তবে এটা খেয়াল করলাম আমার আকর্ষণকে বোনটির কাছে পাড়াগাঁয়ের জীবন যেন একটা নতুন খেলার মতো লাগছে।
সেদিন দেখলাম একটা স্কার্ট পরেছে উৎকট চেকে, তার ওপর ঝুলিয়েছে হাস্যকর একটা ছোটো হাতার জার্সি। পায়ে সিল্কের মোজা, আনকোরা ব্রোগ জুতো।
আমি বললাম, তোকে খাপছাড়া লাগছে। তোর উচিত ছিল, একটা টুইডের স্কার্টপরা আর সবুজ কিংবা রংচটা হলে আরো ভালো হত। সুন্দর উলের জাম্পার আর একটা কার্ডিগান তাহলে তুই লীমস্টকের পটভূমির সঙ্গে মিশে যেতে পারতিস।
জোয়ানা হেসে বলল, তুমি ভেবেছ ওরা আমাকে ভীষণ কিছু মনে করবে? আমি বললাম, না, ভাববে উদ্ভুটে।
আমাদের দর্শনাকাঙ্খী প্রতিবেশীর কার্ডগুলো এরমধ্যে পড়ে দেখতে শুরু করেছিল জোয়ানা। কোনো কারণে ভিকার পত্নীর কার্ডটাই তার দৃষ্টি কেড়েছে। হঠাৎ সোৎসাহে সে বলল, জেরি! যাই বলল, এটা বেশ মজার জায়গা। এখানে কোনো বাজে ব্যাপার ঘটতে পারে তা যেন ভাবাই যায় না বলো?
জানতাম কথাটা ঠিক নয়, তবু ওর সঙ্গে একমত হলাম। ভাবতে আজব মনে হয় যে ঠিক একসপ্তাহ বাদেই আমরা সেই পয়লা নম্বর চিঠিটা পেলাম।
আমি শুরুটা ঠিকভাবে করিনি। লিমস্টকের কোনো বর্ণনাই দিইনি। জায়গাটা কেমন সেটা না বুঝলে আমার গল্পটা বোঝাই সম্ভব হবে না।
প্রথমেই বলি, লিমস্টকের মূল আছে অতীতের ইতিহাসে। নর্মান বিজয়ের সময় লিমস্টক ছিল গুরুত্বপূর্ণ জায়গা, তার প্রধান কারণ অবশ্য ধর্মীয়। একটা মঠে পরপর অনেক উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও শক্তিশালী মঠাধ্যক্ষ দীর্ঘদিন কাজ চালিয়েছেন। আশপাশের গ্রামের লর্ড আর ব্যবসায়ীরা নিজেদের কিছু জমি ছেড়ে দিতেন মঠকে। লিমস্টকের মঠ তাই কয়েক শতাব্দী ধরে ধনে-মানে ফুলে ওঠে ক্ষমতা জাহির করছে। অবশ্য যথাকালে অষ্টম হেনরির পাল্লায় পড়ে তাদের ভাগ্য দাঁড়ায় অন্য সহযাত্রীদের মতো। সে সময় শহরে জাঁকিয়ে উঠেছিল একটা ঝড়। তবুও তারা তখন কিছু ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।
অবশেষে ১৭০০ সাল বা কাছাকাছি সময়ে প্রগতির জোয়ারে লিমস্টক ভেসে গেলো পেছনের এদো খাঁড়িতে। ধসে পড়ল গড়। লিমস্টকের কাছাকাছি রইল না কোনো বড় সড়ক বা রেলপথ। একটা ছোটোখাটো গ্রাম্য বাজার শহর, জলাভূমি নিয়ে শান্ত আবাদ আর ক্ষেতজমি গজিয়ে উঠল।
সপ্তাহান্তে একদিন গরু ভেড়ার পালের হাট বসে। বছরে দুবার নাম না জানা ঘোড়াদের রেস হয়। একটা চমৎকার সদর রাস্তা (হাইস্ট্রিট) রয়েছে। একটা পোশাকের দোকান, ডাকঘর, দুটো কসাইখানা আর একটা আন্তর্জাতিক বিপণী। একজন ডাক্তার আর মেসার্স গ্যালব্রেথ এ্যান্ড সিমিংটন নামের আইন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানটি। একটা বিপুলায়তন গির্জা ১৪২০ সাল থেকে দাঁড়িয়ে আছে। পাশেই একটা স্কুলবাড়ি, দুটো শবখানা। এই হলো লিমস্টক। এমিলি বারটনের উস্কানিতে কেউ কেটা যেই হোক একবার এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করে যায়। এখানকার সবকিছুর মধ্যেই একটা নতুন মজার স্বাদ পাই। ডাক্তার কেন্টের উপদেশ মনে পড়ে স্থানীয় কেচ্ছাগুলো উপভোগ করবে কিন্তু সেসব কেচ্ছা আমার নজরে আসবে কোনদিক দিয়ে?
