এইমি আন্তর্জাতিক বিপণীতে ঢুকলে, মিসেস কলপ বললেন, বেচারী। আমি অবাক হলাম তিনি এইমির জন্যে করুণাববাধ করছেন না। আবার বলতে শুরু করলেন, অন্ধ ঘৃণা, হ্যাঁ অন্ধ ঘৃণা…ঐ চিঠিগুলো বুঝলেন, ঐ অন্ধও দৈববশে কারুর হৃদপিণ্ডে ছুরি বসিয়ে দিতে পারে।…আর তখন কি ঘটবে, মিঃ বার্টন?
আরেকটা দিন কেটে যাবার আগেই তা জানার দুর্ভাগ্য হল আমাদের।
.
শোকসংবাদটা প্রথম নিয়ে এলো প্যারট্রিজ।
জোয়ানা কামরায় জানলার পর্দা তুলে দিতে দিতে সে মুখে একটা অতিরিক্ত বিষাদের ভঙ্গিতে বলল, আজ সকালে একটা ভয়ানক খবর আছে, মিস।
লন্ডনের অভ্যাসমতো জোয়ানার ঘুম ছাড়তে দু-এক মিনিট সময় লাগল। বলল, এমন কী ভয়ানক খবর?
-বেচারী মিসেস সিমিংটন মারা গেছেন।
–আঁ, মারা গেছেন? জোয়ানা বাস্তবিকই প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছে খবরটায়।
-হা মিস, কাল বিকেলে। আরো যেটা খারাপ, আত্মহত্যা করেছেন তিনি। যদিও অবশ্য মনে হয়, তিনি দায়ে পড়ে মরণ ডেকেছেন। বেচারী!
দায়ে পড়ে মরণ? জোয়ানা বলে, ইয়ে নয় তো?
–হা গো তাই..ওই রকমই একটা নোংরা চিঠি।
প্যারট্রিজের আফশোস যে সে-খবরটা সে সংগ্রহ করতে পারেনি।
এরপর একটা ড্রেসিং গাউন চড়িয়ে ও আমার ঘরে এল খবরটা দিতে। আমার আওয়েন গ্রিফিথের কথা মনে পড়ল, আজ হোক কাল হোক, অন্ধকারে মোক্ষম জায়গায় তীর গিয়ে বিধবেই। তাই ঘটেছে মিসেস সিমিংটনের বেলায়। বাইরে থেকে অভাবনীয় মনে হলেও মহিলার হয়তো কিছু গোপন দিক ছিল।
জোয়ানা আমাকে বলল, তোমার কোনো আপত্তি নেই যদি মেয়েটাকে মানে মেগানকে। আমাদের এখানে দু-একদিন থাকতে চায়? বাচ্চাগুলোর তো সমস্যা নেই? ওদের গভর্নেন্স আছে। তবে আমার ধারণা ও যে ধরনের চীজ, মেগানের মতো মেয়েকে পাগল করে ছাড়বে।
মেগানকে এখানে আনার কথা আমারও মনে হচ্ছিল, কিন্তু জোয়ানা নিজের থেকে কথাটা পেড়েছে বলে আমি খুশী হলাম।
প্রাতঃরাশের পরে আমরা সিমিংটনের বাড়ি গেলাম। সৌভাগ্যক্রমে ওদের গেটের মুখে আওয়েন গ্রিফিথের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তাকে চিন্তিত আর অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল।
–বার্টন, ভালোই হলো তুমি এসেছে। একদিন যা ঘটবেই বলে আমার ভয় ছিল, সেটাই ঘটল। বড়ো দুঃখের ব্যাপার।
-গুডমর্নিং ডক্টর গ্রিফিথ! জোয়ানা বলে উঠল।
গ্রিফিথ হকচকিয়ে লাল হয়ে বলল, ওঃ হো গুড মর্নিং, মিস জোয়ানা।
–আমি ভাবলাম আমাকে দেখতেই পাননি।
–খুবই দুঃখিত, আসলে মনটা অন্য দিকে ছিল তো তাই..
