে উল্লেখ করে থাকে।

.

 ছেলেবেলা পিছু ডাকে

রাস্তার ধারে একটা অতি জীর্ণ কটেজ। মিসেস অলিভার চোখে একরাশ সন্দেহ নিয়ে সামনের দরজার দিকে তাকালেন। এবং একটু এগিয়ে থামলেন তিনি। ঠিকানা লেখা ছোট্ট খাতাটা খুললেন এবং মিলিয়ে দেখলেন ঠিকানাটা, কারণ যেখানে আসার কথা ছিল সেই জায়গায় ঠিক এসেছেন কিনা। ইলেকট্রিক বেল বাজালেন, সাড়া না পেয়ে দরজায় আস্তে ধাক্কা মারলেন। এবং তাতেও কোনো যখন কাজ হল না আবার জোরে নক্‌ করলেন। এবার ভেতর থেকে শব্দ পাওয়া গেল। তারপরেই এলোমেলো পায়ের শব্দের সঙ্গে হাঁপানির টানের শব্দ এবং কাঁপা কাঁপা হাতে দরজা খোলার শব্দ তার কানে ভেসে ভেসে এলো৷ আর এই শব্দের সঙ্গে লেটার-বক্সে কিছু অস্পষ্ট শব্দের প্রতিধ্বনি শুনতে পাওয়া গেল।

দরজার ক্যাচক্যাচ শব্দ এবং কেমন একটা ভুতুড়ে শব্দ তুলে দরজাটা খুলে গেল। দরজা খুলে তখন দাঁড়িয়েছিলেন অতি বৃদ্ধ এক মহিলা।

মুখে বলিরেখা, বাতে পঙ্গু, ঝুঁকে পড়া কাঁধ, ভাসাভাসা চোখে তিনি তাকালেন অতিথির দিকে। তার মুখটা দেখে মনে হল গোমড়া। তাকে স্বাগত জানাবার কোনো লক্ষণই দেখা গেল না। অবশ্য তার চোখে মুখে ভয়ের কোনো চিহ্ন ছিল না। তার বয়স সত্তর বা আশি হতে পারে। কিন্তু এই বয়সেও যে তিনি তার বাড়ির রক্ষকের কাজ করছেন বাহবা দিতে হয়।

কিসের জন্য তুমি এসেছ? একটু থামলেন এবং বললেন, তুমি মিস অ্যারিয়াডন না? বাঃ! চমৎকারভাবে আপনি দেখছি আমাকে মনে রেখেছেন। আপনি কেমন আছেন মিসেস ম্যাচাম? মিস অ্যারিয়াডন! দাঁড়াও, আমাকে একটু ভাবার সুযোগ দাও।

অনেক আগে উনি আমাকে মিস অ্যারিয়াডন বলে ডাকতেন, ভাবলেন মিসেস অলিভার। তবে বয়সের ভারে গলার স্বর একটু ভেঙ্গে গেছে। তাহলেও বেশ ভালোই চেনা যায়।

আরে ভেতরে এসো। তোমাকে বেশ ভালোই দেখাচ্ছে। কতকাল আগে যেন তোমাকে দেখেছি। তা প্রায় কম করেও পনেরো বছর হবে না? বৃদ্ধা বললেন, পনেরো বছরেরও বেশি হবে তা শুধরে দিতে চাইলেন না মিসেস অলিভার। ভেতরে ঢুকে মিসেস ম্যাচামের সঙ্গে করমর্দন করলেন। বয়সের ভারে অসম্ভব কাঁপছিল তার হাতটা। যাইহোক কোনো রকমে দরজা বন্ধ করে এলোমেলো পায়ে হেঁটে গিয়ে একটা ছোট্ট ঘরে ঢুকলেন। অবশ্যই ঘরটা তাঁর পছন্দমতো অথবা অপছন্দ অতিথিদের সম্বর্ধনা জানানোর জন্য সেইভাবেই সাজানো এবং এই ঘরের মধ্যে অসংখ্য ফটো, তার মধ্যে কিছু শিশুর আর কিছু প্রাপ্তবয়স্কদের। কিছু কিছু ছবি চামড়ার ফ্রেমে আঁটা। রুপোর ফ্রেমে একটা যুবতীর ছবি মাথায় তার পাখির পালক। সেই ছবির মধ্যে দুজন নৌ বাহিনীর অফিসার, দুজন সামরিক অফিসার আর আছে কিছু নগ্ন শিশুর ছবি এবং ঘরের মধ্যে আসবাব বলতে একটা সোফা, দুটো চেয়ার। একটা চেয়ারে বসলেন মিসেস অলিভার আর সোফার ওপর নিজে বসলেন। বসতে তার কষ্ট হচ্ছিল বলে পিছনে একটা কুসান ঠেসান দিলেন।

তোমাকে দেখবার খুব ইচ্ছা ছিল। আচ্ছা তুমি কি তোমার সুন্দর লেখা এখনও লিখছ তো?

মিসেস অলিভার হ্যাঁ বললেন বটে তবে তার মনে সন্দেহ হল যে, একটা গোয়েন্দা গল্প, বা অপরাধ কাহিনি এবং অপরাধীদের ব্যবহার কী করে সুন্দর ও চমৎকার আখ্যা পেতে পারে।

মিসেস ম্যাচাম বললেন, আমি এখন একেবারে একা নিঃসঙ্গ জীবন কাটাচ্ছি। আমার বোন গ্রেসি গত হেমন্তে মারা গেছে, তার ক্যান্সার হয়েছিল। অপারেশনও হয়েছিল কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে আমার। বোনকে তুমি চিনতে তো? আমার খুব খারাপ লাগছে। আমি সত্যিই দুঃখিত, বললেন মিসেস অলিভার।

মিনিট দশেক বৃদ্ধা এক এক করে আত্মীয়স্বজনের মৃত্যুর আলোচনা করলেন এবং কোনো কোনো আত্মায় এখনও জীবিত রয়েছেন তা বলে আলোচনা শেষ করলেন।

তোমার শরীর কেমন? নিশ্চয়ই ভালো। তোমার স্বামী-ওহো এখন মনে পড়ছে কয়েক বছর আগে সে মারা গেছে তাই না? তা লিটল স্যাটার্ন মাইনার কেন এসেছ, আমি কি জানতে পারি?

মিসেস অলিভার বললেন, এ-পাড়ার কাছেই ত্রাসে ছিলাম। ঠিকানা লেখা খাতায় আপনার ঠিকানা লেখা ছিল। তাই মনে করলাম আপনার বাড়িতে একবার ঘুরে যাই। আপনি কেমন আছেন?

আহ। সম্ভবত পুরোনো দিনের কথা বলতে এবং যখন তুমি তা করো খুব ভালো লাগে তাই না?

মিসেস অলিভার হ্যাঁ বললেন এবং সঙ্গে সঙ্গে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন–যে কারণে তিনি এখানে এসেছেন সেই প্রসঙ্গের একটা ইঙ্গিত মিসেস ম্যাচামের কথায় পাওয়া গেল। তিনি বললেন, না জানি কতগুলো ফটোই আপনি পেয়েছেন।

পুরোনো দিনের একটা বাড়ির কথা মনে পড়ছে। সেই বাড়িতে আমি ছিলাম। বাড়িটার নাম সূর্যাস্ত নীড়। এক বছর তিন মাস সেখানে ছিলাম। কী জঘন্য ব্যবস্থা। আমি আমার নিজস্ব কোনো জিনিস ব্যবহার করতে পারব না। সব কিছুই হোমের। আমি বলছি না সেগুলো ভালো নয় কিন্তু আমি আমার নিজের জিনিসই ব্যবহার করতে পছন্দ করি। যেমন আমার ফটো, আমার ফার্নিচার। তারপর সেখানে একটি নারী এলো কোনো একটি কাউন্সিল থেকে বা সোসাইটি থেকে কিংবা অন্য কোথা থেকে। আমাকে বলল তাদের একটা ভালো হোম আছে সেখানে আমি আমার পছন্দমতো যে কোনো জিনিস ব্যবহার করতে পারব। প্রতিদিন সেখানকার কর্তৃপক্ষ থেকে তোক এসে খোঁজ নিয়ে যায় আমি ভালো আছি কিনা। সত্যি খুব আরামে আছি। কারণ এখানে আমি আমার সব কিছুই কাছে পেয়েছি।

চারিদিক তাকিয়ে দেখলেন মিসেস অলিভার এবং বললেন, সব জায়গা থেকেই যা পাওয়া যায়।

হ্যাঁ ওই টেবিলটা। ওই ব্রাসটা ওই দুটো ক্যাপ্টেন উইলসন সিঙ্গাপুর থেকে আমাকে দিয়েছিলেন। বেনারস ব্রাসটা খুব সুন্দর না। ছাইদানির ওপর ওই জিনিসটা, ওটা একটা মুগুর বা গদা, পাথরের তৈরি ওটা ইজিপ্টের জিনিস। ওরা ওটা দামি পাথর বলে থাকে, এর রঙ উজ্জ্বল নীল।

মিসেস অলিভার বললেন, লাজিস লাজুলি।

তা ঠিক। আজও ঠিক ওটা একই রকম আছে। প্রত্নতাত্ত্বিকের একটি দল মাটি খুঁড়ে পায় এবং ওটা আমাকে পাঠিয়ে দেয়, মিসেস অলিভার বললেন, আপনার অতীতের মতো সব জিনিস সবই কিন্তু সুন্দর।

হ্যাঁ এরাই সব আমার ছেলেমেয়ে। এদের মধ্যে কাউকে জন্মের প্রথম মাস থেকে পেয়েছিলাম। কয়েকজনকে বয়স্কা অবস্থায় আবার আমি যখন ভারতবর্ষে গিয়েছিলাম তখন কয়েকজনকে পাই। ওই মেয়েটি মিস মোওয়া। ও খুব সুন্দর ছিল। ওর দু-দুবার স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ হয়। প্রথম বিয়ের পর স্বামীর সাথে এ্যাডজাস্ট করতে অসুবিধা হচ্ছিল তাই বিচ্ছেদ হয়। দ্বিতীয়বার বিয়ে করে, একজন পপ গায়ককে। সেই বিয়েও ওর বেশি দিন টিকল না। আবার কালিফোর্নিয়ায় বিয়ে করেছিল। বছর দু-তিন আগে মেয়েটি মারা যায় মাত্র বাষট্টি বছর বয়সে।

বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় আপনি ঘুরে বেরিয়েছেন যেমন ভারত, হংকং, ইজিপ্ট এবং দক্ষিণ আমেরিকা। তাই না? মিসেস অলিভার বললেন।

হ্যাঁ বলতে পারো বিদেশ ভ্রমণে আমার ভালো অভিজ্ঞতা আছে।

মিসেস অলিভার বললেন, আমি যখন মালয়েতে ছিলাম, তখন আপনি না একজন সৈনিক পরিবারের সঙ্গে ছিলেন? নামটা ঠিক মনে করতে পারছি না জেনারেল এবং লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট তাই কি?

না, না, নামটা তুমি ভুল বলছ। বারনেবিদের সঙ্গে যখন ছিলাম তুমি তখনকার কথা ভাবছ। তুমি তখন ট্যুরে ছিলে এবং ফিরে এসে বারনেবিদের সঙ্গে ছিলে। তুমি ওই মহিলার পুরোনো বন্ধু ছিলে। এবং তার স্বামী ছিলেন বিচারপতি।

ও হ্যাঁ হ্যাঁ। নামগুলো কেমন যেন গোলমাল হয়ে যায়। মনে রাখা খুব কষ্টকর। বললেন মিসেস অলিভার।

ম্যাচাম বললেন, ওঁদের দুটি ছেলেমেয়ে ছিল। ছেলেটি পড়তে যায় হ্যাঁরোয়ে এবং মেয়েটি যায় রোডিনে। সেইজন্য আমি অন্য আর এক পরিবারের কাছে চলে গিয়েছিলাম। ভালো কথা তুমি যেন কাদের কথা বলছিলে? র‍্যাভেন্সক্রফটদের কথা? হ্যাঁ তাদের কথা খুব ভালো মনে আছে। এখন তারা সেখানে বাস করছেন জায়গাটার নাম ঠিক মনে আসছে না। আমাদের কাছ থেকে খুব বেশি দূরে ছিল না। ওই পরিবারটি প্রত্যেকের খুব পরিচিত ছিল। যদিও অনেক দিন আগের কথা তবুও আমি সব মনে করতে পারি। বারনেবিদের ছেলেমেয়েরা যখন স্কুলে যেত তখন মিসেস বারনেবিদের দেখাশুনা করার জন্য সেখানে থাকতাম। আর হ্যাঁ আমি যখন ওখানে ছিলাম তখনই সেই ভয়ঙ্কর ঘটনাটা ঘটেছিল, আমি র‍্যাভেন্সক্রফটদের কথা বলতে চাইছি। সে কথা আমি ভুলতেই পারব না এবং সে ব্যাপারে আমি নিজেকে জড়াতেও চাই না।

মিসেস অলিভার বললেন, আমারও তো একই ধারণা। আপনি ইংলন্ডে ফিরে যাওয়ার পর বেশ অনেক বছর কেটে গেছে। তারা চমৎকার দম্পতি ছিলেন এবং তাদের কাছে এটা একটা বিরাট আঘাত ছিল। সত্যি এখন আর আমার কিছুই মনে নেই। বললেন মিসেস অলিভার।

আমি জানি। কেউ কেউ আছে যারা সব ভুলে যায় কিন্তু আমি ভুলিনি একদম। তারা আলোচনা করছিল যে, ভদ্রমহিলা যেন কেমন অদ্ভুত ধরনের ছিলেন। যেমন পেরামবুলেটার থেকে একটা পিণ্ডকে উঠিয়ে নিয়ে নদীতে ফেলে দিয়েছিলেন। তারা বলেছিলেন এটা নাকি ঈর্ষা। আবার কেউ বলেছিল সেই পিণ্ডটিকে স্বর্গে পাঠাতে চেয়েছিলেন। অপেক্ষা করতে, চাননি।

আপনি কি লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট-এর কথা বলছেন?

না, আমি তা বলতে চাইছি না। আমি বোনের কথা বলতে চাইছি।

কার বোনের কথা বলতে চাইছেন?

এখন আমি ঠিক জানি না। সে জেনারেলের বোন না লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট-এর বোন, তারা বলেছিল মেয়েটি নাকি দীর্ঘদিন পাগলা গারদে ছিল, তখন তার বয়স এগারো কি বারো। তারপর সেখান থেকে ভালো হয়ে ফিরে এসে কোনো এক সৈনিককে বিয়ে করেছিল। এবং এখান থেকেই গণ্ডোগোলের সূত্রপাত। আবার তাকে নির্জন মানসিক চিকিৎসালয়ে পাঠানো হয়েছিল। আমার বিশ্বাস জেনারেল এবং তার স্ত্রী সেখানে গিয়ে তাকে দেখে আসত। ছেলেমেয়ের দেখাশুনা করার ভার অন্য কেউ নিয়েছিল। তারা বলেছিল শেষের দিকে নাকি সে ভালো হয়ে উঠেছিল। এবং স্বামীর কাছে থাকবার জন্য ফিরে আসে। তার অল্প কয়েকদিন বাদে সে মারা যায় বা ওই রকম কিছু একটা হবে। যে কারণেই হোক সে ভীষণভাবে ভেঙ্গে পড়ে এবং স্বামীর ঘর ছেড়ে ভাই কিংবা বোনের কাছে চলে এসেছিল। যেখানেই সে থাকুক সে তার ছেলেমেয়েদের কাছে পেত। একদিন বিকেলে ছেলেটি তখন স্কুলে। সেই ছোট্ট মেয়েটি এবং আর একটি বাচ্চা মেয়ে এক সঙ্গে খেলা করছিল। অনেকদিন আগেকার কথা। সব খবর আজ আর মনে নেই। তবে শোনা গিয়েছিল সেটি আদৌ তার ছিল না, তারা ভেবেছিল আম্মা যেহেতু তাদের ভালোবাসত তাই সেটা আম্মার কাজ। সেই জন্য সে খুব ভেঙ্গে পড়ে এবং তাদের সেখান থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিল কারণ সেখানে তারা নিরাপদে ছিল না। অন্যেরা কিন্তু তা বিশ্বাস করত না। এমন কি তাদের ধারণা সেটা তাদের কেন্দ্র করেই ঘটেছিল। যাইহোক তার নাম আমি এখন আর মনে করতে পারছি না।

ঘটনাটা হল এইরকম।

জেনারেল বা লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট-এর যেই হোক তার জীবনে কী ঘটনা ঘটেছিল জানেন?

আমার বিশ্বাস সেই একই জায়গায় সেটা হবে একেবারে শেষের দিকে কোনো চিকিৎসক তাকে সঙ্গে করে ইংলন্ডে ফিরে যায়। তবে আমার মনে হয় তার স্বামীর অনেক টাকা ছিল। হয়তো আবার সে সুস্থ হয়ে উঠবে এই আশায় কোনো এক জায়গায় তার দেখাশোনা ভালোই হত। আমি অন্তত বলতে পারি বহুদিন এই বিষয়ে আর ভাবিনি, আমি বলতে পারব না তারা এখন কোথায়, কিংবা অনেকদিন আগেই তারা–মিসেস অলিভার বললেন, এটা খুব দুঃখের কথা হয়তো আপনি খবরের কাগজে পড়ে থাকবেন

ইংল্যান্ডে তাদের একটা বাড়ি কেনার কথা এবং তারপর

হ্যাঁ হ্যাঁ খবরের কাগজে সে রকম একটা ঘটনা যেন পড়েছিলাম, র‍্যাভেন্সক্রফটের কথাটা এখন যেন ঠিক মনে করতে পারছি না। কখন এবং কেমন করে তারা পাহাড়ের ওপরে উঠে ছিল। তারপর তারা যেন–? কিছু একটা হবে। হা সেরকম কিছু একটা হবে বললেন মিসেস অলিভার।

তোমাকে দেখে আমার খুব আনন্দ হচ্ছে, এখন এক কাপ চা না খাওয়ালেই নয়।

না, না আমি চা খাব না, মিসেস অলিভার বললেন।

আমার সাথে এখন রান্নাঘরে এসো। কারণ দিনের বেশি সময় ওখানেই কাটাই। আমি অতিথিদের এঘরেই আপ্যায়ন করে থাকি। কারণ হল আমার সংগ্রহ অতিথিদের দেখালে আমি মনে মনে খুব গর্ববোধ করি যেমন গর্ববোধ করি সব ছেলেমেয়েদের এবং অন্যদের সম্বন্ধে।

আমার ধারণা আপনি যে সব ছেলেমেয়েদের প্রতি নজর রাখতেন তাদের সঙ্গে আপনার জীবন বেশ ভালোভাবেই কেটেছিল। মিসেস অলিভার বললেন।

হ্যাঁ, তুমি খুব গল্প শুনতে ভালোবাসতে তাই তোমায় ছোটোবেলায় আমি বাঘের, বাঁদরের গল্প বলতাম, মিসেস অলিভার, সে তো অনেক দিন আগের কথা, সেসব গল্প আমার খুব মনে আছে।

এই গল্পের আলোচনা করতে করতে তার মন চলে গেল সেই ছয় কিংবা সাত বছরের শৈশবের দিনগুলিতে। তার মনে পড়ল তিনি বোতাম আঁটা জুতো পড়ে ইংল্যান্ডের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মিসেস ম্যাচামের কাছ থেকে একটার পর একটা গল্প শুনতেন ভারত এবং ইজিপ্ট সম্বন্ধে।

মিসেস অলিভার চারিদিক তাকিয়ে দেখলেন স্কুলের ছেলেমেয়েদের, শিশুদের এবং মাঝবয়সি লোকেদের ছবি আটকানো। সম্ভবত তারা তাদের আয়াকে হয়তো ভুলতে পারেনি। হঠাৎই মিসেস অলিভার চিৎকার করে রান্নাঘর পর্যন্ত গেলেন এবং তিনি যে জিনিসটা তার জন্য এনেছেন সেটা তার হাতে দিলেন।

জিনিসটা হাতে নিয়ে তিনি আনন্দে বলে উঠলেন, এটা তো টোফোল থাথামোর টয়ের টিন। এখন এ চা খুবই কম পাওয়া যায়। দেখছি তুমি কখনও কিছু ভোলো না। আরে যে ছেলে দুটো খেলতে আসত তাদের তোমার মনে আছে হয়তো, তারা তোমাকে কি বলে ডাকত জানো? একজন বলত লেডি হস্তি এবং অপর জন বলত লেডি হংসী। যে লেডি হস্তি বলত সে তোমার পিছনে বসত এবং তুমি মেঝের ওপর ঘুরে ঘুরে তাদের কাছে গিয়ে তাদের তোলার ভান করতে।

মিসেস অলিভার বললেন, দেখছি আপনি প্রায় কিছুই ভোলেননি?

মিসেস ম্যাচাম বললেন, তুমি হয়তো জানো একটা পুরন প্রবাদ হাতিরা কখনও ভোলে না।

.

কাজ করে চলেন মিসেস অলিভার

উইলিয়ামস এ্যান্ড বারনেট বলে একটা কেমিস্ট কাম কসমেটিকের দোকানে ঢুকলেন মিসেস অলিভার, নানাধরনের সেলস কাউন্টারের সামনে দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ একটা জায়গায় বেশ মোটাসোটা চেহারার একটা মেয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন এবং কিছু লিপস্টিকের খোঁজ করলেন। তার মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি অবাক হয়ে চিৎকার করে বললেন, তুমি মারলিন না?

হ্যাঁ আপনি ঠিকই বলেছেন এবং সেও চিনতে পেরে বলে উঠল, আপনি তো মিসেস অলিভার? আপনি এখানে কেনাকাটা করতে এসেছেন শুনলে মেয়েরা উত্তেজিত হয়ে উঠবে।

মিসেস অলিভার বললে ওদের নোলো না

আচ্ছা অটোগ্রাফ চাইতে পারে এই মনে করে কি বলছেন আপনি?

আমি চাই সেরকম ওরা যেন কিছু না করে এবং বলো তুমি কেমন আছ?

মারলিন বলল, মোটামুটি চলে যাচ্ছে।

আমি কিন্তু জানতাম না যে তুমি এখানে কাজ করছা?

আমার মনে হয় অন্য জায়গার মতোই ভালো এটা। আপনার সাথে ওরা বেশ চমৎকার ব্যবহার করবে। আর হ্যাঁ আমি এখন ওই কসমেটিক কাউন্টারের ইনচার্জ।

তোমার মা এখন কেমন, নিশ্চয়ই ভালো আছেন?

মা যদি শুনতে পান যে, আপনার সাথে আমার দেখা হয়েছে, খুবই আনন্দ পাবেন তিনি।

হাসপাতালের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে তিনি কি সেখানে ওই বাড়িতেই আছেন?

হ্যাঁ আমরা সেখানেই থাকি। তবে বাবা খুব ভালো নেই। এই সবে হাসপাতাল থেকে এসেছেন। মা ভালোই আছেন, আপনি কি এখানেই কোথাও থাকেন কাছাকাছি?

না, মিসেস অলিভার বললেন। আসলে কি জানো, আমার এক পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম এখানে। ঘড়ির দিকে তিনি তাকালেন। পরে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা মারলিন, তোমার মা কি এখন বাড়িতে আছেন? ওঁর সাথে একবার দেখা করে কিছু কথা বলতে চাই। কারণ অনেকদিন তো আর দেখা হয় না।

নিশ্চয়ই উনি খুব খুশি হবেন আপনাকে দেখে, মারলিন বলল। কিন্তু আমার খুব খারাপ লাগছে যে, এখন আপনার সাথে আমি যেতে পারব না বলে।

ঠিক আছে কোনো ব্যাপার নয়। আবার নিশ্চয়ই দেখা হবে। মিসেস অলিভার বললেন, তোমার বাড়ির নম্বর, বা কোনো নাম আছে কি? আমার ঠিক মনে নেই।

মারলিন বলল, হ্যাঁ বাড়ির নাম আছে লরেন কটেজ।

দেখো তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে খুব ভালো হল।

মিসেস অলিভার একটা লিপস্টিক কিনলেন এবং গাড়ি নিয়ে গ্যারেজ এবং হাসপাতাল পেরিয়ে একটা সরু রাস্তায় এলেন।

লরেন কটেজের সামনে গাড়ি রেখে বাড়ির ভেতরে ঢুকলেন এবং দেখলেন, বয়স প্রায় পঞ্চাশ। ধূসর চুল রোগাটে একজন ভদ্রমহিলা দরজা খুললেন এবং তাকে দেখেই চিনতে পারলেন। আরে আপনি মিসেস অলিভার না? কতদিন বাদে দেখা। প্রায় এক যুগ হবে তাই না?

হ্যাঁ সে অনেকদিন হবে।

আরে আসুন আসুন ভেতরে। একটু চা খেয়ে যান।

মিসেস অলিভার বললেন, একটু আগেই এক বন্ধুর সঙ্গে চা খেলাম। এবং সেখানে কেমিস্টের দোকানে কিছু কেনাকাটা করতে যেতেই সেখানে মারলিনকে দেখলাম।

–হ্যাঁ, খুব ভালো একটা চাকরি পেয়েছে।

আপনি কেমন আছেন মিসেস বাকল? আপনার সাথে যখন শেষ দেখা হয়েছিল তার থেকে এখন খুব একটা বেশি বয়স হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না কিন্তু।

না, চুল আমার ধূসর হয়ে গেছে আর ওজনও আমার খুব কমে গেছে?

বাড়ির ভেতর ঢুকতে গিয়ে মিসেস অলিভার বললেন, আমার পুরোনো বন্ধুদের সাথে দেখা হল। আপনার মনে আছে কিনা জানি না মিসেস কারস্টেয়ার্স, মিসেস জুলিয়াকে।

নিশ্চয়ই মনে আছে। তিনি কেমন আছেন?

হ্যাঁ, তিনি ভালোই আছেন। তার সাথে কথা বলতে বলতে পুরোনো দিনের কিছু কথাবার্তা হল। কথা প্রসঙ্গে সেই বেদনাদায়ক ঘটনার কথাও উঠল আমি তখন আমেরিকায় ছিলাম। সেই ব্যাপারে আমার বিশেষ কিছু জানা নেই। তবে লোকেরা বলত র‍্যাভেন্সক্রফট

হ্যাঁ, আমার বেশ ভালোই মনে আছে।

আচ্ছা মিসেস বাকল এক সময় আপনি না তাদের কাজ করছিলেন?

হ্যাঁ সাতদিনের মধ্যে তিনদিন সকালে ওঁদের বাড়িতে যেতাম। সত্যিকারের মিলিটারি লেডি বলতে যা বোঝা যায় তিনি তাই ছিলেন এবং ভদ্রলোকও খুবই ভদ্র ছিলেন।

সত্যিই সেই ঘটনাটা বড়োই বেদনাদায়ক।

হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন।

আচ্ছা সেই সময় কি আপনি সেখানে কাজ করতেন?

সেই সময় আমি ওখানে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম কারণ ঠিক সেই সময়ে আমার এক বৃদ্ধা অন্ধ মাসিমা আমার বাড়িতে থাকতেন। ওঁকে দেখাশুনা করার পর আর বাড়তি সময় ছিল না যে, বাইরে কোথাও কাজ করার। তবে বলতে পারি সেই ঘটনার এক কী দুমাস আগে পর্যন্ত ওখানে আমি কাজ করেছিলাম।

আমি জেনেছি, মিসেস অলিভার বললেন, ওদের ধারণা এটা নাকি একটা আত্মহত্যার চুক্তি।

মিসেস বাকল বললেন, আমি নিশ্চিত ওঁরা কখনও একসঙ্গে আত্মহত্যা করতে পারে না। কারণ–ওঁরা যেভাবে মিলেমিশে থাকতেন, তাঁদের মধ্যে যেভাবে বোঝাঁপড়া ছিল তাতে এরকম অস্বাভাবিক কিছু ভাবাই যায় না। যদিও তারা সেখানে বেশি দিন ছিলেন না।

আমারও তা মনে হয় না, বললেন মিসেস অলিভার, বোরোন মাউমের কাছে ওঁরা যেন থাকতেন, আগে ইংল্যান্ডে এসে যেখানে বসবাস শুরু করেন ওঁরা তাই তো? হ্যাঁ কিন্তু ওঁরা দেখলেন যেখানে ওঁরা ছিলেন সেই জায়গাটা ইংল্যান্ড থেকে অনেক দূর। তাই তাঁরা চিপিং বারট্রামে চলে এলেন। তাদের বাড়িটা ছিল খুব সুন্দর এবং সেই বাড়িতে ছিল একটা সুন্দর বাগান।

ওঁদের বাড়িতে যখন আপনি শেষ কাজ করেন তখন কি ওঁদের স্বাস্থ্য ভালো ছিল?

জেনারেলের একটু হার্টের কষ্ট ছিল। মাঝখানে একবার স্ট্রোক হয়েছিল। ঘুরেফিরেই একটু বেশি চিন্তিত হয়ে পড়তেন। তাই এক এক সময় ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাতেন।

লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট কেমন ছিলেন?

তবে আমার মনে হয় বিদেশের জীবনযাত্রা এখানে এসে তিনি হারিয়ে ফেলেছিলেন। যদিও এখানে ওঁদের সমকক্ষ অনেক ভালো পরিবার ছিল। এখানে খুব বেশি লোকদের ওঁরা চিনতেন না। সেখানে ওঁদের অনেক চাকর ও জমকালো পার্টি ছিল।

আপনার কি মনে হয় সেইসব জমকালো পার্টি উনি হারিয়ে ফেলেছিলেন?

আমি ঠিক সেটা বলতে পারব না।

আমাকে একজন বলেছেন, আচ্ছা উনি কি পরচুল ব্যবহার করতেন?

মিসেস বাকল একটু মৃদু হাসলেন এবং বললেন, অনেক ধরনের পরচুল ছিল যা খুব মূল্যবান। সত্যিই সত্যিই সেইসব পরচুল পড়লে তাকে খুব স্মার্ট এবং আকর্ষণীয় মনে হত। শুধু তাই নয়, তিনি খুব দামি দামি পোশাকও পরতেন।

মিসেস অলিভার জিজ্ঞেস করলেন, সেই ঘটনার ব্যাপারে আপনার কী মত?

–আচ্ছা দেখুন সেই সময় আমি ছিলাম আমেরিকায়। ফিরে আসার পর আমার বন্ধু-বান্ধবদের সাথে তেমন দেখা হয়নি। আমি কাউকে এই ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করিনি বা কাউকে চিঠি লিখে খোঁজও করিনি কারণ আমি সেটা চাইনি। সুতরাং এই ব্যাপারে আমার কিছুই জানা নেই। তবে আমার মনে হয় এই ঘটনার পেছনে কোনো কারণ থাকলেও থাকতে পারে। আমি যেটুকু জানতে পেরেছি যে এ-ক্ষেত্রে জেনারেল র‍্যাভেন্সক্রফট তার নিজস্ব রিভলবার ব্যবহার করেছিলেন। হ্যাঁ, তিনি বলতেন বাড়িতে দুটো রিভলবার না থাকলে নাকি কোনো নিরাপত্তাই থাকে না। হয়তো ওঁর কথাই ঠিক, একদিন বিকালবেলায় একটা বিশ্রী দেখতে লোক জেনারেলের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। যখন সে তরুণ ছিল তখন নাকি সে জেনারেলের রেজিমেন্টে ছিল। জেনারেলের সন্দেহ হওয়ায় তিনি কয়েকটি প্রশ্ন করেছিলেন কিন্তু আমার ধারণা লোকটি সঠিক উত্তর দিতে পারেনি। এবং তার আরও মনে হয়েছিল লোকটি একদম বিশ্বাসযোগ্য নয়। জেনারেল তাকে পাত্তা না দিয়ে চলে যেতে বললেন।

আপনার কি মনে হয় বাইরের কোনো লোক একাজ করেছে?

হ্যাঁ, আমার মনে হওয়ার কারণ আর কোনো যুক্তিই নেই এরকম ঘটনা ঘটার জন্য। ওদের বাগান পরিচর্যা করত যে মালিটা আমি তাকে পছন্দ করতাম না। শোনা কথা তবে প্রথম জীবনে সে কয়েকবার জেল খেটেছিল নাকি। এতসব ঘটনা সত্ত্বেও জেনারেল তার বাগানে পরিচর্যার জন্য তাকে রেখেছিল।

তাহলে কি আপনি মনে করেন সেই মালিটাই ওঁদের হত্যা করেছিল?

হ্যাঁ, আমি এরকম ধারণার কথাই বলছি। কিন্তু আমার মনে হয় না যে, লোকেরা যখন ওঁদের সম্পর্কে কোনো স্ক্যান্ডাল বা নোংরা আলোচনা করে সবাই তখন বোকার মতো কথা বলে। সুতরাং আমি জোর দিয়ে বলছি এমন নিষ্ঠুর কাজ বাইরের কোনো লোক করে থাকবে। আজকের দিনের সংবাদপত্রের খবরগুলোর দিকে লক্ষ্য করুন শুধু শুধু অপরাধমূলক পরিবেশিত হয়। কোন কোন খবর? যেমন কোনো ছেলেরা প্রচুর ড্রাগ খাচ্ছে, কে বা কারা অকারণে নিরীহ লোককে গুলি করছে, কারা বন্য মনোভাব পোষণ করছে অথবা মেয়েদের অনুরোধ করছে বারে বসে তাঁদের সঙ্গে মদ খেতে এবং পরের দিন তারই মৃতদেহ ড্রেনে বা রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। কিংবা কাউকে শ্বাসরোধ করে মারা আজকাল নিয়মমাফিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ-ধরনের অপরাধ আজকাল যে কেউ করতে পারে। অথচ এক্ষেত্রে দেখতে পাওয়া যায় জেনারেল এবং তার স্ত্রী সেদিন সন্ধ্যায় বেড়োতে বেরিয়েছিলেন এবং এঁদের দুজনকেই মাথায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়।

গুলিটা কি ওদের মাথায় করা হয়েছিল?

আমি সন্দেহজনক তেমন কিছু দেখিনি আর এখন ঠিক মনে করতে পারছি না। তবে ওঁরা অন্য দিনের মতো সেদিনও বেড়োতে বেরিয়েছিলেন।

তবে ওঁদের দুজনের মধ্যে কি কোনো তিক্ততা ছিল?

ওহো এ-প্রসঙ্গে আমি ওদের বয়সের দিকটা আলোচনা করতে চাই। এই বিশেষ দিকটাকে কেন্দ্র করে অনেক কথা উঠবে। আদৌ কোনো কিছু ছিল না। আর পাঁচজন তো পাঁচ কান করবেই।

ওঁদের মধ্যে কেউ একজন হয়তো অসুস্থ ছিলেন। লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট একবার কী দু-বার লন্ডনে গিয়েছিলেন। তবে আমার মনে হয় হয়তো কোনো কিছু অপারেশন করার জন্য তিনি হাসপাতালে গিয়েছিলেন। তাঁর অসুখ কী যদিও তিনি কিছু বলেননি। আমার ধারণা ওরা ঠিক খবরই সংগ্রহ করেছিল যে, অল্প সময়ের জন্য তিনি হাসপাতালে ছিলেন। এবং উনি যখন ফিরে আসেন তখন দেখে মনে হচ্ছিল ওঁনার মুখের অনেক চিকিৎসা হয়েছে। কারণ ওঁনাকে তখন তরুণী বলে মনে হচ্ছিল এবং পরচুল পরলে খুব সুন্দর দেখাত। এক কথায় বলা যায় তিনি যেন নতুন জীবন লাভ করেছেন।

জেনারেল র‍্যাভেন্সক্রফট?

তিনি ছিলেন চমৎকার ভদ্রলোক। কোনো স্ক্যান্ডাল আমার কানে আসেনি ওঁর সম্পর্কে এবং আমি মনে করি না সেরকম কিছু ছিল। অথচ সেই ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে তারা এ নিয়ে অনেক কথা বলতে শুরু করে। তাতে আমার একটা কথা মনে হয়েছে হয়তো মালয় কিংবা অন্য কোথাও জেনারেলের মাথায় আঘাত লেগে থাকবে। এরকম মনে করার কারণ হল আমার এক কাকা কিংবা জ্যাঠামশাই একসময় ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যান এবং মাথায় আঘাত পান। ছ-মাস বাদে তিনি এমন বিপজ্জনক হয়ে ওঠেন যে তাকে মানসিক হাসপাতালে নিয়ে যেতে বাধ্য হন। কারণ তিনি সব সময়ই তার স্ত্রীকে হত্যা করার কথা বলছিলেন এবং এও বলছিলেন তাঁর স্ত্রী নাকি তাকে নির্যাতন করছেন। আরও আশ্চর্য হবেন শুনলে তার স্ত্রী নাকি অন্য দেশের হয়ে গুপ্তচরগিরি করছেন। ভাবুন একবার, তাকে যদি মানসিক হাসপাতালে পাঠানো না হতো কী ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটতে পারত তাদের পরিবারে। ওঁদের দুজনকে ঘিরে যে সমস্ত কথা প্রচার হয়েছিল এবং আমি যা শুনেছি ওঁদের মধ্যে এর ফলে একটা খারাপ ধারণার সৃষ্টি হয়। আর সেই কারণেই ওদের মধ্যে কেউ একজন অপরকে গুলি করে নিজেই নিজেকে গুলি করেছিলেন। এ-ঘটনা আপনি সত্য বলে মনে করেন না তাই তো?

না, না, আমি একেবারেই বিশ্বাস করি না। ওঁদের ছেলেমেয়েরা কি তখন বাড়িতে ছিল?

না, মেয়েটির নাম যেন কি রোজি না পেনেলোপ?

মিসেস অলিভার বললেন, আমার ধর্মকন্যা সেলিয়া।

ওহো হ্যাঁ, মনে পড়েছে। একবার ওকে নিয়ে আপনি যেন কোথায় বেড়োতে যান। ও দারুণ তেজস্বী ও সাহসী মেয়ে ছিল তবে একটু বদ মেজাজিও ছিল। তবু আমার মনে হয় মেয়েটি ওর বাবা মার খুব প্রিয় ছিল। ও তখন সুইজারল্যান্ডের স্কুলে ছিল। মানুষের মুখের কথা যে, দুর্ঘটনার সময় যদি ও বাড়িতে থাকত বাবামা-র অমন বীভৎস মৃতদেহ দেখলে ও খুব আঘাত পেত।

ওঁদের সেই ছেলেটি, সে কি তখন বাড়িতে ছিল না?

হ্যাঁ, ওকে দেখলে মনে হত যে, ও ওর বাবাকে পছন্দ করত না। ওর ব্যাপারে ওর বাবা খুবই চিন্তিত ছিলেন বলে আমার ধারণা।

ছেলেরা অমনি হয়ে থাকে। সেটা এমন কিছু ব্যাপার নয়। আচ্ছা আপনার কি মনে হয় ছেলেটি ওর মার প্রতি অনুগত ছিলো?

ওর মা ছেলের ব্যাপারে বড়ো বেশি হইচই করতেন। এর জন্য বোধহয় ছেলেটিকে খুব বিরক্ত বলে মনে হত। আর কোনো ছেলেই চায় না তার মা তার ব্যাপারে ব্যস্ততা দেখাক। ছেলেটির চুলের স্টাইল তার বাবা পছন্দ করতেন না। আজকালকার ছেলেদের ফ্যাসন সম্পর্কে বাবা-মার আপত্তি করাটা ঠিক নয়। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমি কি বতে চাইছি।

কিন্তু সেই ঘটনা ঘটার সময় ছেলেটি তো তার বাড়িতে ছিল না তাই তো?

না।

আমার ধারণা হয়তো সে খুব আঘাত পেয়েছিল।

হ্যাঁ আঘাত পেতেই পারে। অবশ্য সে সময় আমি তার বাড়িতে যেতাম না, ফলে আমি বেশি কিছু জানি না। তবে আপনি যদি আমাকে প্রশ্ন করেন বাগানের সেই মালিটা যাকে আমি পছন্দ করতাম না, তার নাম ছিল ফ্রেড উইজেল, আমার মনে হয় সে এমন একটা অন্যায় কাজ করেছিল যার ফলে জেনারেল তাকে পদচ্যুত করতে চেয়েছিলেন এবং সেই কারণেই মনে হয়–

সে কি স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই গুলিবিদ্ধ করেছিল?

আমার মনে হয়েছিল তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল জেনারেলকে গুলি করে মারা। কিন্তু জেনারেলকে হত্যা করার পর যদি সে তার স্ত্রীকে ঘটনাস্থলে আসতে দেখে সাক্ষী মুছে ফেলার উদ্দেশ্যে তাকেও সে গুলি করতে বাধ্য হবে। গল্প উপন্যাসে এরকম ঘটনা অনেক ঘটে থাকে এবং আপনি হয়তো পড়েও থাকবেন।

মিসেস অলিভার চিন্তিত হয়ে বললেন, হ্যাঁ গল্প উপন্যাসে এরকম ঘটনার কথা সবাই পড়ে থাকে।

সেখানে একজন শিক্ষক ছিলেন আপনি হয়তো জানেন না। আমি তাকেও ঠিক পছন্দ করতাম না।

শিক্ষক! সে আবার কী রকম?

