–ওঁর বাড়িটা দখল করে আমাদের খারাপ লাগছে, বললে জোয়ানা।
–না না, ইয়ং লেডি ওভাবে নেবেন না ব্যাপারটা।
আমি বললাম, ভারি স্নিগ্ধ একটা আবহাওয়া আছে বাড়িটাতে।
-সত্যি, তাই অনুভব করেন নাকি? আমিও আবহাওয়ায় বিশ্বাস করি বুঝলেন। মানুষের চিন্তা, অনুভূতি–দেয়ালে আসবাবপত্রে তার ছাপ রেখে যায়।
আমি দু-এক মুহূর্ত চুপ করে প্রায়র্স লজের চারদিকে তাকাচ্ছিলাম। মনে হল, এখানে কোনো আবহাওয়া নেই। আর সেটাই আশ্চর্য।
এবার সবাই এলাম বাইরের হলঘরে। সামনের দরজার দিকে এগোতেই চিঠির বাক্সের ভেতর দিয়ে গলানো একটা খাম মেঝেতে পড়ল।
খামটা তুলে নিলো মিঃ পাই, বললেন, বিকেলের ডাক। তিনি আমাদের বিদায় জানালেন।
দু-দুবার করমর্দন করে তিনি আমাদের গাড়িতে তুলে দিলেন। জোয়ানা হুইলে বসল। নিখুঁত সবুজ একখণ্ড জমিতে সাবধানে চক্কর দিয়ে অবশেষে সামনের সোজা রাস্তায় উঠে সে হাত নেড়ে গৃহকর্তাকে বিদায় জানালেন।
কিন্তু আমাদের ইশারা ইশারাই রয়ে গেল।মিঃ পাই তার হাতের চিঠিটা খুলে ফেলেছিলেন। আর ভোলা কাগজটার দিকে মুখখানা কুঁচকে, রাগে আর বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন। প্রথমটায় আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। পর মুহূর্তে অনুভব করলাম ঐ খামটার চেহারা যেন আমার চেনা চেনা। জোয়ানা বলল, কী ব্যাপার! ভদ্রলোকের হলোটা কি?
বললাম, আমি যেন আন্দাজ করছি…আবার সেই গোপন হাতের কাজ।
জোয়ানা আমার দিকে অবাক চোখে তাকালো। বলল, মানে, যে ধরনের চিঠি তুমি পেয়েছিলে সেইরকম একটা?
–আমার ধারণা তো তাই বলছে।
-এ জায়গাটার হলোটা কি! দেখলে তো মনে হয় দেশের সবচেয়ে শান্ত আর ঘুমন্ত এক প্রান্ত কিন্তু এসব কে লিখছে জেরি?
-বাছা, আমি তা কি করে জানবো?
হবে কোনো স্থানীয় আধপাগলা। তবে তুই আমাদের ডাক্তার আওয়েনকে জিজ্ঞেস করতে পারিস।
–ডাঃ আওয়েন আমায় পছন্দ করে না। আমাকে হাইস্ক্রিট ধরে আসতে দেখলেই রাস্তার ওপারে চলে যান। কিন্তু জেরি, এই চিঠি লেখার ব্যাপারটা মোটেই তামাশার ব্যাপার নয়। কেন লোকে বেনামী চিঠি লিখবে?
-ঐ তো যা বলছিলাম। কোনো মানসিক তাড়নার তৃপ্তি খোঁজে বোধহয়। কেউ যদি ভাবে তাকে খাটো করা হয়েছে কিংবা অবহেলিত করা হয়েছে অথবা তার জীবনটা যদি হয়ে যায় একঘেয়ে শূন্য, তাহলে বোধহয় সে সুখী আর আনন্দে মশগুল কাউকে দেখলে পেছন থেকে ছুরি মেরে আত্মপ্রসাদ অনুভব করে।
ব্যাপারটা মোটেই ভালো নয় জেরি।
–ভালো তো নয়ই। তবে এই দেশগাঁয়ে মানুষদের ভেতরমুখো হবার দিকে ঝোঁক–তাই কিছু বিকৃত আজব মানুষ দেখা যায়।
তার মানে খুব অশিক্ষিত, ভাবপ্রকাশে অক্ষম তাই না…
জোয়ানার কথার আমি আর কোনো উত্তর দিইনি।
পাহাড়ী রাস্তায় ওঠার আগে শহরের ভেতর দিয়ে আসার সময় কৌতূহলভরে দেখলাম হাইস্ট্রিটে বিচরণমান কয়েকটা অস্পষ্ট মূর্তি। ঐ ভীড়েই হয়তো কেউ ঈর্ষা আর কুটিলতার বিষ লুকিয়ে শান্ত মুখখানাকে আড়ালে রেখে আবার কোনো নতুন মতলব করছে।
.