–হ্যাঁ, হবেই তো, হাজার হলেও আমি প্রমাণ সাইজের মানুষ
আমি জোয়ানাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে গ্রিফিথের দিকে মন দিলাম। ওকে বললাম, গ্রিফিথ, শোন, আমরা ভাবছিলাম, মেগানকে এখান থেকে নিয়ে গিয়ে দু-একদিন আমাদের কাছে রাখলে মিঃ সিমিংটন কিছু ভাববেন? তোমার কী মনে হয়? আসলে এখানকার পরিবেশ মেয়েটার পক্ষে বেশ দুঃসহই মনে হয়।
–আমার তো মনে হয় ভালোই হবে। একটু বেয়াড়া গোছের অনুভূতিপ্রবণ মেয়ে তো, এখান থেকে দূরে রাখাই ওর পক্ষে ভালো হবে।
আমি একটু ইতস্তত করে বলি, ব্যাপারটা তো–আত্মহত্যাই?
–তা তো বটে। অ্যাকসিডেন্টের মতো কিছু নয়। উনি এক টুকরো কাগজে লিখে গেছে, আমি আর পারছি না। আর চিঠিটা এসেছিল কাল বিকেলের ডাকে। খামখানা তার চেয়ারের পাশে মেঝের ওপর পড়েছিল আর চিঠিখানা দলা পাকিয়ে চুল্লিতে ফেলা হয়েছিল।
আমি তোতলামি করে বলি, কী বলেছিল…মা…মানে মাপ চাইছি।
–জিজ্ঞেস করে দোষের কিছু করোনি। চিঠিটা করোনারের আদালতই পড়ে শোনাবে। একই ধারার ভাষা–সেই নির্দিষ্ট অভিযোগ তা হল দ্বিতীয় ছেলেটি, মানে কলিন, সিমিংটনের সন্তানই নয়।
-তা কি সত্যি হতে পারে বলে মনে হয়?
–সে সিদ্ধান্তে আসার তো কোনো উপায় নেই। আমি এখানে পাঁচ বছর এসেছি। যতদূর জানি সিমিংটন দম্পতি শান্ত সুখী দম্পতিই ছিল। তবে এটা সত্যি যে ছেলেটার বাপ-মায়ের সঙ্গে কোনো মিল ছিল না। কিন্তু এরকম তো অনেক শিশুই আছে, যারা ঠাকুরদা বা দাদামশাইদের মতো দেখতে।
–চেহারার অমিলই পত্ৰলেখককে অভিযোগ আর প্ররোচনা জুগিয়েছিল। আমি বললাম।
-খুবই সম্ভব। স্রেফ লাগামছাড়া প্রতিহিংসা। কিন্তু বেশ জুতসই জায়গাতেই ঘা মেরেছে, তা নাহলে আত্মহত্যার আর কোনো কারণ ছিল বলুন? জোয়ানা বলল।
গ্রিফিথ বলল, বেশ কিছুদিন ধরে মিসেস সিমিংটন অসুস্থ ছিলেন। মানসিক রোগ, হিস্টিরিয়ার মতো। আমিই ওঁর স্নায়ুর চিকিৎসা করেছি। আমার মনে হয়, তার নিজের মনে এই ধারণা জন্মেছিল যে তিনি অস্বীকার করলেও তার স্বামী তাকে বিশ্বাস করবেন না। সব মিলিয়ে লজ্জা ঘেন্নায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় আত্মহত্যা করেন।
গ্রিফিথ ধীরে ধীরে রাস্তার দিকে পা বাড়াল।
সামনের দরজা খোলাই ছিল। আমরা ঢুকলাম।
মিঃ সিমিংটন জড়োসড়ো হয়ে চেয়ারে বসে আছেন, চোখে উদ্রান্তের দৃষ্টি।
মিস এলসি হল্যান্ডের গলা পাওয়া গেল।
-না, মিঃ সিমিংটন আপনাকে কিছু খেতেই হবে। সকালে কিছুই খাননি, রাতেও কিছু মুখে তোলেননি। ডাক্তার বলে গেছেন, শরীরে জোর রাখা দরকার আপনার।
সিমিংটন নিস্তেজ গলায় বলেন, মিস হল্যান্ড, তোমার মনে এত দয়ামায়া…
মিস হল্যাণ্ড তাকে জোর করে গরম এককাপ চা ধরিয়ে দিলেন। সিমিংটন বললেন, তুমি যা করছে, তাতে ধন্যবাদ না জানিয়ে পারি না, তোমার তুলনা হয় না।