আগে ছেলেটি যখন গ্রেপ স্কুলে পড়ত সে পরীক্ষায় কিছুতেই পাশ করতে পারত না। তাই ওঁরা ছেলের জন্য একজন শিক্ষক রেখেছিলেন। লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট তাকে খুব পছন্দ করতেন। আপনি জানেন নিশ্চয়ই লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট গান জানতেন এবং সেই শিক্ষকটিও গান জানতেন। যুবকটির খুব অভিমান ছিল। আমার মনে হচ্ছে তার নাম ছিল মিঃ এডমন্ড। যতদূর মনে হয় জেনারেল তাকে খুব বেশি পাত্তা দিতেন না।

জেনারেল না দিলেও লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট তো দিতেন।

নিশ্চয়ই তা তিনি করবেন। আমার ধারণা ওঁদের দুজনের মধ্যে খুব মিল ছিল। এবং জেনারেলের থেকেও তিনি তাকে বেশি ভালোবাসতেন। কারণ যুবকটির আদব কায়দা ছিল চমৎকার। সুন্দর কথা বলতে পারত। এবং যা করার সবই যে–সেই করত, হা কী যেন তার নাম ছিল? এডওয়াড? আমার মনে হয় নায়কোচিত ধ্যান ধারণা ওঁদের সম্পর্কে কোনো স্ক্যান্ডাল বা খোশগল্প কিছু শুনে থাকলে একদম বিশ্বাস করবেন না। লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট-এর সঙ্গে কোনো পুরুষের বা জেনারেলের সঙ্গে ফাইলিং ক্লার্কের মধ্যে সেরকম কিছু কানে এলে একদম আমল দেবেন না। সেই ভয়ঙ্কর বদমাশ খুনি আর যেই হোক না কেন সে অবশ্যই বাইরের কেউ। পুলিশ কিন্তু কারোরই সন্ধান পায়নি যার ভিত্তিতে আটক করা যেতে পারে। সেখানে শুধু একটা গাড়ি পাওয়া গিয়েছিল তবে সেটা কোনো কাজে লাগেনি। আমার মনে হয় মালয় অথবা বিদেশের কোথাও কিংবা ইংল্যান্ডের রোম সাউথে যদি একটু খোঁজ নেওয়া যায় একটু ক্ল অন্তত খুঁজে পাওয়া গেলেও যেতে পারে। সেখানে গেলে সে খুনির সন্ধান পাওয়া যাবে না এমন কথা কেউ জোর দিয়ে বলতে পারবে না।

মিসেস অলিভার প্রশ্ন করলেন, এ ব্যাপারে কি মত আপনার? কিন্তু আপনি ওঁদের সম্বন্ধে যতটা জানেন ঠিক ততটা ওঁর জানা নেই। অবশ্য তিনি নিশ্চয়ই কিছু শুনে থাকলে থাকতে পারেন। হা নানান লোকের ধারণার কথা উনি শুনেছিলেন। যেমন লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট নাকি মাত্রাতিরিক্ত মদ খেতেন এবং মাতাল হয়ে পড়তেন। মদের খালি পেটি পাওয়া যায় নাকি তাদের বাড়ি থেকে। আমি ওঁকে খুব ভালো করেই জানতাম। সুতরাং আমার দৃঢ় বিশ্বাস এসব একেবারেই অসত্য। ওদের এক ভাইপো ওদের সঙ্গে দেখা করতে আসত মাঝে মাঝে। সে নাকি কোনো এক মামলায় পুলিশি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছিল।

পুলিশের ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছিল ঠিকই কিন্তু আমার মনে হয় না এর সাথে সেই ঘটনার কোনো সম্পর্ক আছে। কারণ পুলিশই তাকে কোনোরকম সন্দেহ করেনি।

জেনারেল ও লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট ছাড়া আর কেউ কি ওদের বাড়িতে থাকত?

হ্যাঁ কখনও কখনও লেডি র‍্যাভেন্সক্রফটের এক বোন তাঁদের বাড়িতে এসে থাকত। সে এঁদের মধ্যে একটা গণ্ডগোলের সৃষ্টি করেছিল আর ও আসলেই আমার আতঙ্কের সৃষ্টি হত কারণ কী জানি আবার কী ঝামেলা বাঁধাবে।

লেডি র‍্যাভেন্সফুটের সে প্রিয় ছিল?

আমার ধারণা না। মেয়েটি তাদের বাড়িতে আসার চেষ্টা করত। কিন্তু লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট চাইতেন না যে, তার বোন এসে তাদের মধ্যে গণ্ডগোলের সৃষ্টি করুক। আবার জেনারেল কিন্তু তাকে খুব পছন্দ করত কারণ সে তাস দাবা খুব ভালো খেলতে পারত। ও খুব আমুদে মেয়ে ছিল। তার নাম ছিল মিসেস জেরিবয় বা ওই ধরনের কিছু। আমার অনুমান সে ছিল বিধবা এবং আমার আরও মনে হয় হয়তো মেয়েটি তাদের কাছ থেকে টাকা ধার করতে আসত।

আপনি কি তাকে পছন্দ করতেন?

আপনি যদি কিছু মনে না করেন আমি বলব তাকে আমি মোটেই পছন্দ করতাম না। কারণ কী জানেন, সব গণ্ডগোলের মূলে ছিল সে, তবে সেই ঘটনা ঘটার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই সে আসছিল না। তার একটা ছেলে ছিল, এক কী দু-বার তার ছেলে এসেছিল, সে তার ছেলেকে খুব একটা পছন্দ করত না। আমার মনে হয় এটাও তার একটা চালাকি।

মিসেস অলিভার বললেন, আমার মনে হয় কখনই কেউ এর সত্য উদঘাটন করতে পারবে না। এখনও নয় এবং পরেও নয়। কারণ আমি আমার ধর্মকন্যাকে সেদিন দেখলাম।

আচ্ছা ম্যাডাম, আমি জিজ্ঞেস করছি আপনি কি তাকে সম্প্রতি দেখেছেন? তার সম্পর্কে আমার জানার খুব কৌতূহল। সে এখন কেমন আছে? নিশ্চয়ই ভালো?

হ্যাঁ, তাকে দেখে আমার মনে হয়েছে সে খুবই ভালো আছে। সে তার বিয়ের জন্য চিন্তা করছে, যেভাবেই হোক সে পেয়েছে–

মিসেস বাকল জিজ্ঞেস করলেন, কি পেয়েছে বয়ফ্রেণ্ড পেয়েছে? আমরা তো সবাই সেটা পেয়েছি। তার মানে নিশ্চয়ই এই নয় যে আমাদের সবাইকে প্রথম প্রেম মেনে নিয়ে বিয়েটা ঠিক করতে হবে। আপনি যদি আপনার ইচ্ছাটাকে কাজে না লাগান দশবারের মধ্যে ন-বার–

মিসেস বারটন কক্সকে কি আপনি জানেন? প্রশ্ন করলেন মিসেস অলিভার।

বারটন কক্স। মনে হচ্ছে আমি নামটা যেন কোথাও শুনেছি। তাদের সঙ্গে অথবা অন্য কারোর সঙ্গে তিনি কি থাকতে এসেছিলেন? তার মানে নিশ্চয়ই এই নয় যে তাদের আমি মনে রেখেছি। তবে হ্যাঁ আমি কিছু কিছু শুনেছিলাম। আমার ধারণা জেনারেল র‍্যাভেন্সক্রফটের পরিচিত কোনো গৃহকর্ত্রী। তবুও আমি আরও কিছু খবর আশা করছি।

আচ্ছা আপনার সাথে আর আমি গল্প করব না। আপনাকে এবং মারলিনকে দেখে খুব আনন্দ হল বললেন মিসেস অলিভার।

.

 হাতি গবেষণার ফলাফল

এরকুল পোয়ারোর পুরুষ পরিচারক জর্জ বলল-মিসেস অলিভারের কাছ থেকে আপনার একটা ফোন এসেছিল।

হ্যাঁ জর্জ, তিনি কী বললেন?

তিনি জিজ্ঞেস করছিলেন, আজ রাতে ডিনারের পর আপনার সাথে দেখা করতে আসবেন কিনা?

পোয়ারো বললেন, চমৎকার, খুব ভালো হয় কারণ আজকের দিনটা বড়ো ক্লান্তিকর। তাকে দেখলেই আমার একটা উত্তেজক অভিজ্ঞতা হয়। তিনি এমন সব কথা বলেন যা সত্যিই অভাবনীয়। আচ্ছা হাতির কথা তিনি উল্লেখ করেছিলেন?

এ্যাঁ, কি বললেন স্যার, হাতি? না তিনি কিছুই বলেননি। আমার মনে হচ্ছে হাতিরা তাকে নিরাশ করেছে। এক এক সময় পোয়ারোর কথা সে ঠিক বুঝতে পারে না তাই সে সন্দেহের চোখে তার প্রভুর দিকে তাকাল। পোয়ারো বললেন, ওঁকে ফোন করো এবং বলল ওঁনাকে আমি অভ্যর্থনা জানাচ্ছি।

তার কথামতো জর্জ ফোন করতে গেল এবং অল্পক্ষণ পরেই এসে জানাল পৌনে নটার সময় মিসেস অলিভার এখানে আসবেন।

পোয়ারো বললেন, কফির ব্যবস্থা করে রাখো।

না, আমার মনে হয় তার দরকার হবে না। আমার নির্দিষ্ট ব্ৰাণ্ডই যথেষ্ট।

আচ্ছা স্যার, বলে চলে গেল।

ঠিক নটার সময় মিসেস অলিভার তাঁর বাড়িতে এলেন এবং পোয়ারো তাকে অভ্যর্থনা জানাতে গিয়ে আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন।

ম্যাডাম, কেমন আছেন?

আমি একেবারেই নিঃশেষ হয়ে গেছি–মিসেস অলিভার বললেন।

চেয়ারে তার ক্লান্ত দেহটা নিয়ে বসে পড়লেন।

সম্পূর্ণভাবে নিঃশেষিত, আপনার কথাটার অর্থ আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না ম্যাডাম।

আমি সেটা মনে করতে পারি কারণ ছেলেবেলায় আমি সেটা শিখেছিলাম। মিসেস অলিভার বললেন।

আমি নিশ্চিত। কিন্তু আপনি যার সন্ধান করছেন তার ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য নয়। আমি হাতির সন্ধানের কথা বলছি। সেটা যদি না কথার কথা হয়ে থাকে।

মিসেস অলিভার বললেন, আদৌ তা নয়। আমি পাগলের মতো হাতির সন্ধান করে চলেছি। যেমন যত পরিমাণ পেট্রল ব্যবহার করেছি বা যে পরিমাণ ট্রেন ভাড়া খরচ করেছি অথবা যত চিঠি এবং তার বার্তা পাঠিয়েছি আপনি কল্পনাই করতে পারবেন না। আর এসব করতে গিয়ে আমি একেবারে নিঃশেষ হয়ে পড়েছি।

তাহলে বরং আপনি একটু কফি খেয়ে বিশ্রাম নিন।

হ্যাঁ সুন্দর করে কড়া কফি আমি ভাবছিলাম।

আপনি কি কোনো ফল পেলেন?

মিসেস অলিভার বললেন, ফলাফল প্রচুর। কিন্তু কি জানেন, কোনটা কার্যকর হবে কিছুই জানি না।

ঘটনাটা তো আপনি জেনেছেন?

না, লোকেরা যা বলছে আমি সেইটুকুই ঘটনা বলে জেনেছি। কিন্তু আমার মনে সন্দেহ জাগছে এতগুলো ঘটনার মধ্যে একটাও সত্য ঘটনা আছে কিনা!

তার মানে আপনি বলতে চাইছেন সেগুলি সবই লোকের মুখের কথা?

না, আমি যা বলেছি তা সবই স্মৃতি। এই স্মৃতিগুলো অনেক লোকের মনের মধ্যে গেঁথে গেছে। কিন্তু যেই সেগুলো মনে করার চেষ্টা করবেন কিছুতেই আপনি ঠিক ঠিক মনে করতে পারবেন না। কি পারবেন আপনি?

না। আপনি যেগুলো ফলাফল, হিসাবে বর্ণনা করবেন তাই নয় কি?

মিসেস অলিভার প্রশ্ন করলেন আপনি কি করলেন?

পোয়ারো বললেন, আপনি এত কঠোর যে ম্যাডাম আপনার দাবি অনুযায়ী আমি সবসময় কাজ করে যাচ্ছি।

বেশ, তাহলে বলুন আপনিও কাজের পিছনে ছুটছেন।

আমি নিজে ছুটছি না, আমার নিজস্ব পেশার কয়েকজনের সঙ্গে পরামর্শ করেছি।

আপনার কাজ শুনে মনে হচ্ছে আমার থেকে অনেক বেশি শান্তিপূর্ণ। বাঃ, আপনার কফি সত্যিই খুব কড়া হয়েছে। আমি যে কি পরিমাণ ক্লান্ত আপনি বিশ্বাস করতে পারবেন না।

আপনাকে দেখে আমার অনুমান আপনি কিছু একটা পেয়েছেন।

আমি প্রচুর লোকের কাহিনি এবং লোকের পরামর্শ পেয়েছি। বুঝতে পারছি না সেগুলোর মধ্যে একটাও সত্যি কাহিনি আছে কিনা।

পোয়ারো বললেন, হয়তো সেগুলোর মধ্যে কোনো সত্য ঘটনা নেই তবু সেগুলো কোনো না কোনো সময় কাজে লাগতে পারে।

মিসেস অলিভার বললেন, আপনি কী বলতে চাইছেন তা আমি জানি আর সত্যি কথা বলতে আমিও সেটা মনে করি। লোকেরা যখন কিছু মনে করার চেষ্টা করে এবং সে ব্যাপারে আপনাকে কিছু বলে আমার মনে হয় সেগুলো কখনও ঘটেনি। তারা নিজেরা যা ভেবে রেখেছে সেটাই ঘটেছে।

পোয়ারো বললেন, কোনো তথ্য ছাড়া কোনো অনুমান গড়ে ওঠে না।

মিসেস অলিভার বললেন, এই ধরনের তালিকা আপনার জন্য আমি এনেছি। আর শুনুন আমি কোথায় গিয়েছিলাম, এবং কী জিজ্ঞেস করেছিলাম কিনা এসব প্রশ্নের ব্যাখ্যা চাইবেন না। আমার এই অভিযানের উপলব্ধি হল সাধারণত এদেশে কেউ চাইলেও তার মনের মতো খবর সংগ্রহ করতে পারে না; কিন্তু আমি সব জেনেছি। এমন কিছু লোকের কাছ থেকে যারা নাকি র‍্যাভেন্সক্রফটদের সম্পর্কে কিছু না কিছু খবরা-খবর রাখে।

আপনি কি বোঝাতে চাইছেন বিদেশের খবরের কথা?

হ্যাঁ বেশ কিছু খবর আছে বিদেশের। কারণ এখানে তাদের সামান্য তোক চিনত। আর এমন সব লোকের মুখের খবর যারা তাদের মাসিমা, কাকিমা অথবা বন্ধুদের কাছ থেকে শুনেছিল অনেকদিন আগে।

আপনার প্রত্যেকটি লিপিবদ্ধ করা তথ্য, সেই ঘটনার উল্লেখ এবং কিছু ব্যক্তির নাম সংগ্রহ সবই তো এই কেসের সঙ্গে জড়িত তাই না?

মিসেস অলিভার বললেন, এই রকমই একটা ধারণা, তা আপনাকে সংক্ষেপে বলব।

তাহলে শুনুন যে মতামতগুলো আমি সংগ্রহ করেছি। তাদের শুরু হল যেমন কিরকম দুঃখের খবর এটা, পুরো কাহিনিটাই, বা অবশ্যই আমার মনে হয়, প্রত্যেকেই জানেন, প্রকৃত ঘটনা কি ঘটেছিল কিংবা ওহো হ্যাঁ অবশ্যই প্রভৃতি সব কথাবার্তা। হা হা আপনি বলে যান আর আমি সব শুনছি, এইসব লোকেরা জানে সেদিন কী ঘটনা ঘটেছিল কিন্তু আশ্চর্য লাগে তাদের ধারণার সমর্থনে তেমন কোনো অকাট্য যুক্তি নেই। যেমন কেউ তাদের বলেছে অথবা তারা তাদের বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে শুনেছে। তাদের মতামতগুলো আপনিও যা ভেবেছেন সেইরকম কিছু মনে করা যাক। জেনারেল তার মালয়ের স্মৃতিকথা যখন লিখেছিলেন তাকে লেখার কাজে সাহায্য করেছিলেন তার একজন যুবতী সেক্রেটারি। মেয়েটি দেখতে সুন্দর ছিল এবং তাদের দুজনের মধ্যে কিছু যে একটা সম্পর্ক ছিল তাতে কোনো দ্বিমত নেই। এই সম্পর্কের পরিণাম দু-রকমের হতে পারে। যেমন মেয়েটিকে তিনি বিয়ে করার আশা করেছিলেন তাই তিনি তার স্ত্রীকে গুলি করে থাকতে পারেন অথবা তার স্ত্রীকে গুলি করার পর মুহূর্তে ভীষণ আতঙ্কের সৃষ্টি হয় যার ফলে তিনি নিজেই নিজেকে গুলি করেন….

পোয়ারো বললেন, ঠিক তাই। এটা একটা রোমান্টিক ব্যাখ্যা। আরেকটা ধারণা হল তাদের ছেলেটি অসুস্থ হয়ে পড়ায় ছ-মাস স্কুলে ক্লাস করতে পারেনি। পরীক্ষায় তাকে তৈরি করানোর জন্য একজন শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছিল। সে ছিল বয়সে তরুণ এবং সুপুরুষ। আচ্ছা দেখছি তাহলে সবই মিলে গেল। সেই যুবকটির প্রেমে পড়ে যান লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট। হয়তো তার সঙ্গে নিবিড়ো একটা সম্পর্ক গড়ে উঠে থাকবে।

মিসেস অলিভার বললেন, হ্যাঁ সেই রকমই একটা ধারণা হয়েছিল, এক্ষেত্রেও কোনো প্রমাণ নেই। আবার সেই রোমান্টিক ধারণা।

সুতরাং তাহলে?

সুতরাং আমার ধারণা সম্ভবত তার স্ত্রীকে জেনারেল আগে গুলি করেছিলেন এবং তারপর তীব্র আতঙ্কে নিজেই নিজেকে গুলি করেছিলেন। অথবা তাঁর স্ত্রী সেই মেয়েটির সঙ্গে তার স্বামীর গোপন সম্পর্কের কথা জেনে থাকবেন, সেই ঘৃণায় তিনি তাঁর স্বামীকে গুলি করে নিজেই নিজেকে গুলিবিদ্ধ করেন। কিংবা সব সময় এরকম একটা কাহিনি প্রচার হয়ে থাকে যেমন মেয়েটির সঙ্গে জেনারেলের কোনো একটা সম্পর্ক গড়ে উঠে থাকবে অথবা অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গে জেনারেলের কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠে থাকবে বা কোনো এক বিবাহিতা মহিলার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠে থাকবে। অপর দিকে এও হতে পারে অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে তার স্ত্রীর কোনো অবৈধ সম্পর্ক থাকতে পারে। এই সমস্ত কাহিনি সামান্য তফাত থাকলেও মূল বিষয়বস্তু প্রায় এক। এইসব কাহিনির সাক্ষ্য প্রমাণ কিছুই নেই। বারো বা তেরো বছর আগে যে কাহিনির সূচনা তা এখন লোকেরা প্রায় ভুলেই গেছে বলতে পারা যায়। কিন্তু আশ্চর্য লাগে কাউকে কয়েকটা নাম সম্বন্ধে প্রশ্ন করলে লোকের মুখে শোনা খবরই দেয় অথচ প্রকৃত তথ্য তারা জানে না। আর সে কাহিনি যে ভুল হতেই পারে তা তাদের জানা নেই। বাগানের পরিচর্যার জন্য একজন মালি ছিল। একজন বয়স্ক কুক-হাউসকিপার ছিল। যে নাকি অন্ধ ও বোবা ছিল। অথচ সেই ঘটনার সঙ্গে মেয়েটি যে জড়িয়ে থাকতে পারে এদের দুজনের মধ্যে কোনো সন্দেহ জেগে ওঠেনি। আমি নামগুলো লিপিবদ্ধ করে রেখেছি। সেখানে কতকগুলো নাম ভুল আবার কতকগুলো নাম ঠিকও হতে পারে। এবং সেটা নির্ধারণ করা খুব কঠিন ব্যাপার। আমি আরও জেনেছি, একসময় তার স্ত্রী এমন কঠিন ধরনের অসুখে পড়েন যাতে তার চুল সব উঠে গিয়েছিল এবং সেই কারণেই তিনি চার চারটে পরচুল কিনেছিলেন।

পোয়ারো বললেন, ঠিক বলেছেন আমিও সেই একই রকম শুনেছিলাম।

এখবর আপনি কোথা থেকে শুনলেন?

আমার এক বন্ধু পুলিশে কাজ করে। সেই ঘটনার সময় পুলিশি তদন্ত হয়। এবং তদন্ত করতে গিয়ে ওদের বাড়ি থেকে যে সব জিনিস পাওয়া যায় তার একটা তালিকা পুলিশ সংগ্রহ করেছিল। আমার সেই পুলিশ বন্ধুটি আমাকে সেই তালিকা দেখায় এবং তাতে দেখি চারটে পরচুলের কথা লেখা আছে। আচ্ছা ম্যাডাম, আমি আপনার মত এই ব্যাপারে জানতে চাই।

সত্যিই আমি এটা বেশি বলে মনে করি, মিসেস অলিভার বললেন। তিনি আরও বললেন, আমার এক কাকির একটা পরচুল ছিল, আর একটা বাড়তি পরচুল ছিল। একটা পরচুল ফেরত পাঠান আমার কাকি নতুন করে সংস্কার করার জন্য। এবং দ্বিতীয়টি তিনি ব্যবহার করতে থাকেন। চারটে পরচুল কারোর থাকতে পারে আমি কখনও আগে শুনিনি। মিসেস অলিভার তার ব্যাগ থেকে একটা ছোটো নোটবুক বার করলেন এবং তার পাতা ওলটালেন বিশেষ প্রতিলিপি খোঁজ করার জন্য।

মিসেস কারস্টেয়ার্স, বয়স সাতাত্তর, একটু ভীমরতিগ্রস্ত। তার মুখের কথাই এখানে লিখে রেখেছি। র‍্যাভেন্সক্রফটদের আমি ভালো করেই জানতাম। তারা চমৎকার দম্পতি। আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম ওঁদের দুজনের মধ্যে কার ক্যান্সার হয়েছিল? কিন্তু মিসেস কারস্টেয়ার্স ঠিক মনে করতে পারলেন না কার যে ক্যান্সার হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন যে, তার ধারণা লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট লন্ডনে এসেছিলেন চিকিৎসকদের কাছ থেকে পরামর্শ করার জন্য এবং সম্ভবত একটা অপারেশনও করে থাকবেন তিনি। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে এলে তার স্বামী খুব মুষড়ে পড়েন। অতএব এর থেকে মনে করে নেওয়া যেতে পারে তিনি প্রথমে তার স্ত্রীকে গুলি করেন। পরে নিজেকে…।

এ-ব্যাপারে তিনি কি নির্দিষ্ট করে কিছু জানতেন, না সম্পূর্ণ তার ধারণা?

আমার মনে হয় পুরোপুরি এটা একটা ধারণা। মিসেস অলিভার বললেন, আমার তদন্তের সময় যা শেষ শুনেছি তা হল, যখন কেউ শোনে তার কোনো এক বন্ধু যাকে সে ভালো চেনে না, অসুস্থ হওয়ায় চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করছে, তখন সে ধরে নেয় তার সেই বন্ধুরই ক্যান্সার হয়েছে। কেউ একজন নামটা ঠিক পড়তে পারছি না, তার মনে হয় নামটা টি দিয়ে শুরু, সেই মহিলাটি বলেছিল স্বামীরই ক্যান্সার হয়েছে। ভদ্রলোক সেইজন্য খুব অসুখী ছিলেন। এই অসুখের কথা চিন্তা করেই হয়তো তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ঠিক করেন আত্মহত্যা করবেন।

পোয়ারো বললেন, দেখুন ব্যাপারটা খুব দুঃখজনক আবার রোমান্টিক।

আমি এটা সত্য বলে মনে করি না। মিসেস অলিভার বললেন। আর এটা চিন্তার ব্যাপার তাই না? সত্যিই লোকেরা কেমন মনগড়া গল্প করতে পারে।

পোয়ারো বললেন, তারা যতটুকু কাহিনি জানে ততটুকু সমাধান করে ফেলে। যেমন কতগুলো লোক জানে কেউ একজন আসছে লন্ডনে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করার জন্য। আবার কেউ দু-তিন মাস হয়তো হাসপাতালে রয়েছে।

মিসেস অলিভার বললেন, দীর্ঘদিন বাদে তারা যখন এ ব্যাপারে কথা বলে, এমন ভাব দেখায় যেন তারা সমাধান খুঁজে পেয়ে গেছে। অথচ সেটা তাদের মনগড়া। সেটা কোনো সাহায্যেই লাগতে পারে না। এটা কোনো কাজের কথাও নয়, তাই নয় কি?

আপনি যা বলেছিলেন সেটা যেমন ঠিক আবার এটা কাজেরও হতে পারে, বললেন পোয়ারো।

একটু সন্দেহের সঙ্গে মিসেস অলিভার বললেন, হাতির ব্যাপারে?

পোয়ারো বললেন, কয়েকটা ঘটনার কথা জানা খুব জরুরি যা মানুষের স্মৃতিপটে দীর্ঘস্থায়ী হয়ে আছে। প্রকৃত ঘটনা কী, বা কেন সেটা ঘটেছিল অথবা তার পরিণতিই বা কি হতে পারে তারা সহজেই যা জানতে পারে আমরা তা জানি না। বিশ্বাসঘাতকতা, অসুস্থতা বা আত্মহত্যার চুক্তি সবই তাদের ধারণার কথা এবং মতামতের কথা আপনাকে জানিয়েছি।

মিসেস অলিভার বললেন, মানুষ অতীতের কথা বলতে ভালোবাসে। প্রথমে তারা অন্য সব লোকেদের কথা যা তাদের স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে তাদের কথা বলেন যা আপনি শুনতে চান না। তারপর তারা এমন লোকেদের প্রসঙ্গ টানত যা নিজেরাই জানে না। অন্য কারোর কাছ থেকে শুনে থাকবে। জানেন প্রথম ভাইপো একবার অপসারিত হলে দ্বিতীয় ভাইপো কিন্তু দু-বার অপসারিত হবে। আর তারপর বাকিরাও ওই একইভাবে অপসারিত হবে। তাই আমার মনে হয় এত সব তথ্য জোগাড় করার পরও সত্যিকারের কোনো কাজের কাজ হয়নি।

পোয়ারো বললেন, সেরকম ভাবার কোনো কারণ আপনার নেই। আমি একদম নিশ্চিত যে, আপনার ওই ছোট্ট নোটবুকে যে সব ঘটনার কথা লেখা আছে তা থেকে একদিন নিশ্চয়ই অতীতের সেই ভয়ঙ্কর ঘটনার কিছু হদিশ আপনি পাবেনই। সরকারি নথিপত্র ঘেঁটে অর্থাৎ পুলিশি ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে সেই মৃত্যু আজও রহস্য রয়ে গেছে। তারা ছিলেন সুখী দম্পতি। তাদের কোনো যৌন অসুবিধা ছিল না। এবং এমন কোনো অসুখ ছিল না তাদের, যা থেকে তারা তাদের আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারে। সুতরাং সেই ঘটনা ঘটার আগের সময় নিয়ে আলোচনা করতে চাই। কিন্তু তারও আগের সময়ের কথা ভাবতে হবে।

মিসেস অলিভার বললেন, আপনি কী বলতে চাইছেন আমি তা জানি। আর এ-ব্যাপারে আমি বৃদ্ধা আয়ার কাছ থেকে কিছু তথ্যও পেয়েছি। আমার ধারণা সেই বৃদ্ধার বয়স হবে আশি। আমি তাকে ছেলেবেলা থেকে চিনি। এবং তিনি আমাকে বিদেশে সৈনিকদের গল্প শোনাতেন।

আকর্ষণীয় কোনো কিছু পেয়েছিলেন?

মিসেস অলিভার হ্যাঁ বললেন। সেখানে যে একটা ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছিল তার কথা বললেন। কিন্তু কথা শুনে মনে হল তিনি সেই ব্যাপারে অনিশ্চিত। কারণ তাদের পদবী তিনি মনে করতে পারছিলেন না। একজন মানসিক রোগিনীর কথা বললেন। সে হয় জেনারেলের বোন নয় লেডি র‍্যাভেন্সক্রফটের বোন হবে। সে কয়েকবছর মানসিক হাসপাতালে ছিল। এবং সে নাকি তার নিজের শিশুদের হত্যা করেছিল অথবা হত্যা করার চেষ্টা করেছিল। তারপর সে সুস্থ হয়ে ইজিপ্ট কিংবা মালয়ে অথবা অন্য কোনো দেশে চলে যায়। আমার এখন আশঙ্কা হল যে, তাদের পরিবারে সত্যিই কোনো মানসিক রোগী ছিল কিনা। আমার মনে হয় তদন্তের ব্যাপারে এটা একটা সূত্র হতে পারে।

পোয়ারো বললেন, সব সময়েতেই একটা না একটা সম্ভাবনা থেকেই থাকে। তারপর দীর্ঘ কয়েক বছর পর সেটা রোমাঞ্চকর খবর হয়ে যায়। সেই কারণেই কে যেন আমাকে বলেছিল, পুরোনো পাপের দীর্ঘ ছায়া।

আমারও ঠিক সেইরকম মনে হয় বললেন, মিসেস অলিভার। বৃদ্ধা আয়া যে সব লোকের কথা তিনি মনে করেছিলেন তারা সত্যিই র‍্যাভেন্সক্রফটরা কিনা। কিন্তু সাহিত্যের ভোজসভায় সেই ভয়ঙ্কর মহিলাটি যা বলেছিলেন এইসব ঘটনার সঙ্গে তার কিছু মিল থাকতে পারে।

তিনি কী জানতে চেয়েছিলেন?

তিনি জানতে চেয়েছিলেন আমি যেন আমার ধর্মর্কন্যার কাছ থেকে খোঁজ নিই তার মা তার বাবাকে খুন করেছিল না তার বাবা তার মাকে খুন করেছিল।

তিনি কি ভেবেছিলেন যে, মেয়েটি সে খবর জানে?

হ্যাঁ, মেয়ের জানার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে। প্রকৃত সত্য তার কাছে গোপন রাখা হয়েছিল। কিংবা তার কাছে সেটা অপ্রকাশিত থেকে গিয়েছিল। তারপর মেয়েটি অনেক চেষ্টা করেছিল জানতে কোন পরিস্থিতিতে দুটো জীবন শেষ হয়ে গেল আর কে কাকেই বা খুন করেছিল। যদিও সে সেটা কখনও প্রকাশ করবে না বা কাউকে কিছু বলবে না এ-ব্যাপারে। অথবা এ ব্যাপার নিয়ে কারোর সঙ্গে কোনোরকম আলোচনাও করবে না।

আপনি সেই যে মহিলার কথা বলেন এই সেই মিসেস

এখন তার নামটা ভুলে গেছি, হা মিসেস বারটন এরকম কোনো একটা নাম হবে। তার ছেলে একটি মেয়েকে ভালোবাসে এবং তারা এখন বিয়ে করবে বলে ভাবছে। তাই যদি হয় এখন আপনি নিশ্চয়ই জানতে চাইবেন মেয়েটির মা কিংবা বাবার পরিবারে কোনো অপরাধী আত্মীয় ছিল কিনা। কারণ মিসেস বারটন নিশ্চয়ই চিন্তা করে থাকবেন যদি মেয়েটির মা তার বাবাকে খুন করে থাকে তাহলে মেয়েটিকে বিয়ে করা অবিবেচকের কাজ হবে। মিসেস অলিভার বললেন, কিছু মনে করবেন না আর বাবা যদি তার মাকে খুন করে থাকে?

আপনি বলতে চাইছেন তিনি ভেবেছিলেন-তার উত্তরাধিকারের ভাগীদার হবে একজন নারী? মিসেস অলিভার বললেন, ও ভালো কথা তিনি খুব একটা বুদ্ধিমতী নারী ছিলেন না। তিনি মনে করতেন যে তিনি অনেক কিছুই জানেন, আদৌ তিনি কিছুই জানেন না। আমার অনুমান আপনিও যদি নারী হতেন তাহলে ঠিক এইভাবেই আপনিও ভাবতেন।

এটা একটা উল্লেখযোগ্য দিক বটে। পোয়ারো বললেন, আমি সেটা উপলব্ধি করতে পারি।

আরও একটা দিকের কথা আমি চিন্তা করেছি। এই দম্পতি একটা শিশুকে দত্তক নিয়েছিল। আমার মনে হয় তখন তাদের একটি শিশু মারা যায় এবং সেই কারণেই সেই দত্তক শিশুটিকে তারা সম্পূর্ণভাবে আঁকড়ে ধরেন। তারপর একদিন তার নিজের মা তাকে ফেরত চায়। সেই ঝামেলা আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল এবং আদালত শিশুটির ভার তাদের ওপর দিয়েছিল। আর তখনই নিজের মা ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে অপহরণ করার চেষ্টা করেছিল, পোয়ারো বললেন, এটাই আমি গ্রহণযোগ্য বলে মনে করি।

যেমন?

চার-চারটে পরচুল।

মিসেস অলিভার বললেন, আমি ভাবলাম এটা আপনাকে আগ্রহ জাগাবে। আমার মনে হয় না এর কোনো মানে আছে। আর অপর কাহিনি হল একজন মানসিক রোগী সে তার শিশুদের অথবা অকারণে অন্য শিশুকে হত্যা করেছিল। সেই হত্যার পিছনে কোনো যুক্তি আছে আমি ভাবতে পারছি না। আর এও বুঝতে পারছি না কেনই বা জেনারেল এবং লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট নিজেদের হত্যা করতে গেলেন?

পোয়ারো বললেন, যদি ওদের মধ্যে কেউ একজন জড়িত থাকে?

তার মানে আপনি কি বলতে চান জেনারেল র‍্যাভেন্সক্রফট কাউকে হত্যা করেছিলেন, মানে একটি অবৈধ সন্তানকে যা ওঁর স্ত্রীর কিংবা নিজের ছিল? কিংবা লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট তার স্বামীর ছেলেকে বা নিজের ছেলেকে হত্যা করেছিল? কিন্তু আমার মনে হয় এটা অতি নাটকীয় হয়ে যাচ্ছে।

পোয়ারো বললেন, লোকের মনে কি ধারণা হতে পারে সাধারণতঃ তারা…।

তার মানে আপনি বলতে চাইছেন?

আমার অনুমান তারা ছিলেন স্নেহপ্রবণ দম্পতি। সুখে স্বচ্ছন্দে বাস করত এবং তাদের মধ্যে কোনো ঝগড়া বিবাদ ছিল না। কতক লোকের ধারণা অপারেশন হওয়া দূরের কথা তাঁদের মধ্যে কেউ একজন অসুস্থ ছিল এমন রেকর্ড পাওয়া যাবে না। এমনকি লন্ডনে গিয়ে ক্যান্সারের চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ারও কোনো রেকর্ড নেই। সেই সময়ে অন্য কেউ যদি সেই বাড়িতে থাকত তদন্তের সময় পুলিশ সব কথা জানত এবং আমার সেই পুলিশ বন্ধুটি নিশ্চয় আমাকে জানাত। যে কারণেই হোক তাঁরা আর বেঁচে থাকতে চাননি। কিন্তু কারণ কী?

মিসেস অলিভার বললেন, আমি একটি দম্পতিকে জানতাম যারা ধরে নিয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যদি জার্মানরা ইংলন্ডে আসে তারা তাদের হত্যা করবে। আমার মনে হয় এটা খুবই বোকামো। বাঁচতে গেলে তোমাকে যথেষ্ট সাহস সঞ্চয় করতে হবে। তোমার মৃত্যুতে কারোর হয়তো ভালো হবে বা কারোর কোনো উপকার হবে তোমাকে সেটা বুঝতে হবে। আর আমি অবাক হয়ে যাই

আচ্ছা কেন অবাক হন বলুন তো?

আমি অবাক হই এই কারণে যে, তাহলে কি লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট ও জেনারেলের মৃত্যুতে কারোর কিছু ভালো হয়েছে? তাদের মৃত্যুতে তাদের অর্থ ও সম্পত্তির কেউ উত্তরাধিকারী হয়েছে?

কেউ হয়তো তার জীবনে উন্নতি করতে চেয়েছিল। তাদের জীবনে এমন কিছু একটা ছিল যার কারণে তারা চায়নি ওঁদের ছেলেমেয়েরা কেউ সেটা জানুক? পোয়ারো একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

তিনি বললেন, আপনার কী দোষ জানেন? আপনি এমন কিছু চিন্তা করেন মনে হয় যেন সেটা এখন ঘটেছে বা ঘটতে পারে। যেমন–কেন ওঁদের দুজনের মৃত্যুর প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল? ওদের কোনো যন্ত্রণা ছিল না, বা ওঁরা অসুস্থ ছিলেন না অথবা ওঁরা অসুখীও ছিলেন না। তবে কেন একটা সুন্দর দিনে সন্ধ্যায় কুকুরকে নিয়ে পাহাড়ে বেড়োতে গিয়েছিলেন?

মিসেস অলিভার প্রশ্ন করলেন, এর সঙ্গে কুকুরের কী সম্পর্ক?

আমি একটু সময়ের জন্য অবাক হই। পর মুহূর্তে মনে প্রশ্ন আসে তবে কি ওঁরা কুকুরকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ছিলেন অথবা কুকুরটা কি ফিরে এসেছিল? মিসেস অলিভার বললেন, আমার মনে হয় এই ব্যাপারটাও পরচুলের পর্যায়ে পড়ে। কারণ আমার একটা হাতি বলেছে কুকুরটা ছিল লেডি র‍্যাভেন্সক্রফটের অনুগত আবার অপর আর একটা হাতি বলেছে, কুকুরটা নাকি ওঁনাকে কামড়ে দিয়েছিল। পোয়ারো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, সবাই সব সময় একই ব্যাপারে ফিরে আসে। সবাই মানুষ সম্পর্কে আরও আরও বেশি জানতে চায়। আর আপনিই বা কেমন করে জানবেন কারণ বহু বছরের ব্যবধানে আপনার কাছ থেকে সব মানুষ বিছিন্ন হয়ে গেছে। একবার কী দু-বার আপনিও সেটা করেছিলেন। কি করেননি? বললেন মিসেস অলিভার। একটা সমুদ্রের ধারে একজন শিল্পী গুলিবিদ্ধ হয়েছিল বা তাকে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছিল। আপনি জানেন সেটা করা হয়েছিল আত্মরক্ষার জন্য বা ওইরকম কিছুর জন্য। আর এই কাজ কে করতে পারে আপনি সেটা খুঁজে বার করেছিলেন। আপনি যদিও কোনো লোককেই জানতেন না। আমি কোনো লোককেই জানতাম না ঠিকই কিন্তু অন্য লোকেদের মারফত তাদের সম্পর্কে আমি জানতে পারি।

মিসেস অলিভার বললেন, আমি তো সেটাই চেষ্টা করছি। সত্যি বলতে কী যারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত, যারা সত্যিকারের সব ঘটনা জানে আমি তাদেরই কাছে যথেষ্ট যেতে পারছি না। আপনার কি মনে হয় এর হাল সত্যি আমি ছেড়ে দেব? পোয়ারো বললেন, সেটা যদি আপনি করতে পারেন তাহলে সেটাই হবে আপনার বুদ্ধিমানের কাজ। আসলে কী হয় জানেন, এমন একটা সময় আসে মানুষ আর জ্ঞানী হতে চায় না। যেমন আমার খুব আগ্রহ আছে সেই দম্পতিদের ব্যাপারে। আমার ধারণা তাদের দুটো সন্তান আছে এবং খুব সুন্দর।

মিসেস অলিভার বললেন, ছেলেটির সম্পর্কে আমি জানি না এবং তার সঙ্গে কখনও মিলিত হইনি। আপনি কি আমার ধর্মকন্যাকে দেখতে চান? আমি ওকে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বলতে পারি। হ্যাঁ আমার মনে হয় ওর সাথে আমার সাক্ষাৎ করা উচিত। তবে ও হয়তো আমার সাথে দেখা করতে চাইবে না। কিন্তু সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে আর সেটা হতে পারে খুব আগ্রহের। আমার আর একজনের সঙ্গেও দেখা করা দরকার।

সেই ব্যক্তিটি কে? সাহিত্যের ভোজসভার সেই ভয়ঙ্কর মহিলা যে নাকি আপনার খুব অন্তরঙ্গ বন্ধু।

মিসেস অলিভার বললেন, মোটেই তিনি আমার বন্ধু নন। আমার কাছে এসেছিলেন এবং কথা বলেন এই পর্যন্ত।

আপনি কি তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারেন না? হ্যাঁ খুব সহজেই, যদি তিনি এই কথা শোনেন সম্ভবত লাফিয়ে উঠবেন তিনি।

আমি ওঁকে অন্তত একবার দেখতে চাই, কারণ আমি তার কাছে জানতে চাইব যে, কেন তিনি সব খবর জানতে চান।

মিসেস অলিভার বললেন, হ্যাঁ আমার মনে হয় সেটা তাদের হতে পারে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, সেই বৃদ্ধা আয়ার কথা আপনাকে বলেছিলাম তিনিও কিন্তু হাতিদের কথা বলেছিলেন, এবং এও বলেছিলেন যে, হাতিরা কখনও ভোলে না। সেই বিশ্রী কথাটা আমাকে তাড়া করে বেড়োয়। তাই হাতিদের কাছ থেকে বিশ্রাম পেলে খুশি হব। ওহো আপনাকে একটা কথা বলা হয়নি। আপনাকে অতি অবশ্যই আরও হাতির খোঁজ করতে হবে। এবার আপনার পালা।

তাহলে আপনি এখন কি করবেন?

খুব সম্ভব আমি হংসের সন্ধান করব।

সেই হংসটিকে কোথায় পাওয়া যেতে পারে বলে মনে করেন?

সেটা একমাত্র আমিই মনে করতে পারি কারণ যার কথা আয়া আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছেন বেশ কয়েকটি ছোটো ছোটো ছেলেদের সঙ্গে আমি খেলা করতাম এবং তাদেরই মধ্যে একজন আমাকে লেডি হস্তিনী বলত আর অপরজন সম্বোধন করত লেডি হংসী বলে। আমি যখন লেডি হংসী হতাম তখন মেঝের ওপর সাঁতার কাটার ভান করতাম এবং যখন আমি লেডি হস্তিনী তখন ওরা আমার পিঠে চড়ে বসত।

পোয়ারো বললেন, সেটা খুব ভালো জিনিস। হাতিরাই যথেষ্ট।

.

ডেসমন্ড

দু-দিন বাদে এরকুল চকোলেট পান করছিলেন এবং অনেকগুলো চিঠির মধ্যে একটা চিঠি নিয়ে দ্বিতীয়বার পড়তে শুরু করলেন। চিঠিতে লেখা ছিল–প্রিয় মঁসিয়ে পোয়ারো,

আমি আশঙ্কা করছি যে, এই চিঠিটা আপনার কাছে একটু অদ্ভুত ধরনের মনে হবে এবং আমার বিশ্বাস আপনার বন্ধুদের মধ্যে এমন একজন আছেন যার সাথে আমি যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু দুঃখের কথা তখন তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। তার সাথে যদি আপনার দেখা হত মনে হয় কাজ হত আপনার। তার সেক্রেটারি বললেন, তিনি পূর্ব আফ্রিকায় গেছেন। তাহলে বেশ কিছুদিন তিনি ফিরছেন না। আমার ধারণা তিনি আমাকে সাহায্য করবেন। আপনার সাথে আমার দেখা করার খুব দরকার কারণ আপনার কাছ থেকে কিছু উপদেশ নেওয়া আমার প্রয়োজন।

আমি জানতে পেরেছি মিসেস অলিভারের সঙ্গে আমার মার পরিচয় আছে। এবং একটা সাহিত্যের ভোজসভায় তিনি মায়ের সঙ্গে মিলিত হন। সুতরাং আপনি যদি সময় করে আমার সঙ্গে দেখা করেন আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব। আমি কিন্তু আপনার সুবিধামতো যে কোনো সময়ে দেখা করতে রাজি আছি। মিসেস অলিভারের সেক্রেটারি হাতির কথা বলেছিলেন। আমার মনে হয় এর সঙ্গে মিসেস অলিভারের পূর্ব আফ্রিকা যাওয়ার কোনো তাৎপর্য আছে। আমার এখন ভীষণ চিন্তা ও উদ্বেগ হচ্ছে। এই সময় যদি আপনি অনুমতি দেন আপনার সঙ্গে দেখা করার, তাহলে চিরকাল আপনাকে মনে রাখব।
আপনার বিশ্বস্ত
ডেসমন্ড বারটন কক্স

দ্বিতীয়বার চিঠিটা পড়ার পর এরকুল অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলেন, এ যেন হঠাৎই

কিছু যদি মনে করেন জর্জ, প্রশ্ন করে কী বললেন আপনি?

