- বইয়ের নামঃ ভিক্টোরিয়া ভিলা
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, উপন্যাস
ভিক্টোরিয়া ভিলা
০১. প্লাস্টারের বাঁধন
০১.
অবশেষে ডাক্তাররা আমাকে প্লাস্টারের বাঁধন থেকে মুক্তি দিয়েছেন। তারপর তারা আমাকে নিয়ে টানা হ্যাঁচড়া করেছেন মনের সুখে, নার্সরা জ্ঞান দিয়েছেন যেন খুব সাবধানে হাত-পা গুলো ব্যবহার করি। ডাক্তার মার্কাস কেন্ট বলেছেন এবার যেন কোনো গ্রামে গিয়ে বসবাস করি। উত্তম হাওয়া শান্ত জীবন আর কর্মহীন থাকাই আমার একমাত্র প্রেসক্রিপশন। আমার বোন আমার দেখাশোনা করবে।
জবাব না পাওয়ার ভয়ে জিজ্ঞেসই করিনি, আবার আকাশে প্লেন নিয়ে উড়তে পারবো কিনা। গত পাঁচমাসে একবারও জিজ্ঞেস করিনি যে, আমাকে এরকম চিৎ হয়ে শুয়ে থাকতে হবে কিনা।
আমি জানি পঙ্গু হওয়ার অবস্থা আমার হবে না। পা দুটো আমি ঠিক চালাতে পারব।
বড়ো খাঁটি ডাক্তার এই কেন্ট। তিনি বললেন, এখন বেশ বুঝতে পারছি, তোমার ঝটপট সেরে ওঠার জন্যে ধৈৰ্য্যচুতি হলে চলবে না। প্রশ্নটা যেখানে স্নায়ু আর পেশি শক্ত করার সেখানে মগজই শরীরকে মদত দেবে। এতদিন ধরে নানা ঔষধপত্রের ফলে তোমার স্নায়ু দুর্বলতা দেখা দিয়েছে আর সেজন্যে তোমার গ্রামে গিয়ে শান্ত, সুস্থির জীবন-যাপন করো। গ্রামে একটা বাড়ি বানিয়ে ফেল। পড়শীদের স্থানীয় কেচ্ছাগুলো উপভোগ করো।
অবশেষে তাই হল, জোয়ানা (আমার বোন) আর আমি বাড়ির দালালদের কাছে সারা বৃটিশ দ্বীপপুঞ্জের সুন্দর বাড়ির তালিকা পাগলের মতো ঘেঁটে শেষে লিমস্টকের লিটলফার্জ বাড়িটা পছন্দ করলাম। ঐ অঞ্চলটা বা সেখানকার কাউকে আমরা চিনি না।
ছিমছাম একতলা, সাদা বাড়ি, ভিক্টোরিয়ার আমলের ঢালু, সবুজ রঙের বারান্দা।
এ বাড়ির মালিক বারটন পরিবারের সবাই অবিবাহিতা মহিলা, তাদের মধ্যে এখন একমাত্র জীবিতা সদস্যা কনিষ্ঠা মিস এমিলি বারটন। ছোটোখাটো মিষ্টি বুড়ি কেমন নরম সুরে জোয়ানকে বোঝালেন, এ বাড়িতে আগে কাউকে ভাড়া দেওয়া হয়নি, পারলে কখনো দিতেনও না, কিন্তু এখন ট্যাক্সের বোঝা, স্টক আর শেয়ারের গচ্ছিত টাকা থেকে কিছুই প্রায় আয় হচ্ছে না। দিনকাল কত কঠিন হয়ে পড়েছে। আর তোমাকে দেখে আমার মনে হচ্ছে এ বাড়িটায় একটা নবীন জীবনের প্রয়োজন। তবে একটা কথা, এখানে কোনো বেটাছেলেকে থাকতে দিতে আমার আপত্তি আছে ভাই।
কথাবার্তার এই পর্যায়ে জোয়ানা আমার ব্যাপারটা খুলে বলতেই মিস এমিলি সামলে নিয়ে বললেন, ওহো, বড়ো দুঃখের কথা! উড়তে গিয়ে অ্যাকসিডেন্ট? তাহলে তোমার ভাই তো প্রায় পঙ্গুই একরকম..
