আমি দালাল অফিসের দরজা ঠেলে ঢুকলাম। যে মহিলাটি টাইপ করছিল তাকে আমার চেনা চেনা লাগছিল। দু-এক মিনিট চিন্তা করার পর মনে পড়ল উনি সিমিংটনের অফিসের মিস গিঞ্চ। আমি সে কথাটা বলেই ফেলি, আপনি তো গ্যালব্রেথ এ্যান্ড সিমিংটনে ছিলেন, তাই না?
-হ্যাঁ, তাই তো। এখানে আমার ভালো পদ, মাইনে যদিও অততটা নয়। তবে কিছু জিনিস আছে যার মূল্য টাকার চেয়ে বেশি, তাই মনে হয় না আপনার?
–নিঃসন্দেহে, আমি বললাম।
মিস গিঞ্চ এরপর ফিসফিস করে বলল, ঐ বিচ্ছিরি চিঠিগুলো। আমি পেয়েছিলাম ভয়ানক একখানা…আমাকে আর মিঃ সিমিংটনকে জড়িয়ে। আমি সোজা পুলিশকে জমা দিলাম। এরপরেও দেখলাম লোকে আমাদের নিয়ে গালগল্প করছে। এহেন পরিস্থিতিতে আমার উচিত মন্দ পরিবেশ ত্যাগ করা, যদিও মিঃ সিমিংটন আর আমার মধ্যে কখনোই খারাপ কিছু ছিল না।
-না না, তা তো ছিল না। আমি বিব্রত হয়ে বলি।
–কিন্তু লোকের মন তো মন্দ। হায়, কী মন্দই যে তাদের মন!
বিচলিতভাবে তার চোখের দৃষ্টি এড়াতে চাইলেও আমার নজর পড়ে গেল সেদিকেই, আর একটা অত্যন্ত অস্বস্তিজনক ব্যাপার আবিষ্কার করে বসলাম।
মিস গিঞ্চ ব্যাপারটা পুরোপুরি উপভোগ করছে। আজ এখানে আসার আগেই একবার এমন লোককে দেখেছি বেনামী চিঠিতে আনন্দের পরিচয় পেয়েছেন, তবে সেটা তার পেশাগত। মিস গিঞ্চের আনন্দটা দেখছি নেহাত্র ইঙ্গিতময় অর বিতৃষ্ণাজনক।
আমার চমক-খাওয়া মনে একটা কল্পনা ঝিলিক মেরে যায়।
মিস গিঞ্চ নিজেই কি এইসব চিঠি লিখেছিল?
.
০৭.
বাড়ি ফিরে এসে দেখি মিসেস ডেন কলপ জোয়ানার সঙ্গে গল্প করছেন। তাকে কেমন যেন বুড়োটে আর অসুস্থ দেখাচ্ছে। বললেন, আমার কাছে এটা ভীষণ আঘাত মিঃ বার্টন। বেচারী… বেচারী।
বললাম, হ্যাঁ, কাউকে বাধ্য হয়ে জীবন শেষ করতে দেখলে প্রচণ্ড দুঃখ হয় বৈকি।
–আপনি কি মিসেস্ সিমিংটনের কথা বলছেন?
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেন আপনিও তো তাই বলছিলেন?
–হা, ওঁর জন্যে দুঃখ তো হয়ই, তবে ঐ ব্যাপারটা একদিন না একদিন তো ঘটতই।
–তাই নাকি? ঘটত নাকি? জোয়ানা বলল।
মিসেস কলপ বললেন, হ্যাঁ, বাছা, তাই-ই মনে হয়। আত্মহত্যাই যদি বিড়ম্বনার থেকে মুক্তি বলে মনে করো, তাহলে যাহোক কিছু বিড়ম্বনাতেই সেটা করা সম্ভব। যেকোনো রকমের বিশ্রী আঘাতের মুখোমুখি হলেই তিনি এ কাজ করতেন। উনি ঐ ধরনেরই মহিলা ছিলেন।
–কিন্তু একটু আগে আপনি বেচারী কাকে বোঝাচ্ছিলেন?