দুদিন বাদে আমরা সিমিংটনদের বাড়িতে ব্রীজ খেলার পার্টিতে গেলাম। শনিবারের বিকেল। দপ্তর বন্ধ, এ কারণেই সিমিংটনরা বরাবরই শনিবারে ব্রীজের আসর বসান।
দুটো খেলার টেবিল। খেলুড়ে সিমিংটন দম্পতি, মিস গ্রিফিথ, আমরা দুজন, মিঃ পাই, মিস বারটন আর কর্নেল অ্যাপলটন যার সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়নি। বয়স তার ষাট। জোয়ানার দিকে তার আকর্ষণটা এমন বর্ধিত রূপ ধারণ করছিল যে বিকেলটা একবারও ওর ওপর থেকে নজর সরাননি।
যখন আমরা সেখানে পৌঁছালাম, তখন বাচ্চাদের গভর্নের্স এলসি হল্যান্ড ক্রিজ স্কোরের খাতা টেবিলের দেরাজ হাতড়ে খুঁজছে।
হাতে খাতা নিয়ে আর পাঁচটা ঝি-এর মতো বকবক করতে লাগল, এগুলোই বুঝি, মিসেস সিমিংটন? কি বোকা আমি, সেদিন প্রায়ান তার রেলগাড়িটা কোথায় খুঁজতে থাকল, আর আমি নিশ্চয় এটাকে কোনো গলদ জায়গায় ঢুকিয়ে ওর কাছে ছুটেছিলাম। এগুলো ঠিক না। আমি বাচ্চাদের একটু লংব্যারোতে নিয়ে যাচ্ছি।
সুশীলা, সুশ্রী ঝলমলে মেয়ে। জোয়ানার দিকে তাকাতেই দেখলাম ও হাসছে। আমি কড়া চোখে ওকে দেখি।
ব্রীজ খেলতে বসলাম আমরা। শ্রীমতী সিমিংটন খুবই ওস্তাদ খেলুড়ে। তাঁর স্বামীও ভালো খেলেন, একটু অতিরিক্ত সতর্ক। মিঃ পাই তো ব্রিলিয়ান্ট। আজকের আসরের আয়োজনটা যেহেতু আমাদের সম্মানে তাই আমি আর জোয়ানা বসেছি সিমিংটন পত্নী আর মিঃ পাই-এর সঙ্গে এক টেবিলে। মিস বারটন দলের সবচেয়ে উঁছা খেলুড়ে, তবে খেলে দারুণ মজা পান।
খেলা এমনিতে ভালোই চলছিল, শুধু মাঝেমধ্যে জোয়ানার দিকে তাকিয়ে থাকার জন্যে কর্নেল সাহেবের কিছু ভুলচুক হচ্ছিল। টেবিল ঘিরে চায়ের আসর বসল ডাইনিং রুমে। খাওয়ার শেষপর্বের সময় দুটো ছোট বাচ্চা হুড়মুড় করে ঢুকে এলো। ওদের পরিচয় দেবার সময় মিসেস সিমিংটন মাতৃগর্বে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন।
মাথা ঘুরিয়ে দেখি মেগান আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ওঃ!..এই হলো মেগান–বললেন ওর মা।
মেগান বেয়াড়াগোছের একটা করমর্দন করল, কোনো শোভনতাই নেই।
-বাছা, আমি তোর চায়ের কথাটা একেবারে ভুলেই গিয়েছিলাম। মিস হল্যান্ড আর ছেলেদুটো বাইরে খেয়ে নিয়েছে, তাই বাচ্চাদের চা হয়নি।
–ঠিক আছে, আমি নয় রান্না ঘরেই যাচ্ছি, মেগান বলল। ও কামরা ছেড়ে বেরিয়ে গেল। একটা বিব্রত হাসি হেসে মিসেস সিমিংটন বললেন, এ আমার বেচারী মেগান। সবে স্কুল ছেড়েছে, ঠিকমতো বড়োও হয়নি, আনাড়ি গোছের।