মেগান ঢ্যাঙা, বয়স কুড়ি যদিও দেখায় ষোলোর মতো, একরাশ বাদামী চুল, সবুজ চোখের তারা, আর মন কাড়া হাসি। পোশাকে একটা অগোছালো ভাব। এক নিশ্বাসে হুসহুস করে কথা বলে।
-বুঝলেন, ল্যাশারদের ঐ খামার বাড়িটায় হাঁসের ডিমের আশায় গিয়েছিলাম। কী চমৎকার সব খুদে খুদে শুয়োরের বাচ্চা। কী মিষ্টি। আপনি শুয়োর পছন্দ করেন? আমার তো ওদের গন্ধটা অবধি ভালো লাগে।
-তাই বুঝি?
–দেখলাম আপনি একা শহরের দিকে হেঁটে চলেছেন, তাই ভাবলাম নেমে আপনার সঙ্গে হাঁটি। বড্ড আচমকা সাইকেল রুখেছি।
কিন্তু তোমার মোজা ছিঁড়ে ফেলেছ। তুমি কি মোজা টোজা সেলাই করো না? তুমি এখন বড়ো হয়ে গেছ, সেটাই বোধহয় বোবঝা না।
-মানে বলতে চান, আমার উচিত আপনার বোনের মতো সেজেগুজে পুতুল হওয়া? ও বড় সুন্দর। আপনি একেবারেই ওর মতো নন। তাই না?
-ভাই-বোন সবসময় একরকম দেখতে হয় না।
–তা সত্যি। আমি যেমন ব্রায়ান বা কলিনের মতো নই। আবার ব্রায়ান কলিনের নিজেদের মধ্যেও কোনো মিল নেই। বড়ো মগজ গুলোনো ব্যাপার…
–কি?
–এই আত্মীয় পরিবার। সংক্ষেপে জবাব দেয় মেগান। আমিও সায় দিয়ে বলি, তাই হয়তো।
খানিকক্ষণ চুপচাপ হাঁটলাম দুজনে। তারপর লাজুক হেসে মেগান বলল, আপনি বুঝি প্লেন চালান?
-হ্যাঁ।
–উড়তে গিয়ে জখম হয়েছিলেন?
–হ্যাঁ, প্লেন ভেঙে পড়েছিল।
–এ তল্লাটে কেউ প্লেন চালায় না।
–মেগান, তুমি প্লেনে উড়তে চাও?
যেন অবাক হয়ে গেল মেগান। আমি? না না। অসুস্থ হয়ে পড়লে…ট্রেনে চড়লেই অসুস্থ হয়ে পড়ি। তারপর একটু চুপ থেকে সরল শিশুর মতো বলে উঠল, আবার সেরে উঠলে প্লেন চালাতে পারবেন? নাকি ঠুটো জগন্নাথ হয়ে পড়ে থাকবেন?
–আমার ডাক্তার বলেছেন, আমি সম্পূর্ণ সেরে উঠবো। আমারও স্থির ধারণা আমি সেরে উঠবোই।
–তাহলে ভালোই। কিন্তু অনেক লোক বড় মিথ্যে কথা বলে। আমার ভয় ছিল আপনি বোধহয় চিরকালের মতো ঠুটো হয়ে থাকবেন, তাই আপনাদের অমন খাট্টা মেজাজ। তবে এটা স্বাভাবিক হলে অন্য কথা।
আমি শান্তভাবে বলি, আমি তো বদমেজাজী নই।
–তাহলে বলব, একটু তিরিক্ষি।
–তিরিক্ষি কারণ, তাড়াতাড়ি সুস্থ হওয়ার তাগিদ। কিন্তু এ ব্যাপারে তাড়াহুড়োটা তো কাজের নয়।
–তাহলে হুজুতি কেন?
–শ্রীমতি, কোনো কিছু তাড়াতাড়ি ঘটুক এ কি তুমি চাও না?
–না তা কেন চাইব? কোনো কিছু নিয়ে তাড়াহুড়ো করলে কিছুই ঘটে না।
–আমি প্রসঙ্গ বদলানোর জন্য বলি, এখানে নিজেকে নিয়ে তোমার কীভাবে সময় কাটে বল তো?
করার আর কী আছে? চোখ কুঁচকে ও বলে।
–মানে, তোমার কোনো শখ-টখ নেই কিংবা খেলাধুলা করো না? অথবা বন্ধুবান্ধব নেই?
খেলাধুলা আমি ভালোবাসি না। এদিকটায় কোনো মেয়ে নেই, যাও বা আছে তাদের ভালো লাগে না। ওদের ধারণা বড় বদখট।
-বাজে কথা। তা কেন ভাববে ওরা?
