সেদিন সকালে এলেন ডাক্তার গ্রিফিথ। তার সঙ্গেই সপ্তাহে সপ্তাহে একবার করে শরীর পরীক্ষার বন্দোবস্ত করে নিয়েছিলাম। গ্রিফিথকে আমার পছন্দই হয়। কেমন যেন থেমে থেমে কথা বলেন, লাজুক প্রকৃতির মানুষ।
জানালেন, আমার স্বাস্থ্যের উন্নতি যথেষ্ট উৎসাহজনক। বললেন, আজ সকালে কি একটু ঠান্ডা লাগিয়ে ফেলেছেন?
-না। ঠিক তা নয়। সকালের কফির সঙ্গে একটা বিশেষ ধরনের কুৎসাভরা বেনামী চিঠি পাই, বোধহয় তারই বিশ্রী স্বাদটা মুখে লেগে আছে।
উত্তেজিত মুখে ডাক্তার ধপ করে মেঝের ওপর হাতব্যাগটা রাখলেন। বললেন, বলতে চান আপনিও ঐ একইরকমই চিঠি পেয়েছেন?
–তার মানে? এরকম ব্যাপার কি চলছে?
–হা কিছুদিন ধরে। কি লিখেছে চিঠিতে।
-ও, তাই বলুন। আমি ভাবছিলাম, বাইরের লোক হিসেবে আমাদের এখানে আসাটা কেউ পছন্দ করছে না। যাই হোক, আপনাকে বলতে আমার আপত্তি নেই। চিঠিটায় স্রেফ একথাই বলেছে আমি সঙ্গে করে যে শখের পায়রাটিকে এনেছি সে মোটেই আমার বোন নয়। সৎ বোনও নয়।
ডাক্তারের মুখখানা রাগে লাল হয়ে গেল। বললেন, কি ইতরামো! তবে কি জানেন, এসব বিকৃত মানসিকতা। মাথা নেড়ে সায় দিই, কে এর পেছনে আছে ধারণা করতে পারেন কিছু?
-না, তবে এটা একজন বিশেষ লোক বা কিছু লোকের বিরুদ্ধে কাদা ছোঁড়া, মানে অভিসন্ধিমূলকই বলা চলে। সেক্ষেত্রে পত্রলেখকের কারুর প্রতি নির্দিষ্ট রাগ থাকে বা শোধ ভোলার জন্যে সে একটা জঘন্য কারচুপির রাস্তা ধরে। পত্ৰলেখক হয় কোনো খেদিয়ে দেওয়া ভৃত্য, নয়তো হিংসুটে স্ত্রীলোক এইরকম আর কি! এধরনের চিঠিগুলো এলোমেলো পাঠানো হয়, আর পাগলামিটা বেড়েই চলে।
গত বছর এই জেলার অন্য দিকটায় এরকম কিছু বিশ্রী ঘটনায় ধরা পড়ল একটা বড় পোশাক কারখানার মার্জিত রুচির শান্ত ধরনের এক মহিলা। আমি নিজে এরকম একখানা চিঠি পেয়েছি। উকিল সাহেব সিমিংটন একখানা পেয়েছেন। এছাড়া আমার গরীব পেশেন্টদের মধ্যেও কেউ কেউ পেয়েছেন।
–সবগুলোই মোটামুটি এই ধরনের?
-হা হা। যৌন সম্পর্কের ওপরেই আসল বক্তব্য, সিমিংটনের চিঠিতে বলা হয়েছিল তিনি নাকি তার মহিলা কেরানীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক রেখেছেন। বেচারি মিস গিঞ্চ, বয়েস চল্লিশ, খরগোসের মতো দাঁত উঁচু। সিমিংটন সোজা গেলেন পুলিশের কাছে। আমার চিঠিগুলোতে অভিযোগ, আমি আমার মহিলা রোগীনীদের সঙ্গে পেশাগত ভদ্রতা লঙ্ঘন করেছি। সবই স্রেফ ছেলেমানুষি, তবু বলব আমি ভয় পেয়েছি। আর কখনো কখনো বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে, বুঝলেন।
-তা তো বটে। আমার চিঠিটা অশিক্ষিত ধরনের লেখা, মনে হয় এমন কেউ লিখেছে যে বলতে গেলে লেখাপড়াই শেখেনি।
-তাই বুঝি? বলে গ্রিফিথ বিদায় নিলেন।
এই তাই বুঝি-কথাটা আমার মনকে বড় অশান্ত করে তোলে।
.
০২.