এরকুল পোয়ারো বললেন, মুখ ফসকে হঠাৎ বেরিয়ে গেল। এমন এক একটা ঘটনা আছে যদি একবার কোনো মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলে তার থেকে রেহাই পাওয়া খুব মুশকিল। আমার কাছে এখন সেটা হাতিদের প্রশ্ন হয়ে উঠেছে।

তিনি তার সেক্রেটারি মিস লেমনকে ডেসমন্ড কক্স-এর চিঠিটা দিলেন এবং বললেন, এই চিঠির লোকের সঙ্গে তার সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করতে।

তিনি তাকে বললেন, আমি এখন খুব ব্যস্ত নই। আগামীকাল সময় হতে পারে।

মিস লেমন তাকে মনে করিয়ে দিলেন যে এরমধ্যে দুটি সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করা আছে। তাসত্ত্বেও তিনি জানালেন আগামীকাল তার যথেষ্ট সময় আছে এবং তাঁর কথা মতন সে যেন ব্যবস্থা করে। পশুশালা বা চিড়িয়াখানার ব্যাপারে কি কিছু করতে হবে?

পোয়ারো বললেন, তার দরকার নেই। তবে হাতির ব্যাপারে সে যেন কিছু কথা না বলে। কারণ হাতিরা বিরাট জন্তু। অনেকটা জায়গা দখল করে নেয়। তার সাথে আলোচনার সময় সেই প্রসঙ্গ যে উঠবেই তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

জর্জ বলল, মিঃ ডেসমন্ড বারটন কক্স এসেছেন। পোয়ারো উঠে দাঁড়ালেন এবং কোনো কথা না বলে একটু সময় স্থির হয়ে রইলেন। তিনি হয়তো একটু নার্ভাস হলেন অথবা একটু অসুস্থতাবোধ হল। তবে বেশ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সেটা ঢাকলেন এবং হাতটা বাড়িয়ে করমর্দন করলেন।

আপনি কি মিঃ এরকুল পোয়ারো?

পোয়ারো বললেন, আপনি ঠিক বলেছেন, আর আপনার নাম তো ডেসমন্ড বারটন কক্স। আপনি এখানে কেন এসেছেন এবং আপনার জন্য আমি কী করতে পারি বলুন?

ডেসমন্ড বারটন কক্স বললেন, ব্যাখ্যা করা খুব মুশকিল, অনেক কিছুই ব্যাখ্যা করা যায় না, তবুও অনেক সময় আছে আমাদের হাতে। এখন বসুন। ডেসমন্ড সামনে বসা মানুষটির দিকে সন্দেহের চোখে তাকালো। তার চেহারা হল ডিমের মতো মাথা এবং বড় গোঁফ। তিনি যেমন মনে মনে আশা করেছিল ঠিক সেইরকম নয়।

আপনি একজন গোয়েন্দা তাই তো? মানে আমি বলতে চাইছি লোকেরা আপনার কাছে আসে তাদের কোনো ব্যাপারে তদন্তের জন্য।

পোয়ারো বললেন, আমার জীবনে এটা একটা কাজ বলে মনে করতে পারেন।

আমার মনে হয় আপনি আমার সম্বন্ধে খুব বেশি জানেন না এবং কেন এসেছি তাও নয়।

কিছু কিছু জানি সব নয়, পোয়ারো বললেন। আপনি বলতে চাইছেন মিসেস অলিভার আপনাকে কিছু বলেছেন?

তিনি আমাকে শুধু বলেছেন তার এক ধর্মকন্যার সঙ্গে দেখা হয়েছে। তার নাম মিস সিলিয়া র‍্যাভেন্সক্রফট। তাই তো?

হ্যাঁ সিলিয়া আমাকে বলেছে। আমার মনে হয় মিসেস অলিভার আমার মাকে বেশ ভালো করেই চেনেন।

না, আমার ধারণা তারা পরস্পর পরস্পরকে ভালোভাবে জানেন। মিসেস অলিভার বলেছিলেন আপনার মায়ের সঙ্গে একটা সাহিত্যের ভোজসভায় দেখা হয়েছিল। এবং তার সঙ্গে মাত্র কয়েকটা কথা হয়, আপনার মা একটা বিশেষ ব্যাপারে তাকে অনুরোধ করেছিলেন।

ছেলেটি দারুণ ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, তাঁর সেটা করার কোনো অধিকার নেই। আবার বলল মায়ের–আমি বলতে চাই

পোয়ারো শুনে বললেন, বুঝেছি। মায়েরা সব সময় চিন্তা করেন তাদের সন্তানদের জন্য। কিন্তু সন্তানেরা তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। কি আমি ঠিক বলিনি?

হ্যাঁ আপনি সত্যি কথাই বলেছেন। কিন্তু আমার মা এমন একটা ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে চায় যেটার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কই নেই।

আপনি ও সিলিয়া র‍্যাভেন্সক্রফট দু-জনে খুব অন্তরঙ্গ বন্ধু। আপনারা দু-জনে পরস্পরের খুবই কাছের মানুষ। মিসেস অলিভার আপনার মার কাছ থেকে শুনেছেন আপনারা বিয়ে করার কথা ভাবছেন।

আমি আপনাকে আবার মনে করিয়ে দিতে চাইছি, যে ব্যাপার নিয়ে আমার মার কোনো সম্পর্ক নেই সেই বিষয় নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা উচিত নয় এবং চিন্তারও কোনো কারণ থাকতে পারে না।

মৃদু হেসে পোয়ারো বললেন, সব মায়েরাই একই রকমের হয়। আর আপনি বোধহয় আপনার মায়ের সঙ্গে খুব জড়িত।

ডেসমন্ড বলল, আমি তা বলব না। বরং আপনাকে আমি খোলাখুলি বলি উনি আমার সত্যিকারের মা নন।

তাই নাকি? এ কথা তো আমার জানা ছিল না।

ডেসমন্ড বলে আমি ওঁর দত্তকপুত্র। কারণ ওঁর একটি ছেলে ছিল এবং সে ছোটোবেলাতেই মারা যায়। তখন উনি দত্তক নিতে চান। এবং আমাকে দত্তক নেওয়া হয়। যদিও উনি আমাকে ওঁর ছেলের মতো করে মানুষ করেছিলেন কিন্তু সবসময় উনি বলেন আমি ওঁর ছেলে নই। আমাদের দুজনকে দেখতে একরকম নয় এবং চেহারার সঙ্গেও কোনো মিল নেই আর আমাদের চিন্তাধারাও কিন্তু এক নয়।

পোয়ারো বললেন, এখন বুঝলাম।

ডেসমন্ড বলল, আমি আপনাকে কী করতে বলব কিছুতেই আপনাকে বোঝাতে পারছি না।

আপনার মনে কিছু প্রশ্নের উদয় হয়েছে। এবং তার উত্তর খুঁজে বার করার জন্য আমার কাছে এসেছেন তাই তো?

হ্যাঁ, আমার তাই মনে হয়।

আপনি কতটুকু জানেন আর তার ঝামেলাই বা কীরকম আমি কিছুই জানি না, পোয়ারো বললেন। আপনার সম্পর্কে একটু আধটু জানি বিস্তারিতভাবে নয়। মিস র‍্যাভেন্সক্রফটের সঙ্গেও আমার দেখা হয়নি। ওঁর সাথে কিন্তু আমি দেখা করতে চাই।

হ্যাঁ, আমি ভাবছিলাম আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্য। ওর সঙ্গে আপনার কথা বলা ভালো।

বুদ্ধিমানের মতোই কাজ করেছেন। আচ্ছা আপনি কি কোনো ব্যাপারে অসুখী বা অসুবিধায় পড়েছেন কোনো বিষয়ে? পোয়ারো জিজ্ঞেস করলেন।

না, না, তেমন কোনো অসুবিধায় পড়িনি। ব্যাপারটা কী ঘটেছে জানেন, অনেক বছর আগে সিলিয়া তখন ছোটো অথবা বলা যেতে পারে সে তখন স্কুলের মেয়ে। তখনই তার জীবনে একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটে যায়। সে রকম ঘটনা যে কোনো সময়েই ঘটতে পারে। দু-জন অভিভাবক হতাশায় আত্মহত্যা করে বসেন। এই ব্যাপারে কেউ খুব বেশি জানে না। যা ঘটনা ঘটেছিল তা নিয়ে অন্য লোকদের ছেলেমেয়ের চিন্তার কোনো কারণ থাকতে পারে না। আমি বলতে চাইছি এই বিষয় নিয়ে আমার মায়ের মাথা ঘামানোর কোনো প্রয়োজন নেই।

পোয়ারো বললেন, কেউ কেউ এমন বেশি আগ্রহ দেখায়, যেমন কারোর জীবনের সফরে, যার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্কই নেই। এমন কি সেটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার বলেও গণ্য হতে পারে না।

কত বছর আগে এঘটনা শেষ হয়ে গেছে। এই ব্যাপারে কেউ খুব বেশি জানেও না। অথচ আমার মা আজও এ ব্যাপারে তিনি খুঁটিনাটি সব কিছু তথ্য জানতে চান এবং এর মাধ্যম হল সিলিয়া। আর সিলিয়াকে এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে ফেলেছে যে, তিনি জানেন না, ও আমাকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক কিনা।

আপনি? আপনি নিশ্চয়ই জানেন ওকে আপনি বিয়ে করতে চান। কি চান না?

হ্যাঁ, অবশ্যই আমি জানি। এবং ওকে বিয়ে করার জন্য আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কিন্তু জানেন ও ভীষণ মুষড়ে পড়েছে। কারণ ও জানতে চায় কেন সেই ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে গেল এবং ওর বিশ্বাস আমি সব কিছু জানি। এবং আরও মনে করে আমার মা এ-ব্যাপারে কিছু জানেন বা কিছু শুনে থাকবেন।

পোয়ারো বললেন, আপনার জন্য আমার যথেষ্ট সহানুভূতি আছে। আপনি বুদ্ধিমান যুবক এবং আপনি মেয়েটিকে বিয়ে করতে চান। এতে কোনো বাধার কারণ দেখতে পাচ্ছি না। অনেক বছর আগে যে ঘটনা ঘটেছিল তার সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা নেই আর ছিলও না। এই ধরনের বেদনাদায়ক ঘটনার ব্যাখ্যা কেউ কখনও জীবনে পায় না।

সেটা ছিল একটা স্রেফ চুক্তি মাফিক আত্মহত্যা তার বেশি কিছু হতে পারে না। কিন্তু

আপনি কি তার কারণ জানতে চান?

হ্যাঁ, সেই রকমই। এই ব্যাপারে সিলিয়া খুব উদ্বিগ্ন। অবশ্যই আমার মাও উদ্বিগ্ন। এক্ষেত্রে কারোর কোনো দোষ বা ত্রুটি ছিল। কিন্তু মুশকিল হল এর বিন্দুবিসর্গ আমরা জানি না। বিশেষ করে আমার জানার কথা নয় কারণ সেই সময় আমি সেখানে ছিলাম না।

আপনি কি তখন জেনারেল আর লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট এবং সিলিয়াকে চিনতেন না?

প্রায় আমার সারা জীবন ধরে আমি সিলিয়াকে জানি। আমার স্কুলের ছুটির সময় আমি আমার অভিভাবকের কাছে চলে আসতাম আর ওরা পাশের বাড়িতেই থাকত। সেইজন্য খুব ছোটবেলা থেকেই আমাদের আলাপ। আমরা পরস্পরকে পছন্দ করতাম এবং এক সঙ্গে থাকতাম। তারপর দীর্ঘ কয়েক বছর আর ওর সাথে দেখা হয়নি। ওর বাবা মা মালয়েতে থাকতেন আর আমার অভিভাবকেরাও। আমার ধারণা তারা আবার পরস্পরের সঙ্গে মেলামেশা করতেন ওখানে। আপনাকে বলা হয়নি আমার বাবা মারা গেছেন। আমার মা যখন মালয়েতে ছিলেন তখন তিনি কিছু একটা শুনেছিলেন আর সেটা এখনও তিনি মনে রেখেছেন। ওঁদের সম্পর্কে গবেষণাও করছেন। তবে আমি নিশ্চিত তার চিন্তাধারা কখনই সত্য হতে পারে না। আর এরজন্য সিলিয়াকে উদ্বিগ্ন করে তোলার জন্য বদ্ধপরিকর। তারজন্যই আমি জানতে চাই সত্যিকারের কী এমন ঘটনা ঘটেছিল যার জন্য ওঁরা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হলেন? এবং সিলিয়াও জানতে চায় কী ঘটেছিল এবং কেন ঘটেছিল আর কি ভাবেই বা।

পোয়ারো বললেন, আপনারা উভয়েই যে সেটা অনুভব করেন অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমার মনে হয় আপনার থেকেও সিলিয়া বেশি উদ্বিগ্ন এবং ওর মনটা বিঘ্নিত। বর্তমানে এখন অতীতের সেই ঘটনা নিয়ে চিন্তা করার কোনো প্রয়োজন নেই। আপনারা উভয় উভয়কে বিয়ে করতে চান। তাহলে অতীতের সঙ্গে আপনার কিসের সম্পর্ক? ওর বাবা-মা চুক্তি মাফিক আত্মহত্যা করেছিলেন কিনা বা প্লেন দুঘর্টনায় মারা যাবার পর অপরজন আত্মহত্যা করলেন কিনা, এইসব বিষয় নিয়ে আপনাদের মাথা ঘামানোর প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না। আর যদি বা ওঁদের বিবাহোত্তর জীবনে প্রেমঘটিত কোনো ঘটনা ঘটে থাকে এবং তার জন্য যদি তারা অসুখী হন এ নিয়ে কি আপনাদের কোনো উদ্বেগের কারণ ঘটতে পারে?

ডেসমন্ড বারটন কক্স বললেন, আপনি যা বললেন তা সুচিন্তিত মতামত এবং খুবই খাঁটি কথা। কিন্তু সিলিয়ার মনের মধ্যে কোনো ঘটনা একবার ঢুকলে ওর ভেতরটা তোলপাড় করে উঠলেও মুখে সেটা প্রকাশ করবে না। এবং তখন ও খুব কম কথা বলে।

পোয়ারো প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা আপনার কি একবারও মনে হয়নি যে, সত্যিকারের যে ঘটনা ঘটেছে তা জানা খুবই কষ্টকর। এবং যদি সেটা অসম্ভব কিছু হয়?

মানে আপনি বলতে চান, ওঁদের মধ্যে কে কাকে খুন করেছিলেন বা কেন খুন করেছিলেন এবং তারপর নিজে আত্মহত্যা করেছিলেন এই তো? অবশ্য যদি না অন্য কোনো ব্যাপার থেকে থাকে।

সেই অন্য ব্যাপারটা ঘটেছে অতীতে। এখন সেটা নিয়ে অহেতুক মাথা ঘামানোর কি কোনো দরকার আছে?

এটা কোনো ব্যাপারই হওয়া উচিত ছিল না যদি না আমার মা অহেতুক নাক না গলাতেন। সিলিয়া যে এ নিয়ে কোনোদিন কিছু ভেবেছে আমার মনে হয় না। কারণ এ-ঘটনা ঘটার সময় সে সুইজারল্যান্ডে স্কুলে ছিল। আর এব্যাপারে কেউ ওকে বিশেষ বলেওনি। আপনি নিশ্চয়ই এটা স্বীকার করবেন কৈশোর বয়সে যে ঘটনা ঘটে আর লোকেরা তাকে সে ব্যাপারে যা বুঝিয়ে থাকে সে সেটাকেই মেনে নেয়।

আপনারা তাহলে অসম্ভবকেই জানতে চাইছেন?

ডেসমন্ড বলল, আপনাকে আমি খোঁজ করতে বলেছি।

অনুসন্ধান চালাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। বললেন পোয়ারো। প্রত্যেকেরই একটা কৌতূহল থাকে বিয়োগান্ত কোনো ঘটনা যার থেকে দুঃখ হতে পারে। আবার বিস্ময়ের কারণ ঘটতে পারে, কেউ হয়তো অসুস্থ হয়ে উঠতে পারে। মানুষের দুঃখ, বেদনা ব্যক্তিগত ব্যাপার হলেও যে কোনো মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হল কৌতূহল জাগা। কিন্তু এত ঘটনার পরেও আমি বলব অতীতের স্মৃতি নতুন করে মনে করাটা কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আর তার কোন প্রয়োজনই নেই। ডেসমণ্ড বলল কিন্তু দেখুন…

তাছাড়া তার কথার মাঝে বাধা দিয়ে পোয়ারো বলে উঠলেন, দীর্ঘ কয়েক বছর বাদে অতীতের সেই ঘটনার প্রকৃত তথ্য খুঁজে বের করা কীরকম কঠিন এবং অসম্ভব ব্যাপার এই বিষয়ে আপনি নিশ্চয়ই আমার সাথে একমত হবেন?

সরাসরি প্রতিবাদ করে উঠে ডেসমন্ড বললেন, দুঃখিত, এক্ষেত্রে আপনার সঙ্গে আমি একমত হতে পারছি না। সেটা খুবই সম্ভব আমার মনে হয়।

খুব সম্ভব, একথা কেন আপনার মনে হল জানতে পারি কি? বললেন পোয়ারো।

কারণ—

সেই কারণটা কি আপনার জানা আছে?

আমার ধারণা এখনও এমন কিছু কিছু লোক আছে যারা সেই ঘটনার কথা জানে। এমন কিছু লোক আছে যারা আপনাকে কিছু বলার বলে মনে করলে তারা বলবে। তারা আমাকে কোনো কিছু বলবে না এবং সিলিয়াকেও না। আপনিই একমাত্র পারেন তাদের কাছ থেকে খোঁজ খবর নিতে।

পোয়ারো বললেন, এটা আকর্ষণীয় বটে–

ডেসমন্ড বলল, অতীতের যা ঘটনা শুনেছি সবই ভাসাভাসা, কেউ একজন বলেছিলেন লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট বেশ কয়েক বছর একটা মানসিক হাতপাতালে ছিলেন। আবার কেউ বলেন তিনি যখন তরুণী ছিলেন একটি শিশু মারা যায় বা এ-ধরনের কিছু হবে। সেই আঘাতই তাকে বিভ্রম করে তোলে।

আপনি নিশ্চয়ই এ-ঘটনা নিজের চোখে দেখেননি?

না, আমার মা বলেছেন, আমার মনে হয় তিনি খবরটা শুনেছিলেন মালয়েতে। সেখানকার লোকের মুখে গল্প শোনা।

আপনি জানতে চান সেগুলো সত্য না মিথ্যা ছিল?

যেহেতু বহু বছর আগেকার ঘটনা তাই জানি না কার কাছে যাব, কাকে জিজ্ঞেস করব। আর যতক্ষণ না আমরা সেই কারণটা খুঁজে বার করতে পারব সেই প্রশ্নটা থেকেই যাবে। কি ঘটেছিল আর কেনই বা ঘটেছিল।

পোয়ারো বললেন, আমি মনে করি অবশ্য সন্দেহও বলতে পারেন। সিলিয়া তার মায়ের অসুস্থতার প্রভাব তার মধ্যে প্রভাবিত হতে পারে না। এটা যতদিন বা যতক্ষণ নিঃসন্দেহ হচ্ছেন ততদিন বা ততক্ষণ পর্যন্ত সে আপনাকে বিয়ে করতে রাজী হবেন না। এই আপনি বলতে চাইছেন তো?

যেভাবেই হোক এটা তার মাথায় ঢুকে গেছে। আর সম্ভবত সেটা তার মাথায় ঢুকিয়েছে আমার মা, এবং আমার মা সেটা বিশ্বাস করেন। আমি মনে করি না শুধু খোগল্প ছাড়া এই বিশ্বাসের সত্যি কোনো কারণ আছে।

পোয়ারো বললেন, তদন্তের পক্ষে এটা খুব সহজ হবে বলে মনে করি না।

আমি কিন্তু আপনার সম্পর্কে অনেক প্রশংসা শুনেছি। যেমন আপনি কোনো ঘটনার ব্যাপারে খুব বুদ্ধির সঙ্গে সত্য উদ্ঘাটন করেন আবার লোকেদের আপনি প্রশ্ন করেন আবার তাদেরকে দিয়েই সত্য ঘটনা বলিয়ে নেন।

আপনি কাকে প্রশ্ন করতে বলেন, বলুন। আপনি মালয়ের লোকেদের কথা বলেছেন কিন্তু তাদের উল্লেখ আপনি কিন্তু করছেন না। আপনি সেই সব মহিলাদের কথা বলছেন যারা সেই সময় সৈনিক স্বামীদের কর্মক্ষেত্র মালয়ে থাকত।

আমার মনে হয় না সেগুলো কোনো কাজের হবে। যারা এই সব গল্প করত, আলোচনা করত, তারা নিশ্চয়ই ভুলে গিয়ে থাকবে যেহেতু তা অনেক দিনের আগের ঘটনা। খুব সম্ভব তারা সকলেই হয়তো মারা গেছেন। আমার আরও মনে হয় মা সব ভুল খবর সংগ্রহ করেছিলেন এবং তিনি যা শুনেছিলেন তার থেকেও বেশি তার নিজের মনগড়া কাহিনি তৈরি করেছিলেন।

আপনি কি এখনও মনে করেন আমি সমর্থ হলে

হ্যাঁ, ভালো কথা, আপনি বরং মালয়েতে গিয়ে কাউকে প্রশ্ন করুন। এখন বোধহয় সেইসব লোকেদের মধ্যে কেউই নেই।

তার মানে আপনি আমাকে নামগুলো দেবেন না?

না, না, সেইসব নামগুলো নয়, বললেন ডেসমন্ড।

তাহলে কি অন্য কোনো নাম আছে?

ঠিক আছে, আমার যা মনে আছে তাই বলি। আমার ধারণা দু-জন লোক সেই ঘটনার কথা জেনে থাকতে পারে। আর কেনই বা ঘটেছিল তা তারা জেনে থাকতে পারে কারণ তারা তখন সেখানে ছিল।

আপনি তাদের কাছে যেতে চান না?

হ্যাঁ আমার যাবার উপায় ছিল এবং আমি যেতেও পারতাম। কিন্তু আমার ধারণা তারা আমার কাছে মুখ খুলবে না। এমন কতকগুলো প্রশ্ন করার আছে যা আমি তাদের বলতে পারব না। সিলিয়াও পারবে বলে মনে হয় না। আমরা কি জানতে চাই তারা জেনে যাবে এবং তারা মনে করে আমাদের সেটা জানা উচিত নয়। তার মানে এই নয় যে তারা খারাপ লোক। হয়তো আমাদের ভালোর জন্য আসল ঘটনার কথা চেপে গেছে বা করে থাকবে।

পোয়ারো বললেন, আপনি বেশ গুছিয়ে কথা বলেন আর আপনার কথা শুনে আমার খুব আগ্রহ হয় এবং আমার অনুমান আপনার মনে নির্দিষ্ট কোনো ধারণা আছে। সিলিয়া কি আপনার সঙ্গে একমত?

আমি ওকে বেশি কিছু বলিনি। ও খুব ম্যাডি আর জেলির ভক্ত।

ম্যাডি আর জেলি সেটা কী?

ওগুলো নাম। আমার ব্যাখ্যা করা উচিত ছিল। সিলিয়া তখন খুব ছোটো। যখন আমি ওকে প্রথম দেখি। আপনাকে আমি আগেই বলেছি এবং মনে আছে নিশ্চয়ই ও আমাদের পাশের বাড়িতেই থাকত। ওর একজন ফ্রেঞ্চ গভরনেস ছিল। তার নাম ছিল মাদমোয়াজেল। সে দেখতে ছিল খুব সুন্দর। আমরা ছোটোরা যখন খেলতাম সিলিয়া ও সঙ্গে থাকত। সিলিয়া তাকে ডাকত ম্যাডি বলে। তার অত বড়ো নাম সে ছোট করে দিয়েছিল। তারপর থেকে সারা পরিবার ওই ম্যাডি বলেই ডাকত।

–হ্যাঁ, দেখুন তিনি ফরাসি মহিলা বলে যতটুকু সে জানে ততটুকু আপনাকে বলবে এবং এ-ব্যাপারে অন্য কাউকে সে বলবে না।

আর অপর আর একটা মেয়ে যার কথা আপনি বলেছিলেন তার নাম?

জেলি। বুঝলেন ওই একই ধরনের। আমার অনুমান ম্যাডি সেখানে দুই কী তিন বছর থেকে পরে এই ফ্রান্সে অথবা সুইজারল্যান্ডে চলে যায়। তার পরে এই মেয়েটি আসে। আমরা তাকে ম্যাডি বলে ডাকতাম আর সিলিয়া বলতো জেলি, সে ছিল খুবই সুন্দরী এবং কৌতুকপ্রিয়া। আমরা সবাই তাকে ভালোবাসতাম। আর জেনারেল তো তার প্রতি খুব যত্ন নিতো। তারা দুজনে তাস খেলতো আরো অনেককিছু।

লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট?

তারা পরস্পর পরস্পরের অনুগত ছিল। আর সেই কারণেই সে ফিরে আসে সেখান থেকে চলে যাবার পরও।

সে ফিরে এসেছিল?

হ্যাঁ, লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট যখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন জেলি তখন ফিরে এসেছিল কারণ তাকে দেখাশোনা করার জন্য এবং সঙ্গ দেবার জন্য। আমি বিশ্বাস করি এবং আমি নিশ্চিত সেই বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটার সময় সে সেখানেই ছিল। সত্যিকারের কি ঘটেছিল–সে সব জানে।

আপনি কি তার ঠিকানা জানেন? বা সে এখন কোথায় থাকে?

হ্যাঁ, আমি জানি সে কোথায় থাকে। তাদের দুজনের ঠিকানাই আমার কাছে আছে। আমি চিন্তা করে দেখেছি আপনি ওদের দুজনের সঙ্গে দেখা করতে পারেন। আমি জানি অনেক কিছু জানার আছে।-ভেঙ্গে পড়ল সে এবার।

কয়েক মিনিটের জন্য পোয়ারো তাকিয়ে রইলেন তার দিকে। পরে তিনি বললেন, হ্যাঁ এটা একটা সম্ভাবনা, অবশ্যই একটা সম্ভাবনা।

২.১ দীর্ঘছায়া

সুপারিনটেন্ডেন্ট গ্যারওয়ে এবং পোয়ারা মন্তব্যগুলো মিলিয়ে দেখলেন।

পোয়ারোর দিকে সুপারিনটেন্ডেন্ট তাকালেন। তখন তার চোখ দুটি পিটপিট করছিল। জর্জ হুইস্কি এবং সোডা রাখল। আর পোয়ারোর সামনে রাখল রক্তবর্ণের পানীয় গ্লাস।

সুপারিনটেন্ডেন্ট আগ্রহ প্রকাশ করে জিজ্ঞেস করলেন আপনার পানীয় কী?

পোয়ারো প্রত্যুত্তরে বলল, কালো আঙুরের সিরাপ। সুপারিনটেন্ডেন্ট গ্যারওয়ে বললেন, খুব ভালো। প্রত্যেকেরই একটি নিজস্ব স্বাদ থাকে, গ্যারওয়ে তার পানীয়তে চুমুক দিয়ে বললেন, এ যে দেখছি আত্মহত্যার রিপোর্ট?

সুপারিনটেন্ডেন্ট গ্যারওয়ে বললেন, এছাড়া আর কী হতে পারে? আর এটাই তো আপনি জানতে চেয়েছিলেন। বলে তিনি মাথাটা দোলালেন। আপনাকে বেশি ব্যথা দেওয়ার জন্য আমি খুবই দুঃখিত বললেন পোয়ারো। কিপলিং-এর গল্পের মতো আমি জন্তু জানোয়ার অথবা শিশু ভালোবাসি। তৃপ্তিহীন এক কৌতূহলে ভুগছি আমি। গ্যারওয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তৃপ্তিহীন কৌতূহল? কিপলিং খুব সুন্দর গল্প লিখেছেন। আর তার লেখার উপাদানও আমি জানি। এবং সেগুলো থেকে আরও জানতে পারি যে, মানুষ একবার যদি জাহাজ ধ্বংসী টর্পেডোবাহী রণপোতের চারপাশে ছোটো খাটো একটা ট্যুর দেয়, তখন দেখা যাবে অনেক বেশি কিছু সঞ্চয় করতে পারে সে, তার জ্ঞানের ভাণ্ডার একজন রয়্যাল নেভির টপ ইঞ্জিনিয়ারের থেকেও বেশি।

এরকুল পোয়ারো বললেন, আমি সব কিছু জানি না। তাই আমাকে জিজ্ঞেস করতে হবে, জানতে হবে। তাই আমার আশঙ্কা প্রশ্নের একটা দীর্ঘ তালিকা আমি আপনার কাছে পাঠিয়েছি।

গ্যারওয়ে বললেন, আমাকে কী বিহ্বল করেছে জানেন? একটা জিনিস থেকে আর একটায় আপনার লাফানোর ভঙ্গিটা। মানসিক রোগের চিকিৎসকের যদি রিপোর্ট হয় তাহলে টাকাটা কীভাবে এলো? বা কেই বা টাকাটা পেল। অথবা কেউ কি এই টাকা আশা করেছিল, পায়নি? বিশেষ করে মেয়েদের চুল পরিচর্যার সরঞ্জাম, পরচুল, অবশ্যই পরচুল যোগানদারের নাম প্রসঙ্গক্রমে এগুলো এসে পড়ে।

পোয়ারো জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি এসব জিনিসগুলো জানেন? আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি ওগুলো আমাকে বিস্ময়ে অভিভূত করে ফেলে।

খুব ভালো কথা, এটা একটা ধাঁধার মতো। এবং এ-বিষয়ে আমরা পূর্ণ মন্তব্য করেছি। এর কোনোটাই যদিও ভালো বলে মনে হয়নি আমাদের। তবুও ফাইলগুলো রেখে দিয়েছে যদি কেউ সেখানে এসে দেখতে চায় সেই জন্য। এই বলে টেবিলের ওপর একটা কাগজ রাখলেন তিনি।

এখানে যে হেয়ার ড্রেসারের ঠিকানা আছে সেটা ব্ৰন্ড স্ট্রিট। খুব ব্যয়বহুল প্রতিষ্ঠান। সেটার নাম হল ইউজিন এ্যান্ড রোসেনটেল। পরে তারা অন্য জায়গায় চলে যায়। তবে এই প্রতিষ্ঠান কিন্তু স্লোয়েন স্ট্রিটে তাদের ব্যাবসা চালাতে থাকে। কয়েক বছর আগে তাদের দুজন সহকারী অবসর নিয়েছে। তারা কিন্তু তখন প্রধান সহকারী হিসাবে তাদের খরিদ্দারদের সেবা করতে। লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট ছিলেন তাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। রোসেনটেল এখন নিজেকে হেয়ার স্টাইলিস্ট হিসাবে পরিচয় দেয় এবং সে এখন থাকে সেলটেবহ্যামে। আমার যৌবনকালে সবাই একই রকম বলত যে, একই লোক আলাদা টুপি।

পোয়ারো বললেন, আ-হা!

গ্যারওয়ে প্রশ্ন করলেন, আ-হা কেন?

এরকুল পোয়ারো বললেন, এক্ষুনি আপনি একটা মতলব আমাকে উপহার দিয়েছেন। আর কী অদ্ভুত ভাবেই না একজনের মাথায় এই মতলবটা আমি।

গ্যারওয়ে বললেন, আপনার মাথায় অনেকগুলো মতলব দানা বেঁধেছে আর সেটা। অনেক অসুবিধার মধ্যে একটা আপনার আর দরকার নেই। আমি পারিবারিক ইতিহাস থেকে যতদূর সম্ভব অনুসন্ধান করে দেখেছি যে সেখানে বেশি কিছুই নেই। অ্যালিস্টেয়ার র‍্যাভেন্সক্রফট ছিলেন স্কটিশ। বাবা ছিলেন যাজক আর দুজন কাকা সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। উভয়ই বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। বিয়ে করেছিলেন মার্গারেট প্রেস্টন গ্রেকে। খুব ভালো বংশের মেয়ে ছিল সে। পারিবারিক কোনো কলঙ্ক ছিল না। জানি না আপনি কোথা থেকে এই খবর সংগ্রহ করেছেন। তবে আপনার ধারণা ঠিক তিনি ছিলেন তার যমজ বোনের একজন। এবং ডোরোথি ও মার্গারেট প্রেস্টন গ্রে-র ডাক নাম ছিল ডলি এবং মলি। প্রেস্টন গ্রে থাকতেন সাসেক্স-এ ব্যাটারস গ্রীনে। যমজ দুই বোনের একই দিনে তাদের প্রথম দাঁত ওঠে। এবং একই দিনে তাদের জ্বর হত । আর তারা পোশাক পরত একই রকম। একই দিনে তাদের দুজনের বিয়ে হয়েছিল এবং উভয়েরই স্বামী সেনাবাহিনীতে কাজ করত। পারিবারিক চিকিৎসক কয়েক বছর আগে মারা যান। অতএব তাদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কোনো খবর তার কাছ থেকে সংগ্রহ করার আর কোনো উপায় নেই। ছোটোবেলা একজনের মাধ্যমে একটা বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটতে দেখা যায়।

লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট-এর?

না, অন্যজনের। ক্যাপ্টেন জ্যারাকে তিনি বিয়ে করেন এবং তাদের দুটি সন্তানও হয়। ছেলেটি ছিল ছোট এবং চার বছরের। ঠেলাগাড়ি বা ওই জাতীয় কোনো একটা গাড়ির ধাক্কা লাগে ছেলেটির মাথায় তাতে সে পুকুরে পড়ে যায় এবং জলে ডুবে মারা যায়। ভদ্রমহিলার অপর মেয়েটি ন-বছরের, সে নাকি তার ছোটো ভাইকে পুকুরে ঠেলে ফেলে দেয়। এক সঙ্গে তারা খেলছিল এবং খেলতে খেলতে তারা ঝগড়া করে। কিন্তু এর মধ্যে সন্দেহ করার মতো কিছু ছিল না। আবার কিছু লোক বলে যে মা নিজেই নাকি সেই নিষ্ঠুর কাজটা করেছিলেন। রেগে গিয়ে মেয়েটির মাথায় আঘাত করেন। আবার কেউ একজন বলে পাশের বাড়ির এক মহিলা নাকি ছেলেটির মাথায় আঘাত করেছিল। কিন্তু তাই বলে আপনি যেন মনে করবেন না। এ খবর আপনার মনে আগ্রহ জাগাতে পারে। মায়ের বোন আর তার স্বামী চুক্তি করে আত্মহত্যা করার সঙ্গে এ-ঘটনার কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে।

পোয়ারো বললেন, না, সেরকম কিছু বলে মনে হচ্ছে না। তবে যে কেউ এর পিছনের ঘটনা জানার আগ্রহ প্রকাশ করতে পারে।

গ্যারওয়ে বললেন, হ্যাঁ, আমি যেমন রয়েছি যে, প্রত্যেককেই অতীতের দিকে তাকাতে হবে। কিন্তু আমি এক্ষেত্রে বলতে পারি না যে, আমরা অতীতের কথা ভেবে দেখেছি কিনা। কারণ এসব ঘটনা ঘটেছিল আত্মহত্যা করার কয়েক বছর আগে। সেই সময় এ-ঘটনার জের থাকে আইনের দিক থেকে কিছু চলেছিল।

হ্যাঁ, কেসটা আমি দেখেছি, এবং খবরের কাগজের বিবরণও আমি পড়েছি। তবে এ ব্যাপারে একটা সন্দেহ অবশ্যই থেকে যায়। এ-ঘটনায় ছেলেটির মা ভীষণভাবে জড়িয়ে পড়েন এবং সম্পূর্ণভাবে ভেঙ্গে পড়েন। তার ফলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে সেই স্বাভাবিক অবস্থায় তিনি আর কখনও ফিরে আসতে পারেননি।

আচ্ছা তারা কি ভেবেছিল সেই নিষ্ঠুর কাজটা তিনিই করেছিলেন?

হ্যাঁ, তার চিকিৎসক সেইরকমই ভেবেছিলেন। প্রত্যক্ষ সাক্ষী বলতে যা বোঝায় তা কিছুই ছিল না। ভদ্রমহিলা বলেছিলেন তিনি নাকি জানালা দিয়ে সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্যটা দেখেছিলেন। যে, তাঁর বড়ো মেয়ে ছেলেটিকে আঘাত করে পুকুরে ঠেলে ফেলে দেয়। আমার মনে হয় না সেই জবানবন্দি তারা বিশ্বাস করেছিল।

আমার মনে হয় মানসিক রোগের কোনো চিকিৎসকের সাক্ষ্য থাকতে পারে। কি পারে না?

হ্যাঁ, কোনো হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে যেতে হয় তাকে। তিনি নিশ্চয়ই ছিলেন মানসিক রোগী, বেশ কিছুদিন তাকে চিকিৎসা করতে হয়। আমার অনুমান লন্ডনের সেন্ট এ্যান্ড্রাস হাসপাতালে একজন বিশেষজ্ঞের কাছে তার চিকিৎসা হয় এবং শেষে তাকে সুস্থ বলে ঘোষণা করা হয়। এবং বছর তিনেক বাদে তার পরিবারের সঙ্গে সাধারণ জীবনযাপন করার জন্য তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

তিনি কি তখন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিলেন?

আমার অনুমান তিনি সব সময়ই স্নায়বিক রোগিণী ছিলেন।

সেই আত্মহত্যার ঘটনার সময় কোথায় ছিলেন তিনি? নাকি তিনি র‍্যাভেন্সক্রফটদের সঙ্গেই থাকতেন?

না, সেই ঘটনার সপ্তাহ তিনেক আগে তিনি মারা যান। তবে মারা যাবার সময় তিনি তাদের সঙ্গে ওভারক্লিসে ছিলেন। ঘুমের মধ্যে হেঁটে বেড়োতেন তিনি, তা বেশ কয়েক বছর ধরে এই রোগে তিনি ভুগছিলেন। আবার এক এক সময় তিনি ঘুমের পিল খেতেন এবং এর ফলে ঘুমের ঘোরে রাতে এক এক সময় বাড়ির ভেতর ঘুরে বেড়াতেন। আবার কখনও কখনও বাড়ির বাইরেও চলে যেতেন। তখন কারো ক্ষেপ থাকত না। এইভাবেই তিনি পাহাড়ের ওপর পড়ে যান এবং সঙ্গে সঙ্গে মারা যান। পরের দিন পর্যন্ত তাঁর সন্ধান পাননি। তার বোন লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট এই ঘটনায় দারুণভাবে মুষড়ে পড়েন, তারা পরস্পর খুব অনুরক্ত ছিলেন। তাঁর বোনের সেই আকস্মিক মৃত্যুতে তিনি এত বেশি আঘাত পেয়েছিলেন যে তাঁকে শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়।

আচ্ছা সেই দুঘর্টনাটাই কি কয়েক সপ্তাহ পরে র‍্যাভেন্সক্রফটদের আত্মহত্যার পথে ঠেলে দিয়েছিল?

সে রকম কোনো অনুমান কখনও করা হয়নি।

আপনি বললেন যে যমজ সন্তানদের জীবনে সর্বক্ষেত্রে একইরকম ঘটনা ঘটে থাকে। তাহলে সেই সূত্র ধরলে বলতে হয় যে, র‍্যাভেন্সক্র নিজেই নিজেকে হত্যা করে থাকবেন হয়তো, কারণ তিনি ছিলেন যমজ বোনের একজন। আর তারপর তার স্বামী নিজেকে দোষী ভেবে আত্মহত্যা করে ছিলেন হয়তো।

গ্যারওয়ে বললেন পোয়ারোকে, আপনার মনে অনেকগুলো ধারণা কাজ করছে। অ্যালিস্টেয়ার র‍্যাভেন্সক্রফট-এর সঙ্গে তার শালির কোনো গোপন সম্পর্ক থাকতেই পারে । কারণ সেরকম কোনো অনুযোগ বা অভিযোগ শোনা যায়নি কারোর কাছ থেকে।

টেলিফোন বেজে উঠতে পোয়ারো উঠে দাঁড়ায় এবং বলেন মিসেস অলিভারের ফোন।

তিনি বললেন যে মঁসিয়ে পোয়ারো, আগামী কাল সিলিয়া আমার এখানে আসছে। পরে সেই ভয়ঙ্কর মহিলাটির আসার কথা। আপনি কি তাহলে চা কিংবা কোরার আমন্ত্রণ রাখতে পারবেন? আর আপনি এইরকমই তো চাইছিলেন তাই না?

পোয়ারো বললেন, হ্যাঁ ঠিক এইরকমটাই চাইছিলাম। মিসেস অলিভার বললেন, আমি একটি পুরোনো যুদ্ধের ঘোড়ার সঙ্গে মিলিত হতে যাচ্ছি। জুলিয়া কারস্টেয়ার্স তার খোঁজ আমাকে দিয়েছেন আমার ধারণা। তিনি ভুল নাম পেয়েছেন। তবে আমার মনে হয় তিনি তার সঠিক ঠিকানা পেয়েছেন।

.

 এরকুল পোয়ারোর সঙ্গে দেখা করল সিলিয়া

পোয়ারো বললেন, ম্যাডাম স্যার হুগো ফস্টারের সঙ্গে কেমন বেড়ালেন?

আমার মনে হয় জুলিয়া তার নাম ভুল দিয়েছেন, তাঁর নামের শুরু ফস্টার নয় ফথার গিল।

তাহলে আপনি কি বলেন হাতিরা সব সময় নাম মনে রাখার ব্যাপারে বিশ্বাসযোগ্য?

