আমার ধারণা আমি ধর্মকন্যার কাছে যেতে পারব, ওই ভয়ঙ্কর মহিলা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে এই কাজটা আমাকে দিয়ে করাতে চেয়েছিল। তিনি ভেবেছেন যে মেয়েটি জানে-ধরে নিলাম মেয়েটি জানে। এবং এও বললেন মিসেস অলিভার, জানেন আজকালকার ছেলেমেয়েরা অস্বাভাবিক অনেক কিছুই জানে।
আচ্ছা বলুন তো সেই সময় আপনার এই ধর্মকন্যার বয়স কত ছিল?
আমি ঠিক মনে করতে পারছি না। তবে আমার মনে হয় মেয়েটি তখন ন-দশ বছরের হবে। তবে বয়সের অনুপাতে তখন বয়স্কাই দেখাচ্ছিল। এটা আমার কল্পনা যে তখন ও স্কুলে ছিল এবং খবরের কাগজে যা পড়েছিলাম যেটুকু মনে আছে বলছি।
কিন্তু আপনি কী মনে করছেন মিসেস কক্স-এর ইচ্ছা আপনাকে দিয়ে মেয়েটির কাছ থেকে খবর সংগ্রহ করা হয় মেয়েটি কিছু জানবে নয়তো ছেলেটিকে ও কিছু বলে থাকবে এবং ছেলেটি তার মাকেও কিছু হয়তো বলে থাকবে। তবে আমার অনুমান মিসেস বার্টন কক্স নিজেই মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করার চেষ্টা করেছিলেন এবং প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। তাই তিনি ভাবলেন মিসেস অলিভার যখন মেয়েটির ধর্ম মা, শুধু তাই নয়, অপরাধতত্ত্ব সম্পর্কে তার প্রভূত জ্ঞান আছে, হয়তো তিনি খবর সংগ্রহ করতে পারেন। তিনি এই ব্যাপারটাকে নিয়ে কেন যে এত মাথা ঘামাচ্ছেন তার কোনো মানে বা কোনো কারণ দেখতে পাচ্ছেন না পোয়ারো। এই একটু আগে আপনি অস্পষ্টভাবে বললেন, লোকেরা সেটাও আমার কাছে ঠিক মতন বোধগম্য হচ্ছে না। কারণ এতদিন বাদে তারা কি আমাদের কোনো সাহায্য করতে পারবে অথবা কেউ কি মনে রাখতে পেরেছে?
মিসেস অলিভারের ধারণা, তারা মনে রেখেছে, হতভম্বের মতো তার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললেন, লোকেরা মনে রাখবে?
হ্যাঁ, ভালো কথা, মিসেস অলিভার বললেন, আমি সত্যি সত্যি হাতিদের কথা ভাবছিলাম, হাতিদের?
মিসেস অলিভার যেন সব যুক্তিতর্কের বাইরে। এবারেও ভাবলেন পোয়ারো অকারণে কিছু কিছু এমন কথা বলে ফেলেন যা বোঝা খুব মুশকিল। এখানে হঠাৎ হাতির প্রসঙ্গ এলো কী করে?
গতকাল মধ্যাহ্নভোজের সময় আমি হাতিদের কথা ভাবছিলাম, বললেন মিসেস অলিভার।
পোয়ারো কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হঠাৎ হাতিদের কথা ভাবছিলেন কেন? ওহো, হা, ভালো কথা, সত্যিই আমি দাঁতের কথাই ভাবছিলাম। কারণ এই দাঁত দিয়েই শক্তজাতীয় কোনো খাবার খাওয়া হয়। এবং আপনার যদি নকল দাঁত থাকে কোনো মতেই কিন্তু আপনি ভালোভাবে খেতে পারবেন না। এবং আপনাকে জানতে হবে কী আপনি খেতে পারেন এবং কী খেতে পারেন না।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পোয়ারো বললেন, ওই ডেন্টিস্টরা আপনার জন্য অনেক কিছু করতে পারে কিন্তু সব কিছু নয়।
তা ঠিকই বলেছেন, অথচ জানেন–আমি ভাবলাম আমাদের দাঁতগুলি কেবলই হাড়, ভয়ঙ্কর ভালো কিছু নয়, অথচ দেখুন কুকুরদের দাঁতগুলোকে সত্যিকারের হাতির দাঁত বলা যেতে পারে। হাতির দাঁতের কথা যখন আপনি ভাবেন তখন নিশ্চয়ই হাতির কথাও ভাবেন? বিরাট হাতির দাঁত। সত্যি ভাবেন না?
