–আছে অবশ্যই।
কথাটা শেষ না করইে মিঃ কুইনের দিকে অর্থপূর্ব দৃষ্টি মেলে দিলেন মিঃ স্যাটারহোয়াইট।
–মনে হচ্ছে, অপরাধীর প্রতি আপনার কোন সহানুভূতি রয়ে গেছে?
–আমার মনে হয় মার্টিন ওয়াইল্ডে একজন সুন্দর চেহারার যুবা পুরুষ যার সব কথা আমরা বিশ্বাস করতে পারি।
–তাই কি? জিজ্ঞাসা করেন মিঃ কুইন। আমাকে ক্ষমা করবেন।
–মার্টিন ওয়াইল্ডের সম্বন্ধে অনেক কিছু বলা হলো। কিন্তু তার কাজের প্রতি আমরা বোধ হয় নজর দিতে পারিনি।
স্যাটারহোয়াইট দ্বিধাগ্রস্ত চিত্তে বলেন, কোন সাক্ষী আছে?
–আমরা বোধ হয় ঠিকমতো সাক্ষীর পেছনে অন্বেষণ করছি না।
মিঃ স্যাটারহোয়াইটের স্ব-আরোপিত গম্ভীরতা আবার ফিরে এসেছে। তিনি আবার বলতে শুরু করেন–আমি বারানাবাসদের সঙ্গে কথা বলেছি। এক অদ্ভুত পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছে তারা।
মিঃ কুইনের মুখে ফুটে ওঠে আগ্রহী হাসির ঝিলিক।
–এমন কোন প্রমাণ সত্যি সত্যি দেখাতে পারেন মিঃ স্যাটারহোয়াইট, আমি বিশ্বাস করবো।
মিঃ স্যাটারহোয়াইট টেবিল চেপে ধরেন দুহাতে।
মিঃ কুইন স্যাটারহোয়াইটকে একেবারে অবাক করে দিয়ে বলতে শুরু করেন তার কাহিনী
-সত্যি কথা বলতে কি, সেদিন ঘটে যাওয়া সেই আশ্চর্য ঘটনা আমার মনের মধ্যেও তোলপাড় করেছিলো। কিন্তু আমি সন্তর্পণে সন্ধ্যার সমাবেশে আগত অতিথিদের প্রত্যেকের জীবন ইতিহাস সংগ্রহ করেছি। তার ফলে কয়েকটি আশ্চর্য ঘটনা চোখের সামনে ভেসে উঠেছে আমার। সত্যি কথা বলতে কি, যাকে আপনারা অভিযুক্ত বলে সন্দেহ করেছেন সেই আইরিশের হয়তো খুব একটা দোষ নেই এই খুনের কাণ্ডে। আমরা পরিস্থিতির স্বীকার বলতে পারি। কেননা তার সঙ্গে গোপন সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল জিমি অ্যালেনসনের আর সেই সম্পর্কের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছিলো ময়রা স্কট।
একটা ত্রিভুজ প্রেমের ঘটনা বলা যেতে পারে। যদিও আইরিশ অনুরক্ত ছিল জিমি অ্যালেনসনের প্রতি, উড়ে এসে জুড়ে বসা ঐ ময়রা স্কটকে সহ্য করতে পারেনি সে। একজন তাকে দিতে চেয়েছিলো অপার্থিব ভালোবাসা। অন্যজন তার হৃদয় রাঙিয়ে দিয়েছিল কামনাতে। এই দুয়ের মধ্যে পড়ে তার মনের মধ্যে যেসমস্ত ভাবনা অনুরণিত হয়। তার ফলেই দ্বিধাবিহ্বল চিত্তে অবশেষে এই পথ বেছে নিয়েছিল।
আইরিশের মনের মধ্যে তখন জমেছে এই ঘটনার ঘনঘটা মেঘের সমাবেশ। কিছুতেই স্থির করতে পারছে না সে, কি করবে। একবার ভাবছে, ছুটে চলে যায় তার প্রথম প্রেমিকের কাছে যে তার জীবনকে ভরিয়ে তুলবে অনাস্বাদিত আনন্দে। পরমুহূর্তেই অন্যতর চেতনায় পরিপ্লাবিত হচ্ছে তার মন। সে ভাবছে, যদি কামনা বাসনা না থাকে তাহলে জীবনে বেঁচে থাকার অর্থ আর কি হতে পারে।
