-না-কিছু নেই–কিছুই বলার নেই–যদি না—
বলুন?
–না, কিছু না। চোখ দুটো আবার বুজে এলো।
জেসপ এসে দাঁড়ালেন, মৃত্যুপথযাত্রী হঠাৎ পরিচিত কাউকে দেখে অস্ফুটস্বরে বললেন, আপনাকে আমি চিনি।
-হ্যাঁ, মিসেস বেটারটন, আপনি আমাকে চেনেন। আপনার স্বামীর সম্পর্কে কিছু বলার থাকলে আমাকে বলুন।
-না। চোখদুটো আবার বুজে এলো। জেসপ ঘর থেকে বেরিলয়ে গেলেন।
ডাক্তার হিলারীকে বললেন, আর বেশিক্ষণ নেই। মিসেস বেটারটন আবার চোখ মেলে তাকালেন। ঘরের মধ্যে দুটি নারী এখন একা–দুটি বেদনার মূর্তি যেন মুখোমুখি। অলিভ বেটারটন শ্বাস টেনে বলার চেষ্টা করছিলেন, আমাকে–আমাকে বলুন–আমি কি
ও কি জানতে চাইছে হিলারী বুঝতে পেরে আধশোয়া দেহটার ওপর ঝুঁকে পড়লো।
হ্যাঁ, পূর্ণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে সে বললো, আপনি মারা যাচ্ছেন। এই কথাটাই আপনি জানতে চাইছেন, তাই না? এবার আমার কথাটা শুনুন। আমি আপনার স্বামীর কাছে যাবার চেষ্টা করবো। যদি কোনো খবর থাকে বলুন।
–ওকে বলো–ওকে বলো–সাবধান। বোরিস–বোরিস–সাংঘাতিক…আর বলতে পারলো না, শ্বাস কষ্ট দেখা দিলো।
হিলারী কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন–আমাকে সাহায্য করার মতো–মানে–আপনার স্বামীর কাছে পৌঁছতে সাহায্য করবে এমন কোনো খবর দিতে পারেন না?
-তুষার।
অস্ফুট টুকরো কথাটা হিলারীর বুকের মধ্যে তোলপাড় করতে লাগলো। তুষার! বরফ! অলিভ বেটারটন ভাঙাভাঙা কথায় আবার বললেন
তুষার, শুধু তুষার, শুভ্র তুষার
তুষার-সে মৃত্যুগহ্বর।
শেষ কথাটা বারবার উচ্চারণ করতে লাগলেন। যাও…যাও…। গিয়ে ওকে বোরিসের কথাটা বললা…আমি বিশ্বাস করিনি। কখনোই বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু…কিন্তু বোধহয় সত্যি… তা যদি হয়, তা যদি হয়…কী এক নীরব আর্ত প্রশ্নে ছটফট করতে করতে চোখ দুটো স্থির হলো হিলারীর ওপর। সাবধান…সাবধান…
গলা থেকে বিশ্রী ঘড়ঘড় একটা শব্দ বেরিলয়ে এসে ঠোঁট দুটো একবার থরথর করে কেঁপে স্তব্ধ হয়ে গেলো।
অলিভ বেটারটন মারা গেলেন।
পরের পাঁচটা দিন প্রচণ্ড মানসিক পরিশ্রম গেলো হিলারীর, যদিও শারীরিক কোনো পরিশ্রমই করতে হয়নি। অলিভ বেটারটনের জীবনযাত্রা সম্পর্কে যতটুকু খোঁজখবর পাওয়া গেছে সেগুলো লিখে হিলারীকে পড়তে দেওয়া হয়েছে। অলিভ যে বাড়িতে বাস করতো সেটা কেমন, আত্মীয়স্বজন কে কে আছে, তার পোষা কুকুর আর পাখিদের নাম–টমাস বেটারটনের সঙ্গে বিয়ে হবার পর থেকে ছটা মাসের প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয় তাকে জানতে হবে। একবার সে জেসপকে জিজ্ঞেস করলো, এসবের কি কিছু দরকার আছে?