–যে ঐ চিঠিগুলো লিখেছিল সেই মহিলার কথা বলছি।
–মাপ করবেন। তার জন্যে সমবেদনা জানিয়ে বাজে শব্দ খরচ করা আমার পোষাবে না।
–কিন্তু আপনি কি মনে করেন না আপনার অনুভূতি নেই? কল্পনাশক্তি নিয়ে ভাবুন, কি প্রচণ্ড মরিয়া, অসুখী মন নিয়ে কেউ এ ধরনের চিঠি লিখতে পারে। সে সমাজ থেকে কতটা বিচ্ছিন্ন। আমি দুঃখ পাই এই শহরে এমন ভয়ঙ্কর অসুখী একজনের আমি খবর রাখি না। বেচারী হতভাগী!
তিনি যাবার জন্যে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর সঙ্গে আমার একমত হবার মতো মন ছিল না। উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করি, মিসেস কলপ, এই মহিলা কে সে সম্বন্ধে আপনার একটুও ধারণা নেই? ধন্দে পড়া দুটো চোখ আমার দিকে ফিরিয়ে বললেন, হ্যাঁ, আন্দাজ করতে পারি। কিন্তু আমার ভুল হতে পারে। তাই না?
দরজা দিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাবার সময় মাথাটা ফিরিয়ে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা, মিঃ বার্টন, আপনি এখনো বিয়ে করেননি কেন? আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কি প্রথমে উত্তর দেব ভেবে পাই না, তারপর বললাম, বোধহয় সঠিক মেয়েটির সাক্ষাৎ পাইনি, তাই।
মিসেস কলপ বললেন, জবাবটা খুব ভালো হলো না, কারণ কতো মানুষই তো দেখেশুনেও ভুল মেয়ে বেছে নেয়। এবার উনি সত্যিই বিদায় নিলেন।
.
পরদিন সকালে আমি আর জোয়ানা একটু দেরি করে ব্রেকফাস্ট করছি।
ঘরের বাইরে বেরিয়ে দেখি এইমি গ্রিফিথ মেগানের সঙ্গে কথা বলছে।
আমাদের দেখে হাসিমুখে বলল, হ্যালো কুঁড়ের বাদশারা, আমি তো উঠেছি কোন ভোরে। এই মিস মেগানকে একটু জিজ্ঞেস করছিলাম আমাদের রেডক্রশ স্টলটার জন্যে কিছু শাকসজী দান করতে পারবে কিনা। যদি হয়, তাহলে আওয়েনকে বলে দেব গাড়িতে তুলে নিয়ে যেতে।
হঠাৎ টেলিফোনটা ঝনঝন করে বেজে উঠল। আমি এইমির কাছ থেকে অনুমতি চেয়ে ভেতরে গেলাম টেলিফোনটা ধরতে। কথা বলে জানলাম কোনো এক অ্যাগনেস ওয়াডল, প্যারট্রিজকে চাইছে।
আমি প্যারট্রিজকে জানালাম। সে বেশ একটু অপ্রতিভ হয়ে, ঝাডুটা ফেলে খরখর করে নিচে নেমে গেল। আমি খাবার ঘরে ঢুকলাম।
প্যারট্রিজ টেলিফোনে কথা বলার শেষে জোয়ানাকে গম্ভীর গলায় বলল, মিস, টেলিফোনে কথা বলার জন্যে আমি মাফ চাইছি। কর্তাকে ফোন করতে হল, আমাকে ডাকতে হল, এসমস্ত ঝামেলার জন্যে আমি দুঃখিত।
জোয়ানা বলল, আরে তাতে কী হয়েছে!
প্যারট্রিজের মুখখানা আরো গোমড়া হয়ে গেল। বলল, এই বছর ষোলোর অ্যাগনেস মেয়েটা অনাথ আশ্রম থেকে সোজা এখানে আসছে। তাকে পরামর্শ দেবার মতো কেউ নেই। কিছু একটা ব্যাপারে ও আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। তাই বলছিলাম, আজ বিকেলে ওকে রান্নাঘরে চা খেতে বলতে পারি?
জোয়ানা হতভম্বের মতো বলল, তাতে কি? সবার সঙ্গে চা খেতে বলায় তোমার অসুবিধে কোথায়?
হঠাই প্যারট্রিজ আরো কঠিন হয়ে জবাব দেয়, বুড়ি মা-ঠাকরুণ এবং মিস এমিলি কখনোই বাইরের লোককে রান্নাঘরে ঢুকতে দেননি।