মেগান মাথা নাড়ল।
স্কুলে যাওনি পড়তে?
–হ্যাঁ। বছরখানেক আগে ছেড়ে এসেছি।
–স্কুল তোমার ভালো লাগেনি?
-মন্দ ছিল না। যদিও শেখানো হত, কিন্তু এলোমেলো। এর একটু ওর একটু। সস্তার স্কুল, বুঝলেন, শিক্ষকরাও ভালো না। কোনো প্রশ্নেরই সঠিক জবাব দিতে পারতেন না। কিন্তু শিক্ষিত হিসেবে প্রত্যেক শিক্ষকেরই সঠিক জবাব জানা উচিত। অবশ্য আমার মাথাটাও মোটা। তবু এত কিছু পড়ানো হয় যা আমার কাছে অখাদ্য মনে হয়। যেমন ধরুন ইতিহাস–একেকটা বইয়ে একেকরকম ব্যাখ্যা।
-আরে মজাটা তো সেখানেই।
–আর ব্যাকরণ; আজে-বাজে রচনা লেখা। শেলী, স্কাইলার্ক নিয়ে কিচিমিচি, তারপর ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেকপীয়ার।
-শেকস্পীয়র আবার কী গলতি করলেন? উদগ্রীব হয়ে প্রশ্ন করি।
–একটা কিছু বলতে গেলেই জড়িয়ে পেঁচিয়ে এমন জটিল করে তোলেন যে তার নাগালই পাই না। তবু তার কিছু লেখা আমার ভালো লাগে।
–আর কোনো বিষয় তোমার ভালো লাগে না?
-হ্যাঁ, অঙ্ক। অঙ্ক তো দারুণ লাগতো, তবে তেমন ভালো করে শেখান হয় না। আমি চাইতাম সত্যিকারের গণিত শিক্ষা।
এবার আমরা হাইস্ট্রিটের মুখে এসে পড়লাম। মেগান তীক্ষ্ণস্বরে বলল, ঐ গ্রিফিথ আসছে। ওকে ঘেন্না করি আমি। ঐ হতচ্ছাড়া গাইডের দলে ভেড়াবার জন্য আমার পেছনে পড়ে আছে। ইতিমধ্যে হুড়মুড় করে ঘাড়ের ওপর এসে পড়ল মিস গ্রিফিথ। একটু পোড়খাওয়া পুরুষালি ধরনের হলেও বেশ সুদর্শনা।
হেঁকে বললেন, এই যে দুজন। মেগান, তোমাকেই খুঁজছিলাম। কনজার্ভেটিভ এ্যাসোসিয়েশনের জন্যে কিছু খামে ঠিকানা লিখবার লোক চাই।
মেগান বিড়বিড়য়ে কিছু বলেই সাইকেলে চলে সুট করে কেটে পড়ল।
তাকে লক্ষ্য করে গ্রিফিথ বললেন, অস্বাভাবিক হর্দ কুঁড়ে মেয়ে। ওর মা অনেকবার চেষ্টা করেছে ওকে একটা কিছুর মধ্যে লাগিয়ে দেবার–শর্টহ্যান্ড, টাইপ কিংবা রান্না-বান্না। কিন্তু ওকে নিয়ে ওর মায়ের দারুণ হতাশা। হ্যাঁ, সবাই তো এক ছাঁচের হয় না। আমি নিজের জীবন ভালোবাসি, তাই চাই যে অন্যরাও জীবনটাকে উপভোগ করুক। এই গ্রামদেশেই আমি সদাব্যস্ত, সবসময় সুখী। গ্রামে একটা না একটা কিছু ঘটছেই। গাইডদের নিয়ে, নানান কমিটি নিয়ে আমার সময় কেটে যায়।
ঠিক এই সময় মিস গ্রিফিথ রাস্তায় তার এক পরিচিত ব্যক্তিকে দেখতে পেয়ে হাঁক পেড়ে ছুটলেন। আমিও রেহাই পেয়ে এগোলাম ব্যাঙ্কের দিকে।
আমি মিস গ্রিফিথের জীবনীশক্তির তারিফ করি। ব্যাঙ্কের কাজটা ভালোয় ভালোয় মিটে গেলে আমি চললাম, গ্যালব্রেথ অ্যান্ড সিমিংটনের দপ্তরে। দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত আইনব্যাবসার পুরানো স্যাঁতসেতে গন্ধটা আমার নাকে ভালো লাগে। দেখলাম প্রচুর দলিল বাক্স রয়েছে, তাতে লেবেল সাঁটা লেডি হোপ, স্যার এভারার্ড কার ইত্যাদি।