এই টানাপোড়েনের মধ্যে চলতে চলতে আইরিশ বোধহয় নিজের সমস্ত চিত্তগ্রাহিকাকে একেবারে হারিয়ে ফেলেছিল। আর পরিণত হয়েছিল অদ্ভুত মানবী সত্তায়। এমনটি ঘটে থাকে অনেক ক্ষেত্রে।
কথা বলতে বলতে হঠাৎ তার মধ্যে ছেদ টেনে স্যাটারহোয়াইট মন্তব্য করেন–যদিও তিনি সহ্য করতে পারছেন না মিঃ কুইনের এই বক্তব্যকে। এর মধ্যে কোথায় যেন বিষণ্ণতার সুর বাজছে। যে রহস্য সমাধানের সমস্ত কৃতিত্ব তারই করায়ত্ত হওয়ার কথা। তা হওয়া সম্ভব হচ্ছে না শুধুমাত্র মিঃ কুইনের উপস্থিতির জন্যে।
মিঃ কুইন আরো বলতে শুরু করেন, খুজতে খুজতে আমি হাজির হয়েছিলাম আইরিশের গ্রামের বাড়িতে। সেখানে গিয়ে যেসব ঘটনার কথা আমি শুনলাম তাতেই মনে হতে পারে সে আইরিশকে যদিও আমরা অভিযুক্ত করতে বলছি এই খুনের অন্তরালে আততায়ী হিসেবে কিন্তু তার মনের মধ্যে বোধহয় একধরনের কোন অভীপ্সা ছিল না। আসলে সেই সন্ধ্যাতে, প্রাইভেট পার্টিতে সাজানো প্রেক্ষাপটটি ছিল এই রকমের-অ্যালেনসন এসে সশব্দে গুলি করে হত্যা করবে ময়রা স্কটকে। আর তার জীবনের পথের এই কাটাটিকে সরিয়ে সে অচিরেই লাভ করবে আইরিশের হৃদয়। কিন্তু কেমন যেন সব হয়ে গেল। তখন তারা দুজনে বসে গল্প করছিলো পার্টিতে, তখন হঠাৎ আইরিশ বুঝতে পারে অ্যালেনসনের মনোভঙ্গিটি। আর সঙ্গে সঙ্গে সে তার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল পিস্তলটি। ঘটনার বিহ্বলতায় আইরিশ অবাক হয়ে যায়। ঠিক এই মুহূর্তে ময়রা স্কট পার্টিতে এসে প্রবেশ করে। সেই অকুস্থলে তখন তাদের দুজনের মধ্যে শুরু হয়েছিলো দ্বন্দ্বযুদ্ধ। হয়তো দুজনকে বাঁচাতেই এমনতর হত্যকারিণীর ভূমিকায় হাত রাঙাতে হয়েছিল আইরিশকে। সে এক বীভৎস বিহ্বল অবস্থা। ঘরের মধ্যে প্রশস্ত লনে জমে উঠেছে আনন্দের উৎসব, যখন আমরা ব্যস্ত ছিলাম পেগের পর পেগ শ্যাম্পেন গলাধঃকরণ করতে তখন পিয়ানোতে বসে ডরোথি স্মিথ তার সুরেলা কণ্ঠস্বরে ভরিয়ে দিয়েছিলো রাতের বাতাস। তখনই হঠাৎ সমস্ত কিছুর বুক বিদীর্ণ করে ছুটে গিয়েছিল তপ্ত সীসার বুলেট। আর দু-দুটো মৃত্যু আবিষ্কৃত হয়েছিল আইরিশের পায়ের তলায়।
ময়রাকে সে গুলি করে হত্যা করতে চায়নি, সরাতে চায়নি তার প্রিয়তম অ্যালেনসনকে। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে আজ তাকে দু-দুটি হত্যকাণ্ডের একমাত্র অভিশাপ মাথায় নিয়ে পৃথিবীকে চিরবিদায় জানিয়ে চলে যেতে হচ্ছে। এর থেকে দুঃখের কাহিনী আর কি হতে পারে, স্যাটারহোয়াইট।
শেষ হয়ে গেল মিঃ কুইনের অনুসন্ধান পর্ব। ততক্ষণে সন্ধ্যা এসে থেমেছে সেখানে। মিঃ স্যাটারহোয়াইট পাইপে অগ্নি সংযোগ করে ভাবতে লাগলেন, না, জীবনে আর কোন রহস্য সন্ধানে তিনি আর ছুটে যাবেন না। কেননা মানুষের জীবনের প্রতিটি পলে অনুপলে জড়িয়ে আছে কত রহস্য গাথা কে তার খবর রাখে?