হাতির ব্যাপার আমি শেষ করে ফেলেছি সুতরাং হাতির কথা আর বলবেন না।

তাহলে আপনার সেই যুদ্ধের ঘোড়া?

বয়স্ক পোমানা ঘোড়া খবরের ব্যাপারে একেবারে অযোগ্য। কিছু লোক বলত বারনেট যারা তারা তাকে ওই নামে ডাকত। মালয়তে একটা দুঘর্টনায় তিনি তার ছেলেকে হত্যা করেছিলেন। তা বলে সেটা র‍্যাভেন্সক্রফটের খুন হওয়ার ঘটনার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। আবার বলছি, হাতিদের ব্যাপারটা আমি শেষ করে ফেলেছি-ম্যাডাম আপনি বেশ আপনার ধারণা ভালোভাবেই বজায় রেখেছেন।

আধ ঘন্টার ভেতর সিলিয়া এখানে আসছে। আমি ওকে বলেছি এ-ব্যাপারে আপনি আমাকে বেশ ভালোভাবেই সাহায্য করেছেন। ও কেবল আপনার সঙ্গেই দেখা করুক আপনি। কি তাই চান?

পোয়ারো বললেন, না, আপনি যেভাবে আয়োজন করেছেন সেইভাবেই ওকে পেতে চাই।

আমার মনে হয় ও বেশিক্ষণ থাকবে না। ও যদি ঘন্টাখানেকও থাকে আমরা সেই সময় প্রয়োজনীয় আলোচনা সেরে ফেলব। তারপর তো মিসেস বারটন কক্স আসছেন।

–হ্যাঁ, হ্যাঁ সেটা খুব আকর্ষণ ও কৌতূহল্লোদ্দীপক হবে। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মিসেস অলিভার এবং বললেন, আমাদের আরও বেশি উপাদান পেতে হবে এবং আরও বেশি খবর সংগ্রহ করতে হবে তাই না?

পোয়ারো প্রত্যুত্তরে বললেন, হ্যাঁ, আমরা জানি না আমরা কি চাইছি। আমরা এখনও পর্যন্ত যা জেনেছি তা হল এক বিবাহিত দম্পতি যাঁরা সুখ ও শান্তিতে বাস করছিলেন। হঠাৎ তারা আত্মহত্যা করতে গেলেন। কিন্তু এই আত্মহত্যার কারণ কি দেখাব? অনেকটা এগিয়ে গিয়েছি। আবার পূর্ব-পশ্চিমে, ডাইনে-বাঁয়ে পিছিয়েও এসেছি।

মিসেস অলিভার বললেন, ঠিক বলেছেন। অনেক অনেক জায়গায় আমরা গেছি। কেবল উত্তর মেরুতে এখনও পর্যন্ত যাইনি।

পোয়ারো বললেন, উত্তর মেরুতে যেমন যাইনি তেমন দক্ষিণ মেরুতেও নয়।

সেখানে কী আছে আর আমাদের খোঁজার পালা কখন শেষে হবে?

আমাদের অনেক কিছু জানার আছে এবং অনেক কিছু পাওয়ার আছে। আমাদের খোঁজার পালা শেষ কবে বলতে পারি না। তবে একটা খালি তালিকা তৈরি করেছি আপনি কি সেটা পড়বেন?

মিসেস অলিভার তার পাশে এসে বসলেন এবং কাচের ওপর দিয়ে পড়তে থাকলেন সেটা।

পরচুল, তিনি প্রশ্ন করলেন প্রথমেই পরচুল কেন?

পোয়ারো বললেন, চার-চারটে পরচুল। খুবই আকর্ষণীয় আর এর সমাধান খুব দুঃসাধ্য ব্যাপার।

আমার অনুমান যে দোকান থেকে উনি ওগুলো কিনেছিলেন, সেই দোকান বোধহয় উঠে গেছে। এখন পরচুলের ব্যবহার কমে গেছে। শুধু বিদেশে বেড়োতে যাওয়ার সময় লোকেরা ব্যবহার করে। কারণ ভ্রমণে ঝামেলার হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়।

পোয়ারো বললেন, শুধু পরচুলের জন্য আমার মনে আগ্রহ জাগে। তা ছাড়া অন্য অনেক কাহিনি আছে যেমন তাদের পরিবারে মানসিক বিপর্যয়ের খবর বা যমজ বোনর গল্প। মানসিক দিক দিয়ে তিনি খুবই বিপর্যস্ত ছিলেন এবং তিনি তার জীবনের বহু বছর মানসিক হাসপাতালে ছিলেন।

সেটা কোনো সঠিক পথের সন্ধান দিতে পারে বলে আমার মনে হয় না। আমি বলতে চাই, বললেন মিসেস অলিভার, সেই মেয়েটি এসে ওঁদের দুজনকে গুলি করে থাকবে হয়তো। তবে আমি এর কারণ কী তা খুঁজে পাচ্ছি না।

পোয়ারো বললেন, না, সেই রিভলবারের ওপর শুধু জেনারেল র‍্যাভেন্সক্রফট আর তার স্ত্রীর হাতের ছাপ ছিল বলে জেনেছি। মালয়তে একটি শিশুকে হয় খুন করা হয় নয় আক্রমণ করা হয়। এবং সেই কাজটা করেছিল সম্ভবত লেডি র‍্যাভেন্সক্রফটের যমজ বোন। সম্পূর্ণ অন্য এক নারী, একজন আয়া কিংবা একজন চাকর। আর একটা ব্যাপার হল অর্থ, আপনি নিশ্চয়ই অর্থের ব্যাপার একটু আধটু জানেন।

একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন মিসেস অলিভার এখানে টাকা এলো কোথা থেকে।

পোয়ারো বললেন, টাকা এখানে আসেনি এবং সেটা যথেষ্ট আগ্রহের কারণ। টাকা স্বাভাবিকভাবেই আসে। আত্মহত্যার জন্য টাকা আসতে পারে আবার ওই কারণে টাকা খোয়াও যেতে পারে। সেখানে কোথাও বেশি পরিমাণ টাকা থাকার খবর পাওয়া যায়নি। হ্যাঁ তবে প্রেম-ঘটিত অনেক কাহিনি শুনতে পাওয়া যায় অর্থাৎ স্বামীর প্রতি অন্য নারীর আকর্ষণ আবার স্ত্রীর প্রতি অন্য পুরুষের আসক্তি। এই আকর্ষণবোধ বা আসক্তি সেটা এক তরফেই হোক বা অপর তরফেই হোক না কেন সেটা আত্মহত্যা বা খুনের পর্যায়ে গড়াতে পারে। অথচ এরকম ঘটনা প্রায়ই ঘটতে দেখা যায়। আর এই মুহূর্তে যে প্রসঙ্গে কথা বলছি সেটা অত্যন্ত আগ্রহপূর্ণ। সুতরাং সেই কারণেই আমি উদ্বিগ্ন হয়ে মিসেস বারটন কক্সের জন্য অপেক্ষা করছি।

সেই ভয়ঙ্কর মহিলাকে কেন যে আপনি গুরুত্ব দিতে চান আমি ঠিক বুঝতে পারি না। উনি যা করেছেন সেটা হল পরের ব্যাপারে নাক গলানো। আবার উনি আমাকে দিয়ে অনুসন্ধান চালাতে চান। আচ্ছা তিনি কেন আপনাকে দিয়ে অনুসন্ধানের কাজ চালাতে চাইছেন? আমার কাছে এটা কেমন যেন মনে হচ্ছে। দেখুন এটা এমন একটা ব্যাপার যা যে কোনো মানুষকেই খুঁজে বার করতে হবে। আর তিনিই হচ্ছেন যোগসূত্র।

যোগসূত্র?

হ্যাঁ, আমরা জানি না আসল সেই যোগসূত্রটা কী? আর সেটা কোথায়? অথবা সেটা কেমন? আমরা প্রত্যেকে জানি সেই আত্মহত্যার ব্যাপারে তিনি বেশি করে জানতে চান। আর যোগসূত্র হিসাবে তিনি আপনার ধমকন্যা সিলিয়া আর সেই ছেলেটিকে একত্রিত করতে চাইতেন।

আপনি তাহলে বলতে চান ছেলেটি ওঁর ছিল না?

পোয়ারো বললেন, সে ছিল একজন দত্তক পুত্র। একটি ছেলেকে তিনি দত্তকে নেন কারণ তাঁর নিজের ছেলে মারা গিয়েছিল।

ওঁর নিজের শিশু মারা গেছে? কী করে? কেন? এবং কখন?

এসব প্রশ্ন আমি নিজেই নিজেকে করেছি। উনি একটা যোগসূত্র হতে পারেন। যেমন কোনো প্রতিহিংসা নেওয়ার একটা ঘৃণা থেকে, অথবা কোনো প্রেমঘটিত ব্যাপার থেকে। হ্যাঁ ওঁর সম্পর্কে আমাকে মনঃস্থির করতেই হবে এবং যে ভাবেই হোক ওঁর সঙ্গে আমাকে দেখা করতেই হবে। আমি অপারগ, তাই সাহায্য করতে পারবো না। কিন্তু তাও চিন্তা করি যে, সেটা খুবই জরুরি।

বাড়ির কলিং বেলটা সেই সময় বেজে উঠল এবং মিসেস অলিভার পাশের ঘরে চলে গেলেন।

তিনি বললেন, এ বোধহয় সিলিয়া এলো, আপনি কিন্তু এ-ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।

পোয়ারো বললেন, হ্যাঁ ঠিকই, তবে আশাকরি মেয়েটার দিক থেকে ও আমাকে নিরাশা করবে না।

কয়েক মিনিট বাদে মিসেস অলিভার সিলিয়াকে নিয়ে এলেন। মেয়েটির চোখে মুখে প্রচণ্ড সন্দেহ।

মেয়েটি বলল, আমি জানি না। যদি আমি–এরকুল পোয়ারোর দিকে তাকালো মেয়েটি এবং সঙ্গে সঙ্গে চুপ করে গেলেন।

মিসেস অলিভার বললেন, তোমাকে এমন একজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই যিনি আমাকে সাহায্য করছেন। আশাকরি তোমাকেও উনি সাহায্য করবেন। তুমি যা জানতে চাইছ সেটার খোঁজ করতেই তিনি এখন ব্যস্ত। সত্য উদঘাটনে উনি একজন বিশেষ পারদর্শী। ইনি হলেন মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো।

ভীষণ সন্দেহের চোখে সিলিয়া তাকাল পোয়ারোর দিকে। তার চেহারা হচ্ছে ডিম্বাকৃতি মাথা, প্রকাণ্ড গোঁফ এবং ছোটো খাটো চেহারা।

সেই সন্দেহের সুরেই সিলিয়া বলল, আমার মনে হয় ওঁর নাম আমি শুনেছি।

পোয়ারো দৃঢ়স্বরে বলতে চেষ্টা করছিলেন আমার নাম অনেক লোকই শুনেছে। কিন্তু তিনি বললেন, না কারণ বহু লোক তার নাম শুনেছেন কিন্তু তারাই এখন নীরব।

আমি নিজের সম্পর্কে কিছু বলব আপনাকে তাই বসুন মাদামোয়াজেল। আমি যখন কোনো তদন্ত শুরু করি তার শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে যাই। আমি সত্য উদ্ঘাটন করব আর আপনি সেই সত্যকেই জানতে চান এবং সেই উপলব্ধিটাই আমি আপনার মনে জাগিয়ে তুলতে চাই। আমি এর বিভিন্ন দিক আপনার সামনে তুলে ধরতে পারি যা আপনাকে আশ্বস্ত করতে পারি। তাই যদি মনে করেন তাহলে আমাকে বেশি কিছু জিজ্ঞেস করবেন না।

পোয়ারো মেয়েটির দিকে একটা চেয়ার এগিয়ে দিলেন। সিলিয়া চেয়ারে বসে আগ্রহের সঙ্গে তাঁর দিকে তাকালেন। তিনি বললেন, আপনার কি মনে হয় না সত্যকে আমি পরোয়া করতে চাই?

পোয়ারো বললেন, আমার ধারণা হয়তো সেই সত্য একটা আঘাত অথবা একটা দুঃখ হতে পারে। আবার এও হতে পারে যে আপনি বলতে পারেন, কেন আমি এগুলো থেকে মুক্ত হতে পারব না? আপনি হয়তো বলতে পারেন কেন আমি জানতে চাইব? এটা এমন একটা বেদনাদায়ক উপলব্ধি যে ব্যাপারে আমি আশাব্যঞ্জক কিছুই করতে পারি না। মা-বাবার আত্মহত্যার ঘটনা আমি স্বীকার করি এবং তাদের আমি ভালোবাসতাম মা বাবাকে ভালোবাসা নিশ্চয়ই কিছু ক্ষতিকর নয়?

আজকাল কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেটা বিবেচনা করতে হবে বলে মনে হয় বললেন মিসেস অলিভার, তবে আমরা বলতে পারি এটা একটা বিশ্বাসের নতুন অধ্যায়।

সিলিয়া বললেন, এমন একটা পরিস্থিতিতে বাস করছি যে, অবাক হয়ে শুধু ভাবছি লোকদের কথা এই ব্যাপারটাকে নিয়ে নানান রকমের কথা বলে বিশেষ করে আমাকে যখন করুণার চোখে দেখে। বলতে পারেন কেন আমি তাদের করুণার পাত্র হব? সেই সঙ্গে কৌতূহলও, আমি বলতে চাইছি লোকেদের ধারণার ব্যাপারে। যে সব লোকের সঙ্গে আপনার সর্বদা দেখা হচ্ছে, কিংবা যে সব লোকেদের আপনি জানেন অথবা যে সব লোক আপনার পরিবারদের জানে, এরকম জীবন আমি চাই না। আমি সত্যকে জানতে চাই, সত্য যতই নিষ্ঠুর, এবং নির্মম হোক আমি সেই সত্যর মোকাবিলা করতে পার এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস, দয়া করে আমাকে অন্তত কিছু বলুন।

একটা আলাদা প্রশ্নের দিকে মোড় নিলেন সিলিয়া যা আগে ওর মনের মধ্যে ছিল। এখন সেটা প্রকাশের অপেক্ষায়, তিনি বললেন, ডেসমন্ডকে আপনি দেখেছেন? আপনার সঙ্গে সে দেখা করতে এসেছিল। সে কিন্তু আমাকে বলেছে যে, আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছে।

হ্যাঁ সে এসেছিল আমার সঙ্গে দেখা করতে। আপনি কি তাকে সেটা করতে বলেননি?

সে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি।

আর তিনি যদি জিজ্ঞেস করতেন তাহলে?

জানি না। সেটা করতে নিষেধ করা উচিত ছিল কিনা। এবং কোনো কারণেই যে তার সেটা করা উচিত নয় এ কথাটাও তাকে বলা উচিত ছিল কিনা তাও আমি জানি না। আবার এ-ব্যাপারে তাকে উৎসাহিত করা উচিত ছিল কিনা তাও জানি না।

একটা প্রশ্ন আমি আপনাকে করতে চাই মাদমোয়াজেল, যদি একটা স্পষ্ট ব্যাপার আপনার মনে জেগে থাকে যা আমার চিন্তার কারণ হয়েছে, সেটা অন্য কিছু থেকে অনেক বেশি জরুরি কিনা আমি জানতে চাই। সেটা কী?

একটু আগে আপনি বললেন ডেসমন্ড আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন। এবং যে কারণে আমার কাছে ওঁর আসা তার জন্য উনি খুবই উদগ্রীব। এখন সেটা খুব জরুরি ব্যাপার। যদি আপনি আর ডেসমন্ড সত্যিই বিয়ে করার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করেন সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ আজকাল তরুণ তরুণীরা চিন্তা করে না দুটি জীবনের মধ্যে যোগসূত্র রচনা করার তাগিদের কোনো বালাই তাদের মধ্যে নেই। সেই রকম একটা জীবনে কি আপনারা প্রবেশ করতে চান? আপনার বাবা মার মৃত্যু আত্মহত্যা বা অন্য ধরনের কোনো কিছু কিনা তাতে আপনার কিংবা ডেসমন্ডের কী আসে যায় বলুন?

সেটা একেবারে অন্য ধরণের মৃত্যু বা সেটা–আপনার কি মনে হয় এ ব্যাপারে?

সেরকম কিছু একটা হতেও পারে। এবং সেটা বিশ্বাস করার মতো কারণ আছে। এ ক্ষেত্রে কয়েকটা ব্যাপার আছে যার থেকে মনে হতে পারে এটা আত্মহত্যা নয়। আবার পুলিশের মতো দেখতে গেলে-সাক্ষ্য প্রমাণ দেখে শুনে তাঁরা মতামত দিয়েছে যে, জোড়া আত্মহত্যা ছাড়া অন্য আর কিছুই হতে পারে না। কিন্তু এর কারণ তারা কখনওই জানতে পারেনি। আপনিও তো তাই মনে করেন?

পোয়ারো বললেন, হ্যাঁ আমিও তাই মনে করি, আমি বলতে চাইছি সব কিছু দেখে শুনে অথবা সেগুলো সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করে কিংবা যে দিক দিয়েই আপনি বিচার করুন না কেন এখনও আপনি ওঁদের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানতে পারেননি, এর কারণ আপনি জানেন না তো তাই না?

না, না, সে ব্যাপারে আমি এখনও নিশ্চিত হতে পারিনি। তবে আমার ধারণা কী জানেন, সেটা জানা খুবই বেদনাদায়ক হতে পারে। আপনাকে আমি জিজ্ঞেস করব আচ্ছা বলুন তো অতীত কি পতিতই? আমি একজন যুবকেৰ কথা ভাবি অবশ্য সেও আমার কথা ভাবে, আমরা একসঙ্গে ভবিষ্যৎ জীবন কাটাব বলে ঠিক করেছি। হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন সিলিয়া, আচ্ছা সে কি আপনাকে বলেছে যে, সে একজন দত্তক পুত্র?

হ্যাঁ উনি তাই বলেছেন।

তাহলেই দেখুন, একটা কি কোনো ব্যাপার হতে পারে ওই ভদ্রমহিলার? কেন তিনি এখানে আসতে যাবেন মিসেস অলিভারকে চিন্তায় ফেলার জন্য? কিংবা তিনি কেন চেষ্টা করবেন তাকে দিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করার জন্য আমার বাবা-মার মৃত্যুর প্রকৃত কারণ কী? আর তিনি যখন ডেসমন্ডের নিজের মা নন?

ডেসমন্ড কি তাকে তোয়াক্কা করে?

সিলিয়া বললেন, না, তবে আমি বলতে পারি খুব সম্ভব ওঁকে অপছন্দই করে ও। আমার অনুমান ওর এই মনোভাব সব সময়ের জন্যই।

ওঁর জন্য অনেক অর্থ খরচ করেছেন যেমন স্কুলের, পোশাকের জন্য এবং অন্য আরও খরচ বাবদ। তাহলে কি আপনি মনে করেন ডেসমন্ডের ভালো মন্দ দেখতে চান না উনি?

আমি তা মনে করি না। আমার মনে হয় আর একটি ছেলে ওঁর মতে পুত্রের জায়গায় আসুক উনি তাই চান। কারণ ওঁর একটি ছেলে ছিল। একটা দুঘর্টনায় সে মারা যায়। আর সেই কারণেই তিনি কাউকে দত্তক হিসেবে নিতে চেয়েছিলেন। ওঁর স্বামী কিছু দিন হল মারা গেছে। এই সব দিনগুলি কাটানো এত কষ্টকর

আমি সব জানি, আমি একটা খবর জানতে চাই।

ওই ভদ্রমহিলা বা ডেসমন্ডের ব্যাপারে তো?

হ্যাঁ ডেসমণ্ডের, আচ্ছা উনি ওঁর কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য পান?

আপনি যা বলতে চাইছেন তা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে আমার অনুমান ও আমার ভার নিতে পারবে না। যদিও একটি স্ত্রীর ভরণপোষণের ভার নেওয়ার ক্ষমতা যথেষ্ট আছে। ওকে যখন দত্তক নেওয়া হয় তখন ওর ভরণপোষণের জন্য কিছু অর্থের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, যথেষ্টই ভালো অর্থ ছিল সেটা। ভাগ্য বা সেরকম কিছু আমি ভাবি না।

কেন, তিনি কি কিছু দাবিয়ে রাখতে পারেন না?

কী বললেন আপনি? ও আমাকে বিয়ে করলে টাকার যোগান বন্ধ করে দেবেন উনি? আমার মনে হয় না সেরকম কোনো কিছু তিনি করতে পারেন। আমার ধারণা উকিলরা বা ওর দত্তক নেওয়ার ব্যবস্থা যারা করেছিলেন মানে দত্তক নেওয়ার সোসাইটির কথা বলছি, তারা তখনই সব কিছু ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। আমি আরও একটা প্রশ্ন করব যার উত্তর শুধু আপনিই জানেন। অবশ্য মিসেস বারটন কক্সও জানতে পারেন, সেটা হল ডেসমন্ডের আসল মা কে ছিলেন?

এ ব্যাপারে ওঁর নাক গলানো সেটাই কি একটা কারণ? আপনি কি তাই মনে করেন? এই যেমন আপনি বললেন কে এই ডেসমন্ড অথবা কার ছেলে এই সব প্রশ্নের উত্তর জানার জন্যই কি ওঁর এত আগ্রহ?

না, বলছি তো না। এসবের আমি কিছুই জানি না। তবে আমার মনে হয় ও কারোর অবৈধ সন্তান। কারণ এই ধরনের ছেলেমেয়েদেরই তো দত্তক নেওয়া হয় তাই নয় কি? উনি হয়তো ওর আসল মা বা বাবার সম্পর্কে কিছু জানতে পারেন বা সেরকম কিছু। তবে উনি যদি জানেন ও ওকে কিছু বলেননি। আমি অন্তত জেনেছি কতকগুলি আজে বাজে ছেলে ভোলোনো কথা উনি বলেছিলেন যেমন কাউকে দত্তক নিতে গেলে যা করতে হয়।

আমার অনুমান কোনো সোসাইটি হয়তো বলে থাকবে যে, এইভাবে খবরটা আপনি বলতে পারেন কিংবা ডেসমন্ড কি জানেন কোনো রক্তের সম্পর্কের কথা?

আমার মনে হয় না ডেসমন্ড জানে। কিন্তু আমার এও মনে হয় না যে, তার জন্য ওর কোনো চিন্তার কারণ আছে। সেরকম চিন্তাগ্রস্ত ছেলে ও নয়ই।

আপনি হয়তো জানেন, মিসেস বারটন কক্স আপনাদের একজন পারিবারিক বন্ধু ছিলেন, হয় মার অথবা বাবার? আপনি কি কখনও ওঁনার সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন? যখন আপনি ছেলেবেলায় আপনার নিজের বাড়িতে ছিলেন?

আমার তা মনে হয় না। কারণ ডেসমন্ডের মা মিসেস বারটন কক্স মালয়তে গিয়েছিলেন। সম্ভবত ওঁর স্বামী সেখানেই মারা যান। এবং ওঁরা যখন বিদেশে ছিলেন সেই সময় ডেসমন্ডকে ইংল্যান্ডের স্কুলে পাঠানো হয়। এবং ছুটির সময় ওঁর কোনো খুড়তুতো অথবা মাসতুতো ভাই কিংবা কোনো পরিচিতজন তাদের বাড়িতে ওকে নিয়ে যেত। এবং এইভাবেই আমরা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম। আমি সব সময়তেই ওকে মনে রেখেছি। গাছে ওঠার খুব ওস্তাদ ছিল এবং ও আমাকে পাখির বাসা আর পাখির ডিমের ব্যাপারে শিখিয়ে ছিল। আমি একজন বড়ো নায়কের পূজারিণী বলতে পারেন। তাই পরে আবার যখন দেখা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বভাবতই আমরা পরস্পর উভয়ই আরো কাছে এসে পড়ি। আমরা দুজনেই আলোচনা করি যে, আমরা ছেলেবেলায় কোথায় ছিলাম। তারপর ও একদিন আমার নাম জিজ্ঞেস করে। ও বলেছিল আমি কেবল তোমার খ্রিস্টান নামটা জানি। তখন আমরা দুজনে অনেক কথাই মনে করার চেষ্টা করি। আপনি হয়তো বলতে পারেন এর ফলে আগের থেকে আমরা দু-জন আরও বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠি। বলতে গেলে ওর সম্পর্কে সব কিছু আমি জানি না। কিন্তু আমি জানতে চাই। এমন একটা ব্যাপার যা সত্যি সত্যি ঘটেছিল যাতে আপনি জড়িয়ে পড়তে পারেন আর সেটা যদি আপনি না জানেন আপনি ঘর বাঁধবেন কী করে? জীবনে আপনি কিই বা করতে যাবেন?

সুতরাং আপনি বলছেন আমি যেন আমার তদন্তের কাজ চালিয়ে যাই।

হ্যাঁ তাতে যদি কোনো ফুল হয়। যদিও আমি আর ডেসমন্ড যে ভাবে কিছু তথ্য অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেছি সে ভাবে নয় কিন্তু। কারণ তাতে আমরা খুব একটা সফল হইনি। সুতরাং এর থেকে সহজেই অনুমান করা যায় সেটা সত্যিকারের জীবনের কাহিনি হতে পারে না। এটা মৃত্যুর কাহিনি অথবা দুটি মৃত্যুর ঘটনা সেটাই বলা যেতে পারে। যখন জোড়া আত্মহত্যা তখন যে কেউ ধরে নিতে পারে সেটা মৃত্যুর খবর। শেক্সপীয়ার বা অন্য কোথাও লেখা সেই উক্তির কথা মনে পড়ে আর মৃত্যুর ক্ষেত্রে সেটা ভাগ করা যায় না। হ্যাঁ আপনি চালিয়ে যান। পোয়ারোর দিকে ফিরলেন সিলিয়া এবং বললেন, অনুসন্ধান চালিয়ে যান। আপনি যদি মনে করেন আপনার তদন্তের ফলাফল সরাসরি আমাকে বলতে পারেন অথবা মিসেস অলিভারকেও বলতে পারেন। তারপর সিলিয়া মিসেস অলিভারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ধর্ম মা, আপনাকে আমি আতঙ্কিত করতে চাই না কিন্তু আমি সরাসরি ঘোড়ার মুখ থেকে কথাটা শুনতে চাই। আমার কথাটা বোধহয় রূঢ় হয়ে গেল কিন্তু বিশ্বাস করুন আঁসিয়ে পোয়ারো আমি ওভাবে বলতে চাইনি।

না, পোয়ারো বললেন, আমি ঘোড়ার মুখ হতে চাই।

আপনি কি মনে করেন আপনি সফল হতে পারবেন?

আমার বিশ্বাস আমি পারব।

আর সব সময়েই সেটা সত্য হয়ে থাকে তাই তো?

পোয়ারো বললেন, সাধারণত সেটা সত্য হয়েই থাকে। তার বেশি আমি কিছু বলতে পারব না।

মিসেস বারটন কক্স

দরজা পর্যন্ত সিলিয়াকে এগিয়ে দিয়ে এসে মিসেস অলিভার জিজ্ঞেস করলেন, মেয়েটির সম্পর্কে আপনার কি ধারণা?

পোয়ারো বললেন, কৌতূহল জাগাল একটি মেয়ে। খুব ব্যক্তিত্বসম্পন্না মেয়ে। আমি যদি সেইভাবে ওকে খাড়া করতে চাই তাহলে অবশ্যই বলব ও বিশেষ একজন, কোনো একজন নয়।

হ্যাঁ সেটা খুবই সত্য, বললেন মিসেস অলিভার। আমি চাই আপনি কিছু বলুন।

কার সম্পর্কে, মেয়েটির সম্পর্কে কি? সত্যি কথা কি জানেন, ওকে আমি খুব একটা ভালো জানি না। ধর্মসন্তান সম্পর্কে কেউ তেমন কিছু জানতে পারেন না। তাদের সম্পর্কে বেশি গভীরে প্রবেশ করা যায় না, আর তাছাড়া কোনো উপায়ও থাকে না।

আমি ওর কথা বলতে বলিনি। ওর মার কথা বলুন।

ও তাই বলুন।

আপনি কি ওর মাকে জানতেন?

ওঁর সম্পর্কে আপনি কী জানতে চান বলুন?

আপনার কি ওঁকে মনে আছে? কী রকম মহিলা ছিলেন উনি?

আপনাকে একটা কথা বলি। কোনো ব্যাপারে কেউ অতীতের কোনো লোককে পুরোপুরি ভুলতে পারে না এবং ভুলতে পারে না সেই অতীতের স্মৃতিটাকে।

আচ্ছা বলতে পারেন আপনার মনে কী রকম রেখাপাত তিনি করেছিলেন?

মিসেস অলিভার বললেন, সুন্দরী ছিলেন তিনি তবে তেরো চোদ্দ বছর বয়সের কিশোরীর মতন নয়, তখন ওঁর দেহে অনেক চর্বি ও মেদ জমে গিয়েছিল। আমার মনে হয় আমাদের সকলেরই সেরকম হয়ে থাকে।

ওঁর মধ্যে ব্যক্তিত্ব ছিলো?

সেটা মনে করা খুব কঠিন ব্যাপার। কারণ উনি আমার একমাত্র বন্ধু বা অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন না। আমরা তখন অনেকেই একসঙ্গে মেলামেশা করতাম, তা আপনি বলতে পারেন আমাদের সবার ধ্যান ধারণা এবং পছন্দ-অপছন্দ প্রায় সবারই একরকম ছিল। টেনিস খেলায় আমাদের খুব আগ্রহ ছিল। এবং আমরা অপেরায় যেতে ভালোবাসতাম। আমাদের একটা সাধারণ ধারণার কথা আপনাকে শোনালাম।

মলি প্রেস্টন-গ্রে। এটাই কি ওঁর নাম ছিল। আপনাদের দুজনেরই কি বয়ফ্রেণ্ড ছিল?

আমার মনে হয় একটা অথবা দুটো হবে। তা অবশ্য পপ গায়কদের জন্য নয়। বিভিন্ন ধরনের বিখ্যাত অভিনেতারা।

মলি অথবা মার্গারেট প্রেস্টন গ্রের কথা বেশি করে বলুন। এই মেয়েটি আপনাকে তার। কথা জানিয়েছিলেন পরে।

না, আমার ধারণা তিনি তা করেননি, কারণ ওঁরা সেরকম নন। তবে আমার মনে হয় এই মেয়েটির থেকে মলি আরও বেশি ভাবপ্রবণ।

আমার শোনা কথা ওঁরা নাকি যমজ বোন?

না, তিনি তা ছিলেন না, প্রায় একই বয়সের বলে তিনি হয়তো তা হতে পারতেন। কিন্তু, তবে আমার অনুমান তিনি ইংলন্ডের একেবারের অন্য এক জায়গার মেয়ে। তবে আমি নিশ্চিত নই। তবে আপনার মতো আমারও মনে হয়েছিল ডলি আর মলি যমজ বোন, একবার কী দু-বার বিশেষ উপলক্ষ্যে ডলির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। এক সময় ওঁকে অবশ্যই মলির মতো দেখাত। যমজ বোনেরা বড়ো হতে থাকলে তাদের নামের সঙ্গে চুলের বাঁধুনি ভিন্ন রকম করা হত। ওদের চুলের স্টাইল ছিল তাই ভিন্ন রকমের। এর ফলে ওদের চিহ্নিত করা সুবিধা হত। আমার মনে হয় তার বোন ডলির অনুরক্ত ছিল, কিন্তু তার ব্যাপারে বেশি কথা বলতেন না তিনি। তখন যা আমার মনে হয়নি এখন আমার মনে হয় তার বোনের সঙ্গে হয়তো একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়ে থাকবে। তিনি একবার কী দুবার অসুস্থ হয়েছিলেন এবং চিকিৎসার জন্য কোথাও গিয়েছিলেন। একবার তো আমি অবাক হয়েছিলাম তিনি কি পঙ্গু হয়ে গেছেন? একবার এক কাকিমা ওঁকে সমুদ্রের ধারে নিয়ে যান কারণ তাঁর স্বাস্থ্য ভালো করে ভোলার জন্য। আমি ঠিক অনুভব করেছিলাম মলি তার অনুরক্ত ছিলেন। এবং যে কোনো ভাবে তাকে রক্ষা করার ইচ্ছা ছিল। এর থেকে কি আপনি কিছু অর্থ খুঁজে পাচ্ছেন? অথবা এর থেকে কি কিছু আন্দাজ করতে পারলেন?

মোটেই নয় বললেন এরকুল পোয়ারো।

অন্য সময়ে দেখেছি তার সম্পর্কে কোনো কথা বলতে চাইতেন না, শুধু তিনি তার মা ও বাবার কথা বলতেন। তিনি খুব প্রিয় ছিলেন তাদের আবার ওঁদেরও তিনি খুব ভালোবাসতেন। তার মা একবার প্যারিসে এসেছিলেন। তিনি তাকে বাইরে বেড়োতে নিয়ে গিয়েছিলেন, খুব একটা সুন্দরী ছিলেন না, কিন্তু চমৎকার শান্ত ও নরম প্রকৃতির মহিলা ছিলেন।

ও তাই বুঝি! আপনার কাছে আমাদের সাহায্য করার মতো কিছুই নেই? তার কোনো বয়ফ্রেন্ডও ছিল না?

মিসেস অলিভার বললেন, এখনকার মতো আমাদের সময়ে এত বয়ফ্রেন্ডের চল ছিল না। আমার অনুমান মলি তার অভিভাবকদের সঙ্গে বিদেশে কোথাও চলে যান। তবে ভারতে নয়, খুব সম্ভব ইজিপ্টে। আমার ধারণা ওঁরা ডিপ্লোম্যাটিক সার্ভিসে ছিলেন। একসময় তাঁরা সুইডেনে ছিলেন। তারপর বারমুডা অথবা ওয়েস্ট ইন্ডিজে। আমার মনে হয় ভদ্রলোক গভর্নর বা সেই রকম কিছু ছিলেন। সেটা কিন্তু কেউ মনে রাখতে পারে না। মলির গানের শিক্ষকের প্রতি খুব আগ্রহ ছিল, তবে আমার মনে হয় এখনকার বয়ফ্রেন্ডের তুলনায় কম ঝামেলার ব্যাপার ছিল সেটা। মানে আমি বোঝাতে চাইছি প্রতিদিন গান শেখাতে আসার আগে ওঁর জন্য প্রতীক্ষা করার মধ্যে আলাদা একটা রোমান্স ছিল, ছিল আলাদা উন্মাদনা। আপনার কাছে তারা একটু আলাদা ধরনের ছিলেন। যে কেউ তাঁদের জন্য রাতে স্বপ্ন দেখতেন। যার জন্য আমার প্রিয় মঁসিয়ে এ্যাডলফ যখন কলেরায় আক্রান্ত হয়েছিলেন তার জীবন রক্ষা করার জন্য আমি রক্ত দান করেছিলাম। এক সময় আমি প্রায় স্থির করে ফেলি যে আমি নার্স হব। যে কোনো মুহূর্তে বারটন কক্স এসে পড়তে পারেন। আপনাকে দেখে এখন শুধু ভাবছি তার কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে?

ঘড়ির দিকে তাকালেন পোয়ারো।

এক্ষুনি তাকে আমরা দেখতে পাব।

প্রথমে কি আমাদের বলার মতো কিছু আছে?

কয়েকটা ব্যাপারে আমাদের চিন্তা করতে হবে।

আমি বলছি একটা কী দুটো ব্যাপারে আমরা তদন্ত করতে পারি। যেমন আপনার জন্য বলব হাতি তদন্ত আর আমার জন্য হাতির প্রতীক রূপে অভিনয় করা।

মিসেস অলিভার বললেন, এটা একটা দারুণ বিস্ময়কর ব্যাপার। আমি আপনাকে আগেই বলেছি যে আমি হাতির কাজ করেছি!

আঃ কিন্তু হাতিরা আপনার হয়ে কাজ করে যে বললেন এরকুল পোয়ারো।

সামনের দরজার ঘণ্টা আবার শোনা গেল এবং পোয়ারো এবং মিসেস অলিভার পরস্পরের দিকে তাকালেন। মিসেস অলিভার বললেন, বেশ। আমি যাই। একটু পরেই মিসেস অলিভার মিসেস বারটন কক্সকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন।

মিসেস বারটন কক্স বললেন, কী সুন্দর আপনার ফ্ল্যাট! আপনার মূল্যবান সময় থেকে খরচ করার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। যদিও আমি নিশ্চিত আপনিই বলেছেন আমাকে আসার জন্য। পাশে বসা এরকুল পোয়ারোর দিকে তাকালেন এবং তার মুখের ওপর এক অস্পষ্ট ছায়া দেখতে পেলেন। আবার পর মুহূর্তেই তার দৃষ্টি গেল জানালার সামনে বোধগ্রস্ত পিয়ানোর ওপর। মিসেস অলিভার মনে করলেন যে, মিসেস বারটন কক্স হয়তো ভাবছেন এরকুল পোয়ারো বুঝি একজন পিয়ানো গায়ক। এই ভুল ধারণা দ্রুত কাটিয়ে তোলার জন্য তিনি তৎপর হয়ে উঠলেন।

পরিচয় করে দেওয়ার জন্য উঠলেন এবং বললেন, ইনি হচ্ছে মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো। পোয়ারো এগিয়ে এসে করমর্দন করলেন।

আমার মনে হয় একমাত্র উনিই পারবেন কোনো না কোনোভাবে আপনাকে সাহায্য করতে। সেদিন আমার ধর্মকন্যা সিলিয়া র‍্যাভেন্সক্রফট-এর ব্যাপারে আপনি জানতে চাইছিলেন আমার কাছে।

আপনার কি দয়া আপনি আমাকে মনে রেখেছেন। আমি আশা করব সত্যিকারের কী  ঘটেছিল সে ব্যাপারে আপনি আমাকে একটু আলোকপাত করতে পারবেন।

মিসেস অলিভার বললেন, আমার আশঙ্কা, আমি খুব বেশি সফল হতে পারিনি। সেই জন্যই মঁসিয়ে পোয়ারোকে আমি বলেছি আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য। এ-ব্যাপারে উনি একজন বিশেষজ্ঞ বলা যেতে পারে। এটা এমন একটা বেদনাদায়ক ঘটনা যা ঘটেছিল আজ থেকে অনেক বছর আগে।

মিসে বারটন কক্স বললেন, তা অবশ্য ঠিক। এখনও ওঁর চোখে একটা সন্দেহ যেন ঘোরাফেরা করছে।

মিসেস অলিভার প্রশ্ন করলেন : এখন বলুন কী চান? চায়ের সময় অনেক আগেই চলে গেছে। সুতরাং এক গ্লাস শেরি? অথবা আপনার পছন্দসই কোনো ককটেল জাতীয় কিছু?

ওঃ! এক গ্লাস শেরি।

পোয়ারোকে জিজ্ঞেস করলেন, কী খাবেন আপনি?

পোয়ারো বললেন, আমিও শেরি।

হাঁফ ছেড়ে যেন যেন বাঁচলেন মিসেস অলিভার। পোয়ারো যে তার প্রিয় ড্রিঙ্কস চাননি তার জন্য মনে মনে ধন্যবাদ জানালেন। কারণ তিনি যদি তার প্রিয় ড্রিঙ্কস চাইতেন, তিনি দিতে পারতেন না। তার ভাড়ায় এই মুহূর্তে সেটা ছিল না। পোয়ারোকে আমি আগেই বলে রেখেছি আপনি যে ব্যাপারে তদন্ত করতে চান।

মিসেস বারটন কক্স বললেন, হ্যাঁ। তার মুখ দেখে কিন্তু মনে হল তার সন্দেহ এখনও যায়নি কারণ পোয়ালোর পারদর্শিতার জন্য।

পোয়ারোকে বললেন তিনি, এই সব তরুণদের আজকাল বোঝা খুবই মুশকিল। যেমন আমার ছেলের কথাই ধরুন। ও ভীষণ ভালো ছেলে এবং আমাদের বিরাট আশা যে, ভবিষ্যতে সে উন্নতি করবে। সম্ভবত মিসেস অলিভার আপনাকে বলেছেন। ওঁর ধর্মকন্যা সিলিয়া অবশ্য এ-খবরটা সবই জানে। সে খুব সুন্দর মেয়ে। এই বন্ধুত্ব গড়ে উঠলেও প্রায়ই দেখা যায় সেটা বেশিদিন টেকে না, এটা ওদের কৈশোর প্রেম। অনেক বছর আগের কথা সব না হলেও কিছু জানা আমার জরুরি অন্তত আগের লোকদের সম্পর্কে। যদিও আমি জানি সিলিয়ার জন্ম বৃত্তান্ত ভালো কিন্তু সেখানে এমন একটা বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটে যায়। আমার মনে হয় বলতে পারেন বিশ্বাস ও এটা একটা আপোষে আত্মহত্যা। কী এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল যাতে তাদের আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছিল। সে সম্পর্কে এখনও পর্যন্ত কেউ আলোকপাত করতে পারেনি। এমন কোনো বন্ধু নেই আমার যাদের সাথে র‍্যাভেন্সক্রফটের বন্ধুত্ব তাদের থেকে সেই আত্মহত্যার ব্যাপারে জানতে পারি। তাই আমার পক্ষে ধারণা করা খুবই কষ্টকর ব্যাপার। আমি জানি সিলিয়া খুবই ভালো মেয়ে। কিন্তু যে কেউ ওদের পরিবারের ব্যাপারে জানতে চাইবে আর অনেক বেশি করে। আর সেটাই তো স্বাভাবিক নয় কি?