ধরেই নেওয়া যায় এমিলি বারটনের যা ভয় তেমন কোনো পুরুষোচিত কাজকর্ম আমি করি না। ভীরু কণ্ঠে এমিলি জানতে চায় যে আমি ধূমপান করি কিনা। জোয়ানা বলে, বাব্বা জাহাজের চিমনির মতো! তবে আমিও সিগারেট খাই।
–তা তো বটেই! আমারই বোকামি। বুঝলে ভাই, আমার বোনেরা সব বেশি বয়সের ছিলেন, মাও বেঁচে ছিলেন ৯৭ বছর অবধি। যথেষ্ট বাছবিচার ছিল। তবে হ্যাঁ, আজকাল সবাই ধূমপান করে। একটা ব্যাপার, এ বাড়িতে কোনো ছাইদানি নেই।
জোয়ানা বলে, ছাইদান আমরা অনেকগুলো আনবো।
অতএব ফয়সালা হলো। ছ-মাসের জন্যে আমরা ভাড়া নিলাম। আরো তিন মাসের আগাম ভাড়ার অভিপ্রায় জানানো রইল। জোয়ানাকে মিস বারটন জানালেন, এ বাড়ি ছেড়ে গেলেও তাঁর নিজের কোনো অসুবিধে হবে না। তারই এক পুরনো পরিচারিকা বিশ্বাসী ফ্লোরেন্সের হেপাজতে দু-কামরা ঘরে চলে যাবেন তিনি। ফ্লোরেন্স ওঁদের সঙ্গে পনেরো বছর বসবাস করে অবশেষে বিয়ে করেছে। স্বামী বাড়ি তৈরির ব্যবস্থা করে। হাই স্ট্রিটে সুন্দর বাড়ি বানিয়েছে। সেখানে খুব আরামেই থাকব।
চুক্তিপত্রে সই হলো। মিস এমিলির আগের ঝি প্যারট্রিজ রাজী হয়েছিল আমাদের সঙ্গে থাকতে। সে মাঝবয়সী, একটু মোটা বুদ্ধির একগুয়ে স্ত্রীলোক। তার তদারকিতে থাকতে পেরে আমরাও দায়মুক্ত হলাম। তবে দেরি করে রাত্রিভোজন সে পছন্দ করতো না।
লিটল ফার্জে থাকার এক হপ্তা পর মিস এমিলি একদিন তার নামের কার্ড রেখে গেলেন। তার দেখাদেখি উকিলপত্নী মিসেস সিমিংটন, ডাক্তারের বোন মিস গ্রিফিথ প্রায়র্স-এন্ডের মিঃ পাই ওরাও এসে যে যার কার্ড রেখে গেলেন।
চমৎকৃত জোয়ানা বলল, জানতাম না লোকে সত্যি সত্যিই এরকম কার্ড দিয়ে দেখা করে! জোয়ানার চেয়ে আমি বছর পাঁচেকের বড়ো। ছেলেবেলায় আমাদের বেঢপ, মস্ত সাদা অগোছালো বাড়িটার কথা মনে পড়ে। আমার বয়স যখন সাত, জোয়ানা তখন দুই, আমরা গেলাম লন্ডনে এক পিসির বাড়ি। এর পরে ক্রিসমাস, ইস্টারের ছুটিগুলো আমাদের কাটতে লাগল পুতুলনাচ, নৌ-বিহার আর স্কেটিং করে। আগস্ট মাসে আমাদের নিয়ে যাওয়া হত সমুদ্রের ধারে এক হোটেলে।
এখন আমার পঙ্গুত্বের কথা চিন্তা করে মনে আশঙ্কার খোঁচা লাগে। জোয়ানাকে বলি, এখানে থেকে তোকে কতকিছুই না খোয়াতে হবে।
কারণটা হল জোয়ানা বেশ সুন্দরী, স্ফুলিঙ্গ, নাচের আসরে ককটেল ভালোবাসে, প্রেম ট্রেম, জোরালো বেগে গাড়ি হাঁকানো সে পছন্দ করে। জোয়ানা হেসে বলে, এর জন্য তার কোনো হেরফের হবে না।
জোয়ানার প্রেমের ঘটনাগুলো প্রায় একই খাতে চলে বরাবর। একেবারে মেরুদণ্ডহীন ছোকরাগুলো যাদের কোনো প্রতিভা নেই, তাদের জন্যে সে প্রেমে পাগল হয়ে ওঠে। তাদের পরিচিতি দেবার জন্যে আপ্রাণ খাটে। তারপর তারা যখন অকৃতজ্ঞ বলে ধরা পড়ে তখন জোয়ানা মর্মাহত হয়। এই বুক ভেঙে যাওয়া ব্যাপারটা মোটামুটি তিনহপ্তা স্থায়ী হয়, যতক্ষণ না আবার একটি গোমড়ামুখো ছেলের আবির্ভাব হয় ওর জীবনে তাই জোয়ানার ভাঙা হৃদয়কে আমি তেমন গুরুত্ব দিই না।