ঐ বেনামী চিঠি প্রাপ্তি মুখে একটা বিস্বাদ রেখে দিলেও অল্প কদিনে মন থেকে মুছে গেছে।
পরবর্তী ঘটনা ঘটল প্রায় এক হপ্তা বাদে। প্যারট্রিজ জানালো, আমাদের রোজকার কাজের মেয়ে বিয়েট্রিজ আজ আসবে না। কারণ স্যার, খবর পেলাম মেয়েটা একেবারে অস্থির হয়ে পড়েছে।
আমি ভাবলাম, বিয়েট্রিজের হয়তো পেটের গণ্ডগোল হয়েছে। তাই বললাম, দুঃখিত, তবে আশা করি শীগগিরই সেরে উঠবে। প্যারট্রিজ বলল, না স্যার, মেয়েটা ভালোই আছে, তবে একখানা চিঠি পেয়ে ওর মন অস্থির হয়ে পড়েছে…ওতে কিছু খারাপ ইঙ্গিত করা হয়েছে।
প্যারট্রিজের চোখের কঠিন ভাব আর ইঙ্গিত কথাটার ওপর বিশেষ জোর আমাকে শঙ্কিত করে তুলল–তবে কি আমাকে জড়িয়েই কোনো ইঙ্গিত। কিন্তু বিয়েট্রিজ সম্পর্কে আমি এতই অজ্ঞ যে ওকে শহরের মধ্যে দেখলে আমি চিনতেই পারব না। চটা মেজাজে বললাম, কী সব বাজে কথা বলছো?
মেয়েটির মাকে তো এ কথাটাই বোঝালুম। এ বাড়িতে আমার তদারকিতে কোনো কাণ্ডকারখানা কখনো ঘটেনি, ঘটবেও না। আর বিয়েট্রিজের ব্যাপার? আসল সত্যিটা হল, ও ঐ গ্যারেজের যে ছোকরাবন্ধুর সঙ্গে ঘোরাফেরা করে, সেও ঐরকম একটা নোংরা চিঠি পেয়েছে।
আমি রেগে গিয়ে বললাম, এমন ঘটনা আমি জীবনে কখনো শুনিনি।
–আমার মতে স্যার, ও মেয়েটাকে বিদায় করতে পারলেই ভালো। বলতে চাইছি, আগুন না থাকলে ধোঁয়াও থাকবে না।
তখন ভাবিনি ঐ শেষ প্রবাদটা আমায় পরে কী দারুণ হয়রান করে তুলবে।
.
সেদিন সকালে একটু অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজেই গ্রামের দিকে হেঁটে যাবো ঠিক করলাম। (যদিও লিস্টককে গ্রাম বললে স্থানীয় লোকেরা আমার ওপর খেপে যাবে, তথাপি জোয়ানা আর আমি গোপনে এটাকে গ্রামই বলি।)
জোয়ানাকে আমার সঙ্গে যেতে কড়াভাবে বারণ করেছি, বলেছি, মনে রাখিস, যে একলা চলে সেই চলে জলদি। এছাড়া গ্যালব্রেথ সিমিংটনে যাব শেয়ারগুলো সরিয়ে আমার ব্যাপারে সইসাবুদ করতে, রুটিওয়ালার কাছে গিয়ে কিছু রাস্টরুটির ব্যাপারে নালিশ জানাব, ধার করা বইখানা ফেরৎ দেব। ব্যাঙ্কেও যাবো। ঠিক হল জোয়ানা গাড়ি করে আমায় তুলে নিয়ে আসবে যাতে লাঞ্চের সময়ে পাহাড়ে ফিরতে পারি।
আমি একাই এগোলাম। অবশ্য দুশো গজ যেতে না যেতে পিছন থেকে শুনি সাইকেলের ঘণ্টা, তারপর সজোরে ব্রেক কষতে গিয়ে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল মেগান হাটার।
উঠে হাত-পা নেড়ে মেগান বলল, হ্যালো।
মেগান মেয়েটাকে আমার বেশ ভালোই লাগে। ও হল উকিল সিমিংটনের সৎ মেয়ে অর্থাৎ মিসেস সিমিংটনের আগের বিয়ের সন্তান। মিস্টার হান্টার নাকি বিয়ের পর থেকেই স্ত্রীর ওপর জুলুম চালাতেন। বিয়ের বছর দুয়েকের মধ্যেই ঐ মহিলা ডিভোর্স নিয়ে ছোটো মেয়েটিকে নিয়ে লিমস্টকে বাস করতে শুরু করেন সব কিছু ভোলার জন্যে। শেষ পর্যন্ত রিচার্ড সিমিংটনকে বিয়ে করেন। দ্বিতীয় বিয়ের ফলে হয় দুটি ছেলে, যাদের প্রতি ভীষণ অনুরক্ত সিমিংটন দম্পতি। আমার ধারণা, মেগানের এক সময়ে এদের পরিবারে উড়ে এসে জুড়ে বসার মতো মনে হয়। তার মায়ের খর্বাকৃতি, ম্রিয়মান চেহারার সঙ্গে তার কোনো মিলই ছিল না।