আমার বন্ধু মিসেস অলিভারের কাছে আমি আমি জানতে পারি আপনি একটা বিশেষ ঘটনার ব্যাপারে আমার কাছে জানতে চান। আর সেই ঘটনাটা হল প্রকৃতপক্ষে সেই আত্মহত্যা ঠিক কীভাবে ঘটেছিল–মানে

মিসেস অলিভার দৃঢ়স্বরে বললেন, সেই যে আপনি জানতে চেয়েছিলেন যে, সিলিয়ার বাবা তার মাকে গুলি করে পরে নিজেই নিজেকে গুলি করেছিলেন না সিলিয়ার মা তার বাবাকে গুলি করে পরে নিজেই নিজেকে গুলি করেছিল।

মিসেস বারটন কক্স বললেন, আমি মনে করি এর মধ্যে নিশ্চয়ই একটা তফাত থেকে যায়।

খুব মূল্যবান যুক্তি, বললেন পোয়ারো এবং তাঁর বলার ধরনটা শুনে মনে হল খুব একটা উৎসাহব্যাঞ্জক নয়। ও হো, এর পশ্চাদপটে একটা ভাবাবেগ আছে আর সেই ভাবাবেগের ঘটনাই তাদের আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেয়। আপনি নিশ্চয়ই এটা মানবেন সব বিয়েতেই যে কেউ সন্তানের কথা চিন্তা করে থাকে। মানে আমি বলতে চাইছি বংশ পরম্পরাক্রমে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের পুনাবৃত্তি যাতে ঘটে। আমরা এখন উপলব্ধি করতে পারি পরিবেশের থেকেও সেটা অনেক বেশি কিছু। এবং সেটা একটা চরিত্র গঠনের দিকে ঠেলে দেয় তাতে একটা বেশ ঝুঁকিও থাকে যা কেউ নিতে চায় না।

পোয়ারো বললেন, সত্য সেই ঝুঁকি যারা নেয় সিদ্ধান্ত তাদেরই নেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। যেমন আপনার ছেলে আর এই তরুণী মেয়েটি, সেটা হবে তাদের পছন্দ।

আমি জানি, অভিভাবকদের কখনওই পছন্দ করার অনুমতি দেওয়া হয় না। শুধু তাই নয় তাদের উপদেশও দিতে দেওয়া হয় না। কিন্তু এ-ব্যাপারে আমি কিছু জানতে চাই এবং সেটা জানার জন্য আমি খুব আগ্রহী। আপনি যদি কোনো তদন্তের ভার নেন তাহলে আমার কথাটা আপনি মাথায় রাখবেন। আমি একজন নির্বোধ মা, এবং আমার পুত্রের জন্য আমি খুব বেশি চিন্তিত। বোধহয় সব মায়েদেরই একরকম অবস্থা হয়। একদিকে মাথাটা সামান্য হেলিয়ে একটু হাসলেন তিনি। শেরির গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললেন, এ-ব্যাপারে আপনি চিন্তা করবেন আর আমিও আপনাকে জানাব। সম্ভবত ঠিক যে ব্যাপারে আমি চিন্তিত সেটা জানাব আপনাকে।

তারপরেই তিনি তার হাত ঘড়ির দিকে তাকালেন, ওহো, আমার আর একটা সাক্ষাৎকারে খুব দেরি হয়ে গেল। এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়ার জন্য সত্যিই খুব দুঃখিত মিসেস অলিভার। কিন্তু কী জানেন, আজকাল বিকালের দিকে ট্যাক্সি পাওয়া খুব মুশকিল ব্যাপার, একটার পর একটা ট্যাক্সিচালক মাথা ঘুরিয়ে সোজা চলে যায়। আমার অনুমান আপনার ঠিকানা মিসেস অলিভারের কাছে। তাই তো আছে না?

পোয়ারো বললেন, আমি আপনাকে আমার ঠিকানা দিচ্ছি। এই বলে তিনি তার পকেট থেকে একটা কার্ড বার করে তাঁর হাতে তুলে দিলেন।

হ্যাঁ, হ্যাঁ কার্ডে লেখা মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো, আচ্ছা আপনি কি ফরাসি? কি ঠিক তাই তো?

আমি বেলজিয়ান, বললেন পোয়ারো।

ও হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি এখন ঠিক বুঝতে পারছি। আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে খুব আনন্দ পেলাম, ওহো আমাকে তাড়াতাড়ি যেতেই হবে।

মিসেস অলিভারের সঙ্গে করমর্দন করে হাত বাড়িয়ে দিলেন পোয়ারোর দিকে, এবং তার সঙ্গে করমর্দন করে তিনি খুব তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

আচ্ছা ওঁর এভাবে চলে যাওয়ার ব্যাপারে আপনার কী রকম মনে হয়? প্রশ্ন করলেন, মিসেস অলিভার। পালটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন তিনি। আপনিই বলুন, আপনি কী মনে করেন?

মিসেস অলিভার বললেন, উনি যেন পালিয়ে বাঁচলেন যেভাবেই হোক আপনি ওঁকে ভয় পাইয়ে দিয়েছেন। হ্যাঁ আমার মনে হয় আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন, বললেন পোয়ারো।

উনি চান সিলিয়ার কাছ থেকে গোপন কিছু, যা ওর জানা আছে, আমি জেনে নিই। কিন্তু উনি চান না সত্যিকারের যথাযথ তদন্ত হোক। উনি কি তা চান? আমার মনে হয় না। এটা অত্যন্ত আকর্ষণপূর্ণ।

আপনার কি মনে হয় যে উনি যথেষ্ট অবস্থাপূর্ণ, বললেন পোয়ারো।

মিসেস অলিভার বললেন, ওঁর দামি দামি পোশাক এবং বিলাসবহুল ফ্ল্যাট দেখলে আমার তো তাই বলা উচিত। উনি ফ্যাশান প্রিয় তেজস্বী মহিলা এবং তিনি অনেক কমিটির সঙ্গে জড়িত। সুতরাং ওঁর সম্পর্কে তেমন কোনো সন্দেহ জাগার কারণ দেখছি না। তবে কিছু ব্যক্তিকে আমি ওঁর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছি, কেউ ওঁকে খুব বেশি পছন্দ করে না। কিন্তু উনি নিজেকে জনদরদি মহিলা হিসাবে জাহির করার চেষ্টা করেন। আবার রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। এ-ধরনের আরও অনেক কাজের সঙ্গে উনি জড়িত।

পোয়ারো জিজ্ঞেস করলেন, তবে ওঁর ত্রুটিটা কোথায়? আপনার কি মনে হয় ওঁর মধ্যে কোনো ত্রুটি আছে? অথবা স্রেফ ওঁকে পছন্দ করেন না আমার মতো?

আমার মনে হয় এমন একটা কিছু আছে যা তিনি প্রকাশ্যে টেনে আনতে চান না, বললেন পোয়ারো। আর আপনি সেটা খুঁজে বার করতে চান?

অবশ্য যদি আমি পারি, পোয়ারো বললেন, হয়তো সেটা খুব একটা সহজ হবে না কারণ উনি এখন পালিয়ে যাওয়ার মতলবে আছেন। আমি ওঁকে যে প্রশ্ন করতে যাব সবে ভাবছিলাম উনি বোধহয় সেটা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন তাই ভয় পেয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি এবং বললেন, ব্যাপারটার মধ্যে যথেষ্ট আগ্রহের অবকাশ আছে। জানেন তো প্রত্যেককে অতীতে ফিরে যেতে হবে এবং এমন কি একটা ভাবনার পরেও।

কি বললেন আপনি, আবার অতীতে ফিরে যেতে হবে?

হ্যাঁ, এমন একটা অতীতে ফিরে যেতে হবে যেখানে একটার বেশি ঘটনার কথা জানতে পারা যাবে। সেখানে এমন একটা কিছু আছে যা প্রত্যেককে জানতে হবে। কী ঘটেছিল সেই প্রসঙ্গে ফিরে আসার আগে ঠিক কত বছর আগে এ ঘটনা ঘটেছিল সেখানে আমাদের ফিরে যেতে হবে, ওভারক্লিফ নামে একটি বাড়িতে বছর পনেরো কুড়ি আগে নিশ্চয়ই এ ঘটনা ঘটেছিল? প্রত্যেককেই আবার সেখানে ফিরে যেতে হবে।

ঠিক আছে, তাই হবে। এখন আপনার তালিকায় কী আছে বলুন, এখন কি করতে হবে? বললেন মিসে অলিভার।

পুলিশের রেকর্ড থেকে কতকগুলি জিনিসের নাম শুনেছি, যেগুলি সেই বাড়ি থেকে পাওয়া গিয়েছিল যেমন চারটে পরচুল, আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে? মিসেস অলিভার বললেন, হ্যাঁ মনে পড়ছে, আপনি বলেছিলেন প্রয়োজনের তুলনায় চারটে পরচুল অত্যন্ত বেশি।

পোয়ারো বললেন, একটু বেশি বলে আমার মনে হয়েছিল। আমি একজন ডাক্তারের ঠিকানা পেয়েছি। মনে হয় সেটা খুব কাজের হবে।

ডাক্তার? তাহলে কি আপনি সেই পারিবারিক ডাক্তারের কথা বলতে চাইছেন?

না, না। পারিবারিক ডাক্তার নয়, আমি সেই ডাক্তারকে বোঝাতে চাইছি যে সেই শিশুটির দুর্ঘটনাজনিত আকস্মিক মৃত্যুর তদন্তের ব্যাপারে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। সেই শিশুটিকে হয় তার বড়ো বোন অথবা অন্য কেউ ধাক্কা দিয়ে পুকুরে ফেলে দিয়ে থাকবে।

আপনি কি তার মাকে ইঙ্গিত করছেন?

মাও হতে পারে আবার অন্য কেউ হতে পারে, যে তখন বাড়িতে ছিল। যেখানে সেই ঘটনা ঘটেছিল ইংল্যান্ডের সেই জায়গা আমি জানি, সুপারিনটেন্ডেন্ট গ্যারোওয়ে ও আমার সাংবাদিক বন্ধুদের মাধ্যমে যারা এই কেসের ব্যাপারে আগ্রহী তারাই সেই ডাক্তারের খোঁজ পেতে সমর্থ হয়েছেন।

আপনি যাচ্ছেন তার সঙ্গে দেখা করতে? এখন তিনি নিশ্চয়ই খুব বুড়িয়ে গেছেন?

না, আমি তার সঙ্গে দেখা করতে যাব না। আমি তার ছেলের সঙ্গে দেখা করতে যাব, কারণ তার ছেলে মানসিক রোগের একজন স্পেশালিস্ট। আমার নাম তার কাছে সুপারিশ করা আছে। অর্থ সংক্রান্ত ব্যাপারেও সেই সময় তদন্ত হয়েছিল। হয়তো তিনি কিছু উল্লেখযোগ্য খবর দিতে পারেন।

অর্থ সংক্রান্ত ব্যাপার বলতে আপনি কী বলতে চাইছেন?

এ-ব্যাপারে আমাকে কতকগুলো জিনিস খুঁজে বার করতে হবে। এবং সেগুলোর মধ্যে একটা অপরাধ কর্ম-সংক্রান্ত হতে পারে। কোনো ঘটনার মধ্য দিয়ে আমাদের দেখতে হবে অর্থের কার লোকসান এবং কে লাভবান হতে পারে। সুতরাং প্রত্যেককেই সেটা খুঁজে বার করতে হবে।

হ্যাঁ ভালো কথা, র‍্যাভেন্সক্রফটদের কেসে তারা সেটা খুঁজে বার করে থাকবে নিশ্চয়ই।

সেটাই স্বাভাবিক বলে মনে হয় সব দিক থেকে। ওঁরা উভয়েই উইল করে গেছেন, স্ত্রী তার অর্থ রেখে গেছেন স্বামীর জন্য এবং স্বামী তার অর্থ রেখে গেছেন স্ত্রীর জন্য। কিন্তু তাঁরা কেউই উপকৃত হতে পারেননি কারণ দু-জনেই মৃত। সুতরাং এর ফলে দেখা যাচ্ছে এতে লাভবান হয়েছে ওঁদের কন্যা সিলিয়া এবং পুত্র এডওয়ার্ড। এবং আমি আরও জেনেছি যে, এই এডওয়ার্ড এখন বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। কোনো সন্তানই সেই ঘটনার সময় সেখানে ছিল না, বা সেই অপ্রিয় কাজটা তারা করতে পারে বলে মনে হয় না। সুতরাং সেটা কোনো কাজের হবে না।

না, সেটা ঠিক সত্য নয়, আরও খানিকটা পিছিয়ে যেতে হবে আমাদের অতীতের দিকে এবং দেখতে হবে সেখানে কোথাও অর্থ সংক্রান্ত মোটিভ আছে কিনা–আমরা বলতে পারি এটা একটা অর্থপূর্ণ–দয়া করে এ-ব্যাপারে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। তার জন্য আমার সত্যিকারের কোনো গুণ নেই। মিসেস অলিভার বললেন, হাতির ব্যাপারে আমি যা বলেছিলাম সেটা বরং মোটামুটি ভালো যুক্তি হতে পারে।

পরচুলার ব্যাপারে আপনি যদি একটু মাথা ঘামান তাহলে সব থেকে ভালো হয় অন্তত আমার ধারণা তাই।

পরচুলা?

পুলিশের রিপোর্টে দেখা যায় পরচুলগুলো যে দোকান থেকে কেনা হয় লন্ডনের স্ট্রিটে হেয়ার ড্রেসার ফার্মটা ছিল খুব বিলাসবহুল। পরে সেই দোকান বন্ধ হয়ে তাদের ব্যাবসা অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই দোকান চালাত দুজন মূল অংশীদার। তবে সেই নতুন ফার্মটাও কিছুদিন বাদে বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে প্রধান ফিটার ও হেয়ার ড্রেসারের ঠিকানা আমি সংগ্রহ করেছি। তাই আমার অনুমান যদি কোনো মহিলা এব্যাপারে খোঁজ-খবর নেয় তবে একটা না একটা ফল পাওয়া যেতে পারে।

মিসেস অলিভার বললেন, সেই মহিলাটি কি আমি?

হ্যাঁ আপনিই।

ঠিক আছে। আমাকে কী করতে হবে এখন বলুন?

সেলটেনহ্যামের একটা ঠিকানায় আপনাকে যেতে হবে। সেখানে গিয়ে আপনি দেখতে পাবেন মেয়েদের চুলের সরঞ্জাম তৈরি করে মাদাম রোসেনটেলকে। এখন সে আর যুবতী নেই। তবে আধুনিক ফ্যাশনের চুলের সরঞ্জাম তৈরি করতে তার জুড়ি নেই। সে এমন একজনকে বিয়ে করেছে যার পেশা তারই মতো। পুরুষদের মাথায় টাক পরে যাওয়ার সমস্যার সমাধান করতে সে বিশেষ পারদর্শী।

এই কাজ আপনি আমাকে দিচ্ছেন? এ-ব্যাপারে সে কি কিছু মনে রাখতে পারে? আপনি কী মনে করেন? বললেন মিসেস অলিভার।

এরকুল পোয়ারো বললেন, হাতিরা মনে রাখে।

সেই ডাক্তার যার কথা আপনি বললেন। আপনি কি তার কাছে খোঁজ করতে যাচ্ছেন?

হ্যাঁ একটা ব্যাপার

আপনি কি মনে করেন তিনি মনে রেখেছেন?

পোয়ারো বললেন, খুব বেশি নয়। তবে আমার মনে হয় এটা সম্ভব, কারণ একটা দুর্ঘটনার কথা তিনি হয়তো শুনে থাকবেন। সেটা খুব আগ্রহের, কেস হিস্ট্রিতে রেকর্ড আছে নিশ্চয়ই বুঝলেন।

আপনি কি যমজ বোনের কথা বলছেন?

হ্যাঁ, তাকে নিয়ে দুটি দুর্ঘটনার কথা যতদূর মনে হয় আপনি শুনেছেন। একবার তিনি যখন যুবতী মা ছিলেন কান্ট্রিতে। ঠিকানাটা যতদূর মনে হয় হ্যাঁটারস গ্রীনে আর দ্বিতীয়বার তিনি যখন মালয়তে ছিলেন। প্রতিবারেই শিশুর মৃত্যুর কারণ হচ্ছে দুর্ঘটনা। সেই ব্যাপারে হয়তো আমি কিছু জানতে পারি

তার মানে আপনি বলতে চাইছেন যেহেতু তারা যমজ ছিলেন, মলির মানসিক রোগ ছিল আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না। তিনি মোটেই সেরকম ছিলেন না, তিনি ছিলেন স্নেহপ্রবণ ও আবেগপ্রবণ এবং দেখতে ছিলেন সুন্দর। তিনি ছিলেন এক ভয়ঙ্কর চমৎকার লোক।

হ্যাঁ ঠিকই। দেখলে সেই রকমই মনে হয়, আর তিনি খুব সুখীও বটে। আপনি কি মনে করেন?

হ্যাঁ তিনি ছিলেন একজন সুখী ব্যক্তি। ওঁর পরবর্তী জীবনের কিছুই জানা নেই কারণ তিনি তখন বিদেশে ছিলেন। তবে কোনো উপলক্ষ্যে ওর সঙ্গে দেখা করতে যেতাম বা ওঁর কাছ থেকে চিঠি পেতাম। সব সময় মনে হত উনি খুবই সুখে ছিলেন?

সেই যমজ বোনের ব্যাপারে আপনি সত্যিই কিছু জানেন না? না, তবে আমার মনে হয় তিনি ছিলেন–খোলাখুলি বলতে গেলে এক ধরনের সংস্থায় তিনি ছিলেন, মলিকে খুব কম উপলক্ষে আমি দেখেছি। সেই মলির বিয়েতেই ওঁকে দেখতে পাইনি আমি। এমন কি ওঁর সহচরী হিসাবেও না।

সেটা খুব অদ্ভুত ব্যাপার।

এর মধ্যে থেকে আপনি কী বার করতে যাচ্ছেন আমি এখনও ঠিক বুঝতে পারছি না।

পোয়ারো বললেন, স্রেফ একটা খবর।

.

ডাঃ উইলবি

পোয়ারো ট্যাক্সি থেকে নেমে ভাড়া এবং টিপস দিয়ে পকেট থেকে ছোটো নোট বইটা বের করে আর একবার ঠিকানাটা মিলিয়ে নিলেন। কারণ ঠিক জায়গায় এসছেন কিনা দেখার জন্য। ডাঃ উইলবিকে উদ্দেশ্য করে লেখা চিঠিটা পকেট থেকে বার করলেন এবং সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলেন। তারপর বেল টিপলেন, দরজা খুলে দেখেন একজন পুরুষ পরিচালক। পোয়ারো নাম বললেন, সেই শুনে সে বলল তাকে, ডাঃ উইলবি তার জন্য অপেক্ষা করছেন। যে ঘরে পোয়ারো ঢুকলেন সেটা একটা ছোটো ঘর। তার চারিদিকে তুক সেলিফ। আসবাব বলতে দুটি আরাম কেদারা। হাতলের ওপর দুটি গ্লাস, একটা কারুকার্য করা সুরাপাত্র সমেত ট্রে। ডাঃ উইলবি দাঁড়িয়ে তাঁকে অভিবাদন জানালেন। তার বয়স বছর পঞ্চাশ-ষাট আর চেহারা পাতলা রোগাটে, কপাল চওড়া, কালো চুল এবং ধূসর চোখ। তিনি করমর্দন করলেন এবং পকেট থেকে চিঠিটা বার করে তাঁর হাতে দিলেন পোয়ারো।

তাঁর হাত থেকে চিঠিটা নিলেন ডাক্তার এবং খুলে পড়লেন। তারপর সেটা একপাশে রেখে খুব আগ্রহের সঙ্গে পোয়ারোর দিকে তাকালেন।

সুপারিনটেন্ডেন্ট গ্যারোওয়ে আমাকে আগেই বলেছিলেন। আর তাছাড়া হোম অফিস থেকে আমার একজন বন্ধুও অনুরোধ করেছে আপনার এই আগ্রহের ব্যাপারে আমি যেন সাধ্যমতো সাহায্য করি।

আমাকে অনুগ্রহ করার জন্য, আপনাকে অনুরোধ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বললেন পোয়ারো। কিন্তু তারও একটা কারণ আছে যা আমার কাছে জরুরি বলে মনে হয়েছে।

এত বছর বাদে হঠাৎ এত জরুরি বলে মনে হচ্ছে কেন?

আপনি যদি একটা বিশেষ ব্যাপারে ঠিক ঠিক খেয়াল করতে পারেন তাহলে আপনি অবশ্যই বুঝতে পারবেন সেটা সত্যিই জরুরি কিনা?

ওরা সেটা করেছে কিনা আমি বলতে পারব না। আমার আগ্রহ এই কারণে যে, স্পেশাল ব্রাঞ্চে এই পেশায় বেশ কয়েক বছর ছিলাম।

এসবের ওপর আপনার বাবার কর্তৃত্ব ছিল সুবিদিত।

হ্যাঁ, তাই ছিলেন তিনি, সেটা একটা বিরাট আগ্রহের ব্যাপার ছিল তাঁর জীবনে। তার মতবাদ ছিল অনেক। তার মধ্যে কিছু মতবাদ গর্বের সঙ্গে সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। আর বাকি, মতবাদ প্রমাণিত হয়েছে হতাশাব্যাঞ্জক। আমি লক্ষ্য করেছি একটা ভয়ের ব্যাপারে আপনি বিশেষ আগ্রহী।

একজন মহিলা, তাঁর নাম ডরোথি প্রেস্টন-গ্রে।

সেই সময় আমি যুবক ছিলাম এবং তখন আমি আমার বাবার পেশায় আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম, যদিও আমার মানসিক বিশ্লেষণ সব সময় বাবার মতবাদের সঙ্গে মিল হত না। এবং যে কাজ তিনি করেছিলেন সেটা ছিল সারা জাগানোর মতো কৌতূহল। এবং যৌথভাবে আমি যে কাজ করেছিলাম সেটা আমাকে খুব আগ্রহ জাগায়, ডরোথি প্রেস্টন গ্রে-র ব্যাপারে আপনার বিশেষ আগ্রহ কেন আমি জানি, কারণ তিনি প্রেস্টন গ্রে থাকলেও পরে মিসেস গ্যারো হন।

পোয়ারো বললেন, আমি জেনেছি তিনি ছিলেন যমজের একজন।

হ্যাঁ, সেই সময় আমার বাবার গবেষণার ক্ষেত্র নির্বাচিত ছিল যমজদের জীবন নিয়ে। যেমন যে সব যমজ সন্তানরা একই পরিবেশে বড়ো হয়েছে, আবার যারা বিভিন্ন পরিবেশে বড়ো হয়েছে, তাদের নিয়ে গবেষণা করা। তারা কতকাল দুজনে একই রকম থাকে বা তাঁদের দু-জনের জীবনে একইরকম ঘটনা ঘটে কিনা এই সব বিষয় নিয়ে ছিল গবেষণা করা, দু-জন বোন বা দু-জন ভাই যারা খুব কম সময়ই একসঙ্গে কাটিয়েছে তাদের জীবনে বিস্ময়করভাবে একই সময় একই ঘটনা ঘটে কিনা সেটাও দেখার বিষয় ছিল। যাই হোক আমি শুনেছি এ-ব্যাপারে আপনার বিশেষ কোনো আগ্রহ নেই।

না বললেন পোয়ারো, বরং বলা যেতে পারে আমার আগ্রহের কারণ একটি শিশুর দুর্ঘটনার ব্যাপারে। হ্যাঁ তা হতে পারে, আমার মনে হয় ঘটনাটা মায়ের খুব ভালো জায়গায় লোকেরা বাস করত। ক্যাম্বরলি থেকে খুব দূরে নয়, মিসেস গ্যারো ছিলেন বিধবা এবং তাঁর দুটি সন্তান ছিল। সম্প্রতি তাঁর স্বামী একটা দুর্ঘটনায় মারা যান। যার ফলে তিনি

পোয়ারো প্রশ্ন করলেন, মানসিক দিক থেকে বিপর্যস্ত?

না, সেরকম কিছু ভাবা যায় না ওঁর সম্পর্কে। তার স্বামী মারা যাওয়ায় তিনি গভীরভাবে শক পেয়েছিলেন এবং তাঁর মনে হয়েছিল তিনি বিরাট কিছু হারিয়ে ফেলেছেন। তাঁর চিকিৎসকের মতে তার স্বাস্থ্য খুব একটা ভালো ছিল না, কিন্তু তিনি যেভাবে সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন সেটা তার চিকিৎসক ভালো মনে মেনে নিতে পারেননি। এর ফলে মনে হয় তার মধ্যে একটা অদ্ভুত ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তবে যাই হোক উনি আমার বাবার সঙ্গে একটা পরামর্শ করতে চান এবং রোগিণীকে নিজের চোখে দেখে আসার জন্য সেখানে যেতে বলেন, তিনি তার অবস্থা দেখে খুবই উৎসাহিত বোধ করেন এবং এও মনে করেন তার বিপদেরও সম্ভাবনা আছে। সুতরাং তাকে যদি একটা নার্সিংহোমে রেখে চিকিৎসা করা যায় বেশ ভালো হয়। এমন কি সেই শিশুর মৃত্যুর পরও তার অবস্থা একই রকম ছিল। ওঁর দুটি সন্তান ছিল। মিসেস গ্যারোর মতে ঘটনাটা যা ঘটেছিল তা হল-বড়ো মেয়ে তার থেকে বছর চার পাঁচের ছোটো ভাইকে আক্রমণ করে। একটা কোদাল দিয়ে তাকে আঘাত করে এবং কৃত্রিম সাজানো পুকুরে জলে ডুবে মারা যায়। পেরামবুলেটার থেকে ছোটো ভাই বা বোনকে ধাক্কা দিয়ে পুকুরে ফেলে দিতে দেখা যায়। তার কারণ ঈর্ষা এবং তারা ভাবে এডওয়ার্ড বা ডোলান্ড অথবা যে নামই হোক না কেন সে যদি পৃথিবীতে না থাকে তার মার কষ্ট কিছুটা দূর হবে। অথবা ভাই বা বোন না থাকলে তার পক্ষে খুব ভালো হয়। এরকম ঘটনা ছোটো ছেলে মেয়েদের মধ্যে প্রায়ই ঘটে থাকতে দেখা যায়। এসবই ঈর্ষা থেকে সৃষ্টি হয়। এই কেসে নির্দিষ্ট কোনো কারণ বা সাক্ষ্য প্রমাণ নেই। মেয়েটি কিন্তু তার ভায়ের জন্ম হওয়াতে ক্রুদ্ধ হয়নি।

অপরপক্ষে দেখা যায় মিসেস গ্যারো এই দ্বিতীয় সন্তানটিকে জন্ম দিতে চাননি। কিন্তু তার স্বামী আসন্ন দ্বিতীয় সন্তানের জন্য খুশি হয়েছিলেন। গর্ভপাতের জন্য তিনি দু-জন ডাক্তার দেখান। কিন্তু গর্ভপাত করতে পারেননি কারণ তখন তা ছিল বেআইনি। তখন আরও শোনা যায় যে একজন চাকর এবং একটি ছেলে এসে বলল, একজন মহিলা নাকি তার ছেলেকে আক্রমণ করে। সেটি কিন্তু কন্যা সন্তান ছিল না। আবার তখন জানালা দিয়ে বাইরে দেখছিল তিনি ছিলেন তার মিস্ট্রে। তিনি বললেন, আমার ধারণা সেই সময় তিনি কী করছিলেন তা তিনি জানতেন না কারণ তাঁর স্বামী মারা গিয়েছিলেন। বিচারে বলা হয় সেটা ছিল একটা দুর্ঘটনা এবং ছেলেমেয়েরা তখন একসঙ্গে খেলছিল। সুতরাং কেসট এইভাবে পরিত্যক্ত হয়। কিন্তু আমার বাবা যখন কেসটা নিয়ে মিসেস গ্যারোর সঙ্গে আলোচনা করেন এবং তাঁকে সহানুভূতি জানিয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করেন, আবার কয়েকটা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে একদম নিশ্চিত হন তখন যা ঘটেছিল তার জন্য তিনিই দায়ী। অতএব তার পরামর্শমতো মিসেস গ্যারোর মানসিক চিকিৎসার দরকার ছিল।

আপনারা বাবা সম্পূর্ণ নিশ্চিত ছিলেন যে, সেই ঘটনার জন্য তিনিই দায়ী ছিলেন?

হ্যাঁ। সেই সময় এই সব রোগের চিকিৎসার জন্য একটা স্কুল ছিল। সেটা খুব জনপ্রিয় ছিল আর সেই স্কুলের প্রতি আমার বাবার বিশ্বাস ছিল। এখানে চিকিৎসা পর মানুষ তার স্বাভাবিক জীবন আবার করতে পারে। তবে তার প্রতি আত্মীয়স্বজন এবং বাড়ির লোকের সুনজর রাখা উচিত এবং দেখা উচিত যে, তারা তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে কিনা, আমি মনে করি এর ফলে বহু ক্ষেত্রে সাফল্য আসতে পারে আবার অনেক ক্ষেত্রে দুর্ভাগ্যজনক হতে পারে। যে সব রুগিরা ভালো হয়ে বাড়িতে ফিরে আসে এবং পরে অসুখটা আবার দেখা দেয় এর ফলে তখনই বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটে থাকে। একটা কেসে আমার বাবা খুবই অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন এবং সেই কেসটা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একই বন্ধুর সঙ্গে যে মহিলাটি বাস করতে এসেছিলেন তিনি কি আগে তাঁর সঙ্গে বসবাস করতেন? প্রায় সব কিছুই সুখে শান্তিতে চলছিল। হঠাৎ পাঁচ কী ছয় মাস পর তিনি ডাক্তারকে ডেকে পাঠান এবং ডাক্তার এলে মহিলা তাকে বললেন, আপনাকে ওপর তলায় নিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছি কারণ আমি যা করেছি তা দেখে আপনি ক্রুদ্ধ হবেন। এবং পুলিশকে খবর দেবেন। এই অপ্রিয় কাজটা করতে আমাকে হুকুম করা হয়েছিল। হিলডিকয়ার চোখে আমি শয়তানের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছিলাম। সেইজন্যই এই নিষ্ঠুর কাজটা করতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমি জেনে গিয়েছিলাম, ওকে খুন করতেই হবে। এবং আমি জানতাম সেটা ঘটবেই। একটা চেয়ারের ওপর মহিলাটি মৃত অবস্থায় বসেছিলেন। তাকে গলা টিপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছিল। শুধু তাই নয় মৃত্যুর পর তার চোখ দুটির ওপরও আক্রমণ করা হয়েছিল। তাকে একটা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং সেখানে সে। মারা যায় কিন্তু তার মধ্যে কোনো অপরাধবোধের চিহ্ন ছিল না। কারণ তার ওপর যে আদেশ অর্পিত হয়েছিল সেটা পালন করা ছিল তাঁর কর্তব্য। শয়তানকে ধ্বংস করাই ছিল তার কর্তব্য।

পোয়ারো মাথা নাড়লেন খুব দুঃখের সঙ্গে।

ডাক্তার বলেই চললেন যে, ডরোথি প্রেস্টন গ্রে মাঝারি ধরনের মানসিক রুগি ছিলেন। তাকে যদি কারোর তত্ত্বাবধানে রাখা যেত তাহলেই তিনি ছিলেন নিরাপদ। তবে আমি বলতে পারি সাধারণত গ্রহণযোগ্য ছিল না সেই সময়। আমার বাবাও তখন এ-ব্যাপারে পরামর্শ দেওয়ার কথা ঠিক বলে মনে করেননি। নার্সিংহোমে ভর্তি হয়ে বছরখানেক থেকে তিনি আবার আগের মতো হয়ে যান। তাঁর সঙ্গে থাকত একজন নার্স, যদিও তিনি নিজেকে একজন পরিচারিকা হিসাবে প্রতিপন্ন করতে চাইতেন তার কাছে। তিনি আবার নতুন করে বন্ধুত্ব পাতালেন এবং কিছুদিন পরে তিনি বিদেশে চলে যান।

হ্যাঁ, তিনি মালয়তে যান তার যমজ বোনের সঙ্গে থাকবেন বলে।

আবার সেখানে আর একটি বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটেছিল তাই না?

হ্যাঁ। একজন প্রতিবেশীর শিশু আক্রান্ত হয়। প্রথমে মনে করা হয়েছিল শিশুটির আম্মা তাকে আক্রমণ করেছিল। পরে আবার গ্রামের এক চাকরকে সন্দেহ করা হয় কিন্তু আবার দেখা যায় যে কোনো মানসিক কারণেই হোক, নিশ্চিন্তে বলা যেতে পারে শিশুটির প্রতি সেই আক্রমণের জন্য মিসেস গ্যারোই দোষী ছিলেন। আমার মনে হয় সেই জেনারেলের নামটা আমি ভুলে গেছি–

র‍্যাভেন্সক্রফট? বললেন পোয়ারো।

হ্যাঁ, হ্যাঁ জেনারেল র‍্যাভেন্সক্রফট তাকে ফেরত পাঠাতে রাজী হন এবং সেখানে চিকিৎসা আবার শুরু হয় তার। আচ্ছা এসব খবরই কি আপনি জানতে চেয়েছিলেন?

পোয়ারো বললেন, হ্যাঁ। এটা একটা আংশিক খবর যা আমি ও আপনি আগেই শুনেছি। আমি যেটা আপনাকে বলতে চাই তা হল যমজ বোনেদের ব্যাপারে। অপর যমজ বোন মার্গারেট প্রেস্টন গ্রের ব্যাপার কী? শত হলেও তিনি ছিলেন জেনারেল র‍্যাভেন্সক্রফট-এর স্ত্রী। আচ্ছা তিনিও কি সেই একই ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন?

ডাক্তারি রিপোর্টে তাঁর সম্পর্কে কখনও কোনো অসুখের খবর পাওয়া যায়নি। কারণ তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ সুস্থ। আমার বাবা তাঁর বাড়িতে একবার কী দুবার গিয়েছিলেন এবং তার সঙ্গে কথাও বলেছেন। তার ব্যাপারে বাবা খুব আগ্রহী ছিলেন। কারণ তিনি দেখেছেন যমজ সন্তানদের মধ্যে যদি কারোর অসুখ করে বা মানসিক বিপর্যয় ঘটে তখন অপর যমজ শিশুটিরও সেই রোগ বা অন্য কোনো অসুখ হতে বাধ্য। অথচ সেই সময় স্বামী স্ত্রী দু-জনেই আন্তরিকতা ও আনুগত্যের মনোভাব নিয়ে তারা তাদের জীবনযাত্রা শুরু করেছিলেন।

আপনি বললেন, কেবল জীবন শুরু করেছিলেন। এ কথার অর্থ কী?

একটা বিশেষ উপলক্ষ্যে দুই যমজ সন্তানের মধ্যে বিদ্বেষের প্রশ্ন উঠতে পারে। আবার প্রথমে দু-জনের মধ্যে গভীর ভালোবাসার সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু পরে কোনো একটা ব্যাপারে পরস্পর পরস্পরের ব্যাপারে হিংসার পাত্র হয়ে উঠতে পারে। এবং সেই কারণটার উৎস হল দু-জনের মধ্যে ভাবাবেগের অভাববোধ। এবং সেই ধরনের কোনো ঘটনা থেকেই সৃষ্টি হতে পারে বিদ্বেষের।

আমার অনুমান এক্ষেত্রে সেটা ঘটতে পারে। জেনারেল র‍্যাভেন্সক্রফট সেই সময় ছিলেন যুবক ও সুপুরুষ। আর পেশাগত মর্যাদাও ছিল অনেক উঁচুতে। আমার ধারণা তিনি ডরোথি প্রেস্টন গ্রেকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। যমজ দুই বোনের মধ্যে সুন্দরী ছিলেন তিনি। তিনিও জেনারেলের প্রেমে পড়ে যান। এরই মধ্যে অপর এক যমজ বোন মার্গারেটের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন। তিনি মার্গারেটকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। এবং জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়া মাত্র তাকে বিয়ে করেন। ডলি যে তার বোনের বিয়েতে ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠেন সেটা বোঝা যায় যে, তখন তিনি মরিয়া হয়ে এ্যালিয়েস্টার র‍্যাভেন্সক্রফট-এর সঙ্গে প্রেম চালিয়ে যেতে থাকেন। সেই সঙ্গে জেনারেলের কাছে তার ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন। ধীরে ধীরে তার রাগ, বিদ্বেষ কাটিয়ে উঠে অন্য আর একজনকে বিয়ে করেন এবং তাদের সুখী দম্পতি বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু প্রায়ই র‍্যাভেন্সক্রফটের কাছে গিয়ে থাকতেন, শুধু মালয়েতে নয় বিদেশের অন্য আর এক দেশেও জেনারেলের কর্মস্থলে গিয়ে থাকতেন তিনি। সেই সময় তিনি যথেষ্ট সুস্থ ছিলেন। তাঁর মধ্যে পাগলামোর কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। আমার বিশ্বাস এবং বাবাও সব সময় বলতেন লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট তার যমজ বোনের প্রতি আগের মতোই অনুরক্ত ছিলেন। এমন কি আমার আরও মনে হয় ডলির চেয়েও মলি তার যমজ বোনকে মাঝে মাঝে দেখতে চাইতেন। কিন্তু জেনারেল সেটা চাইতেন না। আমার ধারণা এর পিছনে অবশ্যই কোনো কারণ ছিল। আর সেই কারণটা হল ডলির উপস্থিতিতে একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়া। পুরোনো প্রেমের কথা মনে পড়লে ডলি হয়তো জেনারেলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করতেন। আর জেনারেলের পক্ষে সেটা বরদাস্ত করা খুবই কষ্টকর বলে মনে হত। যদিও আমার অনুমান যে, তার স্ত্রীর মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে তার প্রতি তার যমজ বোনের আগের মতো সেই ঈর্ষা বা ক্রোধের মনোভাব আর নেই।

আমি শুনেছি র‍্যাভেন্সক্রক্টদের আত্মহত্যা করার তিন সপ্তাহ আগে মিসেস গ্যারো তাঁদের কাছে এসেছিলেন।

হ্যাঁ সেটা খুবই সত্য। তাঁর নিজের সেই বেদনাদায়ক মৃত্যুও ঘটেছিল তখন। ঘুমের মধ্যে প্রায়ই তিনি হেঁটে বেড়োতেন। একদিন রাতে ঘুমের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির থেকে বেরিয়ে পড়েন আর চলে আসেন সেই উঁচু পাহাড়ে এবং সেই পাহাড়ে থেকেই পড়ে যান মিসেস গ্যারো। পরের দিন সকালে পাহাড়ের খাদে তাকে পাওয়া যায়। তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় কিন্তু তার জ্ঞান আর ফিরে আসেনি। কিন্তু আমি বলতে চাই সম্ভবত আপনিও যেটা জানতে চান, পরবর্তীকালে এক সুখী দম্পতির আত্মহত্যার কারণ সেটা কখনওই হতে পারে না। বোন অথবা শালির মৃত্যু কখনওই কাউকে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দিতে পারে না। জোড়া আত্মহত্যার ক্ষেত্রে তো নয়ই।

পোয়ারো বললেন, যদি না সম্ভব তার বোনের মৃত্যুর জন্য মার্গারেট দায়ী হবেন।

ডাঃ উইলবি বললেন, আপনি নিশ্চয়ই সেটা অনুমান করছেন না–

তাঁর কথার সরাসরি উত্তর না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করলেন পোয়ারো তার কাছে–আপনি কি বলতে পারেন ঘুমন্ত অবস্থায় ভ্রমণরত বোনকে মার্গারেট অনুসরণ করেননি? আর মার্গারেটই হাত দিয়ে ডরোথিকে রাতের অন্ধকারে পাহাড় থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেননি?

উত্তেজিত হয়ে ডাঃ উইলবি তীব্র প্রতিবাদ করে ওঠেন এবং বলেন, আপনার এই ধারণা কখনই আমি মেনে নিতে পারছি না।

পোয়ারো বললেন, কিন্তু লোকেদের ধারণা এ-ব্যাপারে কেউ কিছুই জানে না।

.

ইউজিন এবং রোসেনটেল হেয়ার স্টাইলিস্ট এবং বিউটিশিয়ান

মিসেস অলিভার সেলটেনহ্যামের চারিদিকে তাকালেন এবং ভাবলেন এর আগে সেলটেনহ্যামে তিনি কখনও আসেননি। এখানকার জায়গা কত সুন্দর আর বাড়িগুলো কত চমৎকার। তার মনে হল এগুলোই আসল সত্যিকারের বসবাস করার উপযোগী বাড়ি।

এখানে এসে তাঁর মনে পড়ে যায় যে তার কয়েকজন পরিচিত লোক আছে যেমন তার কাকিমা, মাসিমা অথবা তার আত্মীয়স্বজন। তারা যাদের চিনতেন এই সেলটেনহ্যামেই থাকত। তারা এখন অবসরপ্রাপ্ত। আর্মির অথবা নেভির।

হাতে বেশি সময় থাকলে বিদেশের এই জায়গাটায় বিশ্রাম নেওয়ার পক্ষে খুব ভালো, ইংরেজ মনোভাবাপন্ন লোকেরা এখানে বাস করে। আর এখানকার লোকেদের পছন্দও ভালো এবং তাদের কথাবার্তা বেশ মার্জিত ও আনন্দদায়ক। কতকগুলি দোকানের দিকে তাকিয়ে তিনি একটা দোকান দেখতে পেলেন যেটা তিনি খুঁজছিলেন। দোকানের নাম–দ্যা রোজ গ্রীন হেয়ার ড্রেসিং সেলুন। ভিতরে ঢুকে তিনি দেখলেন চার কী পাঁচজন লোক চুলের পরিচর্যা করছে। বেশ মোটা গোল চেহারার একজন যুবতী তার দিকে এগিয়ে এলো খোঁজ নেওয়ার জন্য। মিসেস অলিভার বললেন, যে, মিসেস রোসেনটেল বলেছেন আজ সকালে এলে তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে পারেন। আমার চুলের ব্যাপারে আমি এখানে আসিনি। আমি তার সঙ্গে একটা ব্যাপারে কথা বলতে চাই। আমার সঙ্গে টেলিফোনে তার কথা হয়েছে এবং তিনি বলেছেন সাড়ে এগারোটার সময় এলে তিনি আমার জন্য কিছু সময় ব্যয় করতে পারেন।

ও আচ্ছা, মেয়েটি বলল। আমার মনে হয় ম্যাডাম একজনের জন্য অপেক্ষা করছেন।

একটা ছোটো প্যাসেজ দিয়ে তাঁকে সঙ্গে করে একটা সুইং ডোরের সামনে এসে দাঁড়াল মেয়েটি। সুইং ডোরের নিচে ঠেলা দিতেই দরজা খুলে গেল এবং ভিতরে তাঁরা ঢুকলেন। মোটা গোল চেহারার মেয়েটি দরজায় নক করে বলল একজন মহিলা আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। তারপর সে জিজ্ঞেস করল, কী যেন নাম বলেছিলেন আপনি?

মিসেস অলিভার।

তিনি ভেতরে ঢুকলেন। ভেতরটা যেন একটা শোরুম মনে হল। ওয়াল পেপারের ওপর গোলাপ এবং গোলাপের সূক্ষ্ম ডালপালা ঘরে শোভা পাচ্ছিল। তার বয়সি বা বেশ কয়েক বছরের বেশি হবে, সেই সময় সবে সকালের কফি খাচ্ছিলেন।

মিসেস অলিভার বললেন, আপনি কি মিসেস রোসেনটেল?

হ্যাঁ।

আমার অপেক্ষায় ছিলেন?

কী ব্যাপার যে, আপনি এখানে এসেছেন তা আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। কারণ আজকাল টেলিফোনের লাইন খুব খারাপ। ঠিক আছে কোনো ব্যাপার নয় আমি আপনাকে আধ ঘণ্টা সময় দিতে পারি। আচ্ছা কফি আপনার চলবে?