আজব ব্যাপার, চিঠিখানা যখন এল, তখন যে অন্য কিছুর চেয়ে আমরা মজাটাই পেলাম বেশি। চিঠিটা এসেছিল আমাদের প্রাতঃরাশের সময়ে। পরে খুলব ভেবে খামটা উল্টে রেখে দিয়েছিলাম। শুধু নজরে পড়েছিল ওটা একটা স্থানীয় চিঠি ঠিকানাটা টাইপ করা। লন্ডনের ডাক ছাপমারা বাকি দুখানা চিঠির আগে ওটাই প্রথম খুললাম, কারণ বুঝেছিলাম, লন্ডনের দুটোর মধ্যে একটায় আছে বিল, আরেকটায় আত্মীয়ের ঘ্যানর ঘ্যানর বকুনি।
চিঠি খুলে দেখি একখণ্ড কাগজের ওপর কিছু ছাপা অক্ষর আর শব্দ আঠা দিয়ে সেঁটে আটকানো। দু-এক মিনিট কিছুই মাথায় ঢুকছিল না।
জোয়ানা চমকে উঠে বলল, ওটা কী…কী ওটা?
অত্যন্ত অভব্য ভাষায় চিঠিটার লেখক বলতে চেয়েছে যে জোয়ানা আর আমি ভাই-বোন নই।
আমি প্রাথমিক চমক কাটিয়ে বললাম, ওটা একটা জঘন্য বেনামী চিঠি।
জোয়ানা উৎসাহে চঞ্চল হয়ে বলে, কী লিখেছে চিঠিটাতে?
এধরনের বেনামী চিঠি মহিলাদের দুর্বল স্নায়ুকে আঘাত করতে পারে তাই তাদের বাঁচাতে কেউ এ ধরনের জিনিস তাদের দেখায় না। আমার মাথায় এটা একেবারেই আসেনি তাই আমি ওর হাতে চিঠিটা দিয়ে দিলাম।
ও চিঠিটা পড়ে বলল, কি বিচ্ছিরি নোংরা চিঠি! এধরনের বেনামী চিঠি আগে কখনও দেখিনি। এগুলো কি এই ধরনেরই হয়?
-তা বলতে পারি না। তবে এ অভিজ্ঞতা আমারও এই প্রথম।
–ওরা হয়তো মনে ভেবেছে আমি কোনো ঘরছাড়া নষ্ট স্ত্রীলোক।
-সে তো বটে। আমাদের বাবা ছিলেন চৌকো চোয়াল, কালচেপানা, দীর্ঘ চেহারার মানুষ। আর মার নীল চোখ, হালকা কটা চুল, বেঁটেখাটো। এবার আমি দেখতে হয়েছি বাবার মতো আর তোর মিল মার সঙ্গে।
–ঠিক, একেবারেই মিল নেই আমাদের চেহারায়। কেউ ভাই-বোন বলে ভাববে না। তবে ব্যাপারটা একটা ভয়ানক তামাশা বলে মনে হচ্ছে।
সবচেয়ে ভালো, ঘেন্নার আওয়াজ করে ওটাকে আগুনে ছুঁড়ে দেওয়া।
যেমন বলা, কাজটাও হল তেমনি। হাততালি দিয়ে উঠল জোয়ানা। তারপর ও বাইরের রোদে বেরিয়ে গেল। আমি প্রাতঃরাশের পরের সিগ্রেটটা ধরিয়ে ভাবতে লাগলাম, জোয়ানা ঠিক কথাই বলেছে, কেউ আমাদের এখানে আসাটা অপছন্দ করছে। হেসে উড়িয়ে দিলেই ভালো, কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে ব্যাপারটা মোটেই মজার নয়।