জেসপ বলেছিলেন, হয়তো নেই। কিন্তু সমস্ত ব্যাপারটাই তোমাকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রকাশ করতে হবে। তুমি একজন কাহিনীকার, একটি নারীর জীবনী লিখছো তুমি, সেই নারী-অলিভ।
যতক্ষণ না তুমি অলিভ বেটারটনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত নিজেকে অলিভ বেটারটন হিসাবে চিন্তাই করতে পারো না।
ছাড়পত্রে যে বর্ণনা আছে, তাতে অলিভ বেটারটন আর হিলারী ক্র্যাভেনের মধ্যে যথেষ্ট মিল।
হিলারী জেসপকে জিজ্ঞেস করলো, আপনি বলছেন, অলিভ বেটারটন বলে পরিচয় দিলে আমাকে কেউ অবিশ্বাস করবে না। কিন্তু এ বিষয়ে আপনি এত নিশ্চিন্ত হচ্ছেন কেমন করে?
জেসপ বললেন, কোনো বিষয়েই কেউ সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে পারে না। কিন্তু এ ব্যাপারটা যারা চালাচ্ছে তাদের কাজকর্মের আমরা একটা ধারণা করে নিতে পারি। আমি হলফ করেই বলতে পারি, এখানে ওদের যে ভগ্নাংশটা কাজ করছে তারা শুধু জানে–অমুক দিন অমুক সময় অলিভ বেটারটন প্লেনে করে এখানে আসবে এবং তাকে অমুক অমুক নির্দেশ দিয়ে দিতে হবে–ব্যাস। ওরা চাইছে অলিভ বেটারটনকে যদি তার স্বামীর কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় তবে টমাস বেটারটনকে দিয়ে আরো ভালো কাজ করাতে পারবে। আরো একটা কথা মনে রাখতে হবে, নকল একজন অলিভ বেটারটন সৃষ্টি করার চিন্তা সম্পূর্ণ আকস্মিক। প্লেনে দুর্ঘটনা এবং তোমার মাথার চুলের রঙ থেকেই তার উৎপত্তি। আমাদের পরিকল্পনা ছিলো অলিভ বেটারটনের গতিবিধির ওপর নজর রাখা আর আমাদের প্রতিপক্ষও তাই জানে। অতএব সেটা দেখার জন্যই তারা বেশি মাথা ঘামাবে।
–এ সমস্ত আগে চেষ্টা করেননি?
-করেছি, সুইজারল্যান্ডে। খুব বোকার মতো–তাতে আমাদের আসল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়েছে। আগের চেয়ে অনেক সূক্ষ্ম অথচ ব্যাপকভাবে করতে হবে। প্রতিপক্ষের চেয়ে অনেক বেশি চালাকির পরিচয় দিতে হবে আমাদের।
তার মানে আমার পেছনে আপনারা লোক লাগাবেন?
–অবশ্যই।
–কী ভাবে?
জেসপ মাথা নাড়লেন, সেটা তোমাকে জানানো হবে না।
হিলারী বললো, বুঝেছি, প্রতি পদে, প্রতি মুহূর্তে আপনাদের সতর্ক দৃষ্টির মধ্যে আমাকে কাজ করতে হবে।
-এবার তোমার অন্য কাজ। অলিভ বেটারটন সম্বন্ধে সবকিছু জেনে তাকে পুরোপুরি নকল করা।
ঠিক পারবে তুমি। সপ্রশংসভাবে তিনি তার কাঁধ চাপড়ালেন। একটা কথা শুধু মনে রেখো হয়তো তোমার কোনো সময় মনে হবে তুমি নিঃসঙ্গ কিন্তু আসলে তা নয়।
হিলারীর প্রশ্ন, যদি আমি লক্ষ্যস্থলে পৌঁছতে পারি, তখন কী ঘটবে?
–তার মানে?
আমি বলতে চাইছি–শেষ পর্যন্ত যদি আমি টম বেটারটনের সামনে পৌঁছই তখন কী ঘটবে?
জেসপ গম্ভীর হয়ে বললেন, তখনই সবচেয়ে বিপজ্জনক মুহূর্ত। আমি শুধু এটুকু বলতে পারি-যদি সবকিছু ভালোয় ভালোয় হয় তাহলে ঠিক ওই মুহূর্তের জন্যই তোমার নিরাপত্তা থাকবে। নিশ্চয়ই তোমার মনে আছে–এই অভিযানের মূল কথা হচ্ছে, এ যাত্রা থেকে বেঁচে ফিরে আসার সম্ভাবনা কম।