যে দলিলগুলো আমি সঙ্গে এনেছিলাম, মিঃ সিমিংটন সেগুলো ঝুঁকে পড়ে দেখছেন। ওঁকে খুঁটিয়ে দেখলাম, দীঘল গলা, কণ্ঠস্থি উঁচু, পাংশু মুখমণ্ডল। নাকটা সরু লম্বা। নিঃসন্দেহে সৎ স্বামী ও পিতা।
একটু পরে মিঃ সিমিংটন ধীরে, স্পষ্ট উচ্চারণে নিজের বক্তব্য বললেন। নিজের বক্তব্যের পেছনে যথেষ্ট বোধশক্তি ও তীক্ষ্ণ বিচার ক্ষমতা। আমি এরপর বেরিয়ে এলাম। বাইরের অফিসে এক বুড়োমানুষ কিছু লিখে চলেছে। আর উসকোখুশকো চুল, চোখে চশমা একজন মাঝবয়সী মহিলা টাইপ করে চলেছে সবেগে, টেবিলে ঝোঁক দিয়ে দিয়ে।
এরপর রুটিওয়ালার দোকানে গিয়ে কিউরাট রুটিটা সম্পর্কে একটু নালিশ শোনালাম। যথারীতি বিস্ময় ও অবিশ্বাসের সঙ্গে সব শুনে দোকানদার একটা গরম রুটি আমার বগলে খুঁজে দিয়ে বলল, এই এক্ষুনি চুল্লি থেকে নামল।
দোকান থেকে বেরিয়ে রাস্তার এধার ওধার দেখতে লাগলাম জোয়ানার আসার অপেক্ষায়, কিন্তু জোয়ানার কোনো হদিশ নেই। হেঁটে যথেষ্ট ক্লান্ত বোধ করছি।
হঠাৎ আমার চোখদুটো অবিশ্বাস্য বিস্ময় আর আনন্দে দেখল এক সাক্ষাৎ দেবী যেন ফুটপাথ ধরে আমার দিকে এগিয়ে আসছে।
নিখুঁত মুখশ্রী, কোঁকড়া সোনালি চুল, দীঘল সুগঠিত অঙ্গ। আমার এই গভীর উত্তেজনায় আমার মুঠো থেকে খসে পড়ল পাঁউরুটি আর একটা লাঠি। আর পিছলে গিয়ে আমিও পড়ি আর কি?
সেই দেবীর সবল বাহু আমাকে টেনে ধরল। আমি তোতলাতে লাগলাম–ধন্যবাদ অজস্র। আমি ভীষণ দুঃখিত।
মেয়েটা তার সদয় হাসির সঙ্গে উৎসাহ দিয়ে বলল, কোনো ধন্যবাদ নয়, আমার কোনো অসুবিধাই হয়নি। আমি নজর করিনি, অথচ জোয়ানা কোনো সময় রাস্তার কোণে আমার পাশটিতে গাড়ি এনে দাঁড় করিয়েছে। জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার?
নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, কিছু না এই ট্রয়ের হেলেন-টেলেনের কথা ভাবছিলাম।
–ওসব ভাবার কি আর জায়গা পেলে না? তুমি বগলে রুটি নিয়ে, হাঁ করে কিরকম বেখাপ্পা কায়দায় দাঁড়িয়ে আছে।
–শক খেয়ে গিয়েছিলাম। একবার ট্রয় দর্শন করিয়েই আমায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা হল। আমিও দূরে মিলিয়ে যাওয়া সুললিত ভঙ্গির দিকে দেখিয়ে বললাম, চিনিস নাকি? কে ও?
পেছন থেকে ভুরু কুঁচকে জোয়ানা বলল, ও সিমিংটনের বাচ্চাদের গভর্নেস। এই দেখে তুমি থ মেরে গেছ? দেখতে ভালো ঠিকই কিন্তু ভাদভ্যাদে।
–জানি সদয় সুশ্রী মেয়ে। আর আমি ভেবে বসেছিলাম প্রেমের দেবী অ্যাফ্রোদিতে।
জোয়ানা গাড়ির দরজা খুলল, আমি ঢুকলাম। বলল, বেশ মজার ব্যাপার তাই না। কিছু লোকের রূপ আছে কিন্তু আবেদন একেবারেই নেই। তাদের দেখে বেশ দুঃখ হয় আমার।
-যদি মেয়েটা শিশুদের গুরুমা হয় তাহলে বোধহয় ঠিকই আছে।
.
