সামনেই অবস্থা দেখা যাচ্ছে কতকগুলো বাড়ির তার মধ্যে একটা মহিলা-ইনস্টিটিউট বাড়িটাও। মনের প্রবল ইচ্ছের তাড়নায় আমি সেখানে ঢুকতে চাইলাম। মনে হল কোনো আবছা গোপনকারী সটকে গেটের ভেতর ঢুকল।
গেটটা সামান্য খোলা ছিল, ঢুকে একটুখানি পথ গিয়ে, চারটে ধাপ সিঁড়ি উঠে দাঁড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ আমার পাশেই টের পেলাম একটা মেয়েদের পোশাকের খসখস শব্দ।
আমি চট করে বাড়িটার কোণায় গেলাম। তারপর বাড়ির পেছনে। আমার দুফুট দূরেই একটা খোলা জানলা ছিল।
গুটি মেরে শোনার চেষ্টা করেও কিছু শুনতে পেলাম না। কিন্তু আমার দৃঢ় ধারণা হল কেউ ভেতরে রয়েছে।
আমি জানালার গ্রিলের ওপর ঝুঁকতে গিয়ে একটু আওয়াজ করে ফেলেছি। তখুনি একটা ক্ষীণ শব্দ পেলাম। পকেটে টর্চ ছিল, বোতাম টিপতেই শুনি–নেভান ওটা।
উনি আমাকে পাকড়ে একটা দরজার ভেতরে নিয়ে এসে বললেন, মিঃ বার্টন, ঠিক এই মুহূর্তটাতেই আপনার এখানে আসার সময় হল?
–দুঃখিত, ক্ষমা চেয়ে নিলাম।
কাউকে দেখেছেন?
–সঠিক বলতে পারছি না, মনে হল সামনের গেট দিয়ে কাউকে ঢুকতে দেখলাম।
ব্যাপারটা ঠিকই। একজন কেউ এসেছিল। একজন বেনামী চিঠির লেখক চিঠি না লিখে থাকতেই পারে না, এই তথ্য নির্ভর করে আমি এখানে এসেছি। সে একই মেশিনে ওগুলো টাইপ করতে চাইবে। অন্য মেশিন বা হাতে লেখার ভরসা পাবে না।
এরপর রাতের অন্ধকারে বেরিয়ে আসি। আমার গাড়ির পাশে একটা আবছা ছায়া। চিনতে পারলাম মেগানকে।
হ্যালো, এখানে কি করছিলে মেগান?
–আমি তো বেড়াতে বেরিয়েছি। রাতে বেড়াতে ভালোবাসি। রাতে সবকিছু কেমন রহস্যময় হয়ে ওঠে।
আমি ওকে গাড়ি করে পৌঁছে দিলাম বাড়িতে। সিমিংটন মেগানের ওপর রাগ করলেন। আমার দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, আপনিই ওকে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন বলে ধরে নিতে পারি। ভাবলাম ঐভাবেই প্রশ্নটা থাক।
১১. আমি বোধহয় পাগল
১১.
পরের দিন আমি বোধহয় পাগল হয়ে গিয়েছিলাম।
আমার মাসান্তিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্যে লন্ডনে মার্কাস কেন্টের কাছে যাবার কথা। ট্রেনেই যাবো। জোয়ানা গাড়িটা নিয়ে স্টেশনে পার্ক করিয়ে রাখতে বলল। ফেরার পথে নিয়ে চলে আসতে বলল, কারণ তার এখন গাড়ির দরকার নেই।
গাড়ি চালিয়ে অর্ধেক রাস্তা যেতে দেখি মেগান উদ্দেশ্যহীনভাবে কোথাও চলেছে। গাড়ি থামাই।
-হ্যালো, তুমি এখানে কী করছ?