না, মিসেস অলিভার ধন্যবাদ জানালেন। আমার প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় আমি আপনাকে আটকিয়ে রাখব না। আমি আপনার কাছে এমন কতকগুলো কথা জানতে চাই যেগুলো জানি না আপনি সেগুলো মনে রেখেছেন কিনা। আমি শুনেছি এই হেয়ারড্রেসিং-এর ব্যাবসা আপনার দীর্ঘদিনের।

হ্যাঁ। এখন আমি নিজের হাতে এইসব কাজ আর করি না। ওই মেয়েগুলোর ওপর সব ভার দিয়ে দিয়েছি।

এখনও তো আপনি লোকেদের উপদেশ দেন?

মিসেস রোসেনটেল হাসলেন এবং বললেন, তা অবশ্য করি। তার সুন্দর বুদ্ধিদীপ্ত মুখ এবং সুবিন্যস্ত বাদামি চুল।

আপনি কী ব্যাপারে এখানে এসেছেন এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না।

আমি আপনাকে পরচুলের ব্যাপারে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই?

এখন তো খুব বেশি পরচুল আমরা তৈরি করি না।

লন্ডনে তো আপনাদের ব্যাবসা ছিল?

হ্যাঁ প্রথমে বন্ড স্ট্রিটে তারপর সেটা স্লোয়েন স্ট্রিটে স্থানান্তরিত করা হয়। সেইসব কান্ট্রিতে আমাদের বড়ো ভালো সময় কেটেছিল। তবে আমি আর আমার স্বামী এখানেও সন্তুষ্ট। এখানে আমরা ছোটো একটা ব্যাবসা চালাচ্ছি। তবে পরচুলের কাজ আমরা আজকাল আর বেশি করি না। তাহলেও আমার স্বামী এখনও পরচুলের সম্পর্কে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। টাকওয়ালা পুরুষদের পরচুলের ডিজাইন উনি তৈরি করে দেন। আপনি জানেন বোধহয় পরচুল অনেক পার্থক্য সৃষ্টি করতে পারে। কোনো বয়স্ক লোক যদি পরচুল মাথায় দিয়ে বয়েস কমাতে পারে তাতে তার পক্ষে কাজ যোগাড় করতে বিশেষ সুবিধা হয়ে থাকে। মিসেস অলিভার বললেন, আমি যথেষ্ট অনুমান করতে পারি।

গল্প করার ছলে বেশ কিছু অপ্রয়োজনীয় কথা কিছুক্ষণ বলে চলেন মিসেস অলিভার, আর মনে মনে ভাবতে থাকেন কী ভাবে কাজের কথাটা শুরু করা যায়।

হঠাৎ মিসেস রোসেনটেল বলে উঠলেন–আপনি তো অ্যারিয়াডন অলিভার, ঔপন্যাসিক? তাই না?

মিসেস অলিভার অবাক হয়ে গেলেন তার কথা শুনে, কোনো রকমে সেই অবাক হওয়া ভাবটা কাটিয়ে উঠে তিনি বললেন, নিজের সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে লজ্জা বোধ হয়। বলতে পারেন এটা আমার স্বভাবজাত অভ্যাস উপন্যাস লেখাটা।

আপনার অনেক বই আমি পড়েছি। চমৎকার সব বই। আমি আপনার একজন ভক্ত। এখন আপনি বসুন, আপনাকে আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি?

বেশ ভালো কথা। আমি পরচুলের প্রসঙ্গে কথা বলতে চাই। এটা এমন একটা ঘটনার কথা যা অনেক অনেক বছর আগে ঘটেছিল। এ-ব্যাপারে আপনার কোনো কিছু মনে নাও থাকতে পারে।

আমি অবাক হচ্ছি বহু বছর আগের ব্যাপার নিয়ে আপনি কথা বলতে চাইছেন কেন?

না, ঠিক তা নয়। আমার এক বন্ধু একজন মহিলার প্রসঙ্গে, তার সঙ্গে স্কুলে পড়তাম। তারপর তার বিয়ে হয়ে যায় এবং তিনি মালয়েতে চলে যান। পরে ইংলন্ডে ফিরে আসেন এবং সেখানে একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটে যায় তাঁদের পরিবারে। একটা কথা আমি এখনও চিন্তা করছি যে ব্যাপারে লোকেরাও বিস্মিত তার অতগুলো পরচুল রাখার কি প্রয়োজন ছিল? আমার অনুমান সব কটি পরচুল আপনারা যোগান দিয়েছিলেন।

ওহো, সে এক ট্রাজেডি। তার নাম কি যেন ছিল? আমি যতদূর জানি তার নাম ছিল প্রেস্টন-গ্রে। তবে পরে তাঁর নাম হয়েছিল র‍্যাভেন্সক্রক্ট, হ্যাঁ লেডি র‍্যাভেন্সটকে আমি জানি, আমি তাকে ভালোভাবেই মনে রেখেছি, কি অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন। তাঁর স্বামী ছিলেন কর্ণেল বা জেনারেল পদমর্যাদাসম্পন্ন একজন। তারা তখন অবসর নিয়েছেন এবং বাস করছিলেন কান্ট্রি নামটা কী যেন ঠিক মনে পড়ছে না ভুলে গেছি এখন।

মিসেস অলিভার বললেন, সেখানে বোধহয় একজোড়া খুন হয়ে থাকবে।

হ্যাঁ, আমার মনে আছে সেই ঘটনা। তখন খবরের কাগজে পড়েছিলাম এবং লোকের মুখেও বলতে শুনেছিলাম। ওঁদের দুজনের ছবি খবরের কাগজে দেখেছিলাম। যদিও আমি কখনও সামনে সামনে জেনারেল র‍্যাভেন্সক্রফটকে দেখিনি তবে তার স্ত্রীকে বেশ কয়েকবার দেখেছিলাম। ঘটনাটা খুবই দুঃখের বলে মনে হয়েছিল। শুনেছিলাম ওঁরা নাকি আবিষ্কার করেন যে মিসেস র‍্যাভেন্সটের ক্যান্সার হয়েছিল। এবং সেই রোগ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সব কিছুই তারা করেছিলেন। আমার অনুমান তেমন আশাপ্রদ কিছু হয়নি বলেই বোধ হয় এমন একটা বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু সেই জোড়া আত্মহত্যার বিস্তারিত বিবরণ আমি জানতে পারিনি।

আমিও জানি না, বললেন মিসেস অলিভার।

কিন্তু এ-ব্যাপারে আপনাকে কী বলতে পারি বলুন?

আপনি তাকে পরচুল যোগান দিয়েছিলেন। পুলিশ তখন ভেবেছিল যে কোনো লোকেরই চারটে পরচুল থাকতে পারে, তার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু নেই। কিন্তু তার পরিচিতরা বা লোকেরা সেই যুক্তিটা ঠিক মেনে নিতে পারেনি।

মিসেস রোসেনটেল বললেন, তা ঠিক। বেশির ভাগ লোকের দুটো পরচুল থাকে, একটা সার্ভিসিং-এর জন্য যখন আমাদের কাছে পাঠানো হয় তখন অপরটা ব্যবহার করা হয়। আপনার কি সে কথা মনে আছে যে, লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট যে দুটো বাড়তি পরচুল অর্ডার দিয়েছিলেন?

নিজে অর্ডার দিতে তিনি আসেননি, আমার যতদূর মনে হয় তখন তিনি হাসপাতালে ছিলেন এবং একজন ফরাসি যুবতী এসেছিলেন। আমার মনে পড়ছে এ ফরাসি যুবতী একবার কী দুবার লেডি র‍্যাভেন্সক্রফটের সঙ্গে এসেছিলেন। খুব ভালো মেয়ে ছিল সে এবং খুব পরিষ্কার ইংরিজি বলত। তিনি কেন বাড়তি দুটো পরচুল চান তার সুন্দর একটা ব্যাখ্যা দিয়েছিল মেয়েটি। পরচুলের মাপ, রঙ এবং স্টাইলের বিবরণ দিয়ে অর্ডার দিয়েছিল সে, সেই ঘটনার কথা এখন আর ঠিক মনে করতে পারি না। তবে একটা ঘটনার কথা ছাড়া, সেটা একমাস বা তার থেকেও বেশি হবে। খবরের কাগজে সেই আত্মহত্যার ঘটনার কথা জানেন। আমার আশঙ্কা এই খবরে তিনি এমন মুষড়ে পড়েন এবং তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন যে তিনি আর বেঁচে থাকবেন না। আর তার স্বামীও মনে করেন তাকে ছাড়া তিনি বেঁচে থাকবেন কী করে?

দুঃখের সঙ্গে মাথা নাড়লেন এবং জিজ্ঞেস করলেন মিসেস অলিভার, সেগুলো কি বিভিন্ন ধরনের পরচুল ছিল?

হ্যাঁ চারটে পরচুলের মধ্যে একটাতে ছিল ধূসর রঙের দাগ, দ্বিতীয়টা ছিল খুবই সুন্দর। তৃতীয়টা ছিল সন্ধ্যার সময় ব্যবহারের জন্য আর শেষেরটা ছিল ঘন কোঁকড়ানো। সবকটা পরচুলই টুপির নিচে পড়লে চুল অবিন্যস্ত হয় না এবং ভারি সুন্দর দেখায়। লেডি র‍্যাভেন্সটকে আর দেখা যাবে না কোনোদিন, ভাবতেই বড়ো দুঃখ লাগছে। তার অসুখ ছাড়াও তার বোনের মৃত্যুর জন্য তিনি খুব অসুখী ছিলেন কারণ আপনি জানেন হয়তো ওঁরা দুজন যমজ বোন ছিলেন।

মিসেস রোসেনটেল বললেন, আগে সব সময়ই ওঁকে সুখী মহিলা দেখাত।

দু-জনেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন এবং মিসেস অলিভার প্রসঙ্গ পালটালেন।

আপনার কি ধারণা পরচুল আমার কার্যকর বলে মনে হবে? প্রশ্ন করলেন তিনি।

অভিজ্ঞ হেয়ার ড্রেসার মিসেস রোসেনটেল মিসেস অলিভারের মাথায় হাত দিলেন এবং বললেন, আপনাকে পরচুল ব্যবহার করতে পরামর্শ দেব না–কারণ আপনার মাথায় অনেক চুল আছে এবং বেশ ঘন। আমার অনুমান–তিনি একটু হেসে বললেন, এতেই আপনি আপনার জীবনটা বেশ ভালোভাবেই উপভোগ করেন তাই না?

আমি দেখছি আপনি সব জানেন এবং খুব চালাক আপনি। খুব সত্যি কথা, এই পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে গিয়ে আমি বেশ উপভোগ করে থাকি। যা সত্যিই মজার ব্যাপার।

জীবনটাকে আপনি চুটিয়ে উপভোগ করেন তাই না? হ্যাঁ নিশ্চয়ই করি বৈকি। তবে আমার মনে হয় এটা এমন একটা অনুভূতি যা কেউ জানতে পারে না পরে কী হবে।

মিসেস রোসেনটেল বললেন, তবু সেই অনুভূতি ঠিক এমনি যে, অনেক মানুষই চিন্তা থেকে কখনও বিরত হয় না।

২.২ মিঃ গোবির রিপোর্ট

পোয়ারোর নির্দেশে ঘরে এসে মিঃ গোবি তার চেয়ারে বসলেন। তিনি তার চার পাশে একবার দেখে নিলেন নির্দিষ্ট কোনো ফার্নিচার বা ঘরের কোনো জিনিসের উদ্দেশ্যে তাকে বলতে হবে। এবং তিনি অন্য দিনের মতো ইলেকট্রিক ফায়ারের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। মিঃ গোবির জানা ছিল না যে, কোনো মানুষের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে হয়। তিনি সব সময় নির্বাচন করেন হয় রেডিয়েটের, টেলিভিসন সেট, ঘড়ি প্রভৃতি নয়তো কার্পেট কিংবা মাটি। তিনি ব্রীফকেস খুলে কিছু কাগজ বার করলেন।

আমার জন্য আপনি কি কিছু এনেছেন? বললেন পোয়ারো।

মিঃ গোবি বললেন, হ্যাঁ নানা ধরনের বিস্তারিত খবর সংগ্রহ করে এনেছি।

সারা লন্ডনে এমন কি সারা ইংলন্ডে বিখ্যাত মিঃ গোবি। কারণ খবরের ব্যাপারে তিনি একজন বিরাট সংগ্রাহক। এই অতি আশ্চর্য কাজটা তিনি যে কী করে করেন কেউ সেটা জানে না। তার কর্মচারীর সংখ্যাও কম। তার পা-দুটো সম্পর্কে একক সময়ে অভিযোগ করে থাকেন তাদের যে রকম ব্যবহার করা উচিত তা তারা ঠিক সেরকম করে না। কিন্তু তার সাফল্য আজও মানুষকে অবাক করে দেয়। মিসেস বারটন কক্স, গীর্জায় তত্ত্বাবধায়ক কর্মচারীর মতন তিনি ঘোষণা করলেন তৃতীয় স্তবক, চতুর্থ অধ্যায়, ইসিয়া বই।

আবার তিনি বললেন, মিসেস বারটন কক্স বিয়ে করেন মিঃ সিসিল অন্তবারিকে। তার বিরাট বোতাম তৈরির কারখানা ছিল এবং তিনি ধনী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি আবার রাজধানীতে প্রবেশ করেছেন লিটল স্ট্যান্স মেয়ারের এম. পি. মাত্র চার বছর তাঁদের বিয়ে হয়েছিল। তারপরই একটা গাড়ি দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান। আবার কিছুদিন পরেই তার একমাত্র পুত্র আর একটি দুর্ঘটনায় মারা যায়। মিঃ অন্তবারির এস্টেটের উত্তরাধিকারিণী হন তার স্ত্রী। কিন্তু যতটা আশা করা হয়েছিল ঠিক ততটা নয় কারণ কয়েক বছর হল তাদের ব্যাবসা খুব ভালো চলছিল না। মিস ক্যাথলিন ফেন নামে এক মহিলার জন্যও বেশ মোটা টাকা তিনি রেখে যান। তার সঙ্গে মনে হয় মিঃ অন্তবারির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। মিসেস বারটন কক্স তার রাজনৈতিক জীবন চালিয়ে যান। বছর তিনেক বাদে তিনি একটি শিশুকে দত্তক নেন। এবং এই শিশুটি ছিল মিস ক্যাথলিন ফেনের পুত্র। মিস্ ক্যাথলিন দাবি করেন তার পুত্র আসলে মৃত মিঃ অন্তবারিরই ছেলে। এই খবরটা আমার অনুসন্ধানের যে সূত্র ধরে পেয়েছে যে কোনো কারণেই হোক তা গ্রহণীয় নয় বললেন মিঃ গোবি। আরও অনেক পুরুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করতেন মিস ফেন এবং তারা সবাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত ও উদারনৈতিক। সবাই তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশার জন্য উচিত মূল্যই দিয়েছে। আমার মনে হয় এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যা আমি আপনাকে পরিবেশন করলাম।

এরকুল পোয়ারো বললেন, বলে যান আপনি।

মিসেস অন্তবারি, তখন তিনি ওই পদবিটাই ধারণ করতেন। তিনি সেই শিশুটিকে দত্তক হিসাবে নিতে রাজী হয়ে যান। এর কিছু দিন বাদে মেজর বারটন কক্সকে তিনি বিয়ে করেন। মিস ক্যাথলিন ফেন তখন সফল অভিনেত্রী ও পপ সঙ্গীত শিল্পী হয়ে প্রচুর অর্থের অধিকারিণী হন। তিনি মিসেস বারটন কক্সকে চিঠি লিখে জানান যে, তিনি সেই দত্তক পুত্রটিকে ফেরত নিতে চান। কিন্তু মিসেস বারটন কক্স দত্তক শিশুটিকে ফেরত দিতে অস্বীকার করেন। আমি আরও জানতে পারি, মালয়েতে থাকাকালীন সময় মেজর বারটন কক্স নিহত হন। তবে তিনি তার জন্য প্রচুর অর্থ রেখে যান। আরও একটা খবর আমি পেয়েছি, মিস ক্যাথলিন ফেন যিনি আঠারো মাস আগে হয়তো মারা যান। মারা যাবার সময় তিনি একটা উইল করে যান। তার অর্জিত সমস্ত অর্থ তাঁর প্রকৃত পুত্র ডেসমন্ড, এখন যে ডেসমন্ড বারটন কক্স নামে পরিচিত তার নামে রেখে যান।

তিনি অত্যন্ত উদার, বললেন পোয়ারো। মিস ফেন কীসে মারা যান?

আমি যা খবর পেয়েছি তা হল তিনি লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন।

আর ছেলেটি তার মায়ের সমস্ত অর্থের উত্তরাধিকারী হয়?

টাকাটা একটা ট্রাস্টের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। ডেসমন্ডের যখন পঁচিশ বছর পূর্ণ হবে তখন সেই মোটা টাকার অর্থ ও পাবে।

আর মিসেস বারটন কক্স?

তিনি তার অর্থ বিনিয়োগে সুখী নন। কারণ তাঁর জীবন ধারণের জন্য যথেষ্ট অর্থ থাকলেও সেটা খুব একটা বেশি নয়।

পোয়ারো তাকে প্রশ্ন করলেন, ডেসমন্ড কি কোনো উইল করেছে?

মিঃ গোবি বললেন, সেটা আমি এখনও জানতে পারিনি। তবে সেটা খুঁজে বার করার উপায় আমার জানা আছে। আর যদি জানতে পারি তবে সময় একটুকুও নষ্ট না করে আপনাকে জানিয়ে দেব।

বিদায় নেবার জন্য তিনি উঠে দাঁড়ালেন।

প্রায় দেড় ঘন্টা বাদে আবার টেলিফোন বেজে উঠল। পোয়ারো একটা কাগজের সিটে নোট করছিলেন। যখন তখন লেখা কাটাকাটি করছিলেন আবার নতুন করে লিখছিলেন। টেলিফোনটা বেজে উঠতেই রিসিভারটা তুলে নিয়ে কান পেতে শুনলেন।

ধন্যবাদ, তিনি বললেন। হ্যাঁ কাজটা খুব তাড়াতাড়ি হয়ে গেল-তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। এক এক সময়ে আমি বুঝতে পারি না যে, আপনি এসবের মোকাবিলা কী করে করেন–হ্যাঁ ব্যাপারাটা এখন পরিষ্কার। এটার এমন একটা অর্থ যার অর্থ আগে বোঝা যায়নি-হ্যাঁ-আমি জেনেছি–আমি শুনেছি–আপনি নিশ্চিত এটাই কেস। হা হা সে জানে যে সে দত্তক পুত্র–কিন্তু তাকে কখনও বলা হয়নি, কে তার আসল মা ছিল–হ্যাঁ হ্যাঁ তাই বুঝি–খুব ভাল–অন্য পয়েন্টটা। তো আপনি পরিস্কার করে দেবেন বলেছেন? আচ্ছা ধন্যবাদ।

রিসিভারটা রেখে আবার তিনি লেখায় মন দিলেন। আধঘণ্টা বাদে আবার টেলিফোন বেজে উঠলো। এবং আর একবার রিসিভারটা তিনি তুলে নিলেন।

দূরভাষে ভেসে আসা কণ্ঠস্বর বুঝতে অসুবিধা হল না পোয়ারোর। সেলটেনহ্যাম থেকে আমি ফিরে এসেছি।

আপনি এর মধ্যে ফিরে এসেছেন? মিসেস রোসেনটেলের সঙ্গে দেখা হয়েছে তো?

হ্যাঁ চমৎকার উনি। আপনি ঠিকই বলেছেন যে, উনি আর একটা হস্তিনী।

মানে?

মানে আমি বলতে চাইছি মলি র‍্যাভেন্সটকে তিনি মনে রেখেছেন।

তাঁর পরচুলগুলোর কথাও তিনি মনে রেখেছেন তো?

হ্যাঁ।

অবসরপ্রাপ্ত হেয়ার ড্রেসার পরচুল সম্পর্কে তাকে কী বলেছেন তা সংক্ষেপে তিনি বললেন।

পোয়ারো বললেন, হ্যাঁ ঠিক, সুপারিনটেন্ডেন্ট গ্যারওয়ে ঠিক একই কথা আমাকে বলেছেন। কোঁকড়ানো, সন্ধ্যার সময় ব্যবহার করার মতো, ঘন আর দুটি সাধারণ মোট চারটি। পুলিশ সেই চারটে পরচুলই পেয়েছিল। তাহলে আপনাকে আমি যা বললাম তা দেখছি আপনি আগেই জেনে গেছেন?

না, তার থেকেও বেশি কিছু আপনি আমাকে বলেছেন। লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট বাড়তি দুটি পরচুল পেয়েছিলেন। আগের দুটোর সঙ্গে যোগ করার জন্য যা তার আগেই সংগ্রহ করা ছিল। এবং এই নতুন দুটির সংযোজন ঘটেছিল সেই বেদনাদায়ক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটার প্রায় তিন থেকে ছয় সপ্তাহ আগে। বেশ কৌতূহল জাগায় তাই না?

মিসেস অলিভার বললেন, সেটা খুবই স্বাভাবিক, আমি বোঝাতে চাইছি ওই মহিলাটি সব ব্যাপারেই ভয়ঙ্কর ক্ষতি করতে পারেন। নকল চুল সেটা আবার যদি বিন্যস্ত আর পরিষ্কার করে নেওয়া যায়, বা সেটা যদি পুড়ে জ্বলে যায়, অথবা রঙ করা হয় এবং সব ভুল রঙ করা হয় সেটা আপনি কিছুতেই বুঝতে পারবেন না। অবশ্যই আপনাকে দুটি নতুন পরচুল পেতে হবে অথবা বদল করতে হবে। সেটা কেন যে আপনাকে এত উত্তেজিত করে তুলছে কিন্তু তার কোনো কারণ আমি দেখতে পাচ্ছি না।

পোয়ারো বললেন, ঠিক উত্তেজিত হওয়া নয়। এটা একটা পয়েন্ট। আরও একটা আকর্ষণীয় পয়েন্ট হল যা আপনি এইমাত্র বাড়তি খবর দিলেন। সেটা হল ফরাসি লেডিটি। যিনি সেই বাড়তি দুটি চুল সেখানে থেকে এনেছিলেন। ম্যাচ করানোর জন্য কি?

হ্যাঁ তার সঙ্গিনী বা সেরকম কিছু হবে বলে আমি শুনেছি। সেই সময় লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে ছিলেন এবং তাঁর স্বাস্থ্যও ভালো ছিল না আর নিজে সেখানে গিয়ে পছন্দ করার মতো অবস্থা তখন তার ছিল না।

তাই বুঝি?

সেই জন্য বুঝি সেই ফরাসি সঙ্গীনীটি এসেছিল?

সেই সঙ্গিনীটির নাম জানতে পেরেছিলেন?

না। আমার মনে হয় না মিসেস রোসেনটেল সেটা বলেছিলেন এবং আমার মনে হয় না তিনি জানতেন। আমার ধারণা লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট ফোনে সব ব্যবস্থা করেছিলেন আর সেই ফরাসি মহিলাটি পরচুল দুটি দোকান থেকে এনেছিল।

ভালো কথা, বললেন পোয়ারো। এ-খবরটা আমার পরবর্তী পদক্ষেপে সাহায্য করবে।

মিসেস অলিভার জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কী জানলেন? আর আপনি কিছু করতে পারলেন নাকি? একটু রাগ করে পোয়ারো বললেন, আমি দেখছি আপনি সব সময়ই সন্দেহপ্রবণ। আপনার ধারণা আমি কিছু করি না, শুধু চেয়ারে বসে থাকি আর বিশ্রাম করি।

মিসেস অলিভার স্বীকার করলেন, হ্যাঁ, এখনও আমি মনে করি আপনি চেয়ারে শুধু বসে থাকেন আর ভাবেন। তার সঙ্গে এও বললেন, আপনি কখনও বাইরে যান না এবং বাইরের কাজ কিছুই করেন না।

আমি মনে করি অদূর ভবিষ্যতে আমি বাইরে যাব এবং কাজ করব। চ্যানেলও আমি অতিক্রম করতে পারি তবে নৌকায় নয় মনে হয় প্লেনে করে। আশাকরি সেটা আপনাকে খুশি করবে। বললেন পোয়ারো।

মিসেস অলিভার বললেন, আপনি কি আমাকে আপনার সঙ্গে নিয়ে যেতে চান?

পোয়ারো বললেন, আমার মনে হয় এ-ব্যাপারে আমার একলা যাওয়াই উচিত।

আপনি সত্যি যাবেন?

হ্যাঁ নিশ্চয়। আমি আমার সর্বশক্তি দিয়ে ছুটে যাব। এবং আমার সঙ্গে আপনিও খুশি হবেন ম্যাডাম।

মিসেস অলিভারের সঙ্গে কথা শেষ করলেন এবং নোট বুক থেকে একটা ফোনের নম্বর নিয়ে তিনি ডায়াল করলেন। কারণ একজনের সঙ্গে কথা বলা এই মুহূর্তে তার খুব জরুরি ছিল।

প্রিয় সুপারিনটেন্ডেন্ট গ্যারওয়ে। আমি এরকুল পোয়ারো কথা বলছি। আমি আপনাকে খুব কি বিরক্ত করলাম? তবে আশাকরি এই মুহূর্তে আপনি খুব ব্যস্ত নন!

সুপারিনটেন্ডেন্ট গ্যারওয়ে বললেন, না, না আমি ব্যস্ত নই। আমি এখন গোলাপ গাছের আগাছাগুলো কাটছিলাম এই পর্যন্ত

একটা ছোট্ট ব্যাপারে আপনাকে আমি জিজ্ঞেস করতে চাই।

আমাদের জোড়া আত্মহত্যার সমস্যার ব্যাপারে। হ্যাঁ মনে আছে নিশ্চয়ই আপনার যে, আপনি বলেছিলেন ওঁদের বাড়িতে একটা কুকুর ছিল। সেই কুকুরটা সেদিন ওঁদের সঙ্গে বেড়োতে গিয়েছিল। এ-খবরটা অবশ্য আপনি জানতে পারেন।

হ্যাঁ, একটা কুকুরের কথা বলেছিলাম, আমার মনে হয় হাউসকিপার কিংবা অন্য কেউ বলে থাকবে। সে বলে থাকবে অন্য দিনের মতো সেদিনও সেই কুকুরটা তাঁদের সঙ্গে বেড়োতে গিয়েছিল।

লেডি র‍্যাভেন্সটের মৃতদেহ পরীক্ষা করে যখন দেখা হয় তখন তার দেহে কি কুকুরের কামড়ানোর দাগ পাওয়া গিয়েছিল? সম্প্রতি কামড়ানোর দাগ হলেও চলবে, তবে আমি সেদিনের কামড়ানোর কথা বলছি না।

আপনি কিন্তু একটা অশুভ প্রশ্ন করছেন। আপনি এবিষয়ে না বললে একথা আমার কখনই মনে পড়ত না। হ্যাঁ বেশ কয়েকটা ক্ষত চিহ্ন ছিল তবে খুব একটা খারাপ নয়। সেই হাউসকিপারটি বলেছিল যে লেডি র‍্যাভেন্সক্রফটকে বেশ কয়েকবার কামড়েছিল যদিও মারাত্মকভাবে কিছু নয়। দেখুন পোয়ারো আপনি হয়তো জলাতঙ্কের কথা মনে করছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে সেটা দেখা যায়নি। এক্ষেত্রে তিনি গুলিবিদ্ধ হয়েই মারা গেছেন। তাই বলছি সেপটিক, বা বিষক্রিয়া অথবা টিটেনাসের সম্ভাবনার কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না।

পোয়ারো বললেন, কুকুরটাকে কিন্তু আমি মোটেই কোনো দোষ দিচ্ছি না। শুধু এ-ব্যাপারে আমি কিছু জানতে চাইছিলাম।

এক সপ্তাহ কিংবা দুই সপ্তাহ আগে একবার কুকুরের কামড়ানোর ঘটনা ঘটেছিল। তবে ইনজেকশন বা সে ধরনের কোনো কেস এ-ক্ষেত্রে ছিল না। সুপারিনটেন্ডেন্ট বলে চলেন, সেই কুকুরটা যেটা মরে গিয়েছিল। এটা কোথা থেকে এসেছিল জানি না কিন্তু?

কিন্তু এক্ষেত্রে কুকুরটি তো আর মরে যায়নি, বললেন পোয়ারো তবে সেই কুকুরটিকে আমায় জানতে হবে। খুব সম্ভব কুকুরটি অন্তত বুদ্ধিমান, সুপারিনটেন্ডেন্টকে ধন্যবাদ জানিয়ে রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন এবং বিড়োবিড়ো করে মনে মনে বলে উঠলেন পোয়ারো, বুদ্ধিমান কুকুর, সম্ভবত পুলিশের থেকেও।

.

পোয়ারোর প্রস্থানের ঘোষণা

একজন অতিথি হিসাবে মিস লিভিংস্টোনকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই দরজা বন্ধ করে পোয়ারো মিসেস অলিভারের পাশে এসে বসলেন এবং বললেন, আমি চলে যাচ্ছি।

পোয়ারোর কোনো খবর দেওয়ার পদ্ধতি দেখে মিসেস অলিভার কেমন যেন অবাক হয়ে যান। তাই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী করতে যাচ্ছেন?

আমি চলে যাচ্ছি। তবে প্লেনে করে জেনেভায় যাচ্ছি। আপনার কথা শুনে ঠিক মনে হচ্ছে। আপনি হয় ইউ, এন, ও. অথবা ইউনেস্কো কিংবা ওই ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠানের কেউ।

এটা স্রেফ একটা ব্যক্তিগত সফর বলতে পারেন।

জেনেভায় আপনি কি কোনো হাতির সন্ধান পেয়েছেন?

আপনি ওইভাবে দেখছেন, হয়তো ওদের দুজনের মধ্যে দু-জন–

মিসেস অলিভার বললেন, আমি কিন্তু এর বেশি আর কিছুর সন্ধান পাইনি। এবং তাও জানি না আর বেশি খবর পাওয়ার জন্য কোথায় যে আমাকে যেতে হবে।

আপনি যে বলেছিলেন আপনার ধর্মকন্যা সিলিয়ার একটি ছোটো ভাই ছিল?

হ্যাঁ তার নাম এডওয়ার্ড। মনে আছে একবার কী দুবার তাকে স্কুলে যেতে দেখেছিলাম তাও অনেক বছর আগে। সে এখন কোথায় আছে জানেন?

আমার ধারণা কানাডার বিশ্ববিদ্যালয়ে। অথবা সেখানে ইনজিনিয়ারিং কোর্স নিচ্ছে, আপনি কি সেখানে যেতে চান? এবং ব্যাপারটা তার কাছ থেকে জানতে চান?

না, এই মুহূর্তে নয়। আমি শুধু জানতে চাই সে এখন কোথায়? কারণ আমি শুনেছি সেই আত্মহত্যার সময় সে বাড়িতে সেসময় ছিল না।

আপনি কি একটু সময়ের জন্য ভাবছেন না যে সে এ কাজ করতে পারে? এবং তার বাবা মাকে গুলি করতে পারে? আমি জানি সেই বয়সে কখনও কখনও ছেলেরা সেরকম কিছু একটা করতে পারে।

কিন্তু সে তো সেই সময় বাড়িতে ছিল না, বললেন পোয়ারো। সে খবর আমি আমার পুলিশি রিপোর্ট থেকে ইতিমধ্যেই পেয়ে গেছি।

আপনি আর কোনো আকর্ষণীয় কিছু পেয়েছেন? কারণ আপনাকে খুব উত্তেজিত দেখাচ্ছে।

আমি উত্তেজিত ঠিকই। আমি কয়েকটা ঘটনার কথা জানতে পেরেছি যা আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি এবং তার ওপর আলোকপাত করতে পারে।

ঠিক আছে বলুন না কীসের ওপর আলোকপাত করতে পারে?

এখন আমি বুঝতে পারছি মিসেস বারটন কক্স কেন র‍্যাভেন্সদের আত্মহত্যার ব্যাপারে খোঁজ নেওয়ার জন্য আপনার কাছে আবেদন করেছিলেন?

আপনি বলতে চাইছেন পরের ব্যাপারে নাক গলানোর মতো মহিলা তিনি নন?

না। আমার ধারণা এর পিছনে কোনো মোটিভ থাকতে পারে আর সেটা হল কোথা থেকে টাকা আসতে পারে?

টাকা? এর সঙ্গে টাকার কী সম্পর্ক? আর তার নিজেরই তো প্রচুর টাকা আছে তাই না?

হ্যাঁ তার জীবন ধারণের জন্য যথেষ্ট টাকা আছে। তার দত্তক পুত্রকে তিনি নিজের ছেলে বলে মনে করেন। সে শুধু জানে তাকে দত্তক নেওয়া হয়েছে। কোনো পরিবার থেকে সে এসেছে যদিও সে কিছুই জানে না। হয়তো তার মার পীড়াপীড়িতে একটা নির্দিষ্ট বয়সে সে উইল করে থাকবে। অথবা মিসেস বারটন কক্সের বন্ধুরা তাকে ইঙ্গিত দিয়ে থাকবে। কিংবা কোনো উঁকি যার সঙ্গে পরামর্শ করে থাকবেন। ছেলেটিও হয়তো সেই বয়সে এসে পৌঁছে ভেবে থাকবে, তারও সব কিছু তার মায়ের জন্য রেখে যাওয়া উচিত আর সেই সময় সম্ভবত তার অর্থ উত্তরাধিকার হওয়ার মতো অন্য কেউ তার ছিল না।

কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না আত্মহত্যার বিস্তারিত খবর নিতে চাওয়ার মধ্যে কী সম্পর্ক থাকতে পারে?

আপনি বুঝতে পারছেন না? মিসেস বারটন কক্স তার ছেলেকে বিয়েতে উৎসাহ দিতে চাইছেন না। ডেসমন্ডের একটি মেয়ে বন্ধু আছে। ভবিষ্যতে সে যদি তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় যেমন এখন বহু যুবকেরা করে থাকে। আর তারা এ-ব্যাপারে না-পারে অপেক্ষা করতে না-পারে চিন্তা করতে। এবং সে ক্ষেত্রে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে যে ডেসমন্ড যে অর্থ রেখে যাবে তিনি সেটার উত্তরাধিকারিণী হতে পারছেন না, কারণ ছেলেটি বিয়ে করা মাত্র আগের উইল বাতিল হয়ে যাবে এবং যদি সে তার পছন্দমতো মেয়েকে বিয়ে করে সে তখন তার নতুন উইলে তার সব কিছু তাকে দিয়ে যাবে, তার পালিতা মাকে নয়।

ও তাই জন্য আপনি মনে করেন মিসেস বারটন কক্স সেটা চান না?

হ্যাঁ ঠিক তাই, তিনি এমন কিছু একটা খুঁজে বার করতে চান যা তাকে সেই মেয়েটিকে বিয়ে করতে নিরুৎসাহ করতে পারে। আমার অনুমান তিনি আশা করেন এবং বিশ্বাসও করেন সিলিয়ার মা তার বাবাকে হত্যা করেছে। পরে সে নিজে নিজেকে গুলি করে। এমনকি মেয়েটির বাবা যদি তার মাকে হত্যা করে থাকে তবু সেটাও নিরুৎসাহের কারণ হতে পারে। এই বয়সে ছেলেটির ওপর এ-ব্যাপারটা প্রভাব ফেলতে পারে।

আপনি কি তার মানে বলতে চান মেয়েটির বাবা অথবা মা যদি খুনি হন তাহলে মেয়েটির মধ্যেও খুন করার প্রবণতা থাকবে?

স্বাভাবিকভাবে তা না হলেও ওটা একটা ধারণা হতে পারে বলে আমার মনে হয়।

কিন্তু ছেলেটি তো বড়োলোক নয়? একজন দত্তক পুত্র?

ছেলেটি তার মার সত্যিকারের নাম কি জানে না এবং তিনি যে কে তাও সে জানে না। কিন্তু তার অভিনেত্রী ও পপ সঙ্গীত শিল্পী মা মৃত্যুর আগে প্রচুর অর্থ করে যান এবং এক সময় তিনি তাঁর ছেলেকে ফেরতও চান। কিন্তু মিসেস বারটন কক্স সেই প্রস্তাবে রাজি হননি। তাই আমার অনুমান তিনি তখন এই ছেলেটির কথা চিন্তা করেন এবং সিদ্ধান্ত নেন যে, তার সমস্ত অর্থ তাকে দিয়ে যাবেন। এবং ছেলেটি তার পঁচিশ বছর পূর্ণ হওয়ার পর সেই অর্থের উত্তরাধিকারী হবে। আর সেই সময় পর্যন্ত তাঁর সব অর্থ একটা ট্রাস্টের কাছে গচ্ছিত রাখা থাকবে। অতএব মিসেস বারটন কক্স এখন অবশ্যই চাইতেন না যে, তার পছন্দমতো মেয়েকে বিয়ে করুক। বরং তিনি কেবল চাইবেন তার পছন্দমতো মেয়েকে বিয়ে করুক সেযার ওপর তার প্রভাব থাকতে পারে।

হ্যাঁ। এটা আমার কাছে খুব যুক্তিপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে, তিনি মোটেই একজন ভালো মহিলা নন। তাই তো?

না, বললেন পোয়ারো। আমি তাকে খুব ভালো মহিলা বলে মনে করি না।

বেশি মেলামেশা করলে যদি আপনি তার স্বরূপ জেনে ফেলেন আর সেই কারণেই তিনি চান না যে আপনি তার সঙ্গে দেখা করেন।

তাই হবে হয়তো, বললেন পোয়ারো।

আর কিছু আপনি জানতে পেরেছেন?

হ্যাঁ মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে কয়েকটা ছোটোখাটো ব্যাপারে সুপারিনটেন্ডেন্ট আমাকে ফোন করেছিলেন। সেই ফোনের উত্তরে আমি তাকে একটা প্রশ্ন করি। প্রত্যুত্তরে তিনি আমাকে বলেন যে, বয়স্ক হাউসকিপার চোখে ভালো দেখতে পান না।

পোয়ারো বললেন, হতে পারে। এই বলে তিনি তাঁর ঘড়ির দিকে তাকালেন। তিনি আবার ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন, আমার এখন যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। আমি চললাম।

আপনি কি এখন প্লেন ধরার পথে?

না, আমার প্লেন কাল সকালের আগে ছাড়ছে না। কিন্তু একটা জায়গায় আজই যেতে হচ্ছে কারণ সেই জায়গাটা আমার নিজের চোখে দেখতে হবে।

কৌতূহলের সঙ্গে মিসেস অলিভার জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কী দেখতে চান সেখানে?

খুব একটা বেশি কিছু দেখার অথবা অনুভব করার মতো কিছু নেই। ঠিক কথাটা হল উপলব্ধি করা এবং বোঝবার চেষ্টা করা। আমি কি অনুভব করতে পারি।

.

ছোট্ট নাটিকা

চার্চইয়ার্ডের গেটের ভেতরে দিয়ে একটা পথ ধরে এগিয়ে চললেন এরকুল পোয়ারো। শেওলা পড়া দেওয়ালের সামনে একসময় থামলেন। কয়েক মিনিটের জন্য একটা কবরের দিকে তাকালেন। তারপর তিনি তাকালেন অদূর সমুদ্রের দিকে। তিনি তার দৃষ্টি আবার ফিরিয়ে নিলেন কবরের দিকে। বন্য ফুলের একটা গুচ্ছ হয়তো কোনো বাচ্চা ছেলে রেখে দিয়ে থাকবে। কিন্তু পোয়ারো মনে করেন এটা কোনো বাচ্চা ছেলে ফেলে রেখে যেতে পারে না। কবরের ওপর লেখা অক্ষরগুলো তিনি পড়লেন।

এদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে

ডরোথি গ্যারো
মৃত্যু : ১৫ই সেপ্টেম্বর ১৯৬০
এবং
মার্গারেট র‍্যাভেন্সক্রফট
মৃত্যু : ৩রা অক্টোবর ১৯৬০। ওপরে মহিলার বোন এবং এ্যালিয়েস্টার র‍্যাভেন্সক্রফট।
মৃত্যু : ৩রা অক্টোবর ১৯৬০ ওঁর স্বামীর মৃত্যুতেও ওঁরা বিচ্ছিন্ন হননি।

আমাদের অসঙ্গতভাবে হস্তক্ষেপের জন্য ক্ষমা করবেন আমাদের। যেন আমরা ক্ষমা করি তাদের যারা অসঙ্গতভাবে আমাদের বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ করে–

প্রভু, আমাদের ওপর দয়া করুন।
যিশু আমাদের ওপর দয়া করুন।
প্রভু, আমাদের ওপর দয়া করুন।

কিছুক্ষণের জন্য সেখানে দাঁড়ালেন। তারপর চাচঁইয়ার্ড ছেড়ে এসে ফুটপাথ ধরে হেঁটে চললেন যে পথ গিয়ে মিশেছিল সেই পাহাড়ে বা পাহাড়ের কোণ বরাবর। তিনি আবার তাকালেন সমুদ্রের দিকে আপন মনে বলে উঠলেন

আমি এখন নিশ্চিত হয়ে গেছি সেদিন কী ঘটেছিল আর কেনই বা সেটা ঘটেছিল। এবং সেই বেদনাদায়ক ঘটনার দুঃখবোধ আমি বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারি। এই দীর্ঘ পথ সবাইকে পরিক্রম করতে হয়। আমার শেষেতেই আমার শুরু, আবার কেউ বলে আমার শুরুতেই আমার দুঃখদায়ক ঘটনা দিয়ে শেষ। সেই সুইস মেয়েটি নিশ্চয়ই সব জানে। ও আমাকে বলবে কি? ছেলেটির বিশ্বাস অন্তত ওদের খাতিরে বলবে। সেই মেয়েটি ও সেই ছেলেটির জন্য। এবং ওরা সেটা না জানা পর্যন্ত এ ওকে গ্রহণ করতে পারে না। আর গ্রহণ করতে পারে না ওদের জীবনকে।

.