০৩.
সেদিন বিকেলে আমরা মিঃ পাই-এর বাড়িতে চায়ের নেমন্তন্নে এসেছি।
ছোটখাটো, মোটাসোটা চেহারার মিঃ পাই একেবারেই মেয়েলি ধরনের। যে জমিতে সেই প্রাচীন প্রায়রির ধ্বংসাবশেষ তারই কক্ষের মধ্যে ওর বাসস্থান–প্রায়র্স লজ। নানা টুকিটাকি কারুশিল্প, সূক্ষ্মকাজের চেয়ার এইসব নিয়েই তিনি মশগুল।
মিঃ পাইয়ের বাড়িটি বড়ই মনোগ্রাহী ও খোলতাই। প্রতিটি আসবাব পালিশ করা এবং মানানসই জায়গায় বসানো। পর্দা আর কুশনগুলো দামী সিল্কের, অপরূপ তাদের কারুকার্য ও রং। এ বাড়িতে কারোর বাস করা মানে কোনো জাদুঘরের ঐতিহাসিক কক্ষে বাস করা।
–এখানকার এই ছোটো সমাজটার জন্যে যদি এমন এক সংগ্রহ রাখতে পারি তাতেই আমার আনন্দ। নিজের চোখে দেখেছি এইসব গ্রাম্য চাষাড়ে লোকগুলো একটা আঠারো শতকের শেরাটন চেয়ার–দুর্দান্ত নিখুঁত–যাকে বলে খাঁটি সংগ্রাহকের পিস..তো সেটা রাখা হয়েছে একটা যেমন-তেমন ভিক্টোরিয়া টেবিলের পাশে। তারপর ধরুন গাঢ় রংচড়ানো ওককাঠের বুকশেলফ, রং করা ওক? শুনেছেন কখনো? কেন লোকে কুৎসিত জিনিস দিয়ে নিজেদের ঘিরে রাখে?
-জোয়ানা বলে, ব্যাপারটা অদ্ভুত।
–অদ্ভুত? ক্রিমিনাল। অপরাধমূলক। এই ধরুন আপনারা যে বাড়িটা নিয়েছেন মিস এমিলি বার্টনের বাড়ি-বাড়িটা চমৎকার। দু-একটা জিনিসও রীতিমতো পয়লা শ্ৰেণীর। রুচিও আছে, তবে সে ব্যাপারে আমি আগের মতো নিশ্চিত নই।
মিঃ পাই এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি তো পরিবারটা সম্পর্কে কিছুই জানেন না। কিন্তু জানা থাকলে ভালো। আমি যখন আসি বুড়ি মাটি তখনও বেঁচে। বুড়ি রীতিমতো ডাইনি। গতরখানা তিনমন তো হবেই, আর পাঁচটি কন্যারত্ন চারপাশে ঘুরঘুর করছে। মেয়েদের সবসময় অর্ডার করে যেতেন আর মেয়েরা স্রেফ গোলামের মতো পালন করে যেত। মেয়েরা বিয়ে করছে না বলে গঞ্জনা দিতেন, অথচ ঐ মহিলা ওদের জীবনে এমন রাস্তাই রাখেনি যাতে ওরা কারুর সঙ্গে মেলামেশা করতে পারে। আমার ধারণা এমিলি কিংবা অ্যাগনেস কোনো গ্রাম্য যাদুকরের সঙ্গে একটু জড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু তার পরিবারটি তেমন কিছু নয়, অতএব মা-ঠাকরুন অবিলম্বে বিয়েটা ভণ্ডুল করলেন।
–এ যে উপন্যাসের গল্প মশাই, জোয়ানা বলল।
-হ্যাঁ ভাই। উপন্যাসই বটে। অবশেষে বুড়ি গত হলেন। কিন্তু ততদিনে বড়ো দেরি হয়ে গেছে। মেয়েরা ঐভাবেই জীবন কাটাতে লাগলেন। কিন্তু তাদের দৈহিক শক্তি তেমন ছিল না। তাই এক এক করে বিদায় নিলো দুনিয়া থেকে। এডিথ ইনফ্লুয়েঞ্জাস, মিনি একটা অপারেশনে বেচারী মেরেলের হলো স্ট্রোক। বেচারী এমিলি গত দশ বছর ধরে শুধু সেবাই করে যাচ্ছে, আজকাল সে অর্থচিন্তায় বড়ই কাতর…সব গচ্ছিত টাকারই মূল্য পড়ে যাচ্ছে।