–এই একটু বেড়াতে বেরিয়েছি। ঠিক বিশেষ কোথাও যাচ্ছি না।
আমি ওকে গাড়িতে তুলে নিয়ে বললাম, তাহলে চলো, আমাকে স্টেশন অবধি পৌঁছে দেবে। আমি ডাক্তার দেখাতে লন্ডন যাচ্ছি। গাড়িটা পার্ক করিয়ে টিকিট কেটে প্ল্যাটফর্মে ঢুকলাম।
দেখলাম মেগান একজোড়া ভোতা ওভারসু পায়ে দিয়েছে। মোটা মোজা দিয়ে আকারহীন জায়পার স্কার্ট পরেছে। আমার বিরক্ত লাগল, গাড়ি এল, ফাস্টক্লাস কামরায় উঠে জানলা নামিয়ে মেগানের সঙ্গে কথা বলতে থাকলাম। ট্রেন চলতে শুরু করলে, মেগানের উঁচুতে ভোলা মুখখানার দিকে তাকালাম।
হঠাৎ মাথায় পাগলামী চেপে বসল, দরজা খুলেই মেগানকে এক হাতে মাল তোলার মতো করে টেনে নিলাম।
–এমন কাণ্ড কেন করলেন?
–তুমি আমার সঙ্গে লন্ডন যাবে। একটু চেষ্টা করলে তোমাকে কেমন দেখাতে পারে, সেটা তোমাকে দেখিয়ে দিতে চাই।
টিকিট কালেক্টর এলে আমি ওর জন্যে একটা রিটার্ন টিকিট কাটলাম।
লন্ডনে পৌঁছে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা জোয়ানার পোশাক নির্মাতার দোকান মিরোটিনে।
দোকানের আসল মালিক মেরী গ্রে বছর পঁয়তাল্লিশ বয়স। তাকে বললাম, আমি মামাতো বোনকে এনেছি (মিথ্যে বললাম)। ওর আপাদমস্তক যেমনটি হওয়া প্রয়োজন, তেমনি করে দিন। মোজা, জুতো, অন্তর্বাস সবকিছু। আর জোয়ানার চুলের সজ্জা করে যে মহিলা, তার কাছে নিয়ে গিয়ে ওর চুলটাও ঠিক করে দেবেন। খরচ যত হয় হবে। আমি ছটা নাগাদ এসে ওকে নিয়ে যাবো।
.
মাকার্স কেন্ট আমায় পরীক্ষা করে বললেন, আমি নাকি তার চরম প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে গেছি।
ছটায় মিরাটিনে পৌঁছালাম। মেরী গ্রে আমাকে বড়ো শোরুমটার ভেতরে নিয়ে গেলেন। মেগান একটা লম্বা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। হলপ করে বলছি, তাকে চিনতেই পারিনি। দীর্ঘাঙ্গী, সুচারু পদসন্ধি, তাতে রেশমের মোজা, সুনির্বাচিত পাদুকা ওকে যেন খানদানি আর স্বতন্ত্র করেছে। এর মধ্যে সদ্য ফুটে ওঠা নিষ্কলুষ গর্ব ফুটে উঠেছে।
আমি ওকে নিয়ে রেস্তরাঁয় ডিনারে ঢুকলাম। ওকে পাশে নিয়ে চলতে তখন বেশ গর্ব অনুভব হচ্ছিল।
প্রথমে হালকা পানীয় নিয়ে অনেকক্ষণ সময় কাটালাম দুজনে। তারপর খেয়ে নিলাম। এরপর দুজনে নাচতে শুরু করলাম। ভালোই নাচল ও–আমার বাহুর মধ্যে ও যেন পালকের মতো হালকা, নাচের প্রত্যেকটা ছন্দ ওর চরণ আর দেহ স্পর্শ করেছে।
আমার মাথায় তখন পাগলামির সুর দোলা খাচ্ছে। সেই সুরের তাল ভঙ্গ করে মেগান বলল, আমাদের এখন ঘরে ফেরার সময় হয়েছে। তাই না?
আমি তখন খেয়াল করলাম শেষ ট্রেনটা বেরিয়ে যাবার সময় পেরিয়ে গেছে। মোটর গাড়ি ভাড়ার কোম্পানি লিউয়েলিম-কে ফোন করে সবচেয়ে দ্রুতগামী গাড়িটা শীঘ্র পাঠিয়ে দিতে বললাম।
এসেও গেল। আমি তাতে মেগানকে চড়িয়ে ওর বাড়িতে পৌঁছে দিলাম। ওর কথামতো রোজ-এর জানলায় ঢিল ছুঁড়লাম।