 ম্যাডি এবং জেলি

মাথাটা নিচু করে পোয়ারো বললেন, মাদমোয়াজেল রাউজেল।

মাদমোয়াজেল রাউজেল তার হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। বয়স প্রায় পঞ্চাশ হবে। একটু উদ্ধত। ওঁর নিজস্ব একটা পথ আছে। তিনি বুদ্ধিমতী, বুদ্ধিজীবী এবং সন্তুষ্ট, পোয়ারো ভাবলেন। পোয়ারোর মনে হল তিনি একইসঙ্গে জীবনের আনন্দ এবং দুঃখবোধ অনুভব করছেন।

রাউজেল বললেন, আমি আপনার নাম শুনেছি। এ দেশে আর ফ্রান্সে আপনার অনেক বন্ধু আছে জানেন। আপনার জন্য আমি কী করতে পারব জানি না। আপনার চিঠিতে আপনি যেটা ব্যাখ্যা করেছেন সেটা কোনো অতীতের ব্যাপার তাই না? যে ঘটনাটা ঘটে গেছে সেই ঘটনার ক্ল আপনি জানতে চান যা আজ থেকে অনেক বছর আগে ঘটেছিল। বসুন আপনি। আপনি ক্লান্ত আর টেবিলের ওপর সুরাপাত্র রয়েছে একটু পান করে জিরিয়ে নিন। পোয়ারোর মনে হল ভদ্রমহিলা বেশ অতিথিপরায়ণা, কারণ কোনো ব্যস্ততা নেই বা কোনো চিন্তা নেই। অথচ বেশ মিশুকে।

একটা সময়ে আপনি এক পরিবারে গভর্নেস ছিলেন এবং সেই ঘটনা যখন ঘটেছিল আপনি যুবতী ছিলেন। আর আমি দেখেছি সেই পরিবারে একটি মেয়ে ও একটি ছেলে ছিল এবং তাদের বাবা আর্মিতে জেনারেল পদে উন্নতি লাভ করেছিলেন।

সেই পরিবারে কিন্তু একটি বোনও ছিল।

হ্যাঁ আমার মনে আছে। আমি যখন সেখানে গিয়েছিলাম তখন তিনি সেখানে ছিলেন না। আমার অনুমান তিনি একটু জটিল প্রকৃতির ছিলেন এবং তাঁর স্বাস্থ্য ভালো ছিল না। তিনি যেন চিকিৎসার জন্য কোথায় গিয়েছিলেন।

আচ্ছা আপনি কি তাদের স্মৃশ্চিয়ান নামগুলো জানেন?

মার্গারেট বলে একজনের নাম মনে হয়। আর একজনের নাম এখন আমার আর মনে নেই।

তিনি বললেন, ডরোথি।

হ্যাঁ। যার সঙ্গে আমার খুব একটা পরিচয় ছিল না। তবে তারা পরস্পরের ছোট্ট নাম ধরে ডাকাডাকি করত। মলি আর ডলি। আর সেটা জানেন তো তাঁরা ছিলেন যমজ বোন। একই রকম দেখতে ছিলেন দু-জনে এবং দুজনেই দেখতে খুব সুন্দরী ছিলেন।

আচ্ছা তারা পরস্পর পরস্পরকে ভালোও বাসতেন তাই তো?

হ্যাঁ, তাঁরা পরস্পর পরস্পরের অনুরক্ত ছিলেন। আমি যে দুটি ছেলেমেয়েদের পড়াতে যেতাম তাদের নাম প্রেস্টন গ্রে ছিল। ডরোথি প্রেস্টন গ্রে একজন মেজরকে বিয়ে করেছিলেন। এখন নামটা ঠিক মনে করতে পারছি না। মার্গারেটের বিবাহিত নামটা কী ছিল যেন

পোয়ারো বললেন, র‍্যাভেন্সক্রফট।

হ্যাঁ হ্যাঁ। অদ্ভুত নামগুলো। কিছুতেই মনে রাখা যায় না। মার্গারেট প্রেস্টন গ্রে এখানকার একটা মহিলা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ওঁর বিয়ের পর মাদাম বেনয়টকে চিঠি লেখেন এবং বলেন যদি কোনো গভর্নের্স তার জানা থাকে তিনি যেন ওঁর কাছে পাঠিয়ে দেন। আর তখন আমাকে সুপারিশ করা হয়। এবং সেই সূত্র ধরেই আমি সেখানে যাই। আমার শুধু অপর বোনের সঙ্গেই কথা হত। কারণ আমার কার্যকলাপের সময় তিনি সেখানে থাকতেন। মেয়েটির তখন বয়স ছিল ছয় কিংবা সাত আর তার নাম দেওয়া হয়েছিল শেক্সপিয়ার থেকে। নাম ছিল রোজালিণ্ড বা সিলিয়া। আর ছেলেটির বয়স ছিল মাত্র তিন বা চার তার নাম ছিল এডওয়ার্ড। সে ছিল খুব দুষ্টু তবে চেহারা ছিল মিষ্টি। তাদের সঙ্গে আমি বেশ সুখেই ছিলাম।

আমি শুনেছি আপনাকে পেয়ে তারাও খুব সুখে ছিল।

ওদের সাথে একাত্ব হয়ে গিয়েছিলাম আমি, বললেন, মাদমোয়াজেল।

আমার বিশ্বাস ওরা আপনাকে ম্যাডি বলে ডাকতো। এই কথা শুনে হাসলেন তিনি।

ওরা যে আমাকে ওই নামে ডাকত আমিও তা খুব পছন্দ করতাম। সেটা আমাকে অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যেত।

আচ্ছা আপনি কি ডেসমন্ড বারটন কক্স নামে কোনো ছেলেকে চেনেন?

হ্যাঁ মনে আছে। ছেলেটি হয় ওদের পাশের বাড়ি নয় তার পরের বাড়িতে থাকত। যেখানে অনেক প্রতিবেশী ছিল। আমাদের আর তাদের ছেলেমেয়েরা সবাই একসঙ্গে খেলাধুলা করত।

আপনি কি সেখানে অনেক দিন ছিলেন মাদমোয়াজেল?

না, আমি সেখানে মাত্র তিন থেকে চার বছর ছিলাম। আমার মা অসুস্থ হওয়ার জন্য এবং তাঁকে সেবা শুশ্রূষা করবার জন্য আমি দেশে ফিরে আসি। সেখানে ফিরে যাওয়ার দেড় কী দু বছর পরেই তিনি মারা যান। তারপর আমি নিজেই বয়স্কা মহিলাদের বিভিন্ন ভাষা শেখানোর জন্য একটা প্রতিষ্ঠান খুলি। যদিও এক কী দু-বছর সেই দেশের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছিলাম কিন্তু ইংলন্ডে আর যাইনি।

জেনারেল র‍্যাভেন্সক্রফট এবং তার স্ত্রীর দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল বলে কি আপনার মনে হয়?

অন্তত খুশি ছিলেন তারা। তাঁরা তাঁদের ছেলেমেয়েদেরও খুব প্রিয় ছিলেন এবং তিনিও ওদের খুব ভালোবাসতেন। এক কথায় বলা যায় ওঁরা দু-জন যেন পূর্ণ কবিতা। যার মধ্যে সুর আছে, ছন্দ আছে। সুতরাং তাদের বিয়েটা যে সফল তা বলা যায়।

আপনি বলছেন লেডি র‍্যাভেন্সক্রষ্ট তার যমজ বোনের প্রতি অনুগত ছিলেন।

আমি সেই যমজ বোনটার কথা ভাবছিলাম। সেই জন্যই বোধহয় কেন জানি না ভদ্রমহিলাকে দেখেই একটা দুঃখবোধ অনুভব করি। তিনি ছিলেন ঈর্ষাপরায়ণ মহিলা। আমি জেনেছি একসময় তিনি মনে করতেন তিনি যেন জেনারেল র‍্যাভেন্সক্রফট-এর বাগদত্তা। জেনারেল প্রথমে তার প্রেমে পড়ে যান এবং পরে সব প্রেম ও ভালোবাসা ঘুরে যায় যমজ বোনের দিকে। আমি মনে করি জেনারেলের এই পরিবর্তন খুব সৌভাগ্যের কথা। কারণ মলি র‍্যাভেন্সক্রফট সুন্দরী ও মিষ্টি স্বভাবের মহিলা ছিলেন। আর ডলির ব্যাপারে আমি দেখেছি তিনি কখনও তার বোনকে আদর করছেন ও ভালোবাসছেন আবার কখনও ঘৃণা করছেন ও ঈর্ষা প্রকাশ করছেন। তার ঈর্ষা এত বেশি ছিল যে, তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন যমজ বোনের ছেলেমেয়েদের আর স্নেহ করবেন না। তবে আমার মনে হয় এ-ব্যাপারে আরও বেশি ভালো করে বলতে পারবে মাদমোয়াজেল মিউহোরাট। তিনি এখন লওসেনে থাকেন। আমি চলে আসার দেড় কী দু-বছর পর র‍্যাভেন্সক্রফটদের কাছে তিনি যান। বেশ কয়েক বছর সেখানে ছিলেন। আমার বিশ্বাস সিলিয়া যখন বিদেশে তিনি তখন লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট-এর সঙ্গিনী হয়ে আবার ফিরে আসেন। তাঁর ঠিকানা আমার কাছে আছে।

আমি সেখানেও যাব, বললেন পোয়ারো।

উনি অনেক কিছুই জানেন, যা আমি আবার জানি না। তিনি একজন সুন্দর এবং বিশ্বাসযোগ্য মহিলা। সেই ভয়ঙ্কর বেদনাদায়ক ঘটনাটায় যা ঘটেছিল কেউ যদি কিছু জেনে থাকে তাহলে কেবলমাত্র তিনিই জানবেন সেই দুর্ঘটনার ব্যাপারে। তিনি আমাকে কখনও কিছু বলেননি আর আপনাকেও বলবে বলে মনে হয় না। তিনি বলতেও পারেন আবার নাও বলতে পারেন কারণ তিনি বড়ো চাপা স্বভাবের মেয়ে।

মাদমোয়াজেলের দিকে তাকিয়ে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়েছিলেন পোয়ারো, মাদমোয়াজেল রাউজেল সম্পর্কে তার ধারণা ভালো হয়েছিল। রাউজেলের মতো অত উদ্ধত তিনি নন। যে মহিলাটি তাকে অভ্যর্থনা করার জন্য তার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন তার তুলনায়। তিনি ভাবলেন তার থেকে কম করে দশ বছরের ছোটো হবেন এবং তার অভিব্যক্তি একেবারে আলাদা ধরনের। যে চোখ দিয়ে তিনি আপনাকে দেখেন আবার সেই চোখ দিয়েই নিজেই আপনার সম্পর্কে একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন সঙ্গে সঙ্গে। এবং যখনি আপনাকে আহ্বান জানানোর ইচ্ছা প্রকাশ করবেন তখন তার চোখের দৃষ্টি হয়ে যাবে শান্ত ও প্রতীক্ষারত। তবে অযথা তিনি নরম মনোভাব দেখাবেন না। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে মেয়েটির সম্পর্কে একটা ধারণা করে নেওয়া কম উল্লেখযোগ্য নয়। মাদামোয়াজেল, আমি এরকুল পোয়ারো।

জানি, আমি আপনাকে আজ, অথবা আগামীকালের জন্য অপেক্ষা করে আছি।

আপনি কি আমার চিঠি পেয়েছেন?

না, তবে সন্দেহ নেই। সেটা এখনও তাকেই পড়ে আছে। অন্য একজনের কাছ থেকে আমি একটা চিঠি পেয়েছি।

সিলিয়া র‍্যাভেন্সক্রফট কি চিঠিটা দিয়েছে?

না, চিঠিটা দিয়েছে সিলিয়ার এক বিশেষ ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একজন যুবক তাকে আমরা যেমন করেই মনে করি না কেন তার নাম ডেসমন্ড বারটন কক্স। আমার এখানে যে আপনি আসবেন খবরটা আগে দিয়ে সে আমাকে প্রস্তুত করে রেখেছে।

ও তাই বুঝি! ছেলেটি তো খুব বুদ্ধিমান। আর একটুও সে সময় নষ্ট করেনি বলে মনে হয় এবং তার প্রয়োজনটা খুব জরুরি মনে করে আমি চলে এলাম আপনার সঙ্গে দেখা করতে।

আমি জেনেছি একটা গোলমালের কথা এবং সেই গোলমাল সে মেটাতে চায়। চায় সমাধান করতে এবং সিলিয়াও তাই চায়। তারা কিন্তু মনে করে যে, আপনি তাদের সাহায্য করতে পারেন, কি পারেন না?

আর হ্যাঁ তারাও মনে করে আপনিও আমাকে সাহায্য করতে পারেন।

তারা কিন্তু পরস্পরকে ভালোবাসে এবং বিয়ে করতে চায়।

কিন্তু তাদের বিয়ের পথে একটা বাধা হয়ে আছে।

আমার মনে হয় ডেসমন্ডের মা। সেই রকম কথাই ছেলেটি আমাকে বলেছে।

সিলিয়ার জীবনকে কেন্দ্র করে এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে এবং এমন একটা ঘটনা ঘটে গেছে যে কারণে ভদ্রমহিলা তার ছেলের সঙ্গে এই মেয়েটির বিয়ে দিতে রাজি হচ্ছেন না।

আহা, সেই বেদনাদায়ক ঘটনার জন্য?

হ্যাঁ, সেই বিয়োগান্ত ঘটনার জন্যই। ডেসমন্ডের মা সিলিয়ার ধর্মমাকে অনুরোধ করেছেন কিছু বলার জন্য যে, কোন পরিস্থিতিতে সেই জোড়া আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছিল?

মাদামোয়াজেল মিউহোরাট বললেন, তার কোনো মানে হয় না। তারপর তিনি পোয়ারোকে বসতে বললেন। আচ্ছা সিলিয়া তার ধর্মমাকে কিছুই বলতে পারেনি নিশ্চয়ই? মিসেস অ্যারিয়াডন অলিভার তো ঔপন্যাসিক তাই তো? হ্যাঁ, আমার মনে আছে সিলিয়া এ-ব্যাপারে তাকে কিছু খবরই দিতে পারে না কারণ সে নিজেই তো কিছু খবর পায়নি।

যখন দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছিল তখন মেয়েটি সেখানে ছিল না। আর কেউই এ-ব্যাপারে তাকে কিছুই বলেননি, তাই না?

হ্যাঁ ঠিক তাই, তখন মনে করা হয়েছিল কিছু না বলাই ভালো।

এই সিদ্ধান্ত আপনি মনোনীত করেন, না কি করেন না?

এ-ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলা মুশকিল। খুব কঠিন ব্যাপার। সত্যি কথা বলতে কী এতদিন পরেও আমি ঠিক নিশ্চিত হতে পারিনি। এবং সিলিয়াও কখনও চিন্তিত হয়নি এ-ব্যাপারে। আমি বলতে চাইছি তার কখনও মনে হয়নি কেন বা কীভাবে সেটা ঘটেছিল? সবাই যেমন প্লেন বা মোটর দুর্ঘটনা মেনে নেয় সিলিয়াও ঠিক তেমনভাবে দুর্ঘটনাটা মেনে নিয়েছিল। বিদেশে সে অনেক বছর একটা মহিলা বোর্ডিং-এ একা কাটায়।

আমার ধারণা মাদমোয়াজেল মিউহহারাট, সেটা আপনি চালাতেন তাই না?

হ্যাঁ। সম্প্রতি আমি অবসর নিয়েছি আর আমার একজন সহকর্মিণী সেটা এখন চালাচ্ছে। সেই সময় সিলিয়াকে আমার কাছে পাঠানো হয় এবং বলা হয় আমি যেন একটা ভালো জায়গা খুঁজে দিই যেখানে থেকে ও পড়াশুনা করতে পারবে। তার জন্য আমি অনেক জায়গায় সুপারিশ করতে পারতাম কিন্তু তাকে আমি আমার কাছেই রেখে দিই।

আচ্ছা সিলিয়া আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করেননি।

না। সেই দুর্ঘটনাটা ঘটনার অনেক আগের ঘটনা এটা। ওহো আচ্ছা, আমি ঠিক বুঝতে পারিনি।

সেই দুর্ঘটনা ঘটার কয়েক সপ্তাহ আগে সিলিয়া এখানে এসেছিল। এবং তখন আমি এখানে ছিলাম না কারণ জেনারেল ও লেডি র‍্যাভেন্সক্রফটদের কাছে আমি ছিলাম। তখন আমি সিলিয়ার গভর্নের্স থেকে লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট-এর সঙ্গিনী হিসাবে থাকতাম এবং সিলিয়া তখন বোর্ডিং স্কুলে ছিল। হঠাৎ তখন ব্যবস্থা করা হল যে, সিলিয়াকে সুইজারল্যান্ডে পাঠানো হবে, সেখান থেকে সে তার পড়াশুনা শেষ করব।

আমার মনে হয় লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট-এর স্বাস্থ্য ভালো ছিল না। তাই না?

না, মারাত্মক তেমন কিছু নয়। স্নায়ু দুর্বলতায় তিনি ভুগতেন। আর তা ছাড়া তার মনে নানান দুশ্চিন্তা ছিল।

আপনি কি মেয়েটির সঙ্গে ছিলেন?

এক বোন লওসেনে যার সঙ্গে আমি থাকতাম সেই সিলিয়াকে একটা স্কুলে ভর্তি করে দেয়। সে সেখানে পড়াশুনা শুরু করে এবং আমার ফেরার অপেক্ষায় থাকে। এবং আমি তিন কী চার সপ্তাহ বাদে সেখানে আবার ফিরে যাই।

আচ্ছা আপনি তো সেই দুর্ঘটনার সময় ওভারক্লিফে ছিলেন তাই না?

হ্যাঁ আমি ওভারক্লিফেই ছিলাম। প্রতিদিনের অভ্যাসমতো জেনারেল এবং লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট বেড়োতে যান কিন্তু দুঃখের কথা সেদিন তারা আর ফিরে আসেননি। গুলিবিদ্ধ হয়ে তাদের মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। এবং রিভলবারটা তাদের মাঝখানে পড়েছিল। তবে তাদের মধ্যে কে সব শেষে মারা যান সে ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ বা চিহ্ন পাওয়া যায়নি। দু-জনের দেহতেই গুলিবিদ্ধের ক্ষতস্থান দেখতে পাওয়া যায়। সুতরাং এক্ষেত্রে নিশ্চিত সমাধান হল একজোড়া আত্মহত্যা।

সে ব্যাপারে আপনার মনে কোনো রহস্যে সন্দেহ দানা বাঁধেনি?

পুলিশ যখন কোনো কারণ দেখতে পায়নি তখন আমিও সেটা বিশ্বাস করে নিই।

অস্ফুট স্বরে পোয়ারো বললেন, আহ!

কিছু মনে করবেন না। আপনি কি কিছু বললেন? প্রশ্ন করলেন মাদমোয়াজেল মিউহোরাট।

কিছু নয়। একটা কিছু আর যার ওপর আমি প্রতিফলিত করলাম।

মেয়েটির দিকে পোয়ারো তাকালেন। তিনি দেখলেন চাপা ঠোঁটে দৃঢ়তার চিহ্ন। ধূসর চোখ এবং ভাবলেশহীন মুখ। তবে নিজেকে সংযত করার একটা প্রয়াস দেখা গেল তার মধ্যে।

অতএব আপনি তাহলে এর থেকে বেশি আর কিছু বলতে পারবেন না?

আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন কত দিনের আগের ঘটনা। সুতরাং আর কিছু বলার থাকতে পারে না।

সেই সময় আপনার নিশ্চয়ই বেশ ভালো মনে ছিল?

হ্যাঁ ওরকম একটা দুঃখজনক ঘটনা কেউ কখনও পুরোপুরি ভুলতে পারে না।

আর আপনি এবিষয়ে একমত যে এর বেশি কিছু থাকলেও সিলিয়াকে বলা উচিত নয়?

কেন? আপনাকে তো আমি বলেছি এর বেশি কোনো খবর আমার জানা নেই।

সেই দুঃখজনক ঘটনা ঘটার আগে বেশ কিছু সময় যেমন চার কিংবা পাঁচ আবার ছয়ও হতে পারে আপনি ওভারক্লিফে ছিলেন, না?

তার থেকেও বেশি, আগে আমি সেখানে সিলিয়ার গভর্নের্স হিসাবে ছিলাম। সেই সময় সিলিয়া বিদেশের স্কুলে চলে গেলো এবং আমি চলে আসি লেডি র‍্যাভেন্সটকে সাহায্য করতে।

সেই সময় লেডি র‍্যাভেন্সক্রফটের যমজ বোন তো থাকতেন তাঁদের সঙ্গে তাই না?

হ্যাঁ, বিশেষ চিকিৎসার জন্য সেই সময় কিছুদিনের জন্য সেখানকার হাসপাতালে ছিলেন। একটু সুস্থ হওয়াতে তাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। চিকিৎসকের অভিমত হল সেই সময় যদি সে বাড়ির পরিবেশ এবং আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে থাকেন তাহলে তার সাধারণ জীবন অনেক ভালোভাবে কাটাতে পারবেন। সেই সময় সিলিয়া ছিল স্কুলে। তাই লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট ভেবেছিলেন তার বোনকে নিয়ে এসে রাখলে তাকে একটু দেখাশুনা করতে পারবেন।

তারা দুই বোন পরস্পরের প্রিয় ছিল?

সেটা জানা খুবই মুশকিল, মাদমোয়াজেল মিউহহারাট বললেন। পোয়ারো যেন তার মনে একটা আগ্রহ জাগাল। জানেন তো আমি এত বেশি অবাক হয়েছিলাম যে, সে কথা আজও আমি ভুলতে পারি না। তারা ছিলেন যমজ বোন। তারা দুজনেই পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। এবং তাদের দুজনের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে মিল ছিল আবার এমন কতকগুলো পথ ছিল যেখানে তাদের মধ্যে একদম কোনো মিল ছিল না।

আপনি যা মনে করতে চাইছেন তা যদি একটু বুঝিয়ে বলেন আমি তাহলে খুশী হবো।

সেই বেদনাদায়ক ঘটনার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু আমি বলব আজকাল কেউ কেউ এইরকম মত প্রকাশ করে থাকে যে, মানসিক ভারসাম্য হারানোর পিছনে কিছু শারীরিক কারণও থেকে থাকে। আমার বিশ্বাস চিকিৎসকরা স্বীকার করবেন যে, যমজ ছেলেমেয়েদের জন্ম হয় একটা বিরাট একাত্মবোধ নিয়ে। পৃথিবীতে তাদের মধ্যে দৈহিক বিচ্ছিন্নতা ঘটলেও অন্য সব কিছুতেই তারা অভিন্ন, একই মনোভাবাপন্ন এবং তাদের আচার ব্যবহার, শিক্ষা-দীক্ষা পছন্দ-অপছন্দ চরিত্র পর্যন্ত একই রকম হয়ে থাকে যতই তারা ভিন্ন পরিবেশে বড়ো হোক। এবং এমনও দেখা যায় প্রায় একই সময়ে একই ঘটনা ঘটে থাকে তাদের জীবনে যে যেখানেই থাকুক না কেন। যেমন দুটি বোন। একজন ফ্রান্সে অপর জন ইংলন্ডে থাকেন। আবার তাদের দু-জনেরই কুকুর একই জাতের আর একই দিনে তারা সেটা পছন্দ করেছিল এবং এও দেখা যাবে প্রায় একই ধরনের পুরুষকে তারা বিয়ে করেছে আবার এর বিপরীত চিত্রও দেখা যায়। একটা আকস্মিক পরিবর্তন বিদ্বেষের পর্যায় বলা যেতে পারে, যা এক বোন আর একজনের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে পারে। তারা পরস্পর যেন পরস্পরের একই ধারা মানতে চায় না, অর্থাৎ আগে তাদের মধ্যে যে সব মিল ছিল তা আর রাখতে চায় না দু-জনের কেউ। এবং সেই মনোভাব একটা ভয়ঙ্কর পরিণতি এনে দেয় দু-জনের জীবনে।

পোয়ারো বললেন, সে কথা আমি শুনেছি এবং নিজের চোখে একটি কী দুটি ঘটনা ঘটতে দেখেছি। ভালোবাসা বিদ্বেষে পরিণত হয় সহজে। যাকে তুমি গভীরভাবে ভালোবাস তাকেই আবার তুমি ভয়ঙ্করভাবে ঘৃণাও করতে পারো।

আপনি সেটা জানেন? বললেন মাদমোয়াজেল মিউহোরাট। হ্যাঁ, আমি সেটা দেখেছি শুধু একবার নয়। বহুবার, লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট-এর বোন ছিলেন ঠিক সেই রকম।

কিন্তু আমার মনে হয় যদিও প্রায় সব দিক থেকে দৈহিক গঠন, চেহারা একই রকম তবে মুখের অভিব্যক্তি ছিল একেবারে অন্য ধরনের। তিনি ছিলেন অত্যন্ত কঠোর মনোভাবাপন্ন এবং লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট ছিলেন ঠিক তার উলটো। মনে হয় জীবনের শুরুতে গর্ভাবস্থায় তার এক সন্তানের মৃত্যু হয়। তিনি আর একটা সন্তান কামনা করেছিলেন এবং কখনও তার আর সন্তান হয়নি। তাই শিশুদের প্রতি তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিরূপ।

এবং তাতেই সেই ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে গিয়েছিল তাই না, বললেন পোয়ারো।

আপনাকে কেউ সে কথা বলেছে নাকি?

দুই বোন যখন মালয়েতে ছিলেন এবং যারা তাদের দুজনকেই ভালোভাবে জানতেন তাদের মুখ থেকেই শুনেছি। সেখানে লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট তার স্বামী ও বোনের সঙ্গে বেশ কিছুটা সময় ছিলেন। ডলি তাদের সঙ্গে থাকতে আসেন। এবং সেখানে একটি শিশুর দুর্ঘটনা ঘটে। এ-ব্যাপারে ধরে নেওয়া হয়েছিল ডলিই দায়ী। কিন্তু সেটা প্রমাণ করা যায়নি। কিন্তু আমি শুনেছি মলির স্বামী তার শালিকাকে ইংলন্ডে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। আর একবার তাকে মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়।

হ্যাঁ, যা ঘটেছিল এটা একটা ভালো নজির। আর আমার নিজের জ্ঞানে আমি সেটা জানতে পারিনি।

আমার মনে হয় এমন কতকগুলো ঘটনা আছে যা আপনি আপনার নিজের জ্ঞান দিয়ে উপলব্ধি করেছেন।

যদি তাই হয় যে সব ঘটনা একবার গ্রহণ করা হয়েছে সেগুলো খুঁচিয়ে টেনে না বার করাই উচিত।

সেদিন ওভারক্লিফে আর কিছু ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। যেমন একজোড়া আত্মহত্যা বা একটা খুনও হতে পারে অথবা আর অনেক কিছু হতে পারে। যা ঘটনা ঘটেছিল আপনাকে কি তাই তাই বলা হয়েছিল। কিন্তু একটা ছোট্ট কথা, যা আপনি এইমাত্র বললেন যে, যা ঘটেছিল আপনি সেটা জানেন এবং আপনার এই কথা থেকেই কি আমি মনে করে নিতে পারি যে, আপনি জানেন সম্ভবত কী ঘটেছিল বা অথবা ঘটতে শুরু করেছিল? সেই ঘটনার কিছু আগে সিলিয়া যখন সুইজারল্যান্ডে ছিল এবং আপনি তখন ওভারক্লিফেই ছিলেন। আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করব আর সেই প্রশ্নটা হল, সেই যমজ বোনেদের ক্ষেত্রে জেনারেল র‍্যাভেন্সক্রফট-এর মনোভাব কী ছিল।

আপনি কী বলতে চাইছেন আমি বুঝেছি।

এই প্রথম তার স্বভাব একটু পালটালো। আগের সেই সতর্ক ভাব আর নেই। ঝুঁকে পড়ে পোয়ারোর সঙ্গে এমন সহজভাবে কথা বললেন যে, কিছু বলতে পেরে নিজেকে অনেকটা হালকা বলে মনে করছেন।

ওঁরা দুই বোনই সুন্দরী ছিলেন। লোকের মুখ থেকে যা শুনেছিলাম তা হল জেনারেল র‍্যাভেন্সক্র প্রথমে ডলির প্রেমে পড়েন। ডলি ছিলেন মানসিক দিক থেকে বিপর্যস্ত। কিন্তু তিনি ছিলেন অতিরিক্ত আকর্ষণীয় এবং যৌন আকর্ষণ ছিল দেহ-মনে। জেনারেল তাঁকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। কিন্তু তারপর আর বলতে পারব না জেনারেল তার কোনো চরিত্রের দোষ ত্রুটি দেখতে পেয়েছিলেন কিনা। এমন কিছু ঘৃণ্য জাতীয় খুঁজে পেয়েছিলেন যা তাকে সতর্ক করে দিয়েছিল। জেনারেল তার মধ্যে পাগলামির সূচনা দেখতে পান এবং বিপদের সম্ভাবনা উপলব্ধি করেছিলেন। তাই কি তার কাছ থেকে সরে এসে তার বোন মলির প্রতি সব প্রেম, ভালোবাসা উজাড় করে দিয়েছিলেন? হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত তিনি মলির প্রেমে পড়ে যান এবং তাকে বিয়ে করেন।

আপনি তাহলে বোঝাতে চাইছেন যে, উনি দুই বোনকেই ভালোবাসতেন। একই সময়ে তা বলে নয়। আলাদা আলাদা সময়ে। এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই তার ভালোবাসা ছিল খাঁটি ও অকৃত্রিম।

হ্যাঁ, জেনারেল মলির প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। ওঁরা পরস্পর পরস্পরকে সমানভাবে বিশ্বাস করতেন এবং জেনারেল ছিলেন ভালোবাসার যোগ্য ব্যক্তি।

পোয়ারো হঠাৎ বলে উঠলেন, কিছু মনে করবেন না আমার মনে হয় তার সঙ্গে আপনারও ভালোবাসা ছিল।

আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি যে আপনি কী করে সাহস পেলেন এমন কথা বলার?

হ্যাঁ, একথা বলার সাহস আমার যথেষ্টই আছে। কিন্তু তা বলে আমি একথা বলছি না যে, আপনাদের মধ্যে প্রেমঘটিত কোনো ব্যাপার ছিল। আমি শুধু বলছি তাকে আপনি ভালোবাসতেন।

হ্যাঁ, তাকে আমি ভালোবাসতাম, আপনি যে অর্থে বলছেন আমি সেই অর্থেই বলছি এখনও তাকে আমি ভালোবাসি। এবং তাতে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। আমার ওপর তাঁর আস্থা ছিল এবং তিনি আমাকে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু তাই বলে তার সঙ্গে প্রেমঘটিত কোনো ব্যাপার ছিল না। আপনি কাউকে ভালোবাসতে পারেন এবং তার হয়ে কাজ করতে পারেন। কিন্তু তার কাছ থেকে ভালোবাসা আশা করবেন না। আমার মধ্যে আছে আস্থা, সহানুভূতি এবং বিশ্বাস–বললেন, জেলি মিউহোরাট।

তার জীবনে সেই ভয়ঙ্কর অবস্থায় আপনার সাধ্যমতো অনেক করেছিলেন। আমি জানি এমন কয়েকটা ব্যাপার আছে যা আপনি আমার কাছে লুকাচ্ছেন। তাহলে বরং আমিই আপনাকে বলব সেই ব্যাপারগুলো কি ছিল। বিভিন্ন খবরের উৎস থেকে এবং আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসার আগে পর্যন্ত যা যা খবর আমি শুনেছি তার কিছু কিছু আমি জানি। অন্যদের কাছ থেকে আমি শুনেছি শুধু যারা মলিকে নয় তারা ডলিকেও জানত। এবং ডলির ব্যাপারে আমিও কিছু জানি। তাঁর জীবনের দুঃখ, বেদনা এবং অসুখী এমনকি বিদ্বেষভাব এ-সবেরই মূল কারণ হল ব্যর্থ প্রেম। এই ব্যর্থতার জন্য নিশ্চয়ই তাঁর পরিবারের কেউ একজন দায়ী। যদি শোনা যায় তিনি যাকে ভালোবাসতেন সেই মানুষটি যদি বিয়ে করেন তারই বোনকে তাহলে আপনিই বলুন তার মানসিক অবস্থা তখন কী হতে পারে। হয়তো সেই কারণেই তিনি তাকে সহ্য করতে পারতেন না, ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু মলি র‍্যাভেন্সক্রফট কি তার বোনকে পছন্দ করতেন? অথবা তিনি কি তাকে ঘৃণা করতেন?

জেলি বললেন, ওহো না, তিনি তার বোনকে খুবই ভালোবাসতেন। তিনি সব সময় চাইতেন তার বোন তার কাছে থাকুক। তিনি বিপদের হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন তাঁর বোনকে, কারণ তিনি জানতেন বোনের মানসিক রোগটা যদি আবার দেখা যায় তাহলে বিপদ হতে পারে। আপনি আগেই বলেছেন যে, শিশুদের তিনি একদম সহ্য করতে পারতেন না। তার এই অদ্ভুত মানসিকতাই তাঁকে যন্ত্রণায় অতিষ্ট করে তুলত।

আপনি কি তাহলে বোঝাতে চাইছেন যে, সিলিয়াকে তিনি অপছন্দ করতেন?

না, সিলিয়াকে নয় ছোটো ভাই এডওয়ার্ডকে। দুবার দুর্ঘটনায় বিপদের মুখোমুখি হয়েছিল এডওয়ার্ড। আমি জানি এডওয়ার্ড যখন স্কুলে ফিরে যায় তখন মলি খুবই খুশি হয়েছিলেন। সে তখন ছিল খুবই ছোটো অর্থাৎ বয়স তখন তার আট কিংবা নয়।

পোয়ারো বললেন, হ্যাঁ আমি বুঝতে পারি। কিন্তু ধরুন এখন যদি আমি মাথায় ব্যবহার করার জন্য পরচুলের কথা আলোচনা করি? একজন মহিলার পক্ষে চারটে পরচুলের ঠিক মতন ব্যবস্থা করা অস্বাভাবিক নয় কি? এবং আমি এও জানি যখন তার আরও বাড়তি দুটো পরচুলের প্রয়োজন হল তখন একজন ফরাসি লেডিকে লন্ডনে একটা হেয়ার ড্রেসিংসপে লেডি র‍্যাভেন্সক্রক্ট পাঠান, এবং দুটো পরচুলের অর্ডার দেন। সেখানে একটা কুকুর ছিল এবং সেই দুর্ঘটনার দিন জেনারেল আর লেডি র‍্যাভেন্সটের সঙ্গে কুকুরটা বেড়োতে গিয়েছিল। বেশ কিছু দিন আগে কুকুরটা লেডি র‍্যাভেন্সক্রফটকে কামড়ে ছিল।

কুকুরদের কখনই বিশ্বাস করা উচিত নয়। হ্যাঁ এটা আমি জানি, বললেন জেলি।

আমি কী বলব সেদিন কী ঘটেছিল বা তার আগেই বা কী ঘটেছিল!

আচ্ছা আপনার কথা যদি আমি না শুনি?

আপনি হয়তো বলবেন আমি যা অনুমান করি তা মিথ্যে, কিন্তু আমার মনে হয় না আপনি তা বলবেন। আমি আপনাকে বলছি এখানে এখন কিসের প্রয়োজন–তা হল সত্য। একটি মেয়ে আর একটি ছেলে যারা পরস্পর পরস্পরের যত্ন নেয়, ভাবে এবং চিন্তা করে। তারা তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভীত কারণ যা ঘটেছে তা যদি সত্য হয় আর সেটা সত্য না হলেও মা কিংবা বাবার কৃতকর্মের প্রভাব কি তাদের ছেলে মেয়েদের ওপর পড়তে পারে? আমি ভাবছি মেয়েটির কথা। একটি অবাধ্য মেয়ে উদ্ধত মেয়ে বা বেপরোয়া মেয়ে একটু সুখের জন্য এবং সাহসের জন্য, কিন্তু প্রয়োজন বোধ করছে–সব মানুষই চায় নিরাপত্তা বোধ। আতঙ্কিত ভাব না থাকলেও তবু তারা মুখোমুখি হতে পারে। এবং মোকাবিলা করতে পারে। সাহসের সঙ্গে তারা সেটা গ্রহণ করে মোকাবিলা করে। এবং সেই সাহস আসবে আপনার জীবন থেকে। সেই ছেলেটিকে মেয়েটি ভালোবাসে। সেও তাকে প্রচণ্ডভাবে চায় আমার কথা আপনি শুনবেন নাকি? জেলি মিউহোরাট হ্যাঁ বললেন। আমি মনে করি আপনি অনেক ভালো বোঝেন? আমার ধারণা যা তার থেকেও বেশি আপনি জানেন সুতরাং আপনি বলুন আমি শুনব।

.

কোর্ট অফ এনকোয়ারি

যেখানে জেনারেল এবং লেডি র‍্যাভেন্সক্রফটের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল এবং একজন মহিলা ঘুমের ঘোরে হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ের ওপর থেকে পড়ে গিয়েছিলেন। ঠিক সেখানে আর একবার পাহাড়ের ওপর উঠলেন এবং নিচের দিকে তাকালেন। সুপারিনটেন্ডেন্টের প্রশ্ন কেন এসব ঘটনাগুলো ঘটেছে? কেন? এটা কোনো পথে নিয়ে গেছে?

প্রথম হয় একটা দুর্ঘটনা। তার তিন সপ্তাহ পরে হয় একজোড়া আত্মহত্যা। এটা কি পুরোন পাপের লম্বা ছায়া যার পরিসমাপ্তি বড়ো বেদনাদায়ক। এবং যার শুরু হয়েছিল আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে। দুটি ছেলেমেয়ে সত্য জানতে চায় এবং দুটো লোক সেই সত্যটা জানে। তাই আজ এখানে মানুষের একটা সভা হবে। সরু গলির পথ ধরে একটা বাড়ির দিকে এগিয়ে চললেন এরকুল পোয়ারো। যার নাম ছিল-ওভারফ্লিফ। তিনি দেখলেন বাড়িটার সামনে একটা গাড়ি পার্ক করা রয়েছে। বিশাল বাড়ি এবং সম্পূর্ণ খালি, এই সম্পত্তি বিক্রয়ের জন্য হাউজ এজেন্টের একটা বোর্ড ঝোলোনো রয়েছে। দুটি লোকের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য এগিয়ে গেলেন তিনি। ওরা তার দিকে এগিয়ে আসছিল। তাদের একজন হল ডেসমন্ড বারটন কক্স আর অপরজন হল সিলিয়া র‍্যাভেন্সক্রফট।

ডেসমণ্ড বললেন, হাউজ এজেন্টের কাছ থেকে একটা অর্ডার পেয়েছি। বাড়ির ভিতরে ঢাকার দরকার হতে পারে বলে চাবিও পেয়েছি। কিন্তু পাঁচ বছরে দু-বার হাত বদল হয়েছে। এই বাড়িটা। সুতরাং মনে হয় না সেখানে আর কিছু দেখার আছে। কি আপনার মনে হয় কিছু থাকতে পারে?

সিলিয়া বলল, আমার মনে হয় না কারণ ওটা অনেক লোকের হাত ঘুরে গেছে। প্রথম ক্রেতাকে তারা আর্চার বলে ডাকতেন, দ্বিতীয় ক্রেতাকে ফ্যালেফি বলত। তারা দুজনেই রয়েছে, জায়গাটা খুব নির্জন। এখন শেষে ক্রেতা আবার বাড়িটা বিক্রী করতে চাইছে, হয়তো কেউ তাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে। ডেসমন্ড প্রশ্ন করলেন আচ্ছা ওই ভূতুড়ে বাড়িতে আপনার বিশ্বাস আছে?

সিলিয়া বলল, সত্যি বলছি আমি মনে করি না, কিন্তু আমার মনে হয় এটা–একটা ঘটনা এবাড়ির থেকেই তো ঘটেছিল। আর সেই হিসাবে এই বাড়িটার একটা গুরুত্ব আছে এবং এখানকার সব কিছু

পোয়ারো বললেন, আমার তা কিন্তু মনে হয় না। কারণ এখানে এক সময়ে দুঃখ ছিল, মৃত্যু ছিল আর এখানে তখন ভালোবাসাও ছিল।

সেই সময় রাস্তা দিয়ে একটা ট্যাক্সিকে আসতে দেখা গেল।

সিলিয়া বললেন, আমার মনে হয় মিসেস অলিভার হয়তো এলেন। কারণ উনি বলেছিলেন ট্রেনে আসবেন এবং স্টেশন থেকে ট্যাক্সি ধরে নেবেন।

মিসেস অলিভার এবং তাঁর সঙ্গিনী ট্যাক্সি থেকে নামলেন। পোয়ারো জানতেন সেই মহিলাটি আসবেন তাই তাকে দেখে তিনি বিস্মিত হলেন না। তিনি শুধু সিলিয়াকে লক্ষ্য করছিলেন তার প্রতিক্রিয়া দেখবার জন্য।

সিলিয়া সেই মহিলাটিকে দেখে আনন্দে লাফিয়ে তাঁর কাছে ছুটে গেলেন। ওহো সত্যিই আপনি আমাদের সেই জেলি? আপনাকে দেখে আমি কী যে আনন্দ পেলাম তা আপনাকে বোঝাতে পারব না। আপনি যে এখানে আসছেন তাও জানতাম না।

মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো আমাকে আসতে বলেছিলেন।

সিলিয়া বললেন, তাই বুঝি? কিন্তু আমি জানি না

কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন তিনি। এদিকে মুখ ঘোরাতেই তিনি দেখলেন তাঁর পাশে এক যুবক দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা তুমি ডেসমন্ড না?

হ্যাঁ। জেলি নামে ওঁকে ডাকতে পারি কিনা সেটা জানার জন্য আমি চিঠি দিয়েছিলাম মাদমোয়াজেল মিউহোরাটকে।

জেলি বললেন, তোমরা দু-জনেই ও নামে আমাকে ডাকতে পারো। এখানে আসাটা বুদ্ধিমানের কাজ হল কিনা আমি জানি না। কিন্তু আমি তা আশা করি।

সিলিয়া বললেন, আমরা দুজনেই জানতে চাই ডেসমন্ড ভেবেছে আপনি অন্তত আমাদের কিছু বলতে পারেন।

জেলি প্রত্যুত্তরে বললেন, মঁসিয়ে পোয়ারো আমরা সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন এবং অনুরোধ করেছিলেন আজ এখানে আসার জন্য।

সিলিয়া মিসেস অলিভারের একটা হাত ধরে বললেন, আপনিও এখানে আসুন কারণ আপনি মঁসিয়ে পোয়াবোর সহযোগিতা পেয়েছেন এবং আপনি নিজেও কিছু তথ্য খুঁজে পেয়েছেন। তার জন্য কেসটা আপনি হাতে নিয়েছেন, কি নিয়েছেন তো?