মিসেস অলিভার ঠিক কী বলতে চাইছেন সেটা পোয়ারোর কাছে বোধগম্য হল না। তাই আমাদের যা করতে হবে সেটা হল হাতির মতো দাঁত যাদের তাদের খুঁজে বের করা। কারণ হাতিরা বলে থাকে ভুলে যায় না কখনও।
এই প্রবাদটা শুনেছি বৈকি! কথার সায় দিয়ে পোয়ারো বললেন।
হাতিরা কখনও ভোলে না। বাচ্চাদের একটা গল্প নিশ্চয়ই জানেন যে একজন ভারতীয় দর্জি একবার একটি হাতির দাঁতে না উদরে সূচ বা ওই জাতীয় কিছু ফুটিয়েছিলেন। অনেকদিন পরে ঘটনাচক্রে সেই দর্জির সামনে দিয়ে হাতিটা যাচ্ছিল এবং হাতিটার মুখে ছিল ভর্তি জল। অথচ হাতিটার সঙ্গে দজিটার বেশ কয়েক বছর কোনো দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। তখন হাতি কী করলো জানেন? তার মুখ ভর্তি জল লোকটার গায়ে ছিটিয়ে দিল। হাতি কিন্তু ভুলে যায়নি যে লোকটা তার পেটে সূচ বিঁধিয়েছিল। এখন আমার কাজ কী জানেন–কয়েকটি হাতির সংস্পর্শে আসতে হবে আমাকে, বললেন মিসেস অলিভার।
এরকুল পোয়ারো বললেন, আপনি যে কী বোঝাতে চাইছেন এবং কাকে হাতি হিসাবে বিশ্লেষণ করতে চাইছেন, আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে। ঠিক আপনি চিড়িয়াখানায় যাচ্ছেন কিছু খবর সংগ্রহের জন্য।
ভালো কথা, এটা ঠিক সেরকম নয়। বললেন মিসেস অলিভার। যে সব লোক হাতির সাদৃশ্য তাদের সন্ধান করাই হল আমার কাজ। সত্যি কথা বলতে কী কিছু লোক আছে যারা সেই ভয়ঙ্কর ঘটনা মনে রাখতে পারে। যেমন অনেক কিছুই আমি মনে রাখতে পারি। কারণ সেই সব ঘটনাগুলোকে আমি চোখের সামনেই ঘটতে দেখেছিলাম। আমার বয়স তখন পাঁচ। একটি জন্মদিনের পার্টির কথা আজও মনে আছে, তার ছিল একটা ফ্যাকাসে লাল রঙের কেক। এবং কেকের উপরে ছিল একটা চিনির পাখি, অথবা যেদিন আমার প্রিয় গায়ক ক্যানারি পাখিটা খাঁচা থেকে উড়ে পালিয়ে গেল, স্পষ্ট মনে আছে তখন আমি খুব কেঁদেছিলাম। কোনদিন সেটাও আমার স্পষ্ট মনে আছে। দিনটা ছিল মঙ্গলবার কিংবা আর একটা দিনের কথা মনে পড়ে, যে দিন আমি মাঠে গিয়েছিলাম। সেই মাঠে ছিল একটা ষাঁড়। কে যেন বলল ষাঁড়টা গুতিয়ে দিতে পারে, তখন আমি ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম এবং মাঠ থেকে ছুটে পালিয়ে আসতে চেয়েছিলাম। আর আমার মনে আছে চমৎকার একটা পিকনিকের কথা। সেই পিকনিকে আমার খুব প্রিয় ফল জাম ছিল যার ডালপাতায় খোঁচা লাগার মতো খুব কাটা ছিল। খোঁচাও লেগেছিল ভয়ঙ্করভাবে, কিন্তু খোঁচা লাগার যন্ত্রণা আমি ভুলে গিয়েছিলাম কারণ অন্যদের থেকে আমি অনেক বেশি জাম পেয়েছিলাম বলে। তখন আমার বয়স ছিল মাত্র নয়। কিন্তু পরিণত বয়সে একশোরও বেশি বিবাহ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গেছি কিন্তু দুটি অনুষ্ঠান ছাড়া আর কোনো অনুষ্ঠানের আনন্দ উপভোগের কথা আজ আর আমার মনে নেই। সেই দুটি বিশেষ বিবাহ অনুষ্ঠানের কথা কেন মনে আছে তার কারণ হল একটি অনুষ্ঠানে আমি কনের সহচরী হিসাবে যাই। অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন হয়েছিল নিউফরেস্টে এবং সেখানে আর কে কে ছিল মনে নেই। তবে মনে হয় এক খুড়তুতো বোনের বিয়ে ছিল। কিন্তু আমি তাকে খুব একটা জানতাম না, সে শুধু চেয়েছিল একজন ভালো সহচরী, আর আমার অন্তত সে রকম ধারণা যে আমিই কেবল তার নাগালের মধ্যে ছিলাম। দ্বিতীয় বিবাহ অনুষ্ঠান ছিল আমার এক বন্ধুর। সে নেভিতে কাজ করত। একবার সাবমেরিন থেকে পড়ে গিয়ে জলের তলায় তলিয়ে যাচ্ছিল। শুধু তাই নয় অনেক কষ্টে সে রক্ষা পায়। সেই সময়ে যে মেয়েটির সঙ্গে তার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল তার বাড়ির লোকেরা প্রথমে চায়নি এই ছেলেটির সঙ্গে তাদের মেয়ের বিয়ে হোক। সেই জলে ডুবে যাওয়া ঘটনার পরই তারা এই বিয়েতে রাজি হয়। এবং সেই বিয়েতেই কনের সহচরী হিসাবে হাজির হই। সুতরাং আমার এতগুলো কথা বলার উদ্দেশ্য একটাই সেটা হল এমন কতগুলো ঘটনা আছে যা আপনার মনে গেঁথে যায় চিরদিনের জন্য। চেষ্টা করলেও ভুলতে পারবেন না।