মিসেস অলিভার বললেন, লোকেরা আমাকে বলেছে। সেসব লোককে মনে রাখতে বলেছিলাম সেই ঘটনার কথা তাদের মধ্যে কয়েকজন ঠিকই মনে রেখেছে। আবার কয়েকজন মনে রাখতে গিয়ে ভুল তথ্য দিয়েছে। আর সেটাই হল বড়ো বিভ্রান্তিকর। তবে সিয়ে পোয়ারো বললেন, সেটা কোনো ব্যাপার হবে না।

পোয়ারো বললেন, না। জনশ্রুতি কি সেটা জানাও জরুরী। ধরুন একজনের কাছ থেকে আপনি ঘটনার কথা জানলেন, যদি সেটা সঠিক ঘটনা নাও হয় তবুও আপনি শুনবেন। আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে ম্যাডাম, আপনাকে আমি যেভাবে বুঝিয়েছি এরা সেইসব লোকগুলো যাদের আপনি এক একটা হাতি বলে বর্ণনা করেছেন তাদের কাছ থেকে কিন্তু আপনি কিছু না কিছু জেনেছেন নিশ্চয়ই। এখন সেগুলোকে ভালোভাবে বুঝে উপলব্ধি করে সিদ্ধান্ত নিন। এই কথা বলে পোয়ারো হাসলেন।

হাতি? বললেন মাদমোয়াজেল জেলি।

পোয়ারো বললেন, উনি এই রকমই আখ্যা দিয়ে থাকেন।

মিসেস অলিভার ব্যাখ্যা করে বললেন, হাতিরা মনে রাখতে পারে। এই রকম একটা প্রবাদ আমি চালু করেছি। হাতিদের মতো মানুষও অনেকদিন আগের ঘটনার কথা মনে রাখতে পারে। তবে সব মানুষ নয়। এইভাবে আমি অনেক খবর সংগ্রহ করেছি। এবং এই খবরগুলো একত্রে করে মঁসিয়ে পোয়ারোর হাতে দিয়ে দিয়েছি। উনি যদি ডাক্তার হতেন তাহলে বলতাম রোগ নির্ণয় করতে।

পোয়ারো বললেন, অনেকদিন আগে কী ঘটেছিল তার যথা সম্ভব বিবরণ নিয়ে আমি একটা তালিকা তৈরি করেছি। আর এই তালিকার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমি আপনাদের পড়ে শোনাব আর দেখব আপনারা এসবের সঙ্গে জড়িত কিনা। অথবা আপনাদের কাছে এর কোনো গুরুত্ব আছে কিনা। হয়তো আপনাদের কাছে মামুলি বলে মনে হতে পারে।

সিলিয়া বললেন, সবাই জানতে চায় সেটা কি আত্মহত্যা বা খুনের ঘটনা? যদি ধরা হয় খুন হয়েছে তাহলে কি বাইরের কেউ আমার মা ও বাবাকে খুন করেছে? কোনো কারণে হয়তো তাদের গুলি করা হয়েছে। এই খুনের পিছনে কোনো মোটিভ থাকলেও থাকতে পারে যা আমরা জানি না। আমার সব সময়ে মনে হয় সেই ঘটনার পিছনে একটা কিছু অবশ্যই আছে যেটা খুঁজে বার করা খুবই মুশকিল

পোয়ারো বললেন, আমরা এখানেই থাকব। এখন বাড়ির ভিতর যাওয়ার দরকার নেই। যেহেতু অন্য লোকেরা এখানে বাস করে গেছে সেহেতু এখানকার আবহাওয়া অন্য রকমের। আমাদের এখানে কোর্ট অফ এনকোয়ারির কাজ শেষ হওয়ার পর যদি আমরা মনে করি তবে আমরা ভিতরে যাব।

ডেসমন্ড বললেন, তাহলে এটা কি কোর্ট অব এনকোয়ারির কাজ?

হ্যাঁ, সেদিন এখানে কী ঘটেছিল তা জানার জন্যই এই কোর্ট অফ এনকোয়ারি।

দুটোর মধ্যে যে কোনো একটা অবশ্যই সত্য, বললেন সিলিয়া।

আমি বলব যে, দুটোই সত্য। আমার ধারণা আমরা এখানে এসেছি কেবল একটা খুনের বা আত্মহত্যার ব্যাপার নয় একটা বেদনাদায়ক ঘটনাও আছে–এখানে দুটো মানুষের ট্র্যাজেডি, যাঁরা পরস্পরকে ভালোবাসতেন এবং প্রেমের জন্য যারা জীবন বিসর্জন দিলেন। ভালোবাসার ট্র্যাজেডি যে সবসময় রোমিও এবং জুলিয়েটের মতো হবে তা নয়, প্রেম ও ভালোবাসার দুঃখ বেদনা এবং ব্যর্থতার জন্য মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়ার একচেটিয়া অধিকার শুধুমাত্র যুবক যুবতীদের। কিন্তু প্রেমের বলির সামিল বয়স্করাও হতে পারে, এর মধ্যে তার থেকেও আরও বেশি কিছু থাকতে পারে।

আপনি কী বলতে চাইছেন আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না, সিলিয়া বললেন।

এখনও সময় হয়নি।

সিলিয়া আবার প্রশ্ন করলেন, আমি কি বুঝতে পারব?

পোয়ারো বললেন, আমার তাই মনে হয়। আমি আপনাদের বলব কী করে সেই ঘটনাটা ঘটেছে। এবং সেটা ঘটলই বা কি করে? প্রথম ব্যাপারটার ব্যাখ্যা সাক্ষ্য প্রমাণ নেই, পুলিশি রেকর্ড নেই। এমন কতকগুলো জিনিস আছে যা সাক্ষ্য প্রমাণের দরকার হয় না। যেমন মৃত মার্গারেট র‍্যাভেন্সক্রফট-এর ব্যবহৃত চারটি পরচুলের কথা। এবং একটু জোর দিয়ে পুনরায় বললেন, চার-চারটি পরচুল। সব সময়েই তিনি পরচুল ব্যবহার করতেন না, বিশেষ বিশেষ উপলক্ষে ব্যবহার করতেন। যেমন বাইরে বেড়োতে গেলে, সান্ধ্যভ্রমণের সময়। কারণ বাইরে বেরোলে চুলগুলো অবিন্যস্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

পোয়ারা বললেন, সেই বিশেষ দিনে এরকম একটা ফ্যাশনের চল ছিল। সাধারণত মানুষ বাইরে বেড়াতে গেলে একটা কিংবা দুটো চুল নিয়ে যেতো। কিন্তু তার কাছে ছিল চারটে পরচুল। আমার প্রশ্ন হল তার চারটে পরচুলের প্রয়োজন হল কেন? আমি যাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তার মাথায় যে টাক পড়ার প্রবণতা ছিল তা কিন্তু নয়। সেই বয়সে অন্য মহিলাদের মতোই ভালো রকমের চুল ছিল তার মাথায়। পরে জেনেছি একটা পরচুলে ধূসর রঙের দাগ ছড়িয়ে ছিল আর একটি ছিল কোঁকড়ানো, এবং অপর পরচুলটি তিনি তার মৃত্যুর দিন ব্যবহার করেছিলেন।

সিলিয়া জিজ্ঞেস করলেন, কোনোভাবে সেটা কি অর্থপূর্ণ হতে পারে? চারটের মধ্যে থেকে যে কোনো একটা পছন্দ করতে পারতেন কিন্তু তিনি তা না করে ওই বিশেষ পরচুলটি–

পুলিসের কাছে হাউজকিপার বলেছিল যে, তার মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ আগে থেকে তিনি ওই বিশেষ পরচুলটি ব্যবহার করতেন।

আমি কিন্তু এর কোনো অর্থ খুঁজি পাচ্ছি না। সুপারিনটেন্ডেন্ট গ্যারোওয়ে আমাকে একটা কথা বলেছিলেন–একই লোক, অন্য ধরনের টুপি, তার সেই উক্তিটা আমাকে ভাবিয়ে তোলে।

সিলিয়া কিন্তু সেই আগের কথার পুনরাবৃত্তি করে বললেন, আমি কিন্তু এর কোনো অর্থ দেখতে পাচ্ছি না।

পোয়ারো আরও বললেন, একটা কুকুরের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

কুকুর! কুকুর কী করেছিল?

সেই কুকুরটা মিসেস র‍্যাভেন্সক্রফটকে কামড়ে দিয়েছিল, সেই কুকুরটা কিন্তু তার খুব প্রিয়। এবং অনুরক্ত ছিল। জীবনের শেষ কয়েক সপ্তাহ কুকুরটা তাকে বেশ কয়েকবার আক্রমণ করে।

ডেসমন্ড এবার প্রশ্ন করলেন, তাহলে আপনি কি মনে করেন তিনি যে আত্মহত্যা করতে যাচ্ছেন কুকুরটা টের পেয়েছিল?

পোয়ারো বলেন, না, সেই কুকুরটা এমন কিছু জানত যা অন্য কেউ জানত না, সেই হাউজকিপার যে প্রায়ই অন্ধ ছিল এবং কানে কম শুনত সে নাকি একজন মহিলাকে মলি র‍্যাভেন্সটের পোশাক পরে থাকতে দেখেছিল এবং সেই প্রিয় পরচুলটি তার মাথায় লাগাতে দেখেছিল। এই ব্যাপারে হাউজকিপার বলেছিল তার মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ আগে তার মিস্ট্রেসকে কেমন যেন অন্য রকমের মহিলা বলে মনে হয়েছিল। একই লোক এবং অন্য ধরনের টুপি গ্যারোওয়ের সেই কথাটা মনে পড়ে যায় এবং নতুন একটা ভাবনার জন্ম হয়। যেমন একই পরচুল অথচ অন্য একজন মহিলা। কুকুরটি তার নাক দিয়ে বুঝেছিল এটা অন্য এক মহিলা যাকে সে ভালোবাসে তা সে নয়। এ সেই মহিলা যাকে সে অপছন্দ করত। আমার মনে হয় সেই মহিলা মলি র‍্যাভেন্সক্রফট ছিলেন না। কিন্তু কে হতে পারেন তিনি? তবে কি ধরে নেওয়া যায় তিনি ডলি ছিলেন? সেই যমজ বোন?

সিলিয়া প্রতিবাদ করে বলে উঠলেন, সেটা অসম্ভব।

না, সেটা অসম্ভব কিছু নয়। তারা ছিলেন যমজ বোন। মিসেস অলিভার আমাকে একটা কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন এবং সেই কথাটা তিনি শুনেছিলেন অন্য লোকের কাছ থেকে যারা ব্যাভেন্সক্রফটদের জানতেন। সেই কথাটা হল লেডি র‍্যাভেন্সক্রফট সেই সময় কিছুদিনের জন্য হাসপাতালে ছিলেন। খুব সম্ভব তিনি জেনে গিয়েছিলেন যে তার ক্যান্সার হয়েছে। ডাক্তারি পরীক্ষায় বোঝা যায় তার সেরকম কিছুই হয়নি। এরপর তার ও তার যমজ বোনের ইতিহাস জানতে পারি। তারা উভয়ই পরস্পরকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। তাদের সব কিছুই ছিল একইরকম, একই সময়ে অসুস্থ হয়ে পড়া বা প্রায় একই সময়ে দু-জনের বিবাহ করা, সম্ভবত দুই যমজ বোনের মধ্যে আলাদা বৈশিষ্ট্য আনার জন্য এবং যাতে করে তৃতীয় ব্যক্তি তাদের পরিচয় বুঝতে পারেন যে, কে ডলি বা কে মলি সেই জন্য একই ফ্যাশন এবং একই কায়দা না করে ওঁরা ঠিক বিপরীত ফ্যাশনে অভ্যস্ত হয়েছিলেন। আর তাছাড়া তাদের জীবনের শেষ দিকে এ ওকে অপছন্দ করার একটা মানসিকতাও গড়ে উঠেছিল। জেনারেল র‍্যাভেন্সক্রফট প্রথমে ডরোথি প্রেস্টন-গ্রের প্রেমে পড়েন, যমজ বোনের সেই ছিল বড়ো। কিন্তু কিছুদিন পরে সেই প্রেমের পাত্রী বদল হয়ে যায়। অর্থাৎ ডলির পরিবর্তে মলিকে ভালোবাসতে শুরু করেন। এবার তাকেই বিয়ে করেন এবং যেটা স্বাভাবিক যে দুই যমজ বোনের মধ্যে বিদ্বেষ সৃষ্টি হল। তাই এর ব্যাখ্যা হিসাবে আমার অনেক কিছুই মনে হয়েছে। ডরোথি হল একটা ট্র্যাজিক চরিত্র। সব সময়ে মানসিক দিক থেকে অস্বস্তিতে থাকতেন তিনি। কি কারণে কে জানে যা আজও অজানা। সেই ছোটোবেলা থেকে তিনি শিশুদের পছন্দ করতেন না। আবার এক সময় একটি শিশু হত্যার জন্য তিনিই দায়ী হয়ে পড়েন। অবশ্য সেটা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ ছিল, এবং সেই কারণেই সেই চিকিৎসক তাকে মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য সুপারিশ করেন এবং বেশ কয়েকবছর তাকে মানসিক হাসপাতালে থাকতে হয়। এর কিছুদিন পর তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। র‍্যাভেন্সক্রফট যখন মালয়েতে ছিলেন তখন তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। আর সেখানেই আগের একটা দুর্ঘটনা ঘটে। প্রমাণ না থাকলেও প্রতিবেশী সেই শিশুটির মৃত্যুর জন্য ডরোথিই দায়ী ছিলেন, জেনারেল তখন ডরোথিকে ইংলন্ডে নিয়ে আসেন এবং তাকে মানসিক চিৎকৎসার ব্যবস্থা করেন। তিনি আবার ভালো হয়ে ওঠেন। এবার মার্গারেট বিশ্বাস করলেন তার যমজ বোন চিরদিনের মতো সুস্থ হয়ে উঠেছে এবং তার দিকে সব সময় নজর রাখার জন্য তার কাছে নিয়ে আসলেন। তাতে জেনারেলের সম্মতি ছিল আমার বিশ্বাস হয় না। কারণ তিনি জানতেন জন্ম থেকে এধরনের রোগ চিরদিনের মতো নির্মূল হয় না। তার সব সময় আশঙ্কা ছিল ডলির দিক থেকে যদি আবার বিপদের সূচনা হয় এই ভয়ে।

ডেসমন্ড প্রশ্ন করলেন, তাহলে আপনি বলতে চাইছেন তিনিই র‍্যাভেন্সক্রফটদের গুলি করেছিলেন?

পোয়ারো বললেন, না, সেটা আমার সমাধান নয়। আমার ধারণা কী জানেন, ডরোথি তার বোন মার্গারেটকে হত্যা করেছিলেন। একদিন তারা দুজনে একসঙ্গে পাহাড়ের ওপর বেড়োতে যান। এবং মার্গারেটের অজান্তে ডরোথি ধাক্কা দিয়ে তাকে পাহাড় থেকে ফেলে দেন কারণ ব্যর্থ প্রেম। জীবনের হতাশা থেকে ডরোথি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিল, মার্গারেটের প্রতি তার হিংসা, ঘৃণা ও বিদ্বেষ জন্মায়। অবচেতন মনে মার্গারেটকে হত্যা করে বসেন। আমার অনুমান বাইরের একজন মানুষ এঘটনার কথা জানতেন। আমার ধারণা মাদমোয়াজেল, আপনি জানেন সেই ঘটনার সময় সেখানে কে ছিলেন?

জেলি মিউহোরাট বললেন, আমি জানি, আমি সেই সময় এখানে ছিলাম। তাদের সেই ছোট্ট ছেলে এডওয়ার্ডকে জখম করার পর থেকেই ডলির ব্যাপারে সব সময়ই তাদের চিন্তা হয়। এডওয়ার্ডকে লন্ডনে ফেরত পাঠানো হয় আর আমি এবং সিলিয়া সুইজারল্যান্ডে ফিরে যাই, দুই বোন একসঙ্গে বেড়াতে গেল। একজন ফিরল না অথচ ডলি ফিরে এলো। তাকে নার্ভাস দেখাচ্ছিল। ভিতরে এসে চায়ের টেবিলে বসে পড়লেন আর তখনই দেখলেন ডলির হাতে রক্তের দাগ। জেনারেল তাকে জিজ্ঞেস করেন যে তিনি কোথাও পড়ে গিয়েছিলেন কিনা। সঙ্গে সঙ্গে তিনি লাফিয়ে উঠলেন এবং বললেন, গোলাপ গাছের কাঁটায় হাতটা একটু কেটে গেছে। আর সেই জন্য ওই ক্ষতস্থান দিয়ে রক্ত পড়ছে। পাহাড়ের গায়ে কোনো গোলাপ গাছ থাকে না। সম্পূর্ণ বোকার মতো কথা বলার ফলে খুবই চিন্তিত হয়ে পড়ি, পাহাড়ের গায়ে হলুদ রঙের এক প্রকার কাটা গাছ হয়, তা উনি ওই গাছের কথা বলতেন আমরা না হয় মেনে নিতাম। একটা কিছু চিন্তা করতে করতে বাড়ির থেকে বেরুলেন জেনারেল। আমিও তার সঙ্গে গেলাম। তিনি রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে বলতে লাগলেন, মলির নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে, ওখানে গিয়ে দেখলাম মলি পাহাড়ের নিচে খাদেতে একটা পাথরের ওপর পড়ে আছে। তার দেহ ক্ষত বিক্ষত তখনও তিনি মারা যাননি। তখন মাথায় আসছিল না ঠিক কি করব আমরা। ডাক্তার ডেকে আনা অবশ্যই দরকার। ঠিক সেই মুহূর্তে তার স্বামীকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলেন, হ্যাঁ ডলিই একাজ করেছে। সত্যিই সে জানত না সে কী করতে যাচ্ছে। ওর এই কাজের জন্য কোনো রকম শাস্তি যেন ও না পায়। এবং কেউ যেন জানতে না পারে কী নিষ্ঠুর কাজ ও করেছে। অথবা কেন করেছে। ওর কোনো দোষ আমি দেখতে পাচ্ছি না। তোমায় আমাকে কথা দিতেই হবে যে তুমি ওর সব অপরাধ ক্ষমা করে দেবে। ডাক্তার ডেকে কোনো লাভ হবে না, কারণ সময় আর নেই। আমি জানি মৃত্যুর মুখোমুখি এসে উপস্থিত হয়েছি। তোমাকে আবার বলছি তুমি কথা দাও আমার বোনকে রক্ষা করবে, আমাকে হত্যা করার জন্য ওর বিচারের ব্যবস্থা তুমি করবে না।

আমাকে কোথাও লুকিয়ে রাখো কারণ কেউ যাতে দেখতে না পায়। আর জেলি তুমিও তো আমাকে খুব ভালোবাসো। আমি জানি তুমি আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছ এবং আমার শরীরের যত্ন নেবার চেষ্টা করেছ, আর আমার ছেলে মেয়েদেরও তুমি ভালোবাসো। সুতরাং তোমাকেও দেখতে হবে যেন ডলি রক্ষা পায় এই অপরাধ থেকে। এই হল সেদিনের প্রকৃত ঘটনা।

পোয়ারো জিজ্ঞেস করলেন, তারপর আপনারা কী করলেন? আমার মনে হল এরই মধ্যে

হ্যাঁ তিনি মারা যান। তাঁর সেই কথাগুলো ছিল শেষে অনুরোধ। ওঁর মৃতদেহকে লুকিয়ে রাখতে ওঁকে সাহায্য করলাম। আমরা ওকে ধরাধরি করে নিয়ে এলাম যেখানে পাথরের নুড়ি পড়েছিল। এবং তা দিয়ে আমরা ঢেকে রাখার চেষ্টা করলাম এছাড়া অন্য কোনো পথ আর খোলা ছিল না। ফেরার পথে বার বার অ্যালিয়েস্টার বলতে থাকেন, ওর কাছে প্রতিজ্ঞা করেছি। এবং কথা আমাকে রাখতেই হবে। তবে আমি জানি না কীভাবে সেটা রাখব। ডলি তখন বাড়িতেই ছিল। উনি তখন বেপরোয়া। তিনি বলে চললেন যে, বেশ কয়েক বছর থেকে আমি জানতাম মলি একটা শয়তান ছাড়া কিছু নয়। সে তোমাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। এবং বাধ্য করেছিল তোমাকে বিয়ে করতে। ওরা এখন আমাকে নিয়ে কী করবে? আমি আর মুখ বুজে থাকব না। ওরা বলবে মলির খুনের জন্য আমি দায়ী। আমি এই কাজের জন্য খুশি নই। আমাকে এই নিষ্ঠুর কাজটা করতে হয়েছে, আমি রক্ত দেখতে চেয়েছিলাম বলে। কিন্তু মলির মৃত্যু দেখার সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারিনি। পালিয়ে এসেছি। আমি নিশ্চিত ও করবেই। আমি শুধু চেয়েছি যে, তুমি যেন ওকে দেখতে না পাও।

এ যে দেখছি ভয়ঙ্কর, বীভৎস এবং নিষ্ঠুর কাহিনি, বললেন ডেসমন্ড।

সিলিয়া বললেন, হ্যাঁ বীভৎস তো বটেই তবে জেনে রাখা ভালো তাই না? আমি জানি তিনি খুব মিষ্টি সুন্দর স্বভাবের মেয়ে ছিলেন আর তার মধ্যে শয়তানের কোনো চিহ্ন ছিল না। সারাজীবন ধরে আমার মা খুব ভালো মহিলা ছিলেন। এখন আমি বুঝতে পারি বাবা কেন ডলিকে বিয়ে করতে চাননি। সেই সময় বাবা হয়তো বুঝেছিলেন যে, ডলির মধ্যে ভুল ত্রুটি আছে।

জেলি বললেন, আমরা আশা করেছিলাম মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যাবে না। পরে রাতের অন্ধকারে সেটা সরিয়ে এমন জায়গায় রাখা হবে যাতে লোকে দেখে বুঝতে পারে ঘুমের ঘোরে হাঁটতে হাঁটতে পাহাড় থেকে সমুদ্রে পড়ে গেছেন। অ্যালিয়েস্টার বললেন, আমি মলির কাছে শপথ নিয়েছি। আর ওঁর কথা মতো কাজ করব। ডলিকে বাঁচানোর একটা উপায় আছে যে, ডলিকে ওর ভূমিকা পালন করতে হবে। আমি জানি না সে ওটা করতে সমর্থ কিনা। মৃতদেহটা ডরোথির আর ও যে মলি সেটা ওকে অভিনয় করতে হবে। ডরোথি ঘুমের ঘোরে হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ে উঠে যায় এবং ওখান থেকে পড়ে সে মারা যায়। আর ডলিকে নিয়ে দূরে একটা কটেজে কিছুদিন একসঙ্গে থাকি। তারপর অ্যালিয়েস্টার বলতে থাকেন, ডলির আকস্মিক মৃত্যুর শোক সামলাতে না পেরে মলি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, তাই তিনি তাকে হাসপাতালে পাঠাতে বাধ্য হয়েছেন? এদিকে একদিন ডলিকে ফিরিয়ে নিয়ে আমি মলির ভূমিকায় মলির পোশাক আর পরচুল পড়িয়ে। কোকড়ানো চুলের পরচুল ওর আসল মুখের চেহারাটা চাপা দিয়ে দেয়। বৃদ্ধ হাউজকিপার চোখে ভালো দেখতে পেতেন না। যমজ বোনের ক্ষেত্রে যা হয় ডলি ও মলিকে দেখতে একই রকম ছিল তাই সহজে সবাই ডলিকে মলির ভূমিকায় গ্রহণ করে নিল। তার জন্য কোনো প্রকার সন্দেহ প্রকাশ করেনি। ডলি এমনিতে ছিল গম্ভীর এবং অন্যমনস্কতা ফুটে উঠত। এই ভাবটা মলির তখনকার ভূমিকায় সুন্দর ভাবে মানিয়ে নিল এবং লোকে ভাবলো বোনের মৃত্যুর শোকটা মলি এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি।

সিলিয়া আশ্চর্য হয়ে বললেন, উনিই বা কী করে মানিয়ে নিলেন নিজেকে মলির ভূমিকায়? নিশ্চয়ই সেটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার ছিল।

না, ওঁর কাছে সেটা খুব একটা অসুবিধা বলে মনে হয়নি। উনি যা চেয়েছিলেন সেটাই তো পেয়েছিলেন। অ্যালিয়েস্টারকে তিনি পেয়েছিলেন–কিন্তু অ্যালিয়েস্টার তিনি কী করে সহ্য করলেন? তিনি আমাকে বলেছিলেন কেন আর কীভাবে এই ব্যবস্থাটা সহ্য করে নিলেন।

তিনি আমাকে বলেছিলেন কেন এবং কীভাবে সহ্য করলেন যেদিন উনি আমার সুইজারল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করলেন, সেইদিন তিনি তার মনের কথা আমাকে বলেছিলেন।

তিনি বলেন একটা কাজ করতে শুধু বাকি আছে। মার্গারেটকে শপথ করে বলেছিলাম পুলিশের হাতে ডলিকে ধরিয়ে দেব না। যাতে কখনও কেউ জানতে না পারে ডলি একজন খুনি। এবং ছেলেমেয়েরাও যাতে জানতে না পারে যে তাদের মাসি খুনি।

আমি আর থাকতে না পেরে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলে ফেললাম, আপনি সেটা করবেন কী করে? উত্তরে তিনি বলেন, আমি যা করতে যাচ্ছি সে ব্যাপারে তোমারও জেনে রাখা উচিত।

তিনি বলেন ডলি যাতে বেঁচে না থাকতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে কারণ সে নিজের মুখে বলেছে রক্ত দেখতে ও ভালোবাসে। রক্তের স্বাদ যখন ও পেয়েছে তখন একটার পর একটা খুন ও করবেই। সে কয়েকটা জীবন নষ্ট করবে। বেঁচে থাকার মতো সে উপযুক্ত নয়। আমি যে কারণে সেই অপ্রিয় কাজটা করতে যাচ্ছি আমার নিজের জীবন দিয়েও সেই নিষ্ঠুর কাজটা আমাকে করতেই হবে, ডলির সঙ্গে স্বামী স্ত্রীর মতন আর মাত্র কয়েকটা সপ্তাহ বেঁচে থাকব। তারপর আর একটা বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটবে। তিনি কি বোঝাতে চেয়েছিলেন তা আমি বুঝতে পারিনি–আমি তাকে জিজ্ঞেস করি আর একটা দুর্ঘটনা? আবার ঘুমের ঘোরে হাঁটা। সে আবার কী? তার উত্তরে তিনি বলেন, না, সবাই যা জানবে তা হল আমি আর মলি দু-জনেই আত্মহত্যা করেছি। আমার মনে হয় না কারণটা কেউ জানতে পারবে, তারা হয়তো মনে করতে পারে মলির ক্যান্সার হয়েছে শুনে স্বভাবতই সে আত্মহত্যা করতে পারে কিংবা আমিও সেটা ভাবতে পারি। এই সব ধারণাগুলো লোকেদের মাথায় আসলে তখন তারা ধরে নেবে হয়তো আমরা জীবনের মানে খুঁজতে না পেরে আপোষে দু-জনে মিলে আত্মহত্যা করে থাকব।

দেখো জেলি আমাকে তোমার সাহায্যের প্রয়োজন। তুমি সত্যিকারের আমাকে, মলিকে আর আমাদের ছেলেমেয়েকে ভালোবাসো। আর ডলিকে যদি মরতেই হয় আমাকেই তাহলে এই কাজটা করতে হবে, আমি প্রথমে তাকে গুলি করব এবং পরে নিজেকে নিজে গুলি করব। রিভলবারে তার হাতের ছাপ থাকবে কারণ সে সেটা খুব বেশি ব্যবহার করেনি। ঘাতক হব আমি। একটা কথা তোমাকে বলে যেতে চাই যে আমি এখনও দুজনকেই ভালোবাসি। তিনি বললেন, মলি আমার প্রাণ, আমার জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসি, আর ডলির প্রতি আমার করুণা হয়। এবং সব সময়ে মনে হয় ওর জন্মই বোধহয় এইজন্য। তিনি আবার বললেন, সব সময়ে এই কথাগুলি মনে রেখো। জেলি উঠে সিলিয়ার কাছে এসে দাঁড়াল এবং বলল, প্রকৃত সত্য কি তা তো জানলে। তোমার বাবার কাছে শপথ করেছিলাম যে একথা তোমাদের কখনও জানাব না অথবা তোমরা জানতে পারবে না। আমি কল্পনাও করতে পারিনি তোমাদের কাছে বা অন্য কারোর কাছে সেদিনের সেই দুঃখজনক ঘটনার প্রকৃত তথ্য বলব। আমি আমার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছি। কারণ মঁসিয়ে পোয়ারো আমাকে অন্যরকম ভাবতে শিখিয়েছেন। এটা একটা এমন বীভৎস কাহিনি

সিলিয়া বললেন, আপনার মনের অবস্থা কেমন আমি বেশ বুঝতে পারছি। আপনি আপনার কথা রক্ষার ক্ষেত্রে ঠিকই করেছিলেন কিন্তু এই বিষয়ে জেনে মনের দিক থেকে কতটা হালকা হলাম। এখন মনে হচ্ছে বিরাট বোঝা আমার ওপর থেকে নেমে গেল–

ডেসমন্ড বললেন, আমরা দুজনেই এই ঘটনা জেনে গেলাম। আমরা কিন্তু কিছু মনে করব না। তবে এটা অবশ্যই একটা বেদনাদায়ক ঘটনা কারণ দু-জন মানুষের একটা সত্যিকারের ট্র্যাজেডি। ওঁরা কিন্তু কেউ কাউকে খুন করেনি। তারা পরস্পর-পরস্পরকে ভালোবাসতেন, একজন খুন হয়েছিলেন আর অপরজন ঘাতকের কাজ করেছেন, কারণ খুনিকে সরিয়ে দিয়ে মানবিকতার খাতিরে যাতে ছেলেমেয়েদের দুঃখ ভোগ করতে না হয়। যদি তিনি কিছু ভুল করে থাকেন কেউ তাকে ক্ষমা করে দেবেন। কিন্তু আমি মনে করি না যে সত্যি কোনো ভুল হয়েছিল।

সিলিয়া বললেন, তিনি ছিলেন ভয়াবহ প্রকৃতির মহিলা। আমি যখন শিশু ছিলাম তাকে দেখলেই ভীষণ ভয় পেতাম এবং তখন জানতাম না কেন ভয় পাই। তবে এখন বুঝতে পারি কেন তখন ভয় পেতাম। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমার বাবা ছিলেন খুব সাহসী পুরুষ, তিনি যা করেছেন খুব সাহসের সঙ্গেই করেছেন এবং আমার মা করতে বলেছিলেন বলেই করেছিলেন। বাবা তার যমজ বোনকে রক্ষা করেছেন। সিলিয়া এরকুল পোয়ারোর দিকে সন্দেহের চোখে তাকালেন। আমার অনুমান যে, আপনি একজন ক্যাথলিক। তাদের কবরস্তম্ভে কী যেন লেখা ছিল–মৃত্যুতেও ওঁরা বিচ্ছিন্ন হননি। আচ্ছা এর থেকে কি ধরে নেওয়া যায় না যে, ওঁরা একসঙ্গে মারা গিয়েছিলেন। তবে আমি মনে করি ওঁরা অভিন্ন। দুটি মানুষ যাঁরা পরস্পরকে খুব ভালোবাসতেন এবং আমার ভাগ্যহীনা মাসিমাকে খুব বেশি যন্ত্রণা পেতে হয়নি। মনে রাখবেন যা তিনি লাঘব করতে পারেননি। বললেন সিলিয়া। আশ্চর্য ওঁর গলার স্বর কেমন বদলে গেল। বললেন তিনি, কোনো ব্যক্তি যদি ভালো না হয় আপনি শত চেষ্টা করলেও তাকে পছন্দ করতে পারবেন না। তিনি যদি চেষ্টা করতেন বরং অন্য রকম হতে পারতেন। সম্ভবত তিনি তা করতে পারেননি। আর তা যদি হত যে কোনো লোক তার সম্পর্কে ভাবত একজন অসুস্থ মানুষ হিসাবে। আমার মা ও বাবার জন্য আর কোনো চিন্তা আমার নেই, ওঁরা পরস্পরকে এত গভীরভাবে ভালোবাসতেন যার তুলনা করা যায় না, অসুখী ডলিকেও সমানভাবে ভালোবাসতেন।

ডেসমণ্ড বললেন, সিলিয়া, আমার মনে হয় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের বিয়ে করা উচিত। তোমাকে আমি কথা দিচ্ছি যে, আমার মা এব্যাপারে কখনও একটা কথাও জানতে পারবে না। সবচেয়ে বড়ো কথা উনি আমার নিজের মা নন। এবং উনি সেরকম মানুষই নন যে, যাকে বিশ্বাস করে কোনো গোপন কথা বলা যাবে।

পোয়ারো বললেন, ডেসমণ্ড, আপনার পালিত মা আপনার ও সিলিয়ার ঘনিষ্ঠতার ব্যাপারে খুবই চিন্তিত ছিলেন। আপনার মনে একটা ধারণা তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন এই বলে যে, সিলিয়া উত্তরাধিকার সূত্রে তার মা কিংবা বাবার চরিত্রের দোষ গুণ লাভ করতে পারেন। ওঁর সম্পর্কে এরকম ধারণা করে নেওয়ার মতো যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য কারণ আমার কাছে অবশ্যই আছে। আপনি জানতেও পারেন আবার নাও জানতে পারেন যে, আপনি আপনার সত্যিকারের মার প্রচুর অর্থের অধিকারী হতে যাচ্ছেন। তিনি মারা গেছেন বেশি দিন হয়নি। আপনার যাবার আগে তিনি তার সমস্ত টাকা আপনার নামে উইল করে দিয়ে গেছেন। সেই টাকাটা এখন একটা ট্রাস্টের কাছে গচ্ছিত আছে। আপনার বয়স যখন পঁচিশ বছর হবে ঠিক তখনই সেই অর্থের প্রকৃত উত্তরাধিকার হবেন।

ডেসমন্ড বললেন, যদি সিলিয়াকে আমি বিয়ে করি তবে বাঁচার তাগিদে আমাদের অর্থের প্রয়োজন হবে। আমার বর্তমান পালিতা মার টাকার ওপর খুব লোভ এবং তাকে আমি প্রায়ই টাকা ধার দিয়ে থাকি, এবং তিনি এও বলেছেন যে, আমার বয়স এখন একুশ। এখন উইল না করলে খুবই অসুবিধা হবে সুতরাং আমি যেন উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করি। আমার অনুমান যে তিনি হয়তো ভেবেছেন যে, টাকাটা তিনি পাবেন। আর আমি ভেবেছিলাম সিলিয়া এবং আমি যখন বিয়ে করতে যাচ্ছি তখন আমার প্রায় সব অর্থই তার জন্য রেখে যাব। কিন্তু সিলিয়ার বিরুদ্ধে আমাকে তার প্রভাবিত করা আমি মোটেই পছন্দ করি না।

পোয়ারো বললেন, আপনার সন্দেহটা সম্পূর্ণ ঠিক। আপনার ভালোর জন্য আপনাকে বোঝাতে চেয়েছিলেন এটা তিনি নিজেই আপনাকে বলতে পারতেন, সিলিয়ার জন্মের কথা অথবা তার বাবা আর মায়ের চরিত্র সম্পর্কে আপনার জেনে রাখা উচিত কারণ ওঁকে বিয়ে করলে বিয়ের পর যদি কোনো ঝুঁকি থাকে। কিন্তু

ঠিক আছে, বললেন ডেসমন্ড। যেহেতু তিনি আমাকে দত্তক নিয়েছিলেন এবং বড়ো করে তুলেছেন আমার কৃতজ্ঞতা হিসাবে আমি আমার বাড়তি টাকা তাকে কিছু দিয়ে যাব, কিন্তু ওঁর প্রতি দয়া বলতে কিছু নেই আমার। সিলিয়া আর আমি, একটা সুখের সংসার গড়তে চলেছি। এর আগে ওই একটা ব্যাপারে আমরা দুঃখবোধ করতাম কিন্তু এখন আর আমরা কিছুই চিন্তা করব না। কি বলো সিলিয়া।

সিলিয়া বললেন, না, আমরা আর কখনও চিন্তা করব না। আমি মনে করি আমার বাবা ও মা খুব চমৎকার ছিলেন। মা তার জীবনে বোনের ভালো-মন্দ দেখার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু মনে হয় তার সেই চেষ্টা সফল হয়নি। কারণ মানুষের স্বভাব কোনোদিনই বদলানো যায় না।

জেলি বললেন, প্রিয় বাচ্চারা আমার। ওহো বাচ্চা বলার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। এখন তোমরা বড়ো হয়ে যুবক যুবতীতে পরিণত হয়েছে। সেটা আমি জানি। তোমাদেরকে যে আবার দেখতে পাবো ভাবতে পারিনি। তাই তোমাদেরকে দেখে খুব খুশি হয়েছি। আমি যা করেছিলাম সেটা যে কোনো ক্ষতিকারক ছিল না। এবং তোমরা যে সেটা বুঝতে পেরেছ, তা আমার জেনে খুব ভালো লাগল।

সিলিয়া জেলিকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন, আপনি আদৌ কোনো ক্ষতি করেননি। আপনার দেখা পেয়ে আমরাও খুব খুশি, এবং আপনি সব সময়েই আমার খুব প্রিয় ছিলেন।

আর আপনিও আমার খুব প্রিয় হয়ে উঠেছেন, ডেসমন্ড বললেন, আপনার কথা যখন জানতে পারলাম তখন থেকেই আপনাকে দেখার খুব ইচ্ছে ছিল এবং আজ আমার সেই ইচ্ছা পূরণ হল। আশাকরি আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে সিলিয়াদের পাশের বাড়িতে আমরা থাকতাম এবং আপনি আমাদের সঙ্গে খেলতেন। তখন কী মজার জীবন ছিল।

সিলিয়া এবং ডেসমন্ড দুজনেই মিসেস অলিভারকে ধন্যবাদ জানালেন। এবং বললেন, আপনার খুবই দয়া আর আমাদের জন্য আপনার খুবই কষ্ট করতে হয়েছে। আর আপনাকেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি মঁসিয়ে পোয়ারো।

সিলিয়া বললেন, হ্যাঁ ধন্যবাদ। আপনার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ।

জেলি বললেন, আমাকে এক্ষুনি চলে যেতে হবে। আপনার কী ব্যাপার? আর এ-ব্যাপারে কাউকে আপনার কিছু বলতে হবে?

একজন পুলিশ অফিসার আছেন তাকে আমি গোপনে বলতে চাই। এখন আর কাজকর্ম করেন না, কারণ তিনি অবসরপ্রাপ্ত। ঘটনাটি যখন অনেক বছর আগের তখন আর এই বিষয়ে তিনি মাথা ঘামাবেন না। যদি তিনি কর্মক্ষম থাকতেন তবে অবশ্য আলাদা কথা ছিল।

ভয়ঙ্কর বীভৎস একটা কাহিনি, মিসেস অলিভার বললেন। যেসব লোকেদের সঙ্গে দেখা করেছি এব্যাপারে এখন দেখতে পাচ্ছি তারা সবাই কিছু না কিছু ঠিকই মনে রেখেছে। কিছু একটা যা সত্য আবিষ্কার করতে সাহায্য করেছে। সেগুলোকে অবশ্য একসঙ্গে জড়ো করে কাজে লাগাতে পারেনি। কেবল মঁসিয়ে পোয়ারো যিনি সব সময়ে অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে পারেন। ছোটো ছোটো ঘটনাগুলিকে এক সঙ্গে করে একটা সত্য ঘটনা সৃষ্টি করতে পারেন কেমন অনায়াসে। যেমন পরচুল এবং সেই যমজ বোনের কথাই ধরা যাক।

জেলির কাছে এগিয়ে গেলেন পোয়ারো এবং বললেন যে, আপনাকে এখানে আনার জন্য এবং সেই ঘটনার সময় আপনি কী কী করেছিলেন তা খুলে বলার জন্য আপনাকে চাপ দিয়েছিলাম। সত্যি তার জন্য আমি দুঃখিত। তার জন্য আপনি আমাকে দোষারোপ করবেন না।

না, না। আমি বরং খুশি হয়েছি। আপনি ঠিকই করেছিলেন। দুটি ছেলেমেয়ে খুব ভালো। এবং ওরা নিশ্চয়ই সুখী হবে। আমরা যে এখানে দাঁড়িয়ে আছি, এক সময়ে এখানে দু-জন প্রেমিক প্রেমিকা প্রেম করতেন, সেখানে দু-জন মারাও গেছেন। তার সেই কাজের জন্য আমি জেনারেলকে দোষ দিই না। আমার ধারণা সেটার ভুল হয়ে থাকবে। কিন্তু তা বলে আমি তাকে দোষ দিতে পারি না। সেটা ছিল একটা খুব সাহসিকতার কাজ। যদিও সেটা ভুল হয়ে থাকে তবুও।

হ্যাঁ তাকে আপনি তো ভালোবাসতেন তাই না? বললেন এরকুল পোয়ারো।

হ্যাঁ সব সময়। যেদিন প্রথম আমি এ-বাড়িতে আসি সেইদিন থেকেই তাকে আপনজনের মতো ভালোবাসতাম। আমার মনে হয় না তিনি সেটা জানতেন। এছাড়া অন্য আর কোনো সম্পর্ক ছিল না। তিনি আমাকে বিশ্বাস করতেন এবং আমিও তাঁর খুব প্রিয় ছিলাম। আমি ওঁদের দুজনকেই ভালোবাসতামও।

আমি আপনাকে আবার জিজ্ঞেস করতে চাই যে, তিনি ডলি ও মলিকে দু-জনকেই ভালোবাসতেন তাই না?

একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ওঁদের দুজনকেই তিনি ভালোবাসতেন, এবং সেই জন্যই তিনি ডলিকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন। আর মলিও তার বোনকে সমান ভালোবাসতেন। আর তা না-হলে কেনই বা তিনি মৃত্যুর শিয়রে দাঁড়িয়ে তার স্বামীকে দিয়ে শপথ করেছিলেন ডলিকে রক্ষা করার জন্য। তবে দুই বোনের মধ্যে কাকে বেশি ভালোবাসতেন সেটা বলা বেশ শক্ত। এই প্রশ্নটা এমন জটিল যে, সম্ভবত আমি কখনওই এর সঠিক উত্তর দিতে পারব না। আমি কখনও এই বিষয়ে ভেবে দেখিনি এবং ভেবে দেখবও না। এক মুহূর্তের জন্য তার দিকে তাকিয়ে মুখটা ঘুরিয়ে নিলেন পোয়ারো। তারপর মিসেস অলিভারের সঙ্গে যোগ দিলেন।

দৈনন্দিন জীবনে আমাদের ফিরে যেতেই হবে। বেদনাদায়ক ঘটনা। প্রেমঘটিত ব্যাপারে এসব এখন ভুলে যান কেমন?

হাতিরা মনে রাখতে পারে। আমরা ক্ষমাশীল এবং আমরা কেমন সহজেই ভুলে যাই, বললেন মিসেস অলিভার।

Exit mobile version